নিখিল মানখিন
প্রকাশ : ০৪ জুন ২০২৫ ০২:৩০ এএম
জুলাই সনদ নিয়ে ঐকমত্য হবে কী
রাজনৈতিক দলগুলোর মতের আলোকেই আগামী জুলাইয়ের মধ্যে ‘জুলাই সনদ’ ঘোষণা করা হবে বলে জানিয়েছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। এ লক্ষ্যে দলগুলোর সঙ্গে কমিশনের দ্বিতীয় দফার আলোচনা শুরু হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ অনেক ইস্যুতে মতবিরোধ রয়ে গেছে। সংবিধানের মূলনীতি, জরুরি অবস্থা জারির বিধান, সংবিধান সংশোধনপ্রক্রিয়া, আন্তর্জাতিক চুক্তি, রাষ্ট্রপতি নির্বাচনপদ্ধতি, সংরক্ষিত নারী আসনের নির্বাচনপদ্ধতি, গণপরিষদসহ কিছু প্রস্তাব নিয়ে বিএনপির সঙ্গে জামায়াত ও এনসিপির এখনো মতপার্থক্য আছে।
এর মধ্যে বিভিন্ন বিষয়ে বিএনপি ও জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) পরস্পরবিরোধী অবস্থান দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে। উভয়পক্ষের বক্তব্য ও মন্তব্যের ভাষা ও ধরন হয়ে উঠছে আক্রমণাত্মক। দেশের প্রধান দু’টি রাজনৈতিক দলের এমন সম্পর্কের নেতিবাচক প্রভাব ঐকমত্য সৃষ্টি সর্বোপরি ‘ জুলাই সনদ’ ঘোষণায় বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। এমন আশঙ্কা করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। জুলাই সনদের আগে নির্বাচনী রোডম্যাপ নয় বলে হুঙ্কার দিয়ে রেখেছে এনসিপি।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এবং জাতীয় নাগরিক কমিটির উদ্যোগে ২০২৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর শহীদ মিনারে ‘জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র’ প্রকাশের মাধ্যমে ‘বাহাত্তরের মুজিববাদী সংবিধানের কবর রচনা হবে’ এমন ঘোষণা দেয়া হয়েছিল। পরবর্তীতে অন্তর্বর্তী সরকার জুলাই ঘোষণাপত্র প্রকাশের যে উদ্যোগ নিয়েছে সে প্রেক্ষিতেও ছাত্রদের দেওয়া সাত দফা দাবির মধ্যে নতুন সংবিধানের অঙ্গীকার রাখার দাবি রয়েছে।
খসড়ায় বলা হয়, ‘আমরা, ছাত্র-জনতা সেই অভিপ্রায়বলে আত্মমর্যাদা, সাম্য ও সামাজিক ন্যায়বিচারের যে আদর্শে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়েছে, সেই আদর্শ বাস্তবায়নের জন্য সার্বভৌম জনগোষ্ঠী হিসেবে নিজেদের সংগঠিত করিলাম। আমরা, প্রহসনের নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সংসদ ভেঙে দেওয়ার আহবান জানাচ্ছি এবং ছাত্র-জনতার পক্ষ থেকে রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, স্থিতিশীলতা ও অখণ্ডতা রক্ষার্থে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের আহ্বান জানালাম। আমরা সুশাসন ও সুষ্ঠু নির্বাচন এবং ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার পুনরাবৃত্তি রোধ নিশ্চিত করার জন্য অন্তর্বর্তী সরকার প্রয়োজনীয় সংস্কার সম্পন্ন করবে, এই অভিপ্রায় ব্যক্ত করলাম।’
খসড়ায় আরও বলা হয়, ‘আমরা ফ্যাসিবাদ ও স্বৈরাচারকে লালন করার দলিল ১৯৭২ সালের সংবিধান সংশোধন বা প্রয়োজনে বাতিল করার অভিপ্রায় ব্যক্ত করিলাম। আমরা জুলাই গণ-অভ্যুত্থানকালে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকার কর্তৃক সংঘটিত গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ এবং রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি লুটপাটের অপরাধগুলোর উপযুক্ত বিচার করা হবে, এই অভিপ্রায় ব্যক্ত করিলাম।’
খসড়ায় আরও বলা হয়, ‘আমরা এই ঘোষণা প্রদান করলাম যে ১৯৭২ এবং ১/১১ কালের রাজনৈতিক বন্দোবস্তের পরিবর্তন ঘটানোর জন্য আমাদের একটি নতুন জনতন্ত্র (রিপাবলিক) প্রয়োজন, যা রাষ্ট্রে সকল ধরনের নিপীড়ন, শোষণ ও বৈষম্যর অবসান ঘটাবে এবং এ দেশের তরুণসমাজের প্রত্যাশাকে ধারণ করতে পারবে। আমরা এই অভিপ্রায় ব্যক্ত করিলাম যে এই ঘোষণাপত্রকে উপযুক্ত রাষ্ট্রীয় ও সাংবিধানিক স্বীকৃতি প্রদান করা হবে।’
ঐকমত্য কমিশনের প্রথম পর্যায়ের আলোচনা
মৌলিক যেসব পরিবর্তনের প্রস্তাব আছে, সেগুলো মূলত সংবিধান-সম্পর্কিত। সংবিধান সংস্কার কমিশন তাদের প্রতিবেদনে সংস্কারের যেসব উদ্দেশ্যের কথা উল্লেখ করেছে, তার অন্যতম হলো ভবিষ্যতে যেকোনো ধরনের ফ্যাসিবাদী শাসনব্যবস্থার উত্থান রোধ এবং রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গ-নির্বাহী বিভাগ, আইনসভা ও বিচার বিভাগের মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য আনা।
জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) কমিশনের প্রস্তাবের সঙ্গে অনেকটা কাছাকাছি অবস্থানে আছে। এনসিপি জোর দিচ্ছে মৌলিক সংস্কারে। দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ করার প্রস্তাবের সঙ্গে প্রায় সব দলই একমত হয়েছে; কিন্তু নির্বাচনপদ্ধতি নিয়ে মতভিন্নতা আছে।
অন্য প্রস্তাবগুলোর ক্ষেত্রে ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপির মতপার্থক্য বেশি। জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) কমিশনের প্রস্তাবের সঙ্গে অনেকটা কাছাকাছি অবস্থানে আছে। এনসিপি জোর দিচ্ছে মৌলিক সংস্কারে। সংস্কার বাস্তবায়নের পদ্ধতি নিয়েও দলগুলোর মধ্যে বড় ধরনের মতভিন্নতা আছে। অবশ্য সংস্কার বাস্তবায়নপ্রক্রিয়া নিয়ে এখনো দলগুলোর সঙ্গে কমিশনের বিস্তারিত আলোচনা হয়নি।
বিদ্যমান সংবিধান অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান বিচারপতি পদে নিয়োগ ছাড়া রাষ্ট্রপতিকে অন্য যেকোনো কাজ প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী করতে হয়। এনসিসি গঠন করা হলে সাংবিধানিক পদগুলোতে নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা কমবে। তবে এ প্রস্তাবের সঙ্গে বিএনপি একমত নয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, এনসিসি গঠনের প্রস্তাব নিয়ে বিএনপির জোরালো আপত্তি আছে। তারা মনে করে, এ বিধান করা হলে সরকার দুর্বল হবে।
সংবিধানের মূলনীতি, জরুরি অবস্থা জারির বিধান, সংবিধান সংশোধনপ্রক্রিয়া, আন্তর্জাতিক চুক্তি, রাষ্ট্রপতি নির্বাচনপদ্ধতি, সংরক্ষিত নারী আসনের নির্বাচনপদ্ধতিসহ কিছু প্রস্তাব নিয়েও এখনো মতপার্থক্য আছে।
সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবে বলা হয়েছে, এক ব্যক্তি সর্বোচ্চ দুবারের বেশি প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না। একই ব্যক্তি একাধারে প্রধানমন্ত্রী, দলের প্রধান ও সংসদ নেতা হতে পারবেন না। এই দুটি প্রস্তাবে এনসিপি একমত। তবে এ দুটি প্রস্তাব নিয়ে ভিন্নমত জানিয়েছে বিএনপি। বিএনপি চায় কোনো ব্যক্তি টানা দুবার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর বিরতি দিয়ে আবার প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন, এমন বিধান। আর দলের প্রধান, সরকারপ্রধান ও সংসদ নেতা কে হবেন, তা দলীয় সিদ্ধান্তের বিষয়।
সংবিধানের মূলনীতি, জরুরি অবস্থা জারির বিধান, সংবিধান সংশোধনপ্রক্রিয়া, আন্তর্জাতিক চুক্তি, রাষ্ট্রপতি নির্বাচনপদ্ধতি, সংরক্ষিত নারী আসনের নির্বাচনপদ্ধতিসহ কিছু প্রস্তাব নিয়েও এখনো মতপার্থক্য আছে।
এদিকে, এক সাক্ষাৎকারে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি আলী রীয়াজ বলেন, রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী পদে একজন ব্যক্তি কতবার দায়িত্ব পালন করতে পারবেন, সংসদ কত কক্ষবিশিষ্ট হবে, সংসদে নারীর প্রতিনিধিত্ব কীভাবে হবে, নির্বাচন কী পদ্ধতিতে হবে, জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল, ৭০ অনুচ্ছেদ প্রভৃতি বিষয়ে এখনো রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে পুরোপুরি ঐকমত্য হয়নি। তবে চেষ্টা চলছে ঐকমত্যে পৌঁছার।
তিনি বলেন, ‘রাষ্ট্র সংস্কারের এসব ইস্যুতে সব রাজনৈতিক দলকে একই প্ল্যাটফর্মে আনতে শেষ পর্যন্ত চেষ্টা করব। যদি না পারি, দায়িত্ব থেকে চলে যাওয়ার আগে জনগণকে সব জানিয়ে যাব।’
রাজনীতি বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রাশেদা রওনক খান বলেন, সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল ৫ আগস্টের আগে। সংবিধান, নির্বাচন, সংস্কারের মতো মৌলিক বিষয়ে প্রত্যেক দলের ভিন্ন রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি ও স্বার্থ রয়েছে। যে কারণে ঐকমত্যের ভিত্তিতে কোনো ধরনের বিপ্লবী ঘোষণাপত্র দেয়াটা এখন কঠিন।
একমত্য কমিশনের দ্বিতীয় পর্যায়ের আলোচনা
গতকাল মঙ্গলবার থেকে শুরু হয়েছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর দ্বিতীয় পর্যায়ের আলোচনা। রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয়। আলোচনায় বিএনপির সঙ্গে জামায়াত ও জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) মতবিরোধ স্পষ্ট ফুটে ওঠে। অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে স্থানীয় সরকার নির্বাচন নিয়ে জামায়াত ও এনসিপির দাবির ঘোর বিরোধিতা করে বিএনপি।
আর বিএনপির ডিসেম্বরের মধ্যে জাতীয় নির্বাচনের দাবির সঙ্গেও জামায়াত ও এনসিপির অনৈক্য দেখা গেছে। এছাড়া এনসিপির গণপরিষদ, নতুন রিপাবলিক ও সংবিধান সংক্রান্ত ইস্যুতে বিএনপি ও এনসিপি রয়েছে বিপরীত অবস্থানে। বিভিন্ন বিষয়ে বিএনপি ও জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) পরস্পরবিরোধী অবস্থান দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে। উভয়পক্ষের বক্তব্য ও মন্তব্যের ভাষা ও ধরন হয়ে উঠছে আক্রমণাত্মক।
এবার গত সোমবার প্রধান উপদেষ্টার উপস্থিতিতে এক বৈঠকে তা প্রকাশ পেলো। রাষ্ট্রের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কার প্রশ্নে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের দ্বিতীয় পর্বের আলোচনা চলছে।
গত সোমবার বিকেলে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের প্রধান ও অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে আলোচনা শুরু হয়। বক্তব্য দেওয়ার পর তিনি প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস ও কমিশনের সদস্যরা রাজনৈতিক দলগুলোর বক্তব্য শোনেন।
এ সময় বিএনপির পক্ষ থেকে সালাহউদ্দিন বলেন, ‘বিএনপি নির্বাচন অনুষ্ঠিত করার বিষয়ে ৩১ ডিসেম্বরের এক দিন পরেও সময় দিতে রাজি নয়। ’
তিনি বলেন, সংবিধান সংশোধন ছাড়া প্রয়োজনীয় অন্যান্য সব ধরনের সংস্কার এক মাসেই সম্পন্ন করা সম্ভব।
এর পরই জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নেতা নাহিদ বলেন, ‘কিছু দল ভারতের কথার সঙ্গে সুর মিলিয়ে ডিসেম্বরেই নির্বাচন চায়। তাদের বক্তব্যের সঙ্গে ভারতের বক্তব্যের পার্থক্য নেই। তারা ভারতের সুরেই নির্বাচনের কথা বলছে।
সঙ্গে সঙ্গে এ কথার ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানান, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, ডিসেম্বরে নির্বাচন চাইলে যদি ভারতের সুরে কথা বলা হয়, তাহলে যারা নির্বাচন পেছাতে চায় তারা নিশ্চয়ই যুক্তরাষ্ট্র কিংবা চীনের সুরে কথা বলছে।’ বৈঠকে উপস্থিত কয়েকজন রাজনৈতিক নেতা বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তারা বলেন, এ নিয়ে বিএনপি ও এনসিপির প্রতিনিধিদের মধ্যে তীব্র বিতণ্ডা শুরু হয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন বলেন, ‘বৈঠকে মূলত সংস্কার নিয়ে আলোচনা হওয়ার কথা থাকলেও তা হয়ে দাঁড়ায় নির্বাচনের সময়কাল নিয়ে বিতর্কে। বিএনপি ও এনসিপির মধ্যে তর্ক হয় নির্বাচন ডিসেম্বরে হওয়া উচিত কি না তা নিয়ে।’
ভোরের আকাশ
