আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশ : ১৭ জুন ২০২৫ ০২:৩৭ এএম
ইরান-ইসরায়েল উত্তেজনায় শান্তির পক্ষে চীন-রাশিয়া
মধ্যপ্রাচ্যে ইরান-ইসরায়েল সংঘাতে আন্তর্জাতিক উদ্বেগ ক্রমেই বাড়ছে। এমন এক সময়েই ইরানের ঘনিষ্ঠ মিত্র চীন ও রাশিয়া জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের জরুরি বৈঠকে ইসরায়েলের অব্যাহত হামলার তীব্র নিন্দা জানায়। একইসঙ্গে তারা সব পক্ষকে অবিলম্বে উত্তেজনা হ্রাসে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানায়।
চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র গুও জিয়াকুন সোমবার এক বিবৃতিতে বলেন, “আমরা সব পক্ষকে আহ্বান জানাচ্ছি যেন তারা এমন পদক্ষেপ গ্রহণ করে যা উত্তেজনা হ্রাসে সহায়ক হয় এবং এই অঞ্চলকে আরও বিশৃঙ্খলার দিকে ঠেলে না দেয়।”
চীন ইরানের সার্বভৌমত্ব ও ভূখণ্ডের অখণ্ডতা রক্ষায় তার অবস্থান স্পষ্ট করেছে। এক বিবৃতিতে বলা হয়, বেইজিং আঞ্চলিক উত্তেজনা সৃষ্টি বা সংঘাতমূলক যেকোনো কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে এবং আলোচনার মাধ্যমে সমাধানেই বিশ্বাসী।
তবে হরমুজ প্রণালী বন্ধ করার ইরানি হুমকির বিষয়ে চীনের অবস্থান ছিল কিছুটা সতর্ক। এক চীনা মুখপাত্র জানান, “এ ধরনের অনুমাননির্ভর প্রশ্নের উত্তর দেওয়া সঠিক নয় এবং এই অঞ্চলের পরিস্থিতি আরও খারাপ হোক, সেটা কেউই চায় না।”
ইসরায়েলি হামলায় চীনা দূতাবাসে আংশিক ক্ষয়ক্ষতির পর চীনা নাগরিকদের সতর্ক থাকার নির্দেশ দিয়েছে বেইজিং।
এর আগে, ২০২৪ সালের অক্টোবর মাসে সংঘাতের সময়েও চীন একইভাবে শান্তিপূর্ণ সমাধানের পক্ষে অবস্থান নেয়। সে সময় চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই ইসরায়েলের প্রতি আহ্বান জানান, যেন ‘অব্যাহত যুদ্ধ ও বিশৃঙ্খলা’ বন্ধ করে। একইভাবে ইরানকেও সামরিক উত্তেজনা থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানানো হয়।
চীনের জাতিসংঘ প্রতিনিধি ফু কং তখন ইসরায়েলি হামলা নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, “ইসরায়েলকে অবশ্যই সব ধরনের উসকানিমূলক কর্মকাণ্ড বন্ধ করতে হবে।”
সম্প্রতি, আইএইএ-এর পরিচালনা পর্ষদের এক ভোটাভুটিতে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও জার্মানির আনা প্রস্তাবের বিপক্ষে ভোট দিয়েছে চীন ও রাশিয়া। সেই প্রস্তাবে ইরানকে পারমাণবিক প্রতিশ্রুতি লঙ্ঘনের অভিযোগ আনা হয়েছিল। চীনের প্রতিনিধি লি সং বলেন, “আন্তর্জাতিক সমাজ যেন চাপ ও হুমকির বদলে কূটনৈতিক উপায়ে সমাধানে যায়।”
ইরান-ইসরায়েল সংঘর্ষ নিয়ে চীনা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম সিনা ওয়েইবোতে ব্যাপক আলোচনার সৃষ্টি হয়েছে। একটি হ্যাশট্যাগ ১৬ কোটি বার দেখা হয়েছে, এবং এতে ৭৬ হাজার মন্তব্য এসেছে।
চীনা বিশিষ্ট ভাষ্যকার হু শিজিন ইসরায়েলি হামলাকে ‘সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। তিনি বলেন, “ইরান এখন ছিদ্রযুক্ত ঝাঁঝরির মতো হয়ে গেছে। এই অবস্থান চীনের জন্যও একটি শিক্ষা।”
একজন ব্লগার লেখেন, “ক্ষমতাই নির্ধারণ করে কে ঠিক আর কে ভুল। আন্তর্জাতিক মঞ্চে যে অবস্থানের পেছনে শক্তি নেই, তা দরকষাকষির কোনো উপায় হতে পারে না।”
রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন চ্যানেলগুলো ইসরায়েলের হামলার খবর প্রচার করলেও কোনো সরাসরি নিন্দা জানায়নি। তবে তারা জানিয়েছে, ইসরায়েল বেসামরিক স্থাপনাতেও হামলা চালিয়েছে, যাতে সাধারণ মানুষ নিহত হয়েছেন।
প্রো-ক্রেমলিন ভাষ্যকার সার্গেই মার্কভ বলেন, “রাশিয়া ইরানের বন্ধু এবং রাজনৈতিক মিত্র হলেও সামরিক মিত্র নয়।” তিনি আরও বলেন, “রাশিয়ার একমাত্র সম্ভাব্য ভূমিকা হতে পারে রাজনৈতিক সমাধানে মধ্যস্থতা করা।”
তবে সাম্প্রতিক সময়ে ইরানের সঙ্গে রাশিয়ার বিস্তৃত কৌশলগত অংশীদারিত্ব চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছে। সেই চুক্তিতে সামরিক সহযোগিতার দিকটিও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। কিন্তু রাশিয়ার উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী আন্দ্রেই রুডেনকো স্পষ্টভাবে জানিয়েছেন, “যদি ইরান যুদ্ধে জড়ায়, তবুও রাশিয়া সামরিক সহায়তা দিতে বাধ্য নয়।”
রাশিয়ান সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও ইসরায়েলি হামলার যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে। একটি পোস্টে বলা হয়, “এইসবই কি সেই পারমাণবিক স্থাপনা, যার কথা ইসরায়েল বলছিল? দেখা যাক, তথাকথিত সভ্য বিশ্ব কী প্রতিক্রিয়া দেখায়।”
চীন ও রাশিয়া—উভয়েই ইরানের ঘনিষ্ঠ মিত্র হওয়া সত্ত্বেও সরাসরি সামরিক সহায়তার বদলে কৌশলী এবং কূটনৈতিক অবস্থান নিয়েছে। উত্তেজনা হ্রাস এবং শান্তিপূর্ণ সমাধানই এখন তাদের মুখ্য বার্তা। তবে সামাজিক মাধ্যমে তাদের অভ্যন্তরীণ প্রতিক্রিয়ায় ইসরায়েলের বিরুদ্ধে অসন্তোষ স্পষ্টভাবে প্রকাশ পাচ্ছে।
সূত্র: বিবিসি বাংলা, জাতিসংঘ ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থা।
ভোরের আকাশ//হ.র