সম্প্রীতি ও ভ্রাতৃত্বের বন্ধন
টাঙ্গাইল প্রতিনিধি
প্রকাশ : ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ০৩:২১ পিএম
ছবি: ভোরের আকাশ
টাঙ্গাইলের নাগরপুরের চৌধুরি বাড়ির একই আঙিনায় কোনো সাম্প্রদায়িক হানাহানি ছাড়াই চলছে নামাজ ও দুর্গাপূজারসহ সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বিভিন্ন ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান। দুটি ধর্মের অনুসারীরা সম্প্রীতি ও ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে নিজ নিজ ধর্ম চর্চা করে আসছে দীর্ঘ ৬৩ বছর ধরে।
উভয় ধর্মের অনুসারীরা একে অপরের ধর্মচর্চায় সহযোগিতার মাধ্যমে নিজ নিজ ধর্ম পালনে সারাদেশে এক বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।
জানা যায়, টাঙ্গাইলের নাগরপুর উপজেলার চৌধুরী বাড়িতে ১৩৩৯ বঙ্গাব্দে ওঝা ঠাকুর ও হরনাথ স্মৃতি কেন্দ্রীয় দুর্গা মন্দির প্রতিষ্ঠিত করেন শ্রী পরেশ চন্দ্র ও শৈলেশ চন্দ্র দাসয়ো। এরপর থেকে প্রতিবছর ধুমধাম করে দুর্গাপূজা উদযাপন করে এলাকার সনাতনধর্মীর লোকজন। মন্দির প্রতিষ্ঠার পর বাড়ির আঙিনার অপরপাশে (পশ্চিমাংশে) ১৯৬২ সালে নির্মাণ করা হয় নাগরপুর চৌধুরী বাড়ি কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ।
একই মাঠের পশ্চিমাংশে মসজিদ আর পূর্বাংশে মন্দির নিয়ে স্থানীয় জনসাধারণের মাঝে কখনও ধর্মীয় কোনো দ্বন্দ্ব বা সাম্প্রদায়িক হানাহানি হয়নি। একই সঙ্গে স্থানীয় হিন্দু-মুসলিমরা যার যার ধর্ম পালন করছেন।
সরেজমিনে নাগরপুর ওঝা ঠাকুর ও হরনাথ স্মৃতি কেন্দ্রীয় দুর্গা মন্দির পূজা মণ্ডপে গিয়ে দেখা যায়, পূজা-অর্চনা, উলুধ্বনি ও ঢাকের বাজনাও চলছে। দর্শনার্থীরা প্রতিমা দেখছে ভিড় করছেন। আযানের আগে মাইক্রোফোনে ঘোষণা করা হলো, আজান এবং নামাজের পর আবার পূজার কার্যক্রম শুরু হবে। ঠিক নির্ধারিত সময়ে আজান শুরু হতেই থেমে যাচ্ছে, ঢাক-ঢোল-কাঁসর, মাইক ও উচ্চশব্দের বক্সের বাজনা।
আজানের পর মুসল্লিরা মসজিদে এসে নামাজ আদায় করছেন। নামাজ শেষ হওয়ার বেশ কিছু সময় পর আবার বেজে ওঠে মন্দিরের ঢাক-ঢোল-কাঁসর আর উচ্চশব্দের বাজনা। নামাজের ওয়াক্তের আজানের শুরুতেই থেমে যায় শঙ্খ ও ঢাক-ঢোলের শব্দ এবং নিরব থাকে নামাজ আদায় শেষ না হওয়া পর্যন্ত।
ঠিক তেমনি সনাতন ধর্মাবলম্বীরা যখন পূজা অর্চনায় মেতে ওঠেন তখন নামাজ ব্যতীত কোন ধরনের ইসলাম ধর্মীয় চর্চা থেকে সম্পূর্ণরূপে বিরত থাকেন মুসল্লিরা।
এ ছাড়া প্রতিমা দর্শনে আগতরা বেশিরভাগ সময়ে অবস্থান নেন মসজিদ আঙিনায়। রোজা, নামাজ, পূজা একই সাথে একই আঙিনায় পালন করেন দুটি ধর্মের অনুসারীরা।
এলাকার হিন্দু-মুসলিম সকলেই একে অপরের মসজিদ মন্দিরের সুরক্ষায় কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুগের পর যুগ ধরে চলে আসছে এই বন্ধন। ইতিপূর্বে কোনো সহিংসতা তো দূরের কথা, কোনোদিন বাক-বিতণ্ডার নজির নেই এখানে। উভয় ধর্মের অনুসারীরা এ সম্প্রীতি ও ভ্রাতৃত্ববোধকে শতাব্দীর পর শতাব্দী টিকিয়ে রাখতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।
মসজিদে নামাজে আসা মুসল্লিদের সাথে কথা বলে জানা যায়, এ এলাকা মানুষ অত্যন্ত শান্তি প্রিয়। দুই ধর্মের লোকজনদের মাঝে ধর্ম পালন নিয়ে কোনোদিন বিরোধিত সৃষ্টি হয়নি। ইসলাম ধর্মের মানুষ তাদের সর্বোচ্চ সহযোগিতা করে। তারাও নামাজ ও আজানের সময় পূজা বন্ধ রাখেন। এটা কাউকে বলে দিতে হয় না।
অন্যদিকে মন্দির পূজা মণ্ডপ পরিদর্শনে আসা ভক্তদের সাথে কথা বলে জানা যায়, এ মন্দিরের নামকরণ করা হয় নাগরপুর চৌধুরী বাড়ি উঝা ঠাকুর কেন্দ্রীয় দুর্গা মন্দির। মন্দির প্রতিষ্ঠার পর এখানকার ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা মন্দিরের পাশেই প্রতিষ্ঠা করেন নাগরপুর চৌধুরী বাড়ি কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ।
এরপর থেকেই পাশাপাশি চলছে দুই ধর্মের মসজিদ-মন্দিরের কার্যক্রম। এতে ধর্ম পরিচালনা করতে কোনোদিন কোনো প্রকার ঝামেলা হয়নি। তাদের প্রত্যাশা যুগ যুগ ধরে চলতে থাকবে এই সম্প্রীতি।
নাগরপুর উপজেলা পূজা উদযাপন ফন্ট এর সাধারণ সম্পাদক ঝুটন কুমার সাহা জানান, এ বছর নাগরপুর উপজেলায় ১২টি ইউনিয়নে ১২৬টি মণ্ডপে দুর্গাপূজা উদযাপন হচ্ছে। এর মধ্যে ১৩৩৯ বঙ্গাব্দে নাগরপুর চৌধুরী বাড়িতে ওঁঝা ঠাকুর ও হরনাথ স্মৃতি কেন্দ্রীয় দুর্গা মন্দির প্রতিষ্ঠার পর থেকেই সনাতন ধর্মাবলম্বীরা পূজা করে আছে।
মন্দিরের আঙ্গিনার পাশেই ১৯৬৩ থেকে কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ ও ঈদগাহ মাঠ স্থাপনের পর থেকেই একই আঙিনায় মন্দির মসজিদে পাশাপাশি দুটি ধর্মের অনুসারীরা ভ্রাতৃত্বের সাথে ধর্ম চর্চা করে আসছে। যা বাংলাদেশ এক বিরল দৃষ্টান্ত।
নাগরপুর চৌধুরী বাড়ি কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ পরিচালনা কমিটির সাধারণ সম্পাদক আরিফুজ্জামান সোহেল জানান, তিনি জন্মের পর থেকে একই বাড়ির আঙিনায় মসজিদ ও মন্দির দেখছেন। পূর্বাংশের মন্দিরে সনাতন ধর্মের লোকজন পূজা-অর্চনা করেন। এখানে কোনো ভেদাভেদ নেই। সবাই একে অপরের পরিপূরক হিসেবে কাজ করছে।
নামাজের আজানের সময় হলে বন্ধ হয়ে যায় পূজার কর্ম। সারা বছর এলাকার হিন্দু-মুসলিম ভাই ভাই হিসেবে মিলেমিশে বসবাস করছি। এখন পর্যন্ত দুই ধর্মের মানুষদের মধ্যে কোনো বিশৃঙ্খলার ঘটনা ঘটেনি বলে জানান তিনি।
নাগরপুর উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মো: হাবিবুর রহমান হবি বলেন, প্রতি বছরের ন্যায় এ বছরও নাগরপুরে সুষ্ঠু ও সুশৃঙ্খলভাবে দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এর মধ্যে ওঝা ঠাকুর ও হরনাথ স্মৃতি কেন্দ্রীয় দুর্গা মন্দির দুর্গাপূজা ছোট পরিসরে হলেও। এর একটি ঐতিহ্য রয়েছে। সেটা হলো দীর্ঘ ৬৩ বছর ধরে একই আঙিনায় মসজিদ ও মন্দিরে হচ্ছে ধর্ম চর্চা। যা একটি বিরল ঘটনা। আমরা উপজেলা বিএনপির পক্ষ থেকে উপজেলার সব পূজা মণ্ডপ পরিদর্শন করছি। দুর্গোৎসব সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে শেষ হয় সে ব্যাপারে আমরা সার্বিকভাবে সহযোগিতা করছি।
পূজা মণ্ডপ পরিদর্শনে এসে জেলা পুলিশ সুপার মিজানুর রহমান জানান, দীর্ঘ ৬৩ বছর ধরে নাগরপুরে মসজিদ ও মন্দিরে প্রত্যেক ধর্মের মানুষ নিজ নিজ ধর্ম সম্প্রীতি বজায় রেখে ধর্ম পালন করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। এই পূজা মণ্ডপ পরিদর্শন করে দেখতে পেলাম একই স্থানে নামাজ হচ্ছে, আবার পাশেই শান্তিপূর্ণভাবে পূজা চলছে। এই এলাকার মানুষের মধ্যে সামাজিক ও সম্প্রীতির বন্ধন বিদ্যমান রয়েছে। এই দৃষ্টান্ত প্রমাণ করে বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ। এমন বাংলাদেশ আমরা সবাই প্রত্যাশা করি।
তিনি আরো জানান, জেলার ১২ উপজেলায় ১২৫১ টি পূজা মণ্ডপে সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। কোন প্রকার অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে পুলিশের পাশাপাশি, র্যাব, ডিবি ও আনসার সদস্যরাও দায়িত্ব পালন করছেন। সেই সাথে মোবাইল টিম ও সাদা পোশাকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা কাজ করে যাচ্ছে।
ভোরের আকাশ/মো.আ.