ধর্ম ডেস্ক
প্রকাশ : ০৭ জুলাই ২০২৫ ০১:৫০ এএম
আশুরার মাহাত্ম্য ও কারবালার ইতিহাস: ত্যাগ, সাহসিকতা ও সত্যের পথে অনন্য দৃষ্টান্ত
হিজরি বর্ষের প্রথম মাস মহররম। আর এ মাসের দশম দিন—আশুরা—ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের জন্য এক গভীর তাৎপর্যপূর্ণ দিন। পবিত্র এই দিনটি বহু ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী, যার সর্বশেষ সংযোজন হচ্ছে ৬১ হিজরিতে কারবালা প্রান্তরে ঘটে যাওয়া হজরত ইমাম হোসাইন (রা.)-এর শাহাদাত। আশুরা কেবল শোকের নয়—এটি আত্মত্যাগ, ন্যায়, আদর্শ ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের প্রতীক।
‘আশুরা’ শব্দের অর্থ দশম দিন। ইসলামের আগমন পূর্বেই আরবদের কাছে মহররম ছিল সম্মানিত মাস। কোরআনে আল্লাহ বলেন,
“আল্লাহর কাছে মাস গণনায় বারোটি মাসই, যেদিন তিনি আসমান ও জমিন সৃষ্টি করেছেন, এর মধ্যে চারটি সম্মানিত।” (সুরা তাওবা: ৩৬)
এই সম্মানিত চার মাসের একটি হলো মহররম। ইসলামপূর্ব যুগ থেকে আশুরা ছিল ধর্মীয়ভাবে গুরুত্বপূর্ণ। ইসলামী ঐতিহাসিক বর্ণনায় পাওয়া যায়, এ দিনে বহু নবী ও অলির জীবনে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটেছে: হজরত নূহ (আ.)-এর জাহাজ থেমেছিল জুদি পাহাড়ে, হজরত মুসা (আ.) ফেরাউনকে পরাজিত করে বনি ইসরায়েলকে মুক্ত করেছিলেন, হজরত ইব্রাহিম (আ.) অগ্নিকুণ্ড থেকে উদ্ধার পান, হজরত ইউনুস (আ.) মাছের পেট থেকে বেরিয়ে আসেন এবং হজরত আইয়ুব (আ.) রোগমুক্ত হন—এই সব ঘটনাই ঘটেছে আশুরার দিনে।
তবে ইসলামের ইতিহাসে আশুরার তাৎপর্য আরও গাঢ় হয় কারবালার মর্মন্তুদ ঘটনার মধ্য দিয়ে।
কারবালার ইতিহাস
হজরত মুয়াবিয়া (রা.)-এর মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র ইয়াজিদ খেলাফতের দাবিদার হন। মুসলিম বিশ্বের একাংশ তাঁকে মেনে নিলেও, মদিনা ও কুফার অনেকে তা প্রত্যাখ্যান করেন। কুফার জনগণ নবীজির দৌহিত্র হজরত হোসাইন (রা.)-কে খলিফা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে চেয়ে বারবার চিঠি পাঠান। ইমাম হোসাইন (রা.) এ পরিস্থিতি যাচাইয়ের জন্য চাচাতো ভাই মুসলিম ইবনে আকিলকে কুফায় পাঠান। কুফায় পৌঁছেই ১৮ হাজার লোক মুসলিমের কাছে বাইয়াত করে।
এই খবরে আশ্বস্ত হয়ে ইমাম হোসাইন (রা.) পরিবার ও সঙ্গীদের নিয়ে কুফার উদ্দেশ্যে রওনা দেন। কিন্তু পরিস্থিতি দ্রুত বদলে যায়। ইয়াজিদের পক্ষ থেকে ওবায়দুল্লাহ ইবনে জিয়াদকে কুফার নতুন গভর্নর নিয়োগ দেওয়া হয়। সে জনগণকে হুমকি দিয়ে মুসলিম ইবনে আকিলকে হত্যা করে এবং হোসাইন (রা.)-কে কুফায় প্রবেশ করতে বাধা দেয়।
কারবালা প্রান্তরে হোসাইন (রা.)-এর ওপর চূড়ান্ত অবরোধ আরোপ করা হয়। ফোরাত নদী থেকে পানি সংগ্রহের পথও বন্ধ করে দেয় ইয়াজিদ বাহিনী। শেষ পর্যন্ত ১০ মহররম আশুরার দিনে, পানি ও সহায়তা থেকে বঞ্চিত অবস্থায়, ইমাম হোসাইন (রা.) ও তাঁর পরিবার ও সাথীরা একে একে শহীদ হন। ইতিহাসের অন্যতম নিষ্ঠুরতার শিকার হন মহানবীর প্রিয় দৌহিত্র। শিমার নামক এক সেনাপতি হোসাইন (রা.)-এর মাথা দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে এবং তাঁর পরিবারকে বন্দি করে দামেশ্কে নিয়ে যাওয়া হয়।
ইয়াজিদের মুখোশ খুলে পড়ে
ইমাম হোসাইন (রা.)-এর শহীদ হওয়ার পর ইবনে জিয়াদের নির্মমতাই বিশ্ববাসীর সামনে ইয়াজিদের প্রকৃত চেহারা উন্মোচন করে। যদিও ইয়াজিদ বাহ্যিকভাবে দুঃখ প্রকাশ করে দাবি করে, সে ইমাম হোসাইনকে হত্যা করতে বলেনি—তবে ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, এই অন্যায়ের দায় এড়ানোর সুযোগ নেই।
কিন্তু ইতিহাসের পরিণতি অন্যরকম। ইয়াজিদ মাত্র চার বছরের মধ্যে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর বংশ আর কখনো শাসনক্ষমতায় আসতে পারেনি। কারবালার হত্যাকাণ্ডে জড়িত অধিকাংশ ব্যক্তিকে নির্মমভাবে হত্যা করেন মুখতার সাকাফির বাহিনী।
আশুরা: শুধুই শোক নয়, আদর্শের প্রতীক
আজও আশুরা মুসলিম বিশ্বে নানা আবেগ ও আবহে পালিত হয়। তবে আশুরাকে কেন্দ্র করে কিছু বিভ্রান্তি দেখা দেয়। শিয়া মতবাদ অনুসারীরা আশুরাকে শুধু শোকের দিন হিসেবে দেখেন এবং রক্তপাতময় কর্মসূচি পালন করেন। কিন্তু ইসলামি স্কলাররা মনে করেন, আশুরা শুধুমাত্র শোক নয়—বরং এটি এক আত্মত্যাগের মহাবিজয়। হজরত হোসাইন (রা.) তাঁর রক্ত দিয়ে অন্যায়ের বিরুদ্ধে যে সাহসিকতা ও সত্য প্রতিষ্ঠার দৃষ্টান্ত রেখেছেন, তা আজও প্রেরণার উৎস।
আশুরা আমাদের শেখায়—জুলুমের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হয়, হকের জন্য প্রাণ দিতেও প্রস্তুত থাকতে হয়, আর সত্যের পথ কখনো একা হলেও সঠিক পথ। কারবালার প্রান্তরে রচিত হয়েছে সাহসিকতার এমন অধ্যায়, যা শুধু মুসলিম নয়, মানবতার ইতিহাসেও চিরকাল গৌরবময় হয়ে থাকবে।
ভোরের আকাশ//হ.র