তাকী মোহাম্মদ জোবায়ের
প্রকাশ : ০২ জুন ২০২৫ ০৯:২২ এএম
বড় চ্যালেঞ্জের বাজেট
জুলাই অভ্যুত্থানের মাধ্যমে যে নতুন অর্থনৈতিক পথনকশার স্বপ্ন দেখেছিল বাংলাদেশ, তার প্রতিফলন থাকছে না আগামী অর্থবছরের জন্য আজকের ঘোষিত জাতীয় বাজেটে। এমনকি, অর্থনীতির সঙ্গে সম্পর্কিত টাস্কফোর্স ও কমিটিগুলোর সুপারিশের প্রতিফলনও খুব বেশি নেই। কিছুটা এদিক-সেদিক করে ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য গতানুগতিক বাজেটই দিতে যাচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকার। এটিকে স্বপ্নভঙ্গের বাজেট হিসেবে আখ্যায়িত করছেন অর্থনীতি বিশ্লেষকরা।
বাজেট বিশ্লেষণে দেখা গেছে, নতুন অর্থবছরেও পূর্বের মতোই বাজেট ব্যবস্থাপনা করা হচ্ছে। বাজেটের কাঠামোগত সংস্কার না হওয়ার পেছনের কারণ হিসেবে সক্ষমতার ঘাটতি ও সদিচ্ছার অভাবকে দায়ী করেছেন বিশেষজ্ঞরা। তবে এবারের বাজেটে ব্যতিক্রম হিসেবে অর্থ উপদেষ্টার বাজেট বক্তৃতা ছোট হচ্ছে ও বাজেটের আকার পূর্বের বছরের তুলনায় ৭ হাজার কোটি টাকা কমছে। আজ সোমবার বিকেল ৩টায় বিটিভির মাধ্যমে আগামী অর্থবছরের বাজেট উপস্থাপন করবেন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ।
বাজেটে নতুন কোনো চমক থাকছে না উল্লেখ করে শে^তপত্র প্রণয়ন কমিটির প্রধান ও বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেছেন, দুঃখজনকভাবে এবারের বাজেটও গতানুগতিক হতে যাচ্ছে। খেলাপি ঋণ আদায়, পাচার হওয়া অর্থ ফেরত ও করের আওতা বাড়ানোর মতো নতুন কিছু নেই।
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য আরও বলেন, বর্তমানে যে প্রকল্পগুলো সরকারের কাছে রয়েছে তা অতিমূল্যায়িত। সেগুলোর ৪০ শতাংশ ব্যয়ই ভুয়া। অতীতের যে প্রকল্পগুলো থেকে রক্তক্ষরণ হতো সেগুলো এখনো অব্যাহত রয়েছে বলে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন তিনি। এদিকে আগামী বাজেট নিয়ে জনমনে যে স্বপ্ন জেগেছিল তা ভেঙে গেছে বলে মন্তব্য করেছেন অর্থনীতিবিদ এম এস সিদ্দিকী।
ভোরের আকাশ’কে তিনি বলেছেন, আমরা এই সরকারের কাছে যা আশা করেছিলাম, তার উল্টোটা হচ্ছে এবং সরকার কেন এভাবে বাজেট প্রণয়ন করছে তার কোনো যৌক্তিকতাও ব্যাখ্যা করছেন না। যতটুকু দেখেছি, এই বাজেটটা আগের থেকে কোন অংশে ভালো বাজেট হবে বলে মনে করি না। অর্থনীতি বিশ্লেষক মো. মাজেদুল হক ভোরের আকাশ’কে বলেন, এই সরকারের কাছে বাজেটের কাঠামোগত সংস্কারটা আশা করেছিলাম। এবার যদি সংস্কার না হয় তাহলে আমি বলবো, এটা জাতির জন্য দুর্ভাগ্য।
এবার আশা ছিল বাজেটকে গণমানুষের সঙ্গে সম্পৃক্ত করার একটা প্রচেষ্টা থাকবে। সেটা আসলে হচ্ছে না। প্রত্যেক করদাতার অধিকার আছে, তার টাকা কোথায় ব্যয় হচ্ছে সেটি জানতে পারার। পূর্বে এই সংস্কৃতি আমাদের দেশে ছিল না। এবার অন্তত এই সংস্কৃতির পরিবর্তন আসার দরকার ছিল বলে মন্তব্য করেন মাজেদুল হক।
গত জুলাই বিপ্লবে স্বৈরাচার সরকার পরিবর্তনের পর সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি গঠিত হয়। এরপর গঠিত হয় বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণাপ্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক মহাপরিচালক কে এ এস মুরশিদের নেতৃত্বাধীন অর্থনৈতিক কৌশল পুনর্র্নির্ধারণ-সংক্রান্ত টাস্কফোর্স। শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি ৩৯৭ পৃষ্ঠার ও টাস্কফোর্স ৫২৬ পৃষ্ঠার সুপারিশ-সংবলিত প্রতিবেদন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে জমা দেয়। তার পর গঠন করা হয় জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সংস্কার কমিটি। এ কমিটি অবশ্য এখন পর্যন্ত পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন তৈরিতে পারেনি, তবে একটি অন্তর্র্বর্তী প্রতিবেদন তৈরি করেছে।
সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, বাজেট প্রণয়ন করতে গিয়ে সুপারিশগুলোকে খুব বেশি আমলে নেয়নি অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ। ফলে অর্থনৈতিক সংস্কারের ভবিষ্যৎ পরিণতি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। যদিও অর্থ বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, শ্বেতপত্র ও টাস্কফোর্সের কিছু সুপারিশ বাস্তবায়নের দিকনির্দেশনা থাকবে আগামী অর্থবছরের বাজেটে। আর কিছু রাখা হবে পরের অর্থবছরের জন্য। কারণ, অর্থ বিভাগ মনে করছে নির্বাচিত সরকার ছাড়া প্রকৃত সংস্কার আনার সুযোগ কম।
জানা গেছে, শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি আগামী দুই বছরের জন্য একটি কর্মপরিকল্পনা করার পরামর্শ দিয়েছিল। এ ছাড়া অবিলম্বে স্বল্প মেয়াদে কিছু বিষয়ে মনোযোগ দেওয়ারও সুপারিশ করেছিল। এগুলো হলো অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা আনতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়া, আগামী অর্থবছরের পাশাপাশি ২০২৬-২৭ সময়ের জন্যও পরিকল্পনা করা, সংস্কারের অগ্রাধিকার ঠিক করা, স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উত্তরণের কৌশল ঠিক করা, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য (এসডিজি) অর্জনের গতি বৃদ্ধি এবং উন্নয়ন সহযোগীদের নিয়ে একটি সংলাপের আয়োজন করা। বাজেটে এসব সুপারিশ বাস্তবায়নের সুনির্দিষ্ট কোনো পদক্ষেপ থাকছে না বলে অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে।
এদিকে আগামী অর্থবছরের বাজেট নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেছেন, অর্থ উপদেষ্টা চলতি অর্থবছরের বাজেট সংশোধন করলেন, রাজস্ব বাজেটের লক্ষ্যমাত্রা কমালেন এবং আগামী অর্থবছরের জন্য পরোক্ষ করের ওপরই নির্ভরশীল থাকলেন। কিন্তু তিনি অগ্রাধিকার প্রকল্পের মধ্যে কোন ভিত্তিতে কী বাদ দিলেন ও কী রাখলেন, তা পরিষ্কার করলেন না। ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে সংসদে বিবৃতি দেওয়ার বাধ্যবাধকতা আছে উল্লেখ করে তিনি প্রশ্ন রাখেন, সংসদ নেই বলে কি আর্থিক পরিস্থিতির কথা জানিয়ে বিবৃতি দেওয়া যায় না? না দিলে মানুষ জানবে কীভাবে যে সরকার ভালো করছে না খারাপ করছে?
যা থাকছে বাজেটে : অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ব্যক্তিশ্রেণির করদাতাদের জন্য করমুক্ত আয়সীমা ২০২৫-২৬ করবর্ষে অপরিবর্তিত থাকছে। তবে করস্তরগুলোর সর্বোচ্চ স্তরে ধনীদের জন্য সর্বোচ্চ ৩০ শতাংশ কর বসানোর প্রস্তাব থাকতে পারে, যা এখন ২৫ শতাংশ। বর্তমানে ব্যক্তি করদাতার করমুক্ত আয়সীমা সাড়ে তিন লাখ টাকা। অর্থাৎ, বছরে এই পর্যন্ত আয় হলে কর দিতে হয় না। আবার মোট আয় থেকে সাড়ে তিন লাখ টাকা বাদ দিয়ে করের পরিমাণ হিসাব করা হয়। এ ক্ষেত্রে ছাড় দেওয়া হলে মানুষ স্বস্তি পায়। বাংলাদেশে করমুক্ত আয়সীমা কম এবং মূল্যস্ফীতির হার চড়া-এ দুই বিবেচনায় ছাড় দেওয়ার সুপারিশ করেছিলেন অনেকেই।
সূত্র জানায়, এবার কোনো ছাড় দেওয়ার পরিকল্পনা গতকাল রোববার পর্যন্ত ছিল না। তবে বাজেটে পরের দুই করবর্ষে করমুক্ত আয়সীমা ৩ লাখ ৭৫ হাজার টাকা রাখার ঘোষণা থাকবে। সে ক্ষেত্রে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে আহত গেজেটভুক্ত ব্যক্তিদের করমুক্ত আয়সীমা ৫ লাখ ২৫ হাজার টাকা করা হতে পারে। ন্যূনতম করে ছাড় দেওয়া হতে পারে নতুন করদাতাদের উৎসাহিত করার লক্ষ্যে।
বর্তমানে এলাকাভেদে ন্যূনতম কর ৩ তিন থেকে ৫ হাজার টাকা, যা নতুন করদাতাদের জন্য কমিয়ে এক হাজার টাকা করা হতে পারে। বেসরকারি চাকরিজীবীদের করযোগ্য আয় গণনার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ বাদযোগ্য অঙ্কের পরিমাণ বাড়ানো হচ্ছে। এখন নানা ধরনের ভাতাসহ সাড়ে চার লাখ টাকা পর্যন্ত আয় বাদ দেওয়া যায়। এই অঙ্ক বাড়িয়ে পাঁচ লাখ টাকা করা হতে পারে। এতে কিছুটা ছাড় পাবেন চাকরিজীবীরা।
আগামী অর্থবছরে আয়কর রিটার্নের প্রমাণপত্র দেখানোয় বড় ছাড় আসছে। বর্তমানে ৪৫ ধরনের সেবা নিতে আগের অর্থবছরের রিটার্ন দাখিলের প্রমাণপত্র লাগে। এই সেবার সংখ্যা কমিয়ে আনা হচ্ছে। সঞ্চয়পত্র কেনাসহ বেশ কিছু খাতের এই বাধ্যবাধকতা থাকছে না। তবে ক্রেডিট কার্ড নেওয়ার ক্ষেত্রে রিটার্ন দাখিলের বাধ্যবাধকতা থাকছে। করমুক্ত দানের আওতায় স্বামী-স্ত্রী, পিতা-মাতা ও সন্তানের পাশাপাশি আপন ভাই ও আপন বোনকে অন্তর্ভুক্ত করা হতে পারে। এর মানে হলো, আপন ভাইবোনকে দান করলে তা করমুক্ত থাকবে।
এদিকে বাজেটে করপোরেট কর বাড়তে পারে। শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত নয়, এমন কোম্পানির ক্ষেত্রে আড়াই শতাংশ বাড়িয়ে করপোরেট কর সাড়ে ২৭ শতাংশ করা হতে পারে। ব্যাংকসহ আনুষ্ঠানিক ব্যবস্থায় লেনদেনের শর্তে করপোরেট কর ২৫ শতাংশই থাকবে। তবে সে শর্ত পূরণ কঠিন হতে পারে। শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির জন্য ২০ শতাংশ করপোরেট কর অব্যাহত থাকছে।
পুঁজিবাজারে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কাজ করা মার্চেন্ট ব্যাংকের করহার সাড়ে ৩৭ শতাংশ থেকে কমিয়ে সাড়ে ২৭ শতাংশ করার প্রস্তাবও করতে পারেন অর্থ উপদেষ্টা। এ ছাড়া সিকিউরিটিজ লেনদেনের মোট মূল্যের ওপর ব্রোকারেজ হাউসগুলোর ওপর করহার কমানো হতে পারে। বর্তমানে বছরে তিন কোটি টাকার বেশি টার্নওভার (বছরে লেনদেন) হয় এমন প্রতিষ্ঠানকে লাভ-লোকসান নির্বিশেষে শূন্য দশমিক ৬ শতাংশ কর দিতে হয়। এটি বাড়িয়ে ১ শতাংশ করার প্রস্তাব করা হতে পারে। মানে হলো, পণ্য বা সেবা বিক্রির মোট আয়ের ওপর ১ শতাংশ কর দিতে হবে। বর্তমানে জমি কেনায় করহার বেশি। এই করহার কমানোর প্রস্তাব করতে পারেন অর্থ উপদেষ্টা, যাতে কালোটাকা তৈরি না হয়। এখন কর ফাঁকি দিতে অনেকেই জমির মূল্য কম দেখান। এতে কালোটাকা তৈরি হয়।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সূত্রে জানা গেছে, জমি কেনাবেচার ওপর কর এলাকাভেদে ৬, ৪ ও ৩ শতাংশ নির্ধারণ করা হতে পারে, যা এখন ৮,৬ ও ৪ শতাংশ। ফ্ল্যাট ও জমি কেনায় কালোটাকা সাদা করার সুযোগ অব্যাহত রাখা হতে পারে। সে ক্ষেত্রে বর্তমানে যে করহার আছে, তা এলাকাভেদে কয়েক গুণ বাড়ানো হবে বলে জানা গেছে। এমনকি অর্থের উৎস সম্পর্কে প্রশ্ন করার সুযোগও রাখা হতে পারে। বাজেটে রেফ্রিজারেটর, শীতাতপনিয়ন্ত্রণ যন্ত্র (এসি), মুঠোফোনের রড, ফেসওয়াশ, লিপস্টিক ও চকলেট দাম বাড়তে পারে। দাম কমতে পারে বাস, মাইক্রোবাস, চিনি, বিদেশি মাখন, ড্রিংক, সিরিশ কাগজ, ক্রিকেট ব্যাট ইত্যাদির।
ভোরের আকাশ/আজাসা