তাকী মোহাম্মদ জোবায়ের
প্রকাশ : ১৩ এপ্রিল ২০২৫ ০৯:৫৭ এএম
বাজেটের আকার ছোট হচ্ছে
বেশ কয়েকটি চ্যালেঞ্জ সামনে রেখে আগামী অর্থবছরের বাজেট প্রণয়ন করছে সরকার। এসব প্রতিবন্ধকতা আমলে নিয়ে বাজেটের আকার কমানো হচ্ছে। আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটের সম্ভাব্য আকার ৭ লাখ ৯২ হাজার কোটি টাকা। এটি চলতি অর্থবছরের তুলনায় পাঁচ হাজার কোটি টাকা কম। ইতিহাসে এবারই প্রথম পূর্বের বছরের তুলনায় দেশের বার্ষিক ব্যয়ের লক্ষ্যমাত্রা ছোট হচ্ছে। পাশাপাশি মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যও কমানো হচ্ছে। আগামী অর্থবছরে প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য থাকবে ৫ দশমিক ৫ শতাংশ। বর্তমানে এই লক্ষ্য ৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ।
গত বুধবার অর্থ মন্ত্রণালয়ে এক কমিটির সভায় বাজেট নিয়ে এই সিদ্ধান্ত এসেছে। অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদসহ বাজেট প্রণয়ন কমিটির সদস্যরা এতে উপস্থিত ছিলেন। টেলিভিশনের মাধ্যমে জুনের প্রথম সপ্তাহেই আগামী অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাব উত্থাপনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন অর্থ উপদেষ্টা ।
অর্থ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, বাজেটের আকার নির্ধারণে কয়েকটি বিষয় বিবেচনায় নিচ্ছে অর্থ মন্ত্রণালয়। প্রথমত, সরকারের সামনে অর্থসংস্থান বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সাম্প্রতিক আর্থরাজনৈতিক পরিস্থিতিতে রাজস্ব আদায়ের গতি মন্থর হয়েছে। সামনেও রাজস্ব আয় খুব বেশি বাড়ানো সম্ভব হবে না বলে জানিয়ে দিয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। পাশাপাশি বৈদেশিক ঋণসহায়তা ও অনুদানের গতিও মন্থর হয়ে পড়েছে। সামনে কিছু প্রতিশ্রুত ঋণ সহায়তাও আটকে যাওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে।
অন্যদিকে চলতি অর্থবছরের বাজেট বাস্তবায়নের গতিও মন্থর। এখুনি প্রয়োজন নেই এমন প্রকল্পগুলোতে অর্থ ব্যয়ের ক্ষেত্রে সতর্ক অবস্থানে রয়েছে সরকার। সামনেও অপ্রয়োজনীয় কিংবা কম প্রয়োজনীয় প্রকল্পগুলোতে সরকার অর্থ বরাদ্দ দিবে না, এমনটাই জানিয়েছে মন্ত্রণালয়। এতে বাজেটের আকার কমে আসছে। সরকার পরিচালনার পাশাপাশি রাষ্ট্রের সকল উন্নয়ন ব্যয় ও ভর্তুকির অর্থসংস্থান হয় দুটি খাত থেকে। সরকারের আয়ের প্রধান উৎস কর, শুল্ক ও ভ্যাট। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এগুলো সংগ্রহ করে। বাকি অর্থের ব্যবস্থা হয় বিদেশি ঋণ ও অনুদান থেকে।
এদিকে দেশে বেসরকারি বিনিয়োগ ক্রমাগত কমছে। ফেব্রুয়ারিতে ইতিহাসের তলানিতে পৌঁছেছে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ। এতে কর্মসংস্থানের সুযোগ সংকুচিত হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে বাজেট ছোট হওয়া মানে সরকারের বিনিয়োগ কমা। এতে কর্মসংস্থানের সুযোগ আরও সংকুচিত হবে। বেকারত্ব বাড়বে। তবে এই পরিস্থিতি মেনে নিয়েই বাজেটের আকার কমানোর পক্ষে মত দিয়েছেন অর্থনীতিবিদগণ।
অর্থনীতি বিশ্লেষক মো. মাজেদুল হক এ প্রসঙ্গে ভোরের আকাশ’কে বলেন, বর্তমানে সামগ্রিক অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে আমাদের এখন সংকুচিতভাবেই চলতে হবে। এতে বেকারত্ব বাড়বে ঠিক। কিন্তু বৃহত্তর স্বার্থে এটি মেনে নিয়েই আগাতে হবে। কারণ, একদিকে সরকারের রাজস্ব আয় কমে গেছে। অন্যদিকে বাজেট ঘাটতি মোকাবিলায় বর্তমানে বিদেশি ঋণের পর্যাপ্ত সংস্থান নেই। তাই বাজেট প্রণয়নে বিদেশি ঋণনির্ভরতা কমাতে হবে।
এদিকে অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা আইএমএফের ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ সহায়তার শেষ দুই কিস্তির ২৩৯ কোটি ডলার প্রাপ্তি নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে। ঋণের শর্ত হিসেবে রাজস্ব আদায় বৃদ্ধি ও মুদ্রা বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করার জন্য বেশ চাপ দিচ্ছে সংস্থাটি। কিন্তু রাজস্ব আদায়ে আইএমএফের বেধে দেওয়া লক্ষ্য কোনোভাবেই বাস্তবায়ন করতে পারবে না বলে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে এনবিআর। পাশাপাশি, মূল্যস্ফতি নিয়ন্ত্রণকে অগ্রাধিকার দেওয়ায় ডলারের বিনিময় হারও পুরোপুরি বাজারভিত্তিক না করার বিষয়ে অনড় অবস্থানে রয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
বর্তমান ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য জাতীয় বাজেটের আকার ছিল ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি বা এডিপিতে বরাদ্দ ছিল ২ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা। এখান থেকে ৪৯ হাজার কোটি টাকা কাটছাঁট করা হয়েছে। বর্তমানে সংশোধিত এডিপির আকার ২ লাখ ১৬ হাজার কোটি টাকা।
সরকারি তথ্য অনুযায়ী, ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এডিপি বাস্তবায়ন ২৫ শতাংশের নিচে ছিল; যা গত ১৪ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। আগামী অর্থবছরের জন্য এডিপি বরাদ্দ ২ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা নির্ধারণ করা হতে পারে বলে অর্থ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে।
জানা গেছে, আগামী অর্থবছরে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের জন্য ৫ লাখ ১০ হাজার কোটি টাকা আদায়ের লক্ষ্য দেওয়া হতে পারে। চলতি অর্থবছরের লক্ষ্য ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা। এর বিপরীতে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এনবিআর ২ লাখ ২১ হাজার কোটি টাকা আদায় করতে পেরেছে। অর্থবছর শেষে সর্বোচ্চ ৪ লাখ কোটি টাকা আদায় করতে পারে বলে জানিয়েছে সংস্থটি। এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে আগামী অর্থবছরের জন্য একটি বড় বাজেট প্রণয়ন করা কঠিন হবে এবং এমন বড় বাজেট মূলত অকার্যকর থাকবে বলে জানিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়।
কর্মকর্তারা জানিয়েছন, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ৪৭০ কোটি ডলার ঋণ কর্মসূচির শর্তানুযায়ী বাংলাদেশকে কয়েকটি রাজস্ব সংস্কার বাস্তবায়ন করতে হবে। এর মধ্যে রয়েছে বাজেটের আকার কমানো, রাজস্ব আদায় বৃদ্ধি, বাজারভিত্তিক মুদ্রাবিনিময় হার গ্রহণ এবং বাজেট ঘাটতি হ্রাস।
এছাড়া সরকার ২০২৫-২৬ অর্থবছরে মুদ্রাস্ফীতি ৬ দশমিক ৫ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। এই লক্ষ্য অর্জনে সরকারকে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি বাস্তবায়নের পাশাপাশি ব্যয় সাশ্রয়ী পদক্ষেপ নিতে হবে।
বাজেট ঘোষণা হবে টেলিভিশনের পর্দায় : জাতীয় সংসদ না থাকায় অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ আগামী বাজেট উপস্থাপন করবেন টেলিভিশনের পর্দায়। রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশের মাধ্যমে এ বাজেট ঘোষণা করা হবে। জুনের প্রথম সপ্তাহে নতুন বাজেট ঘোষণা হবে। প্রচলিত বিধান অনুযায়ী, রাজনৈতিক সরকারের অর্থমন্ত্রীরা সংসদে বাজেট উপস্থাপন করেন। রাজনৈতিক সরকার ক্ষমতায় না থাকায় এ বছর সেটি হবে না।
বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মতো টেলিভিশনে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণের মাধ্যমে বাজেট উপস্থাপন করা হবে।
সর্বশেষ ২০০৭-০৮ সালে টেলিভিশনে ভাষণের মাধ্যমে দুটি বাজেট ঘোষণা করেছিলেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম।
ভোরের আকাশ/এসএইচ