স্থলপথে ৯ পণ্যের ভারতীয় নিষেধাজ্ঞা
সিরাজুল ইসলাম
প্রকাশ : ২৯ জুন ২০২৫ ১২:২১ পিএম
ফাইল ছবি
বাংলাদেশ থেকে স্থলবন্দর দিয়ে কাঁচাপাট ও পাটজাত ৯ ধরনের পণ্য আমদানিতে নতুন নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে ভারত। গত শুক্রবার এ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। ফলে বাংলাদেশি পণ্য রফতানি নিয়ে নতুন আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। ক্ষতির আশঙ্কা করছেন রপ্তানিকারক ও বিশ্লেষকরা। তারা আলোচনার মাধ্যমে বিষয়টি মীমাংসার তাগিদ দিয়েছেন।
তারা বলছেন, বাংলাদেশি পাটজাত পণ্যের বড় বাজার ভারত। বাংলাদেশ যত পাটজাতীয় পণ্য রপ্তানি করে, এর অর্ধেকের বেশি যায় ভারতে। বড় এই বাজার যেন হাতছাড়া না হয় সেদিকে খেয়াল রাখার আহ্বান জানিয়েছেন তারা।
জানা গেছে, যশোরের বেনাপোল; ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া; সাতক্ষীরার ভোমড়া ও লালমানিরহাটের বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর দিয়ে ভারতে পাট ও পাটজাত পণ্য রফতানি করে থাকে বাংলাদেশ। এছাড়া নেপাল ও ভুটানেও এ পণ্য ভারতের ট্রানজিট ব্যবহার করে রপ্তানি করা হয়। মূলত এই দেশগুলোই বাংলাদেশি পাটপণ্যের অন্যতম বাজার।
ভারতের বৈদেশিক বাণিজ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অজয় ভাদু স্বাক্ষরিত বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, আমদানি নিষিদ্ধ করা এসব বাংলাদেশি পণ্যের মধ্যে রয়েছে কাঁচাপাট, পাটের রোল, পাটের সুতা ও বিশেষ ধরনের কাপড়। তবে বাংলাদেশ থেকে এসব পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে নভোসেবা বন্দর ব্যবহার করা যাবে। এসব পণ্য পুনরায় রপ্তানি করা যাবে না। বাংলাদেশ থেকে স্থলবন্দর দিয়ে ভারতের মধ্য দিয়ে নেপাল ও ভুটানে এই পণ্য রপ্তানিতে কোনো বিধিনিষেধ নেই।
এই নিষেধাজ্ঞার প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশ জুট স্পিনার্স এসোসিয়েশনের ডিরেক্টর ও রাজবাড়ী জুট মিলসের চেয়ারম্যান শেখ শামসুল আবেদিন বলেন, ভারতের নতুন সিদ্ধান্তের প্রভাব দেশের পাটশিল্পে কতটা পড়বে সেটি তারা বিশ্লেষণ করছেন।
তিনি বলেন, কাঁচাপাট রফতানি বন্ধ হবে হয়তো। তবে স্থলবন্দর না হলে নৌপথে কীভাবে রফতানি চালু রাখা যায় সে আলোচনা এর মধ্যেই শুরু হয়েছে। অ্যান্টি ডাম্পিং শুল্ক আরোপের কারণেও বাংলাদেশের পাট ও পাটজাত দ্রব্য ভারতের রফতানিতে কিছুটা সমস্যা তৈরি হয়েছিল; কিন্তু তারপরেও বাংলাদেশের পাট ভালো করছিল। এখন হয়তো কাঁচাপাট রফতানি সংকটে পড়বে। তবে একই সঙ্গে দেশে পাটের ফিনিশড গুড উৎপাদন আরও বাড়ানো সুযোগ আছে। যদিও নৌপথে ভারতের রফতানির সুযোগ এখনো আছে। সেটি কতটা কাজে লাগানো যায় তা বিশ্লেষণ করা হচ্ছে।
ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের (বিটিটিসি) সাবেক সদস্য ও বাণিজ্য বিশ্লেষক মোস্তফা আবিদ খান বলছেন, ভারতে বাংলাদেশি পণ্যের রফতানি স্থল পথে বন্ধ হলে সেটি নৌপথে রফতানি করে পোষানো খুবই কঠিন বিষয় হবে।
তিনি বলেন, ভারতে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রফতানি প্রায় বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর পাটও বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। স্থলবন্দর দিয়ে ভারত আমদানি বন্ধ করার কারণে বাংলাদেশের রফতানি অনেকটা কমে যাবে। ফলে প্রভাবটি অনেকটাই সরাসরি পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
সিপিডির সম্মানীয় ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, রাজনৈতিক টানাপোড়েনের কারণেই এসব পাল্টাপাল্টি পদক্ষেপ হচ্ছে; যা বাংলাদেশের জন্যই বেশি ক্ষতিকর হবে। বাংলাদেশ থেকে পোশাকের পর পাট রফতানি ক্ষতিগ্রস্ত হলো। আমার মনে হয় আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধানের উদ্যোগ নেয়া উচিত আমাদের স্বার্থেই।
প্রসঙ্গত, গত বছর ৫ আগাস্ট বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্কের অবনতি ঘটে। এরপর বিভিন্ন ইস্যুতে দুই পক্ষের মধ্যে কয়েক মাস ধরে বাকযুদ্ধের পর ভারত ও বাংলাদেশ একে অপরের বিরুদ্ধে বেশ কিছু বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে শুরু করে। ফলে দুই দেশের রাজনৈতিক সম্পর্কের টানাপোড়েন এখন সরাসরি ব্যবসা বাণিজ্যে প্রভাব ফেলেছে।
স্থলবন্দর দিয়ে আমদানি নিষিদ্ধ করা এসব বাংলাদেশি পণ্যে মূলত পাট ও পাটজাত পণ্য বেশি। এর মধ্যে কাঁচা পাট, পাটের রোল, পাটের সুতা, একাধিক ভাঁজের বোনা কাপড়, একক শণ সুতা, পাটের একক সুতা ও বিশেষ ধরনের কাপড় রয়েছে এই তালিকায়।
ভারত এ ধরনের যে ৯টি পণ্যের ওপর স্থলবন্দর নিয়ে আমদানি নিষিদ্ধ করেছে, এসব পণ্য থেকে ২০২৩-২৪ অর্থ বছরে বাংলাদেশের রফতানি আয় ছিল প্রায় ১৫ কোটি ডলারের কাছাকাছি। এর প্রায় সবটাই স্থলবন্দর দিয়ে ভারতে পাঠানো হয়েছিল। রাজস্ব বোর্ডের হিসেবে, এই ১৫ কোটি ডলারের রফতানির মধ্যে মাত্র বিশ লাখ ডলারের রফতানি স্থলবন্দর দিয়ে হয়নি।
বাংলাদেশ রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) হিসাবে, ভারতে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ১৫৭ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে বাংলাদেশে; যা দেশটির মোট রপ্তানি আয়ের ৩ দশমিক ৭৫ শতাংশ। অন্যদিকে ভারত থেকে বাংলাদেশ ৯শ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি করে। মূলত ভারতীয় ভোগ্যপণ্যের বড় বাজার হলো বাংলাদেশ। ভারতে সবচেয়ে বেশি রপ্তানি হতো পোশাক এবং এরপর পাট ও পাটজাত পণ্যই দেশটিতে বেশি যায় বাংলাদেশ থেকে।
এছাড়া প্লাস্টিক পণ্য রফতানিতেও বাংলাদেশ ভালো করছিল। এর ওপরে আগেই বিধিনিষেধ দিয়েছে ভারত। বাংলাদেশে যে প্রভাব পড়বে: শুক্রবার স্থলবন্দর দিয়ে ৯টি পণ্য আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপের মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে পণ্য আমদানিতে তিন মাসে তিন দফায় বিধিনিষেধ দিল ভারত।
এর আগে গত ১৭ মে স্থলবন্দর দিয়ে ভারতে তৈরি পোশাক, প্রক্রিয়াজাত খাদ্য, প্লাস্টিক, কাঠের আসবাব, সুতা ও সুতার উপজাত, ফল ও ফলের স্বাদযুক্ত পানীয়, কোমল পানীয় প্রভৃতি পণ্য আমদানিতে বিধিনিষেধ দিয়েছিল। তারও আগে গত ৯ এপ্রিল ভারতের কলকাতা বিমানবন্দর ব্যবহার করে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানির সুবিধা প্রত্যাহার করেছিল দেশটি।
এর আগে আটই এপ্রিল অন্য দেশে পণ্য রফতানির জন্য বাংলাদেশকে দেয়া ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিল করেছিল ভারত। এরপর পনেরই এপ্রিল স্থলবন্দর দিয়ে ভারত থেকে সূতা আমদানি বন্ধ করে ঘোষণা করে বাংলাদেশ।
অর্থনীতিবিদ মোস্তাফিজুর রহমান বলছেন, ভারত অনেক দিন ধরে বাংলাদেশকে শুল্কমুক্ত সুবিধা দেয়ার কারণে দেশটিতে বাংলাদেশের রফতানি বৃদ্ধি পেয়ে প্রায় দুই বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি চলে যায়। কিন্তু এখনকার পাল্টাপাল্টি ব্যবস্থা নেয়ার বিষয়টি সংকট তৈরি করছে। এটা কারও জন্যই ভালো নয়। বাংলাদেশ ভারতের ওপর অনেক পণ্যের ক্ষেত্রেই নির্ভরশীল।
আবার ভারতীয় পণ্য রফতানির জন্য বাংলাদেশের উপরেও নির্ভরশীলতা আছে। তাই দুই পক্ষই যত দ্রুত সমাধানে পৌঁছাতে ততই দুই দেশের বাণিজ্য ও অর্থনীতি উপকৃত হবে।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, তৈরি পোশাকের পরে ভারতে পাট ও পাটজাত পণ্যই বেশি যাচ্ছিল। ২০১৭ সালে দেশটি বাংলাদেশি পাটপণ্যে ‘অ্যান্টি ডাম্পিং’ শুল্ক আরোপ করে; যা ২০২৩ সালে আরও পাঁচ বছর বাড়ানো হয়।
পাট অধিদফতরের হিসেবে চলতি বছরের মার্চ মাসে ভারতসহ মোট ১২টি দেশে ৬৯৮ কোটি টাকার কাঁচাপাট রফতানি হয়েছে। এর মধ্যে শুধু ভারতেই ৪৪৮ কোটি টাকার বেশি মূল্যের কাঁচাপাট রপ্তানি হয়েছে। এর প্রায় পুরোটাই গেছে স্থলবন্দর দিয়েছে। এর আগে ২০২৩-২৪ অর্থ বছরে এক ১ হাজার ৭০০ কোটি টাকার বেশি কাচাপাট রফতানি হয়েছে ভারতসহ ১৩টি দেশে।
এর মধ্যে সর্বোচ্চ ৭ লাখ ৯৭ হাজার ৩৩২ বেল পাট গেছে ভারতে; যার মূল্য ১ হাজার ২৯ কোটি টাকার বেশি। এখানেও পুরোটা স্থল বন্দর দিয়েই রফতানি হয়েছে। এমনকি তৃতীয় দেশে রফতানির জন্য বাংলাবান্দা স্থল বন্দর দিয়ে প্রায় আড়াই লাখ বেল পাটা গেছে বাংলাদেশ থেকে।
যদিও গত মে মাসে পোশাকসহ কিছু বাংলাদেশি পণ্য স্থলপথে আমদানি ভারত নিষিদ্ধ করার পর বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন দাবি করেছিলেন- ভারতই বাংলাদেশে বেশি রফতানি করে বলে স্থলবন্দর কেন্দ্রিক বিধিনিষেধে বাংলাদেশের চেয়ে ভারতীয় ব্যবসায়ীরাই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। অবশ্য আলোচনার মাধ্যমে সমস্যাটির সমাধান করা সম্ভব বলেও তিনি তখন আশাবাদ ব্যক্ত করেছিলেন।
ভোরের আকাশ/এসএইচ