দেখেশুনে মনে হচ্ছে বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটা অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এর ফলাফল এমন হতে পারে যে রাজনীতি পথ হারিয়েছে, অন্তত কিছুকালের জন্য হলেও এটা ঘটে যেতে পারে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান মুহাম্মদ ইউনূস বেশ কিছুদিন ধরেই বলছিলেন, ডিসেম্বরে নির্বাচন হবে। অবশ্য ২৫ মার্চ জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে ডিসেম্বরে স্থির থাকলেন না। বললেন, ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে নির্বাচন হবে। তবে সংসদ নাকি গণপরিষদ কোন নির্বাচন হবে তার বক্তব্যে সেটি খোলাসা হয়নি বলে মনে করছেন অনেকেই। সম্ভবত রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্যের ওপর তিনি সেটা ছেড়ে দেবেন। বর্তমানে সক্রিয় রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় দল বিএনপি বলছে, আগে জাতীয় সংসদ নির্বাচন করে গণতান্ত্রিকভাবে রাজনৈতিক সরকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। গণপরিষদ গঠন করার কোনো প্রয়োজন নেই বলে মনে করছে দলটি। নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) বলছে, পাঁচটি সংস্কার কমিশনের সংবিধানসম্পর্কিত সংস্কারগুলো গণপরিষদে নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত জাতীয় সংসদ নির্বাচন মেনে নেবে না তারা। এই দলটি আগে চায় গণপরিষদ। সংসদ নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচনও তাদের দাবির একটি। জামায়াতে ইসলামী গণপরিষদ বনাম জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে এখন অবধি খুব স্পষ্ট মন্তব্য করেনি। জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেছেন, সরকারকে জাতীয় দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে তাড়াতাড়ি নির্বাচন দিতে হবে। কি ধরনের নির্বাচন চায় তারা সেটা খোলাসা করে বলেনি এই দলটি। অন্যান্য দলগুলো কিছুটা টলোমলো, যারা বিএনপির ঘরানার, তারা বিএনপির সঙ্গেই সুর মিলিয়ে জাতীয় সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি জানিয়ে যাচ্ছে। জাতীয় সংসদ বা গণপরিষদ যে নির্বাচনই হোক না কেন, কারা এই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারবে, আরো সুক্ষ্মভাবে বলতে গেলে, কারা পারবে না, তা নিয়েও বিতর্ক চলছে। দুর্ভাগ্যবশত তর্ক-বিতর্কে সেনাবাহিনীকেও টেনে আনা হয়েছে। আর এই কাজটা করেছেন নবগঠিত রাজনৈতিক এনসিপির দুই নেতা হাসনাত আব্দুল্লাহ ও সারজিস আলম। এই দুই নেতা জুলাই অভ্যুত্থানের পর থেকে একের পর এক বিতর্কের জন্ম দিয়ে যাচ্ছেন। অথচ কোটাবিরোধী আন্দোলন শুরু হওয়ার কিছুকাল আগেও তারা ছিলেন ছাত্রলীগের নেতাকর্মী। সেনাপ্রধানের সঙ্গে বৈঠকের প্রসঙ্গ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশ করে হাসনাত যে বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন, সেখানে সারজিস আবার ভিন্নমত প্রকাশ করে বিতর্ককে উসকে দিয়েছেন। এই সব তর্ক-বিতর্কে ঘৃতাহুতি দিয়েছে পঞ্চগড়ে সারজিসের গাড়িবহর নিয়ে শোডাউনের ঘটনা। যে দল নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের কথা বলছে, সংস্কারে আনার প্রত্যয় ব্যক্ত করছে, সেই দলের নেতার এমন আচরণ খোদ দলের মধ্যেই বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য এইসব সংস্কারের প্রস্তাব গ্রহণ বাধ্যতামূলক নয়। যেমন সংস্কারের ১৬৬টি সুপারিশের মধ্যে ১১৩টির সঙ্গে একমত হয়েছে এনসিপি। বাকিগুলো তারা বাতিল করে দিয়েছে। বিএনপি যে অস্থায়ী সরকারের অধীনে কোনো সংস্কারই চায় না, তা অনেকভাবে জানিয়ে দিয়েছে। তাদের নেতা তারেক রহমান আট দফা প্রস্তাব করেছেন, যেগুলো নীতিনির্ধারণীবিষয়ক সংস্কার শিল্প প্রতিষ্ঠান উন্নয়ন, স্বাস্থ্যসেবা উন্নয়ন, জিনিসপত্রের দাম কমানো ইত্যাদি। এখন কি হবে? আপনারা দেখেছেন, যখন রাস্তায় যানবাহন চলাচলের কোনো শৃঙ্খলা থাকে না, তখন গাড়িগুলো সোজাসুজি ডানে-বায়ে, আড়াআড়ি সবদিকে চলতে থাকে, যে যেদিকে যেতে চায়। অন্যদের অগ্রযাত্রা রুদ্ধ করে নিজেকে এগিয়ে নেওয়ার যে প্রবণতা সৃষ্টি হয়, তার কারণে সবারই এগুনো বন্ধ হয়ে যায়। এটাকে বলে ডেডলক বা অচলাবস্থাÑ মোদ্দা কথায় হ-য-ব-র-ল। তখন ট্রাফিক পুলিশ আসে যানবাহন নিয়ন্ত্রণের জন্য। তারা একদিকের যানবাহনকে সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেয়, যেসব গাড়ি ইন্টারসেকশনে আড়াআড়ি আটকে রয়েছে তাদেরকে ক্লিয়ার করে, একদিকটা একটু হালকা হলে, অন্যদিকের গাড়িকে যেতে দেয়। এখন প্রশ্ন হলো কে হবেন আমাদের ট্রাফিক পুলিশ? আরো প্রশ্ন আছে, তিনি কোনদিকের ট্রাফিক আগে বন্ধ করবেন? আর তিনি চাইলেই কি বন্ধ করতে পারবেন? যারা সংস্কার নিয়ে কাগজ লিখেছেন, তারা কি এইসব সমাধানের পথ বাতলে দিয়েছেন? যখন সংস্কার গ্রহণ বাধ্যতামূলক নয়, তখন জাতীয় ঐকমত্য হবে কিভাবে? নির্বাচন নিয়েও প্রশ্ন আছে। যে নির্বাচনই হোক না কেন, একটা নির্বাচনি পরিবেশ লাগবে। যখন ছাত্র নেতারা হুমকি দেন ‘এটা হতে দেব না’, ‘এটা করতে পারবে না’, সেটা নির্বাচনি ভাষা হয় না। আপনি বলতে পারেন, আমাদের দলকে নির্বাচিত করুন, তাহলে আমরা ‘এটা’ হতে দেব না। কিন্তু অন্যরা নির্বাচিত হলে তাদেরকে ‘এটা’ করতে দেবেন না, সেটাতো গণতান্ত্রিক পদ্ধতি নয়। ধরুন ইউনূস সরকার এনসিপির দাবি মেনে ‘গণপরিষদ’ নির্বাচন করল আগে। বিএনপি যে তা মানবে না, এটা অনুমান করার জন্য খুব বেশি দূরদৃষ্টির প্রয়োজন নেই। দলটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ওপর আস্থা হারাচ্ছে। নির্বাচনের সম্ভাব্য সময়সূচি নিয়ে প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্য ‘অস্পষ্ট’ মনে হচ্ছে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের কাছে। তিনি স্বাধীনতা দিবসের সকালে ঢাকার শেরেবাংলা নগরে প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের কবরে শ্রদ্ধা নিবেদনের পর সাংবাদিকদের সঙ্গে বলেছেন, ‘আমরা বার বার বলে আসছি যে স্পষ্ট রোডম্যাপ এবং দ্রুত নির্বাচন। তা না হলে যে সংকটগুলো সৃষ্টি হচ্ছে, এই সংকটগুলো কাটবে না।’স্বাধীনতা দিবসের আগের দিন সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, ‘নির্বাচনের ব্যাপারে আমি আগেও বলেছি, আবারও বলছি, এ বছর ডিসেম্বর থেকে আগামী বছরের জুনের মধ্যে নির্বাচন হবে।’ এর প্রতিক্রিয়ায় বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘এটা অত্যন্ত অস্পষ্ট কথা। ডিসেম্বর থেকে জুন ছয় মাস। সুতরাং এটা কোনো রোড ম্যাপ দেওয়া হয়নি।’ বিএনপি ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য নির্বাচনের কথা বলছে নাÑ এমন মন্তব্য করে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘বিএনপি জাতির স্বার্থে, জাতিকে রক্ষা করার স্বার্থে, স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বকে রক্ষা করার স্বার্থেই নির্বাচনের কথা বলছে এবং নির্বাচিত সংসদ এবং সরকারের কথা বলছে।’ বিএনপি আবারও সংসদ নির্বাচনের কথা বলেছে। ধরা যাক, অন্তর্বর্তী সরকার বিএনপিকে বুঝিয়ে-শুনিয়ে এনসিপির দাবি অনুযায়ী সংসদের আগে গণপরিষদ নির্বাচন দিল। কিন্তু সেই নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে নির্বাচিত হয়ে আসার কোনো আলামত এনসিপির কর্মকাণ্ডে প্রতীয়মান হচ্ছে না। যদি তা-ই হয় সংস্কারের কী হবে? দল গঠনের আগে যতটা জনসমনর্থন পেয়েছিল, প্রতিষ্ঠার মাসখানেকের মধ্যে এনসিপি নামের নতুন দলটি তা-ও হারাতে বসেছে বলে মনে হচ্ছে। গণপরিষদে নির্বাচন আগে হলে এবং সেই নির্বাচনে যারা বিজয়ী হয়ে আসল, তারা যদি সংস্কার কমিশনগুলোর কোনো সংস্কার প্রস্তাবের সঙ্গেই একমত না হয়, তখন কি হবে? তারা বর্তমান শাসনতন্ত্রে ভালো কিছু কিছু পরিবর্তন করে গণপরিষদ ভেঙে দিতে পারে। আপনার-আমার বলার কিছুই বলার থাকবে না তখন, কারণ তাদেরকে নির্বাচিত করা হয়েছে জনগণের ভোটে, তারা আমাদের প্রতিনিধি, আমাদের ‘চাওয়া’ আমরা তাদের কাছে ভোট দিয়ে হস্তান্তর করেছি। সুতরাং যেই কপাল সেই মাথা। সংবিধানবিশেষজ্ঞ ড. কামাল হোসেন যা বলেছিলেন আগে ‘বিদ্যমান সংবিধানেই কাক্সিক্ষত পরিবর্তন করা যেতে পারে।’ আবার গণপরিষদ নির্বাচনের সময়ও ঝামেলা হতে পারে। যেসব প্রার্থী তার নির্বাচনি প্রচারে বলবেন, না সংস্কার কমিশনের সংস্কারে আমি একমত নই, তাদের উপর কি ‘মব’ হামলা হবে? তাহলে গণতান্ত্রিক নির্বাচন কিভাবে হবে? এইবার অন্যদিকটাও ভাবুন, ধরুন, ইউনূস সরকার জাতীয় সংসদ নির্বাচন দিলেন ডিসেম্বরে। একটা দল দুই তৃতীয়াংশ আসন পেল, সরকার গঠন করল। তারা এসে বলল, আমরাতো সংস্কার মানিনি। সুতরাং একই লোক ১০বার প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হতে দোষ কি? যেহেতু তাদের দুই তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা, এই ১০বার ক্ষমতায় থাকতে তারা হয়তো সবরকম চেষ্টা করবেন। আমার আশঙ্কাগুলো হয়তো একটু বেশি বেশি মনে হবে, কিন্তু অমূলক বা অতিরঞ্জিত নয়। তবে রাজনীতিবিদরাও অনেক সময়ও যুক্তিসঙ্গত আচরণ করেন। এমনও হতে পারে রাজনীতিকরা সবাই বসে কিছু ব্যাপারে একমত হবেন। যেমন, কতগুলো সংস্কার সুস্থ নির্বাচনের জন্য অত্যন্ত জরুরি। নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন, স্বাধীন বিচার ব্যবস্থা, নির্বাচন কমিশনকে সরকারের কর্তৃত্ব থেকে দূরে রাখা, একজন দুইবারের বেশি প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না এইসব বিষয়গুলোকে অধ্যাদেশের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করার বিষয়ে সবাই একমত হতে পারেন। আরো একমত হতে পারেন, যেই ক্ষমতায় আসবে, এগুলোকে সংবিধানে সংযোজন করবে। এইরকম কিছু ন্যূনতম সংস্কার গ্রহণ করে নির্বাচন হতে পারে ঐকমত্যের ভিত্তিতে। তাহলে এই নতুন সংস্কারগুলো মেনে সুন্দর একটা গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হতে পারে। সংস্কার নিয়ে এনসিপির আকাক্সক্ষাকে প্রশ্নবিদ্ধ না করেও এই মন্তব্য করা যায় যে তারা এখনও কোনো জাতীয় নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত নয়। তাদের ঘর গোছাতে এবং দল গোছাতে আরো সময় লাগবে। সুতরাং এখন যেকোনো নির্বাচন তাদের জন্য খুব সুফল আনবে না। ইউনূস সরকার ক্ষমতায় থাকলে তারা বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবে, তারা মুখে না বললেও তারাই যে কিংস পার্টি, এটা তাদের চেয়ে বেশি তো অন্য কারোর জানা নেই। এখনই থামতে না জানলে রাজনীতি কিছুকালের জন্য হলেও পথ রুদ্ধ হতে পারে। অবশ্য এনসিপির প্রধান নাহিদ ইসলামের একটা মন্তব্য খুবই প্রশংসার দাবি রাখে। মার্চের প্রথম সসপ্তাহে এএফপিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, ‘আশা করি আমরা এই নির্বাচনে জিতব, কিন্তু এটাই শেষ নির্বাচন নয়।’ নাহিদ আরো বলেছেন, ‘আগামী নির্বাচনের আমাদের দল সরকার গঠন করতে না পারলেও, আমরা এমন একটি রাজনৈতিক শক্তি তৈরি করছি, যা আগামী কয়েক দশক রাজনীতিতে সরব থাকবে।’ নাহিদের বক্তব্যের সারমর্ম কিন্তু জয়-পরাজয় যাই হোক এনসিপি তাদের রাজনীতি করে যাবে। আমাদের রাজনীতিতে কেউ এই কথা বুঝেনি যে ‘এটাই শেষ নির্বাচন নয়’। সবাই সবসময় বর্তমান নির্বাচনকেই শেষ নির্বাচন ভেবে যে করেই হোক ক্ষমতায় যেতে চেয়েছে। আশা করি, নাহিদ তার এই বিশ্বাসটা তার দলের সবার কাছে গ্রহণযোগ্য করে তুলবেন। তাদেরকে বিশ্বাস করতে হবে, এটাই শেষ নির্বাচন নয়। কোনো একটা নির্বাচনে তাদের বড় পরিসরের সংস্কারগুলোকে জনগণ ভোট দেবে এবং তাদেরকে ক্ষমতায় বসাবে, ততদিন তারা দলের জন্য শান্তিপূর্ণভাবে কাজ করে যাবেন। এটাই তাদেরকে সফলতা এনে দিতে পারে। এবার যারা ক্ষমতায় যাবেন তাদেরকে বুঝতে হবে, ক্ষমতায় গিয়ে যেন ভবিষ্যতে অন্যদের ক্ষমতায় আসার পথ রুদ্ধ করার কারণ না হন। শেখ হাসিনা ১৫ বছর ধরে সেই চেষ্টাই করেছেন, সফল হননি। যদি কোনোভাবে অন্যদের পথ রুদ্ধ করা হয়, ভবিষ্যতের নাহিদরা আবার বিদ্রোহ করবে। এই উপলব্ধিটা আমাদের রাজনীতিবিদদের জন্য একান্ত জরুরি। লেখক : রাজনীতি বিশ্লেষক। ভোরের আকাশ/মি
৪ দিন আগে
মাগুরায় শিশু ধর্ষণের ঘটনায় দেশ বিক্ষোভ প্রতিবাদে উত্তাল। এ প্রসঙ্গে কিছু কথা বলা প্রয়োজন বোধ করছি। এই জঘন্য অপরাধে দায়ী ব্যক্তি ও তার সহযোগীদের দেশের আইন অনুযায়ী মৃত্যুদণ্ড দাবি করি। যদিও ২০২০ সাল থেকে বাংলাদেশের আইনে ধর্ষকের মৃত্যুদণ্ডের বিধান করা হয়েছে। কিন্তু অদ্যাবধি কোনো ধর্ষকের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার ঘটনা ঘটেনি। এবারের ধর্ষণের ঘটনায় দোষীকে মৃত্যুদণ্ড দিয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করা উচিত।আইনের প্রাথমিক নীতি হচ্ছে, ‘অপরাধীর শাস্তি তার দ্বারা কৃত অপরাধের উপযুক্ত হওয়া উচিত।’ কিন্তু ধর্ষককে তার অপরাধের শাস্তি হিসেবে বহু বছরের জন্য কারাগারে প্রেরণ করা এই নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। ধর্ষণের উপযুক্ত শাস্তি হওয়া উচিত ধর্ষকের মধ্যাঙ্গ সমূলে কর্তন করা। এ শাস্তি যদি অতি কঠোর বলে মনে হয়, তাহলে নিদেন পক্ষে ধর্ষকের ‘বল’ বা ‘টেস্টিক্যালস’ বা ‘অণ্ডকোষ’ বা সোজা বাংলায় ধর্ষকের ‘বিচি’ দুটি অপসারণ করা। লেখালেখির ক্ষেত্রে আমার গুরু ভারতের পরলোকগত লেখক সাংবাদিক খুশবন্ত সিং ধর্ষকের শাস্তি হিসেবে বিচি অপসারণ করার পক্ষে মত দিয়েছেন। তাতে ধর্ষকের পৌরুষ চিরতরে বিলুপ্ত হবে। সেক্ষেত্রে ধর্ষক উন্মত্ত ‘ষাড় থেকে বলদ’ অথবা ‘পাঠা থেকে খাসি’তে পরিণত হবে। তার পক্ষে আর কখনো ধর্ষণের মতো অপরাধের পুনরাবৃত্তি করা সম্ভব হবে না। এ ধরনের আইন প্রণীত হলে দেশ থেকে ধর্ষণের মতো ঘৃণ্য অপরাধ দ্রুত হ্রাস পাবে। পুরুষত্ব হারানোর চেয়ে ভয়ঙ্কর ভীতি পুরুষের আর নেই। তারা সমাজে পরিচিত হবে ‘হিজড়া’ হিসেবে। অতএব এই চেষ্টা করায় সমস্যা কোথায়? ধর্ষকের আরেকটি শাস্তি হতে পারে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা।বছর চার বছর আগে জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের প্রধান নাইজেরিয়ার কাদুনা স্টেটে এ ধরনের আইনের দৃষ্টান্ত প্রত্যক্ষ করেছেন। ধর্ষক যদি পুরুষ হলে আইনে তার সাজা অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে তার অণ্ডকোষ অপসারণ করা হয়, ধর্ষক নারী হলে তার ফেলোপিয়ান টিউব বা ‘ডিম্ববাহী নালী’ অপসারণ। ধর্ষিতার বয়স যদি ১৪ বছরের কম হয়, তাহলে ধর্ষকের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। ধর্ষণের বিরুদ্ধে নারী আন্দোলনের চাপে ২০২০ সালে বাংলাদেশ সরকার আইন সংশোধন করে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ডের বিধান করলেও এখন পর্যন্ত ধর্ষণের অপরাধে কাউকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার ঘটনা জানা যায়নি। বাংলাদেশে বেশির ভাগ ধর্ষণের অভিযোগের মিমাংসা ঘটে আদালতের বাইরে, প্রভাবশালীদের দ্বারা এবং ধর্ষিতার পরিবারকে কিছু অর্থ দানের মধ্য দিয়ে। গুরু অপরাধে এমন লঘু শাস্তির কারণে বাংলাদেশে ধর্ষণের ঘটনা বাধাহীনভাবে ঘটে চলেছে। ‘আইন ও সালিশ কেন্দ্রে’র সমীক্ষা অনুযায়ী বাংলাদেশে প্রতি নয় ঘণ্টায় অন্তত একটি ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। তাদের ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত সময়ে বাংলাদেশে ৬,২৭২টি ধর্ষণ ও গণধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু অপরাধ আইন বিশেষজ্ঞাদের মতে সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন হওয়ার আশঙ্কায় অনেক পরিবার ধর্ষিতার তথ্য চেপে রাখে এবং অনেক ক্ষেত্রে ধর্ষিতাকে তার মানসিক বিপর্যয় কাটিয়ে উঠতে সাহায্য না করে বরং তাকেই দোষারূপ করে। ধর্ষণ ঠেকানোর উপায় কী হতে পারে? ধর্ষণের শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার দাবি সর্বত্র। বেশ কিছু দেশে মৃত্যুদণ্ড এবং দীর্ঘ কারাদণ্ডের বিধান থাকা সত্ত্বেও কোথাও ধর্ষণ থেমে নেই। বহুদিন আগে ‘জখমি আওরত’ নামে একটি হিন্দি মুভি দেখেছিলাম। মুভিতে এক নারী পুলিশ অফিসার তিন ব্যক্তির দ্বারা গণধর্ষণের শিকার হন। বিচার ব্যবস্থা যখন ধর্ষকদের শাস্তি দিতে ব্যর্থ হয়, তখন তিনি আরও ক’জন ধর্ষিতার সঙ্গে মিলে ধর্ষকদের খাসী করে তাদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ গ্রহণের পরিকল্পনা নেন। তারা এক নারী চিকিৎসকের সহায়তা নিয়ে তিন ধর্ষককে এক এক করে ফাঁদে ফেলে প্রত্যেককে খাসি করে প্রতিশোধ স্পৃহা চরিতার্থ করে। বিচার ব্যবস্থার ওপর ভুক্তভোগীর আস্থা উঠে গেলে তারা যদি আইন হাতে তুলে নেয়, তাহলে কী অন্যায় হবে? ধর্ষণের শিকারকে জীবনভর জ্বলন্ত নরকে দগ্ধ হওয়ার চেয়ে নিদেনপক্ষে ধর্ষকের বিচি অপসারণ খুব গুরুতর অপরাধ হবে না। দেশে দেশে ধর্ষণের বিরুদ্ধে শাস্তির বিধান : বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ধর্ষণের মতো শয়তানি অপরাধ নির্মূল অথবা হ্রাস করে বা শাস্তির কঠোরতার ভীতি জাগিয়ে রেখে দেশকে নাগরিকদের জন্য নিরাপদ রাখতে সচেষ্ট। আফগানিস্তানে ধর্ষণের অভিযোগ উঠলে ধর্ষককে পাকড়াও করার পর চার দিনের মধ্যে তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। সৌদি আরবে ধর্ষককে প্রকাশ্যে শিরচ্ছেদ করা হয়। ভারতে ধর্ষণের দায়ে অভিযুক্তকে ১৪ বছরের কারাদণ্ড দেওয়ার বিধান রয়েছে। তবে ধর্ষকরা ২-৩ বছরের মধ্যে জামিন পেয়ে যায়। অবশ্য অনেক ক্ষেত্রে ভারতে ধর্ষকের মৃত্যুদণ্ডের বিধান আছে। চীনে ধর্ষকের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড এবং কিছু ক্ষেত্রে অণ্ডকোষ কর্তন। রাশিয়ায় ধর্ষণের শাস্তি ভুক্তভোগীর ক্ষতি বিবেচনায় ৩ বছর থেকে ৩০ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড। উত্তর কোরিয়ায় ধর্ষণের মতো অপরাধে কোনো ধরনের ক্ষমাশীলতার সুযোগ নেই। ধর্ষকের শাস্তি ফায়ারিং স্কোয়াডে মৃত্যুদণ্ড। যুক্তরাষ্ট্রে ধর্ষণের শাস্তি দুই ধরনের আইনে হতে পারেÑ স্টেটের আইন ও ফেডারেল আইনে। অতএব দেখা যায়, অনেক ধর্ষক জরিমানা দিয়ে পার পেয়ে যাচ্ছে, কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে ৩০ বছরের কারাদণ্ড লাভ করছে। নরওয়েতে ধর্ষকের সাজা ৪ থেকে ১৫ বছর। ইসরায়েলে ধর্ষণের জন্য দাষী ব্যক্তির শাস্তি ৪ থেকে ১৬ বছরের কারাদণ্ড। ফ্রান্সে ১০ থেকে ৩০ বছর পর্যন্ত; ইরানে মৃত্যুদণ্ড; সংযুক্ত আরব আমিরাতে মৃত্যুদণ্ড। যেকোনো অপরাধ বা আইনবহির্ভূত কাজের জন্য শাস্তির বিধান থাকা সত্ত্বেও অপরাধীরা শাস্তির ভয়ে অপরাধ করেনি, এমন দৃষ্টান্ত বিরল। হত্যার দায়ে মৃত্যুদণ্ড বিশ্বের প্রায় সব দেশে চালু ছিল। কিন্তু আন্তর্জাতিক মানবাািধকার সংস্থগুলো চাপ, দেনদরবারে ১৪৪টি দেশ মৃত্যুদণ্ড বিলোপ করে হত্যার দায়ে অভিযুক্তদের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিচ্ছে। ৫৫টি দেশে এখানো মৃত্যুদণ্ড বহাল রয়েছে। কিন্তু শাস্তির কঠোরতা বা নমনীয়তার কারণে অপরাধীদের দ্বারা অপরাধ ঘটানো কমলেও অপরাধীর মনোজগত থেকে অপরাধ দূর হয় না।ধর্ষণের ক্ষেত্রেও তাই। বাংলাদেশের মতো চিরউচ্ছৃঙ্খল, রাজনৈতিক অস্থিতিশীল ও যৌন অবদমিত দেশে সুযোগ সন্ধানী ধর্ষকের যদি তার অসহায় শিকারের ওপর জবরদস্তি প্রয়োগের, ফুসলানোর বা বেকায়দায় ফেলার সুযোগ আসে, তাহলে তার লাম্পট্য চেগিয়ে উঠে। তার শিকারের যে শারীরিক ও মানসিক ক্ষতি হয় তা তার পক্ষে জীবনে কখনো কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয় না। বাংলাদেশে ধর্ষণের ঘটনাগুলোতে দেখা যায়, ধর্ষিতরা বেশির ভাগ ধর্ষককে জানে। তারা আশপাশের মানুষ, এমনকি আত্মীয়স্বজনের মধ্যে গণ্য। অতএব, জানাজানি হলে সংঘবদ্ধ প্রচেষ্টা ও চাপ থাকে আপসের। ধর্ষণের ক্ষেত্রে আপসের এই সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে না আসতে পারলে মৃত্যুদণ্ডের বিধান থাকা সত্বেও ধর্ষণের হার কমবে না। ওয়ার্ল্ড পপুলেশন রিভিউ এর হিসাব অনুযায়ী, ২০২০ সালের ধর্ষণ বিষয়ক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, বিশ্বের অন্তত ৩৫ শতাংশ নারী তাদের জীবনে কখনো না কখনো যৌন হয়রানির কবলে পড়েছেন। কিন্তু জাতিসংঘের তথ্যউপাত্ত অনুযায়ী এমন দেশও আছে যেখানে ৭০ শতাংশ নারী তাদের ঘনিষ্ট পুরুষ সঙ্গী দ্বারা শারীরিক ও যৌন সহিংসতার শিকার হয়েছে।যুক্তরাষ্ট্রে ধর্ষণ ও বিচার : আমি যেহেতু বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করছি, অতএব, ‘মানবাধিকারের এই মহান দেশে’ ধর্ষণ চিত্র তুলে না ধরা সঠিক হবে না। যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি লাখ মানুষের মধ্যে ধর্ষণের হার ২৭.৩ শতাংশ। আগেই উল্লেখ করেছি যে যুক্তরাষ্ট্রে ধর্ষণের দায়ে শাস্তি সর্বোচ্চ ৩০ বছরের কারাদণ্ড। কিন্তু এখানে আইনের প্রয়োগ ‘বজ্র আঁটুনি ফসকা গেঁড়ো’র মতো। ওয়ার্ল্ড পপুলেশন রিভিউ এর উপাত্ত অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্রে ৯ শতাংশ ধর্ষকের বিচার হয়, যার মধ্যে মাত্র ৩ শতাংশ সাজা পায়, অবশিষ্ট ৯৭ শতাংশ ধর্ষক অবাধে রাস্তায় ঘুরে বেড়ায়। এদেশে ৭০ শতাংশ ধর্ষণের ঘটনা ঘটে ভুক্তভোগীর পরিচিত পুরুষ দ্বারা।লেখক : যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী প্রখ্যাত সাংবাদিক। ভোরের আকাশ/মি
১ সপ্তাহ আগে
যারা রাষ্ট্র ক্ষমতায় থাকেন, তাদের মধ্যে একটা অহমিকা অটোমেটিক্যালি তৈরি হয়ে যায়। তখন তারা আর জনগণের ভাষা বুঝতে পারেন না কিংবা বুঝতে চান না। তারা ব্যক্তি স্বার্থে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। তারা অনেক কিছুই জনগণের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন। ফলে জনগণের সঙ্গে তাদের দূরত্ব তৈরি হয়। এই দূরত্ব বাড়তে বাড়তে একটা সময় তারা সরকারের ওপর বিরক্ত হয়ে যান; ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। বিভিন্ন দাবি নিয়ে মাঠে নামেন। এই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আন্দোলন বৃহৎ আন্দোলনে রূপ নেয়। সরকারবিরোধী গোষ্ঠী এবং দেশপ্রেমিক জনগণও এই আন্দোলনে যোগ দেন। একটা সময় সরকারের পতন হয়Ñ এটাই গণতান্ত্রিক দেশের স্বাভাবিক চরিত্র। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম না।এদেশে আন্দোলন সংগ্রামে রাজনৈতিক দলের পাশাপাশি তরুণ ও ছাত্র সমাজই সব চেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে, রাখছে, রাখবে। তারাই জনগণকে বারবার জাগিয়ে তুলেছে। পুলিশের বন্দুকের সামনে তারাই বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়েছে বারবার। ’৫২, ৬৯ ও ৭১-এর পর ১৯৯০ সালে গণঅভ্যুত্থানে স্বৈরশাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের পতন ঘটিয়েছিল মূলত ছাত্রসমাজ। দীর্ঘ সময় পর ২০২৪ সালে আরেকটি অভ্যুত্থান দেখল বাংলাদেশ। আন্দোলনের তীব্রতার মুখে দেশ ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হলেন টানা সাড়ে ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকা শেখ হাসিনা।আওয়ামী লীগের মতো একটা বড় ও প্রাচীন দলের প্রধানকে যখন দেশ ছেড়ে চলে যেতে হয়; তখন তার ও দলের ভুল নিয়ে চলে নানা বিশ্লেষণ। এটাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যবইয়ে অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। অন্য রাজনৈতিক দলগুলো এটা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা করতে পারে তাদের ভবিষ্যৎ শিক্ষা-দীক্ষার জন্য। তারা যেন এই ভুলগুলো এড়িয়ে চলতে পারেন।শেখ হাসিনার সব চেয়ে বড় ভুল হলো পরিবারতন্ত্র। বিভিন্ন পদে তিনি আত্মীয়-স্বজনকে বসিয়েছেন। দলের দুঃসময়ে তারা তেমন ভূমিকা রাখতে পারেননি। এই পরিবারতন্ত্রের কারণে ক্ষতি হয়েছে দলের। ত্যাগী-নেতাকর্মীরা কোণঠাসা হয়ে পড়েন। তাদের অনেককে নিষ্ক্রিয় করে রাখা হয়েছে। অনেকে রাজনীতির মাঠ থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছেন।উদাহরণটা শুরু করতে চাই কুমিল্লা থেকে। এই নগরের আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী এমপি ছিলেন আ ক ম বাহারউদ্দিন। কুমিল্লা সিটির উপনির্বাচনে তার মেয়ে তাহসিনা সূচনা বাহার আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পান এবং ভোটে জিতেও যান। খুলনার মেয়র নির্বাচিত হয়েছিলেন তালুকদার আব্দুল খালেক। এর আগে তিনি বাগেরহাটের এমপি, প্রতিমন্ত্রী এবং এরও আগে খুলনা সিটির মেয়র ছিলেন। একাদশ সংসদে তার স্ত্রী হাবিবুন নাহার বাগেরহাট-৩ আসনে এমপি নির্বাচিত হন। পরে তিনি বন, পরিবেশ ও জলবায়ুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী হন।ঢাকা দক্ষিণ সিটির অন্যতম জনপ্রিয় মেয়র ছিলেন সাঈদ খোকন। তার বাবা মোহাম্মদ হানিফও অত্যন্ত জনপ্রিয় মেয়র ছিলেন। এই সাঈদ খোকনকে বাদ দিয়ে রাজনীতিতে হঠাৎ আবির্ভাব হওয়া ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপসকে মনোনয়ন দেয় আওয়ামী লীগ। এর আগে তিনি আওয়ামী লীগের টিকিয়ে এমপি নির্বাচিত হন। তিনি শেখ হাসিনার ফুপাতো ভাই শেখ মনির ছেলে। তাপসের আরেক ভাই শেখ ফজলে শামস পরশকে সপ্তম কংগ্রেসে যুবলীগের চেয়ারম্যান করা হয়। এখানে লক্ষণীয় যে তাপস ও পরশ রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন না। কেবল শেখ পরিবারের সদস্য হওয়ায় ত্যাগী নেতাকর্মীদের মূল্যায়ন না করে তাদের চেয়ারে বসানো হয়েছে। গত সংসদে ঢাকায় যারা সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন; তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন বাহাউদ্দিন নাছিম। মাদারীপুরের এই ভদ্রলোককে ঢাকায় কেন মনোনয়ন দিতে হলো? ঢাকার স্থানীয় এমন কোনও নেতা নেই; যাকে মনোনয়ন দেওয়া যায়? স্থানীয়দের মনোনয়ন না দেওয়ায় হয়তো শেখ হাসিনার ভয়ে কেউ মুখ খোলেননি; কিন্তু নেতাকর্মীদের মধ্যে ক্ষোভ ছিল, তা তো বলার অপেক্ষা রাখে না। বেশ কয়েক বছর অবিভক্ত ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া। ঢাকায় এতো নেতাকর্মী থাকতে চাঁদপুরের এই লোককে কেন ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের দায়িত্ব দিতে হলো? ঢাকার পাশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ জেলা হলো নারায়ণঞ্জ। নারায়ণগঞ্জ-১ (রূপগঞ্জ) আওয়ামী লীগের টিকিটে এমপি এবং পরে মন্ত্রী হন গোলাম দস্তগীর গাজী। তার স্ত্রী হাসিনা গাজী তারাব পৌরসভার মেয়র নির্বাচিত হন আওয়ামী লীগের টিকিটে। ফরিদপুর-৩ (সদর) আসনে টানা তিনবার এমপি এবং পরে মন্ত্রী হন ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেন। তার আপন ছোট ভাই এহতেশাম বাবর ফরিদপুর সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন আওয়ামী লীগের টিকিটে। সারাদেশে একই অবস্থা ছিল। বাবা এমপি, ছেলে উপজেলার চেয়ারম্যান কিংবা পৌর মেয়র। স্বামী এমপি আবার স্ত্রী মেয়র কিংবা উপজেলা চেয়ারম্যান। কখনো কখনো এই দায়িত্বে বসানো হয়েছে এমপি-মন্ত্রীর নিকট আত্মীয়কে। এ কারণে টানা সাড়ে ১৫ বছরে আওয়ামী লীগে কিছু সুবিধাভোগী তৈরি হয়েছে। নতুন নেতা কিংবা ত্যাগী কর্মী তৈরি হয়নি। ফলে রাজপথে লড়াই করার মতো নেতাকর্মী দলটিতে ছিল না। এছাড়া অনেক নেতার নির্যাতনে অনেক নেতাকর্মীও গোপনে দলের বিরোধিতা করেছেন। বিতর্কিত বক্তব্য : গত ১৪ জুলাই সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, কোটা বিষয়ে আমার কিছু করার নেই। মামলার পর আদালত যে রায় দেন, এতে নির্বাহী বিভাগের কিছু করার নেই। আদালতেই সমাধান হবে। সাংবাদিকের এক প্রশ্নে তিনি তেলে-বেগুনে জ¦লে ওঠেন। তিনি পাল্টা প্রশ্ন করেন, মুক্তিযোদ্ধার নাতি-পুতিরা (কোটা) পাবে না, তাহলে কি রাজাকারের নাতি-পুতিরা পাবে? তার এই বিতর্কিত বক্তব্য শুধু তার জন্য নয়, দেশ ও জাতির জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়। প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্যের পরই ১৪ জুলাই রাতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো প্রতিবাদমুখর হয়ে ওঠে। বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীদের সেøাগান ওঠে, ‘আমি কে? তুমি কে? রাজাকার রাজাকার’। পরে তা বদলে হয় ‘চেয়েছিলাম অধিকার/ হয়ে গেলাম রাজাকার’, ‘আমি কে? তুমি কে? রাজাকার, রাজাকার/ কে বলেছে? কে বলেছে? সরকার, সরকার’। ক্ষেত্রবিশেষে সরকারের বদলে ‘স্বৈরাচার’ শব্দটিও শোনা গেছে। এরপর এই আন্দোলন আর দমানো যায়নি। সরকারি-বেসরকারি সব বিশ্ববিদ্যালয় ও স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীরা রাজধানীর সব সড়ক অবরোধ করে প্রতিদিনই আন্দোলন করেন। আন্দোলন পরবর্তীতে এমনভাবে বৃদ্ধি পায় যা আর কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়নি।এর আগে গত ৪ জুলাই কোটা ইস্যুতে আদালত যখন শুনানি আরও এক মাস পেছান তখন ছাত্রদের আন্দোলন আরও তীব্রতর হতে থাকে। অবশেষে ৬ জুলাই কোটাবিরোধীরা সারা দেশে ‘বাংলা বন্ধের’ ডাক দেন। সড়ক-মহাসড়ক অবরোধ, পরীক্ষা বর্জন ও সাধারণ ছাত্র ধর্মঘটের আহ্বান জানান। গত ১১ জুলাই ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, কোটাবিরোধীরা সর্বোচ্চ আদালতের বিরুদ্ধে যে শক্তি প্রদর্শন করছেন, তা বেআইনি। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, শিক্ষার্থীরা লিমিট ক্রস করে যাচ্ছেন। সারা দেশব্যাপী জনদুর্ভোগ সৃষ্টি করে কোটা আন্দোলন করতে দেওয়া প্রশাসনিক দুর্বলতা কি নাÑ এমন প্রশ্নে ওবায়দুল কাদের বলেন, এটা প্রশাসনিক দুর্বলতা নয়, আমরা ধৈর্য ধরছি। ধৈর্য ধরা মানে দুর্বলতা নয়। সময়মতো যথাযথ অ্যাকশন নেওয়া হবে। আরেক প্রশ্নে তিনি বলেন, ছাত্র আন্দোলনের কতিপয় নেতা যে বক্তব্য দিয়েছেন, সেটার জবাব ছাত্রলীগই দেবে। ছাত্রদের বিষয় ক্যাম্পাস পর্যন্ত সীমিত থাকবে। আমরা দেখি রাজনৈতিকভাবে কারা প্রকাশ্যে আসে, তখন দেখা যাবে। আমরাও মোকাবিলা করতে প্রস্তুত। ওবায়দুল কাদেরের বক্তব্যের পরই ১৬ জুলাই সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতি সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকারীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলায় তিন শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হন। এরপরই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজয় একাত্তর হলের সামনে প্রথমে দুই পক্ষের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া হয়। পরে দফায় দফায় ক্যাম্পাসজুড়ে সংঘর্ষ ও পাল্টাপাল্টি ইটপাটকেল ছোড়ার ঘটনা ঘটে।পরে ছাত্রলীগ নেতাকর্মী একজোট হয়ে ফের আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা চালায়। একপর্যায়ে ধারালো অস্ত্র, রড ও লাঠিসোটা হাতে থাকা ছাত্রলীগ নেতাকর্মীর দখলে চলে যায় ক্যাম্পাস। সংঘর্ষের সময় কয়েকজন যুবককে আগ্নেয়াস্ত্র হাতে দেখা গেছে। সন্ধ্যায় বহিরাগতদের ক্যাম্পাস থেকে বের করতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে সেখানে পুলিশ প্রবেশ করে। পরিস্থিতি শান্ত হওয়ার পর মধ্যরাতে ক্যাম্পাস ত্যাগ করে পুলিশ।এভাবে আন্দোলন তীব্র হতে থাকে। এক পর্যায়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী অ্যাকশনে যায়। তাদের গুলিতে দেড় হাজারের মতো মানুষ নিহত হন। আহত হন আরও অনেক মানুষ। তাদের সিংহভাই ছাত্র-তরুণ। এক পর্যায়ে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা ভারতে চলে যান বলে খবর আসে। এরপর সারাদেশে তাণ্ডব চালানো হয়। থানায় থানায় আক্রমণ করা হয়। অনেক পুলিশ সদস্য প্রাণ হারিয়েছেন। আহত হয়েছেন। আওয়ামী লীগের অনেক নেতাকর্মী এবং তাদের সম্পদ হামলার শিকার হয়েছে। আওয়ামী লীগের এই পরিবারতন্ত্র, ত্যাগী নেতাকর্মীদের অবমূল্যায়ন এবং অহমিকায় পতন থেকে অন্যদলগুলো শিক্ষা নিকÑ এটাই প্রত্যাশা। লেখক : সভাপতি, বাংলাদেশ রেলওয়ে পোষ্য সোসাইটি। ভোরের আকাশ/মি
১ সপ্তাহ আগে