ছোট দলে বড় দুশ্চিন্তা
জোটে ভোট করলেও নিজ দলীয় প্রতীকে নির্বাচনে অংশ নিতে হবে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর- এমন বিধান যুক্ত করেই নির্বাচন-সংক্রান্ত আইন গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের (সংশোধন) অধ্যাদেশের খসড়া অনুমোদন করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। এই সিদ্ধান্তে পুরোপুরি একমত হয়েছেন আইন উপদেষ্টা এবং নির্বাচন কমিশন (ইসি)।ইতোপূর্বে ইসি রাজনৈতিক দলগুলোকে জানিয়েছেন, ভোটে জোটবদ্ধ নির্বাচন করলেও নিজ দলের প্রতীকেই ভোট করতে হবে। তবে ইসি এও বলছেন, অনিবন্ধিত দলগুলো জোটসঙ্গী শীর্ষ রাজনৈতিক দলের প্রতীকে নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে।ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে অনুষ্ঠিতব্য সংসদ নির্বাচনের ভোটের মাঠে জোট করলেও ইসির আরপিওতে যুক্ত হওয়া নতুন বিধিমালার জন্য উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় জোটসঙ্গী দলগুলো। ভোটে বিজয় অর্জনের ক্ষেত্রে বড় ভয়ের শঙ্কায় ছোট দলগুলোর নেতারা। একইসঙ্গে ভোটের মাঠে জোটের শীর্ষ দলের কেউ যদি বিদ্রোহী প্রার্থী হয়, তাহলে জোটপ্রার্থীর জয় পাওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। কাজেই দলীয় প্রতীকে ভোট এবং স্বতন্ত্রপ্রার্থী আতঙ্কের কারণে অস্বস্তিতে নিবন্ধিত ছোট রাজনৈতিক দলগুলো- এমনটাই ভাবছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকসহ রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা।সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, নিবন্ধিত ছোট দলগুলো ভোটের মাঠে জোট করলেও জোটসঙ্গীর প্রতীক ব্যবহার না করতে পারলে কিছুটা ঝুঁকি তৈরি হবে। ছোট দলগুলোকে ছেড়ে দেওয়া আসন উদ্ধার করা কঠিন হতে পারে। আগে জোটসঙ্গীর প্রতীক ব্যবহার করতে পারার কারণে কেউ স্বতন্ত্রপ্রার্থী হলেও তেমন সুবিধা করতে পারত না। এ ক্ষেত্রে জোটসঙ্গীর কোনো সদস্য স্বতন্ত্র নির্বাচন করলে এই ঝুঁঁকি আরও বাড়বে। কাজেই ভোটের মাঠে বড় দলের সঙ্গে জোট করলেও উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় ভুগছেন নিবন্ধিত দলের জোটসঙ্গীরা- এমনটাই ধারণা রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের।সূত্রে জানা গেছে, নির্বাচনের পূর্ব মুহূর্তে সরকারের এমন সিদ্ধান্তে ভোটের মাঠে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ছেন ছোট দলগুলোর। জোটের প্রতীকে ভোট করতে পারলে তাদের জয় অধিকতর সহজ কিন্তু নিজ দলীয় প্রতীকে তা বেশ কঠিন হবে। জোটের প্রার্থীর নির্বাচনী প্রচারেও জোটের শীর্ষ দলের নেতাকর্মীদের অনীহা দেখা দিতে পারে। আরপিও সংশোধনের পর আসন ছাড় পেলেও নতুন করে ভাবতে হচ্ছে জোটের প্রার্থীদের। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে শরিকরা জোটপ্রধানের সঙ্গে পরামর্শ করে নতুন সিদ্ধান্ত নেবেন। তবে যেসব শরিক দলের নিবন্ধন অর্থাৎ নিজস্ব প্রতীক নেই, তাদের ধানের শীষেই ভোট করতে বাধা নেই। তারা অনেকটা স্বস্তিতেই আছেন।ইসি সূত্রে জানা যায়, গত ১১ আগস্ট গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে (আরপিও, সংশোধন) জোটগতভাবে নির্বাচন করলেও প্রার্থীকে নিজ দলের প্রতীকে ভোট করার বিধান যুক্ত করে নির্বাচন কমিশন (ইসি), যা চূড়ান্ত করতে ২ সেপ্টেম্বর আইন মন্ত্রণালয়ে ভেটিংয়ের জন্য পাঠায় ইসি। সংসদ নির্বাচনে জোট হলেও প্রার্থীদের নিজ দলের প্রতীকে ভোট করতে হবে- এমন বিধান যুক্ত করে বৃহস্পতিবার নির্বাচন-সংক্রান্ত আইন গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) সংশোধনের খসড়া অনুমোদন করেছে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ।রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছে, সরকার নিজেই প্রতীকের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ভোট কোনো প্রতীকে করবে তা নিজের ওপর ছেড়ে দেওয়া উচিত। এটা যার যার স্বাধীনতা। জোটের নেতৃত্ব দেওয়া দলের প্রতীক না পেলে অনেকেই জয় না পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। কারণ অন্যরা নতুন নিবন্ধিত দল। তাদের প্রতীক জনগণের কাছে অপরিচিত।শরিক দলগুলোর নেতারা বলছেন, আসন ছাড় পাওয়ার পরও তারা বিএনপির প্রতীক ধানের শীষে নির্বাচন করতে আগ্রহী। তাদের ধারণা, এর ফলে ভোটের মাঠ ও জয়ের ক্ষেত্রে ঝুঁঁকি থাকবে না। নিজেদের প্রতীকের চেয়ে ধানের শীষ প্রতীকের গ্রহণযোগ্যতা অনেকগুণ বেশি। মার্কা হিসেবে ধানের শীষ থাকলে বিএনপির তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীদের সহজে সমর্থন ও সহযোগিতা পাওয়া সম্ভব হবে।এমনপরিস্থিতিতে ছোট দলগুলোর পাশাপাশি আরপিও নিয়ে আপত্তি রয়েছে দেশের বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপিরও। বিএনপি নেতারা বলছেন, নির্বাচনে যেমন- যোগ্য প্রার্থী গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি প্রতীকও একটি ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করে। সাধারণ ভোটাররা ভোটকেন্দ্রে জনপ্রিয় প্রতীককে খুঁজে এবং পছন্দ করে। কিন্তু যদি সেটা না হয় তাহলে দ্বিতীয় পছন্দের প্রতীকেই ভোট দিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে থাকেন। আগামী নির্বাচনে বিগত দিনে ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে বিএনপির সঙ্গে যুগপতে থাকা দলগুলো নিয়ে নির্বাচন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন দলের শীর্ষ নেতৃত্ব। সেখানে জোটসঙ্গী দলগুলোকে ৫০-৭০টি আসন ছাড় দেওয়ার পরিকল্পনাও রয়েছে দলটির। কিন্তু বিএনপির নির্বাচনী প্রতীক ধানের শীষ ব্যতীত ওইসব দলের নিজ দলীয় প্রতীকে নির্বাচন করলে অনেক ক্ষেত্রেই ভরাডুবি ঘটতে পারে, অনেক আসন হাতছাড়া হতে পারে বলে শঙ্কা রয়েছে। কারণ, ওইসব প্রতীক সাধারণ ভোটারের কাছে অপরিচিত।এ প্রসঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ ভোরের আকাশকে বলেন, এ খসড়ায় পরিবর্তন আনতে সরকার ও নির্বাচন কমিশনকে তারা চিঠি দেবে।সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, নির্বাচন সংস্কার কমিশনের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর আলোচনায় নির্বাচনী ব্যবস্থা সংস্কার-সংক্রান্ত বিষয়গুলোর অনেকগুলোতে আমরা সবাই সম্মত হয়েছিলাম। কিন্তু নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে আইন মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে নির্বাচনী আচরণবিধি ও আরপিওর যে খসড়াটা উত্থাপন করা হয়েছে, এটাতে যে পরিবর্তন আনা হয়েছে, তাতে বিএনপির কোনো সম্মতি ছিল না।নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না ভোরের আকাশকে বলেন, প্রতীকের বিষয়টি নির্ভর করছে আরপিও সংশোধনের ওপর। সরকার তো নতুন একটি সিদ্ধান্ত নিল। ২০১৮ সালে ধানের শীষ নিয়ে ভোট করেছিলাম। এবারও চাই ধানের শীষে করতে। তবে নিয়মের বেড়াজালে একেবারেই সম্ভব না হলে আমাদের নিজস্ব প্রতীকে নির্বাচন করব।এনডিএম চেয়ারম্যান ববি হাজ্জাজ ভোরের আকাশকে বলেন, সরকারের এই সিদ্ধান্তকে নেতিবাচক হিসেবে দেখছি। দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা ছাড়াই একতরফা সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এখন এটা কাদের চাপে, কী জন্য করেছে, সেটা সরকারকেই বলতে হবে। এ রকম কাজ তো শেখ হাসিনা করতেন। জোটবদ্ধ নির্বাচনে প্রতীক উন্মুক্ত থাকা দরকার।তিনি বলেন, হুটহাট করে কেন সরকার এমন সিদ্ধান্ত নিল, আমার বুঝে আসছে না। রাজনীতিবিদদের কোনো পরামর্শ কিংবা দলগুলোর মতামত না নিয়ে সরকার আরপিও অনুমোদন দিয়েছে। আমাদের কোনো কথা তারা শুনল না। প্রায় প্রত্যেকটি দল নির্বাচন কমিশনের কাছে প্রতীক ইস্যুতে আপত্তি জানিয়েছি। এমনকি নির্বাচন সংস্কার কমিশনকেও বিষয়টি বলেছি। এ সিদ্ধান্তের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে নষ্ট করেছে।তিনি বলেন, নির্বাচন একটি স্ট্রাজিটিক্যাল বিষয়। এখন আমরা জোটের সঙ্গে আলোচনা করে প্রতীকের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেব। আমি জোটের প্রতীক ধানের শীষে নির্বাচন করতে চাই। ইতোমধ্যে আমি জোটের প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনী এলাকায় গণসংযোগ শুরু করেছি।বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি-বিজেপি চেয়ারম্যান আন্দালিব রহমান পার্থ ভোরের আকাশকে বলেন, এই আইন বাস্তবায়ন করতে গেলে দেশে বহুদলীয় গণতন্ত্র, বহুমতের গণতন্ত্র এবং সংসদে বহু দলের অংশগ্রহণ অনেকটাই ব্যাহত হবে। আগে ছোট দলগুলো যে সুবিধা পেত, তা ক্ষতিগ্রস্ত হবে।গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি ভোরের আকাশকে বলেন, প্রতীকের বিষয়টা উন্মুক্ত থাকাটাই উচিত ছিল। এটাই ভালো হতো।বাংলাদেশ লেবার পার্টির চেয়ারম্যান ডা. মোস্তাফিজুর রহমান ইরান ভোরের আকাশকে বলেন, জোটের প্রতীকে ভোট করতে না পারলে অনেক ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হতে হবে। প্রথমত, মাঠ পর্যায়ে জোটের শীর্ষ দলের নেতাকর্মীরা কাজ করতে অনীহা প্রকাশ করবেন। ধানের শীষ থাকলে তারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে মাঠে নামতেন। আমার দল নতুন নিবন্ধন পেয়েছে। প্রতীক আম। শুরুতেই এ প্রতীককে ভোটের মাঠে পরিচয় করানোটা কঠিন হবে।ভোরের আকাশ/এসএইচ