মাইলস্টোন ট্রাজেটি
নিখিল মানখিন
প্রকাশ : ২৫ জুলাই ২০২৫ ১০:২৪ এএম
সংগৃহীত ছবি
রাজধানী উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনায় সৃষ্ট বিভ্রান্তি কাটছে না। সরকার ও কলেজ কর্তৃপক্ষের পৃথক পৃথক তত্ত্বাবধানে গঠিত কমিটি এ সংকট নিরসনে কাজ করছে। হাসপাতালে ভর্তি রোগী ও নিহতদের তালিকা আলাদাভাবে প্রকাশ করেছে সরকার ও কলেজ কর্তৃপক্ষ। তবে আইএসপিআর, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও মাইলস্টোন কর্তৃপক্ষের দেয়া নিহতের তালিকায় ভিন্নতা রয়ে গেছে। তথ্য সংগ্রহ কার্যক্রম চূড়ান্ত রূপ পেলে এই ভিন্নতা কেটে যাবে বলে জানিয়েছে সরকার।
সোমবার ঢাকার উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ভবনে বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় এ পর্যন্ত ২৯ জনের মৃত্যু এবং শতাধিক আহতের তথ্য জানানো হয়েছে সরকারের পক্ষ থেকে। তবে সরকারের দেওয়া তথ্যের সঙ্গে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর বা আইএসপিআরের তথ্যের কিছুটা পার্থক্য দেখা গেছে। মঙ্গলবার আইএসপিআর আহত ও নিহতদের যে সংখ্যা জানায়, তাতে নিহতের সংখ্যা ৩১ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের (আইএসপিআর) পক্ষ থেকে গত মঙ্গলবার বেলা ১২টা পর্যন্ত ৩১ জনের মৃত্যুর খবর জানানো হয়েছিল। এরপর ওই দিন রাতে বার্ন ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আরও একজন মারা যান। যে কারণে গণমাধ্যমে নিহতের সংখ্যা ৩২ উল্লেখ করা হয়েছিল। এর মধ্যে গতকাল বৃহস্পতিবার আরও একজনের মৃত্যু হয়েছে।
হাসপাতালে ভর্তি রোগী ও নিহতদের তালিকা প্রকাশ করল সরকার : রাজধানীর উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে ক্যাম্পাসে ভয়াবহ বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে এখন পর্যন্ত ভর্তি রোগী ও নিহতদের সংখ্যা ও নামের তালিকা প্রকাশ করেছে সরকার।
গতকাল প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে প্রকাশিত হয়েছে এ তালিকা।
পরিসংখ্যান অনুযায়ী, রাজধানীর ৬টি হাসপাতালে মোট ২৯ জন নিহত এবং ৫৭ জন দগ্ধ হয়ে ভর্তি আছেন। এর মধ্যে-জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ৪৫ জন ভর্তি হয়েছিলেন, যার মধ্যে ১১ জন মারা গেছেন। সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে ১১ জন ভর্তি হলেও মৃতের সংখ্যা দেখানো হয়েছে ১৫ জন। শহীদ মনসুর আলী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ১ জন ভর্তি হয়েছিলেন, তবে কেউ মারা যাননি। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে : কেউ ভর্তি হননি, তবে ১ জনের মৃত্যু হয়েছে। লুবানা জেনারেল হাসপাতাল অ্যান্ড কার্ডিয়াক সেন্টারে কেউ ভর্তি হননি, কিন্তু ১ জন (অজ্ঞাত) মারা গেছেন। ইউনাইটেড হাসপাতাল লিমিটেডে কেউ ভর্তি হননি, তবে ১ জনকে মৃত দেখানো হয়েছে।
এখনও নিখোঁজ ৩ শিক্ষার্থী ও ২ অভিভাবক : রাজধানীর উত্তরায় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বিমানবাহিনীর যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হওয়ার তিন দিন পরও নিখোঁজ রয়েছেন পাঁচজন। তাদের মধ্যে তিনজন শিক্ষার্থী এবং দুজন অভিভাবক রয়েছেন বলে নিশ্চিত করেছে কলেজ কর্তৃপক্ষ।
গতকাল বৃহস্পতিবার কলেজের অধ্যক্ষ মোহাম্মদ জিয়াউল আলম এক বিবৃতিতে এসব তথ্য জানিয়েছেন।
তিনি জানান, বিমান দুর্ঘটনায় ‘স্কুল শাখার’ ওই ভবনটিতে থাকা ১৮ জন শিক্ষার্থী, ২ জন শিক্ষক এবং ২ জন অভিভাবক মৃত্যুবরণ করেন। এ ছাড়া, ভয়াবহ এ দুর্ঘটনায় গুরুতরভাবে আহত হন আরও ৫১ জন। আহতদের মধ্যে ৪০ জন শিক্ষার্থী, ৭ জন শিক্ষক, ১ জন অভিভাবক, ১ জন আয়া এবং ১ জন পিয়ন রয়েছেন। তাদের মধ্যে কয়েকজনের অবস্থা এখনো আশঙ্কাজনক।
মাইলস্টোনে বিমান দুর্ঘটনায় উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে তিন সিদ্ধান্ত : রাজধানীর উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বিমান দুর্ঘটনায় উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে তিনটি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার প্রেস উইং থেকে পাঠানো এক বার্তায় এই সিদ্ধান্তের কথা জানানো হয়।
প্রেস উইং জানায়, বৃহস্পতিবার সকালে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে উপদেষ্টা পরিষদের নিয়মিত বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। বৈঠকের শুরুতে মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বিমান দুর্ঘটনায় নিহতদের স্মরণে শোক প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়েছে। তাদের আত্মার প্রতি সম্মান জানিয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়েছে এবং নিহতদের রূহের মাগফিরাত কামনা করে মোনাজাত করা হয়েছে।
এতে আরও বলা হয়, মর্মান্তিক এ দুর্ঘটনায় নিহতদের পরিবার এবং আহতদের চিকিৎসাসেবায় সরকারের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় সব সহায়তা দেওয়ার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। এ লক্ষ্যে শিক্ষা মন্ত্রণালয় স্কুল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে পরবর্তী পদক্ষেপ নির্ধারণ করবে। উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে স্কুলের নিহত দুজন শিক্ষককে রাষ্ট্রীয় সম্মাননা প্রদানের সিদ্ধান্ত হয়েছে। এই সম্মাননার বিস্তারিত অতিদ্রুত নির্ধারণ করা হবে।
প্রেস উইং আরও জানায়, নিহতদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করে ও আহতদের সুস্থতা কামনা করে আজ শুক্রবার সকল ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে বিশেষ প্রার্থনার সিদ্ধান্ত হয়েছে। ধর্ম মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় সমন্বয় করবে।
মাইলস্টোনের বর্তমান চিত্র : রাজধানীর উত্তরা দিয়াবাড়িতে মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে ভয়াবহ বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় এখনও খোঁজ মেলেনি তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী মরিয়ম উম্মে আফিয়ার (৯)। নিখোঁজ মেয়ের খোঁজে গতকাল বৃহস্পতিবার সকাল পৌনে ১১টার দিকে স্কুলে ছুটে আসেন তার মা তামিমা উম্মে ও স্বজনরা। প্রিয় সন্তানের সন্ধানে স্বজনদের সঙ্গে স্কুল চত্বরে প্রবেশ করলেও শেষ পর্যন্ত ফিরে যেতে হয়েছে পোড়া স্কুল ব্যাগ হাতে। দুপুর ১২টার দিকে কান্না জড়িত অবস্থায় বেরিয়ে আসেন তামিমা। এ সময় স্বজনদের হাতে আফিয়ার পোড়া স্কুল ব্যাগটি দেখা যায়, যা উদ্ধার করা হয়েছে বিধ্বস্ত ভবনের ধ্বংসস্তূপ থেকে।
আফিয়ার মামা সাব্বির জানান, ‘ভাগ্নির শোকে আমার বোন প্রায় পাগল হয়ে গেছেন। তিনি শারীরিকভাবে এতটাই অসুস্থ যে এখন ঠিকমতো কথা বলতেও পারছেন না। আমাদের বাসা তুরাগের চন্ডালভোগে।’
একইভাবে এই স্কুলের নার্সারি শ্রেণির শিক্ষার্থী রাবেয়াকে স্কুল থেকে নিতে এসেছিলেন তার মা হাসিনা ও সাত বছর বয়সী ভাই হাসান। সোমবার বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার মুহূর্তে তিনজনই স্কুল চত্বরে ছিলেন। বিস্ফোরণের পরপরই শুরু হয় হুড়োহুড়ি। পরে রাবেয়া ও মা হাসিনার সন্ধান মিললেও এখন পর্যন্ত খোঁজ পাওয়া যায়নি হাসানের।
বৃহস্পতিবার হাসানের সন্ধানে আবারও স্কুলে ছুটে আসেন স্বজনরা। হাসিনার খালাতো বোন সামিয়া ইসলাম বলেন, ‘বিমান বিধ্বস্তের দিন হাসান তার মায়ের সঙ্গে স্কুলে এসেছিল। দুর্ঘটনার পর মা ও বোনকে পাওয়া গেলেও হাসানের কোনও খোঁজ নেই। আমরা বিভিন্ন হাসপাতালে খোঁজ করেছি, কোথাও তাকে পাইনি।’
রাজধানীর উত্তরার যুদ্ধবিমান দুর্ঘটনায় হতাহত ও নিখোঁজদের তথ্য সংগ্রহে হেল্প ডেস্ক চালু করেছে মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ কর্তৃপক্ষ। আর হতাহত পরিবারের সদস্যরা গতকাল বৃহস্পতিবারও এই হেল্প ডেস্কে ভিড় জমায়।
গতকাল বৃহস্পতিবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে স্কুলের পাঁচ নম্বর ভবনে দেখা যায়, হেল্প ডেস্কে নিখোঁজদের পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। তবে নিরাপত্তার স্বার্থে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির প্রধান ফটক বন্ধ রাখা হয়েছে এবং বহিরাগতদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। কমিটির সদস্য ও প্রতিষ্ঠানটির প্রধান শিক্ষিকা খাদিজা আক্তার বলেন, ‘সকাল থেকেই আমাদের পাঁচ নম্বর ভবনে একটি বুথ বসানো হয়েছে। সেখানে নিখোঁজদের স্বজনরা এসে তথ্য দিচ্ছেন। এ পর্যন্ত অনেকেই এসেছেন। পরে বিস্তারিতভাবে সব তথ্য প্রকাশ করা হবে।’
সকালে সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের প্রধান ফটক বন্ধ রাখা হয়েছে। আগের দিনের তুলনায় ভিড় কিছুটা কম হলেও এখনও উৎসুক জনতা বাইরে অবস্থান করছে। তবে নিখোঁজের স্বজনদের ও শিক্ষার্থীদের খোঁজে আসা পরিবারের সদস্যদের ভেতরে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে।
প্রধান ফটকের সামনে দায়িত্ব পালনরত মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের প্রশাসনিক কর্মকর্তা এস কে সোলাইমান বলেন, ‘আমরা বারবার অনুরোধ করছি, যেন কেউ অপ্রয়োজনে ভিড় না করেন। তবে যদি কেউ নিখোঁজ স্বজনের খোঁজে আসেন, তাদের আমরা ভেতরে ঢুকতে দিচ্ছি। ভেতরে তথ্য সংগ্রহের জন্য আলাদা বুথ খোলা আছে।’
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে এবং তথ্য সঠিকভাবে সংগ্রহে সব ধরনের সহযোগিতা করছে স্কুল কর্তৃপক্ষ। ভবিষ্যতে নিখোঁজদের তালিকা ও প্রাপ্ত তথ্য গণমাধ্যমে প্রকাশ করা হবে বলেও জানানো হয়েছে।
ভোরের আকাশ/জাআ