মাজাহারুল ইসলাম
প্রকাশ : ২১ নভেম্বর ২০২৫ ১২:০৫ এএম
ছবি- সংগৃহীত
সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনর্বহালে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেছে রাজনৈতিক মহল-এমনটাই মনে করছেন বিশ্লেষকসহ সংশ্লিষ্টরা। তাদের ভাবনা, সুশাসন ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে বিগত ১৬ বছর রাজপথে আন্দোলন-সংগ্রাম করেছিল কিন্তু ফ্যাসিস্ট আচরণের মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করে স্বৈরাচারী শাসন কায়েম করেছিল তৎকালীন শেখ হাসিনা সরকার। তাই তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনর্বহাল একটা গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। এই রায়ের মধ্যদিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোরসহ দেশবাসী স্বস্তি ফিরে পেয়েছে মনে করছেন তারা।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতামত, যে রায়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করা হয়েছিল, সেটি ছিল বিতর্কিত ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের ফলে শেখ হাসিনা স্বৈরাচারী শাসন কায়েম করার সুযোগ পেয়েছিলেন। তত্ত্বাবধায়কবিহীন বিগত নির্বাচনগুলো ইতিহাসে কলঙ্কিত নির্বাচন হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। এই রায়ের মাধ্যমে গণতন্ত্র তার ইতিবাচক ধারায় ফিরে আসবে বলেও ভাবছেন রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অনুপস্থিতিতে বাংলাদেশের যেসব নির্বাচন কেড়ে নেওয়া হয়েছে এবং মানুষের ভোটাধিকার হরণ করা হয়েছে- যার ফলে অপশাসন, নিপীড়ন ও নির্যাতনের অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। কাজেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মাধ্যমে আগামী নির্বাচনগুলো সুসংহত ও গ্রহণযোগ্য হবে প্রত্যাশা করছেন এই রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। বহুল আলোচিত নির্বাচনকালীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলের রায় অবৈধ ঘোষণা করেছেন আপিল বিভাগ। একইসঙ্গে ত্রয়োদশ সংশোধনী বৈধ ঘোষণা করে সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনর্বহাল করেছেন দেশের সর্বোচ্চ আদালত। গতকাল সকাল ৯টা ৪০ মিনিটে প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বে ৭ বিচারপতির পূর্ণাঙ্গ আপিল বিভাগ ঐতিহাসিক এ রায় ঘোষণা করেন।
প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘এ রায়ের মাধ্যমে সংবিধানে স্বয়ংক্রিয়ভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ফিরলেও আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে। পরবর্তী অর্থাৎ চতুর্দশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা কার্যকর হবে বলে রায়ে বলা হয়েছে।’
এ প্রসঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনর্বহাল দেশের রাজনীতিতে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে এবং দলের দীর্ঘদিনের আন্দোলন সফল হলো।
আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পূনর্বহালের রায়কে আমরা স্বাগত জানাই। এটার জন্য আমরা অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছি, অনেক প্রাণ দিয়েছি। আমাদের ৬০ লাখ লোকের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। আমাদের হাজার হাজার নেতাকর্মী গুম-খুন হয়েছে। চাকরি-ব্যবসা হারিয়েছে, পঙ্গু হয়েছে, এগুলো তো আর ফিরিয়ে দেওয়া যাবে না। আজকে কেয়ারটেকার সরকার থাকলে আমরা এ অবস্থায় থাকতাম না। সবকিছু ধ্বংসের পেছনে হচ্ছে একটি অনির্বাচিত সরকার শেখ হাসিনা আর ১৪-১৫ মাস ধরে আরেকটা অনির্বাচিত সরকার এখনো চলছে।
তিনি বলেন, কেয়ারটেকার সরকার পুনঃপ্রবর্তন হওয়াতে আমাদের দীর্ঘ আন্দোলনের একটা ফল আমরা পেয়েছি। তবে যেহেতু এটা আগামী নির্বাচন থেকে শুরু হবে, আমি অনুরোধ করবো বর্তমান সরকারকে এটা মাথায় রেখে, বর্তমান সরকারকে কেয়ারটেকার সরকারের আদলে পরিচালিত করতে হবে। যেহেতু ওনারা অন্তর্বর্তী সরকার, কেয়ারটেকার সরকার আগামী নির্বাচন থেকে শুরু হবে, বর্তমান সরকারকে এটা মাথায় রাখতে হবে। এটাই বাংলাদেশের মানুষের চাহিদা। যারা নির্বাচনকালীন সরকারে থাকবেন তাদের নিরপেক্ষতা নিয়ে যাতে কোনো প্রশ্ন না ওঠে, এজন্য অন্তর্বর্তী সরকারকে আমি অনুরোধ করব কেয়ারটেকার সরকারের আদলে এখন থেকে নির্বাচনের দিন পর্যন্ত সরকার পরিচালনা করুন। কোনো বড় সিদ্ধান্ত বা অন্য সিদ্ধান্তে আপনাদের যাওয়া উচিত হবে না। আপনারা পুরোপুরি নির্বাচনের দিকে যান এবং নির্বাচনে কেয়ারটেকার সরকারের ভূমিকাটা পালন করেন।
তিনি আরও বলেন, স্বৈরাচার ফ্যাসিস্টকে বিতাড়িত করার পর দেশের মানুষের মধ্যে যে বিশাল পরিবর্তন, প্রত্যাশা ও আশা-আকাক্সক্ষা তৈরি হয়েছে, এটাকে যদি আমরা ধারণ করতে না পারি তাহলে কোনো রাজনীতিবিদ ও রাজনৈতিক দলের ভবিষ্যৎ নেই। আগামী নির্বাচনে বিএনপি যদি সরকার গঠন করতে পারে, ওই ধারণাগুলো (জিয়াউর রহমান যেভাবে দেশ চালিয়েছিলেন) আবার ফেরত নিয়ে আসবো। সেটার ভিত্তিতে আমরা এখন সব কাজ করতেছি।
বিএনপির এ নেতা বলেন, যেই গণতন্ত্রের কথা বলছি, সেটাকে সফল করতে হলে যদি জবাবদিহিতা আনতে না পারি, যদি রাজনীতিবিদরা প্রশ্নের সম্মুখীন না হয়, তাহলে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। এরপরে রাজনীতিতে সহনশীলতা থাকতে হবে। অপরের সঙ্গে আপনি দ্বিমত পোষণ করেও, তার মত-কে সম্মান জানাতে হবে। এই সংস্কৃতি যদি আমরা আনতে না পারি, তাহলে শত সংস্কার করেও কোনো পরিবর্তন হবে না।
আমীর খসরু বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অনুপস্থিতিতে মানুষ অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছে। এখন এটি ফেরত এসেছে, কীভাবে গঠন হবে তা নিয়ে আলোচনা হবে। তার মতে, সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব এই ব্যবস্থার অধীনে, এবং ইতোমধ্যেই এই ব্যবস্থায় গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, গণতন্ত্রের পথচলায় কেউ যেন নতুন করে ফ্যাসিস্ট হয়ে না উঠতে পারে সেজন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনর্বহালের রায় ইতিবাচক হিসেবে কাজ করবে।
রিজভী বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনর্বহাল হওয়ায় ন্যায় ও গণতন্ত্রের পথে বড় অগ্রগতি এসেছে। এ রায় অত্যন্ত ইতিবাচক। ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী করতেই আওয়ামী লীগ তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বাতিল করেছিল।
তিনি আরও বলেন, এই রায়ের মাধ্যমে গণতন্ত্রের প্রাণভোমরা আবারও পুনরুজ্জীবিত হয়েছে। ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠা হলে সেই সরকারের কোনও মানবতা থাকে না। তাই শেখ হাসিনার মধ্যে মানবিক আচরণ ছিল না। রাষ্ট্রক্ষমতায় তিনি কঠোর ও নিষ্ঠুরতা প্রদর্শন করেছেন।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল অ্যাডভোকেট এহসানুল মাহবুব জুবায়ের বলেন, বিগত প্রায় ১৬ বছর দেশে আওয়ামী-বাকশালীদের অপশাসন-দুঃশাসন চলেছে।মাফিয়াতান্ত্রিক সরকার জনগণের সকল অধিকার কেড়ে নিয়ে দেশকে প্রায় অকার্যকর রাষ্ট্রে পরিণত করেছিল। সংবিধান ও আইনের তোয়াক্কা না করে সবকিছু করা হয়েছিল গায়ের জোরে। পরিকল্পিতভাবে দেশ ও জাতিসত্তাকে হুমকির মুখে ঠেলে দেওয়া হয়েছিল। নানামুখী ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত করা হয়েছিল দীর্ঘ পরিসরে। কিন্তু ছাত্র-জনতার যুগপৎ বিপ্লবের মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে সে অবস্থা থেকে মুক্তি দিয়েছেন। আমরা এখন অতীত ভুলে নতুন বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে চাই।
তিনি বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে যারা দায়িত্ব নিয়েছেন তারা অনেকগুলো ফরমেটে দেশ সংস্কারের কাজ করছেন। আমাদের কাছ থেকে পরামর্শ নিচ্ছেন, আমরা সব দল মিলে তাদেরকে পরামর্শ দিচ্ছি। অবশ্যই একটি সুন্দর দেশ, জাতি, রাষ্ট্র গঠনের জন্য কিংবা একটি সুন্দর বাংলাদেশ গড়ার জন্য ভালো ব্যবস্থাপনার প্রয়োজন। সেজন্য ফ্যাসিবাদ ফিরে আসার সমস্ত পথ করতে হবে, স্বৈরশাসক ফিরে আসার পথ বন্ধ করতে হবে। কিন্তু এটি শুধুমাত্র কিছুসংখ্যক সংস্কার দিয়ে সম্ভব নয়।
এ প্রসঙ্গে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের সিনিয়র নায়েবে আমির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ ফয়জুল করিম বলেন, আওয়ামী লীগ সরকার জোরপূর্বক নির্বাচনকালীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করেছিল। বাতিলকৃত সেই রায় পুনর্বহাল হয়েছে। এটা অবশ্যই জনকল্যাণ এবং জনগণের ভবিষ্যৎ ভালো হবে।
মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ ফয়জুল করিম বলেন, আশা করি নির্দলীয়, নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে যদি নির্বাচন হয়, তাহলে বিগত যে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনগুলো হয়েছে তার চেয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনের নির্বাচনগুলো অনেকটা গ্রহণযোগ্য ও স্বচ্ছ এবং নিরপেক্ষ। এই আইন প্রণয়নের মাধ্যমে জনগণ আশ্বস্ত হয়েছে এবং খুশি হয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ কর্তৃক তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহালের ঐতিহাসিক রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছে খেলাফত মজলিস।
খেলাফত মজলিসের আমীর মাওলানা আব্দুল বাছিত আজাদ ও মহাসচিব ড. আহমদ আবদুল কাদের এক যৌথ বিবৃতিতে বলেন, ২০১১ সালের ১০ মে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংবিধান থেকে বাতিল ঘোষণা করেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ।
এর পরিপ্রেক্ষিতে দলীয় সরকারের তত্ত্বাবধানে অনুষ্ঠিত তিনটি জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে দেশে একদলীয় আওয়ামী ফ্যাসিবাদী শাসন প্রলম্বিত হয়। বিরোধী রাজনৈতিক দল ও ভিন্নমতের বিরুদ্ধে শুরু হয় নিষ্ঠুর দমন-পীড়ন। বিগত ১৬ বছর গণহত্যা, গুম, অপহরণ, নির্যাতন ও নিপীড়নের স্টিমরোলার চালিয়ে বাকস্বাধীনতা রুদ্ধ করা হয়েছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব ও জননিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ফেলে দেওয়া হয়েছে।
তারা আরও বলেন, আজকে প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে উচ্চ আদালতের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা পুনর্বহালের পক্ষে যে রায় দিয়েছেন, তাতে দেশবাসী আনন্দিত। এতে জনগণের বিজয় অর্জিত হয়েছে। আজকের দিনটি ঐতিহাসিক। এই রায় চতুর্দশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন থেকে কার্যকর হবে। ক্ষমতার পটপরিবর্তনকালীন সন্ত্রাস-সহিংসতা প্রতিরোধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ছাড়া এই মুহূর্তে অন্য কোনো বিকল্প পথ নেই। আমরা উচ্চ আদালতসহ এই রায়ের পক্ষে যারা কাজ করেছেন সকলকে মোবারকবাদ জানাই।
ভোরের আকাশ/এসএইচ