× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

শুধু উপার্জনের বিদ্যা নয়, মানুষ হওয়ার শিক্ষার্জনও জরুরি

এস এম নুর ইসলাম

প্রকাশ : ১২ মে ২০২৫ ০২:২৬ এএম

শুধু উপার্জনের বিদ্যা নয়, মানুষ হওয়ার শিক্ষার্জনও জরুরি

শুধু উপার্জনের বিদ্যা নয়, মানুষ হওয়ার শিক্ষার্জনও জরুরি

আমরা এখন প্রযুক্তিনির্ভর শিল্প বিপ্লবের যুগে এসে প্রতীয়মান। যেখানে পারস্পরিক প্রতিযোগিতা এবং আর্থিক সাফল্যের প্রতি মানুষের আকর্ষণ তুঙ্গে, সেখানে একাডেমিক বা পেশাগত দক্ষতার পাশাপাশি মানুষ হওয়ার শিক্ষার্জন অনেকটা অবহেলিত বলা চলে। কিন্তু কথা হচ্ছে জীবনে সত্যিকারের সফল ও স্বার্থক হয়ে পরিপূর্ণ জীবনযাপন করতে হলে কি শুধুমাত্র উপার্জন বা পেশাগত দক্ষতা অর্জনই আমাদের জন্য যথেষ্ট?   

সামাজিক জীব হিসেবে একজন মানুষের পেশাগত দক্ষতা অর্জনের পাশাপাশি মানবিক গুণাবলি অর্জন করা অত্যন্ত জরুরি। তবে এই শিক্ষিত সমাজের যেন এদিকে রয়েছে চরম অনীহা। বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশের একটি উল্লেখযোগ্য অংশের মধ্যে এ ধরনের তথাকথিত শিক্ষিত লোকের সংখ্যা এখন অনেক বেড়েছে। ছাত্রজীবন থেকে যাদের জীবনের একমাত্র লক্ষ্য ছিলো ভালো একাডেমিক রেজাল্ট অর্জনের মাধ্যমে ভালো বা বড় কোন চাকরি প্রাপ্তি। প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএ (বাংলাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ অনুষদ) থেকে স্নাতক-স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করা অনেক ছাত্ররাও বিএটি-তে চাকরির স্বপ্ন দেখছে, অন্যরা দেখছে বিসিএস সহ অন্যান্য চাকরির স্বপ্ন। সংগত কারণেই আমাদের দেশে কোনো ইলন মাস্ক, আইনস্টাইন তৈরি তো হয়ই না বরং বেকারত্বের হার বাড়ে। বেকারত্বের তালিকায় শুধু তারাই স্থান পায় যারা ৭ দিনে ১ ঘন্টাও কাজ করেন না তবে কাজ পেলে করতে আগ্রহী এবং যারা ৩০ দিনে বেতন, মজুরি বা কোনো মুনাফার বিনিময়ে কোনো না কোনো কাজ খুঁজছেন এবং এরা শিক্ষিত জনগোষ্ঠী। পরবর্তীতে দেখা যায় এরা দুশ্চিন্তা ও হতাশাগ্রস্থ হয়ে বিভিন্ন অপরাধের সাথে জড়িয়ে পড়ে, না হয় কোনো সামাজিক বিশৃঙ্খলা তৈরি করে। আর যারা পেশাগত সফলতা পায় তারা অর্থ উপার্জনের নেশায় এমনভাবে মত্ত হয়ে পরে যে, তাদের এই উপার্জনের খেলার কাছে মানবিকতাও হার মেনে যায়।

অন্যদিকে আবার দেশের অভ্যন্তরে দুই একটি নয়- হাজার হাজার যৌন নির্যাতন, দুর্নীতি, অনিয়ম, স্বেচ্ছাচারিতাসহ সমাজের নানা রকম অপরাধমূলক কর্মকান্ডে শিক্ষিত লোকেরা জড়িত হচ্ছে যেগুলো আগে অশিক্ষিত বা মূর্খ লোকদের কর্মকান্ড বলে বিবেচিত হত। অথচ শিক্ষার মাধ্যমে মানুষের পরিশোধিত হওয়ার কথা ছিলো। বিবেকবোধ ও জ্ঞানের সমন্বয়ে একজন দেশপ্রেমিক ও মানবিক চরিত্রবান মানুষ সৃষ্টিইতো ছিলো শিক্ষার উদ্দেশ্য কিন্তু বাস্তবতা তার থেকে অনেকটাই উল্টো। কারণ আমরা মানুষ হওয়ার শিক্ষা গ্রহণে নারাজ, উপার্জনের বিদ্যা শিখতে মরিয়া। বাংলাতে একটা কথা আছে যে, পানি ছাড়া জাহাজ চলেনা কিন্তু সেই পানি যদি জাহাজের উপরে উঠে তাহলে জাহাজই ডুবে যায় সুতরাং পানি যেন জাহাজের নিচেই থাকে। ঠিক তেমনি মানুষের জীবন ধারণের জন্য পেশাগত দক্ষতা বা উপার্জনের বিদ্যা শেখার প্রয়োজনীয়তা অবশ্যই রয়েছে কিন্তু কোনভাবেই যেন সেটি মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি ও মূল্যবোধকে ছাড়িয়ে না যায়। অন্যথায়, শুধু সংখ্যাগত দিক দিয়েই শিক্ষিত মানুষ বাড়বে এবং প্রকৃত মানুষ তৈরি হবেনা।

আমাদের শিক্ষা ও সংস্কৃতির দিকে বিশেষভাবে নজর দেয়া প্রয়োজন। কেননা এটি প্রকৃত মানুষ তৈরির সবচেয়ে বড় উপযুক্ত মাধ্যম। আমাদের জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটিয়ে এমন এক কার্যকরী শিক্ষা অন্তর্ভুক্ত করতে হবে যেখানে মানবিক গুণাবলির বিকাশ ঘটিয়ে একজন মানুষকে যোগ্য মানুষে রূপান্তর করা যায় এবং কেবলমাত্র চাকরি বা ব্যবসাই নয় বরং কিভাবে একজন মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি ও মূল্যবোধসম্পন্ন  মানুষ হওয়া যায় সে শিক্ষাও প্রদান করা হবে। এমন শিক্ষাতেই যেন আমরা শিক্ষিত হই, যে শিক্ষায় একজন ব্যক্তির আত্মোন্নয়ন, নৈতিক মূল্যবোধ, সামাজিক দায়িত্ব, সহানুভূতি ও সৃজনশীলতা গড়ে ওঠে।  

সাধারণত, পরিবারই মানুষের জীবনচরিতের মূল ভিত্তি। পরিবারে ছোটবেলা থেকে শিক্ষা, স্নেহ এবং সহানুভূতির পরিবেশ একজন ব্যক্তির চরিত্রের বিকাশ ঘটাতে সহায়ক তাই সন্তানকে শুধুমাত্র পেশাগতভাবে সফল হওয়ার দিকে নয়, বরং মানবিক দিক দিয়ে যথার্থ মানুষ হয়ে ওঠার শিক্ষা প্রদানের কাজটাও পরিবার থেকে শুরু করতে হবে। কেননা সামাজিক দায়িত্ববোধও কিন্তু একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সমাজের প্রতি দায়িত্ব পালন না করলে আমাদের সমাজে ধীরে ধীরে ক্ষত সৃষ্টি হবে ও দুর্গন্ধ তৈরি হবে। সৃষ্টি হবে নানা রকম ক্ষতিকর রোগ-জীবাণু (সামাজিক অপরাধ)। আর এই রোগে আক্রান্ত হবে সমাজের সকল শ্রেণী পেশার মানুষ। সমাজের প্রতি সহানুভূতি, অন্যের দুঃখে দুঃখিত হওয়া এবং ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়িয়ে কাজ করা ইত্যাদি বৈশিষ্ট্যগুলো একজন মানুষের প্রকৃত শিক্ষা ও মানবিকতার ধারক। সমাজের কল্যাণে কাজ করা এবং অন্যদের প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শন করা একজন মানুষকে শুধুমাত্র ভালো নাগরিকই নয়, বরং একটি পরিপূর্ণ মানুষ হতে সাহায্য করে এবং প্রকৃত ও পরিপূর্ণ মানুষেরাই কেবল পরবর্তী প্রজন্মকে একটি সুস্থ সমাজ উপহার দিতে পারে। 
আমরা এখন প্রযুক্তি নির্ভর যুগে আছি। প্রযুক্তি ও যন্ত্রের সাথে থাকতে থাকতে মানুষের জীবন-যাপনও অনেকটা যান্ত্রিক হয়ে যাচ্ছে সাথে আমাদের অনুভূতিও যান্ত্রিকতায় রূপ নিচ্ছে। এমতাবস্থায় এই যান্ত্রিকতার মাঝে মানবিকতা ও মূল্যবোধের জায়গা করে নেওয়াটা দুষ্কর একটি কাজ। যেখানে প্রতিনিয়তই প্রযুক্তি এবং উপার্জনের পেছনে ছুটে চলা মানুষদের সংখ্যা বাড়ছে, সেখানে মুল্যবোধের শিক্ষা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই উপেক্ষিত। মুল্যবোধের শিক্ষা আমাদের মনে শান্তি, ধৈর্য্য এবং সহিষ্ণুতা আনতে সাহায্য করে। এটি আমাদের আত্মবিশ্বাসী, সৎ এবং নির্লোভ মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে সহায়তা করে। মানুষ হওয়ার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের মধ্যে অন্যতম হলো নৈতিকতা ও মূল্যবোধ। এগুলো ছাড়া আমাদের সমাজ বা মানবিক সম্পর্ক কোনোভাবেই টিকবে না। সৃজনশীল সাহিত্য সাময়িকী ‘রূপান্তর’ সূচনা সংখ্যায় প্রকাশিত ‘শুদ্ধাচার’ নামক গবেষণামূলক প্রবন্ধটি থেকে জানা যায়, একজন মানুষকে যোগ্য মানুষ হতে হলে অন্তত ২৪১ টি ইতিবাচক গুণাবলী অর্জন ও ১৭৬ টি নেতিবাচক গুণাবলী বর্জন করা উচিত। কিন্তু আমাদের মধ্যে এমন অনেকেই আছেন যারা প্রকৃতপক্ষে অনুধাবনই করতে পারেন না যে, একজন মানুষের জন্য এ মানবিক গুণাবলীসমূহ কতোটা প্রয়োজন। সৎ, ন্যায়পরায়ণ এবং অন্যদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা, মিথ্যাচার বা প্রতারণা থেকে দূরে থাকা, সমাজের নৈতিক দায়িত্ব পালন করা এসব গুণাবলী আমাদের মানসিক শান্তি প্রদান করে ও অবসাদমুক্ত রাখে এবং পাশাপাশি একটি বিকৃত মস্তিষ্ক সৃষ্টিতে বাঁধা দেয়।

অবশ্যই, জীবনে চলার পথে উপার্জন বা পেশাগত সাফল্য প্রয়োজন। কিন্তু যদি সেই উপার্জন আমাদের মানবিক গুণাবলীর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ না হয়, তবে তা এক সময় ব্যক্তির আত্মসন্তুষ্টি এবং সুখের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। একজন প্রকৃত সুখী মানুষ হতে হলে শুধু অর্থ উপার্জনই নয়, তার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ জীবনযাপনও জরুরি।  

এবার কথা হচ্ছে, কীভাবে আমরা মানুষ হওয়ার শিক্ষা অর্জন করতে পারি? আমাদের প্রতিটি পদক্ষেপে, প্রতিটি সিদ্ধান্তে এবং প্রতিটি আচরণে মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি ও মূল্যবোধের প্রয়োগ ঘটাতে হবে। আমরা যদি শুধুমাত্র উপার্জনের জন্য দৌঁড়াতে থাকি এবং মানবিকতা ভুলে যাই, তাহলে সেই উপার্জন কখনোই আমাদের মানসিক সুখ ও আত্মতৃপ্তি এনে দিতে পারবে না। তাই, প্রকৃত মানুষ হওয়ার জন্য প্রথমে নিজ নিজ ধর্ম অনুযায়ী ধর্মীয় শিক্ষা অর্জন করা সবার আগে জরুরি যেটা পরিবার থেকে নিশ্চিত করতে হবে। কেননা প্রতিটি ধর্মেই এমন কিছু নৈতিক শিক্ষা থাকে যা আমাদের ইতিবাচক আত্মগঠন ও মূল্যবোধ তৈরির মূল সহায়ক। তারপর ইচ্ছানুসারে পেশাগত দক্ষতা অর্জন, তাহলে এটি আমাদের পরিবার, সমাজ, ব্যক্তিগত ও রাষ্ট্রীয় জীবনে পরিপূর্ণতা আনতে সহায়তা করবে বলে আশা করা যায়। পাশাপাশি আমাদের মানবিক গুণাবলীসমূহ সম্পর্কে জানতে হবে  এবং সেগুলো বাস্তবজীবনে বেশি বেশি প্রয়োগ করতে হবে।

যেহেতু নশ্বর পৃথিবীতে স্বল্প সময়ের জন্য সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে আগমন করে আবার অচিরেই বিদায় নিতে হবে সুতরাং শুধুমাত্র উপার্জনের বিদ্যা নয়, মানুষ হওয়ার শিক্ষা গ্রহণের মাধ্যমে মনুষ্যত্ব অর্জন করে মানবিক কাজের মাধ্যমে স্থায়ী ছাপ রেখে যাওয়াটাই শ্রেয়! অন্যথায় ষোলো আনাই বৃথা।

লেখক-এস এম নুর ইসলাম
সম্পাদক, রূপান্তর সাহিত্য সাময়িকী


ভোরের আকাশ/ হ.র

  • শেয়ার করুন-
 ইসরায়েলকে ‘গণহত্যাকারী রাষ্ট্র’ ঘোষণা, বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিন্ন করলো স্পেন

ইসরায়েলকে ‘গণহত্যাকারী রাষ্ট্র’ ঘোষণা, বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিন্ন করলো স্পেন

সংশ্লিষ্ট

শুধু উপার্জনের বিদ্যা নয়, মানুষ হওয়ার শিক্ষার্জনও জরুরি

শুধু উপার্জনের বিদ্যা নয়, মানুষ হওয়ার শিক্ষার্জনও জরুরি

বাংলাদেশের আইন এবং সংবিধানে পরিবর্তন ও সংযোজন

বাংলাদেশের আইন এবং সংবিধানে পরিবর্তন ও সংযোজন

বাংলাদেশে সমাজতান্ত্রিক আদর্শের বিকাশ এবং এর প্রভাব

বাংলাদেশে সমাজতান্ত্রিক আদর্শের বিকাশ এবং এর প্রভাব

প্রজন্ম জেড-ই গণতন্ত্র রক্ষা করবে

প্রজন্ম জেড-ই গণতন্ত্র রক্ষা করবে