এম আর চৌধুরী রাজু, নীলফামারী
প্রকাশ : ০৩ মে ২০২৫ ০১:৫০ পিএম
নীলফামারীর অরক্ষিত লেভেল ক্রসিংগুলো যেন মরণ ফাঁদ
দীর্ঘদিন ধরে নীলফামারীর বেশিরভাগ লেভেল ক্রসিংগুলোই রয়েছে অবহেলিত আর অরক্ষিত। নেই রেলগেইট ও গেইটম্যান। ফলে প্রতি বছরেই ঘটছে প্রাণহানিসহ নানা ক্ষয়-ক্ষতির ঘটনা। ঝুঁকিপূর্ণ এসব লেভেল ক্রসিংগুলো যেন পরিনত হয়েছে মরণ ফাঁদে। নিরাপত্তার স্বার্থে এসব লেভেল ক্রসিংয়ে স্বেচ্ছাশ্রমে পাহাড়া দিচ্ছেন কেউ কেউ। স্থানীয়দের অভিযোগ রেল বিভাগের জরাজীর্ণ সতর্কতামূলক সাইনবোর্ড কোন কাজেই আসছে না। অনেকে প্রশ্ন তুলছেন, আর কত প্রাণ গেলে সুরক্ষিত হবে এসব অরক্ষিত লেভেল ক্রসিংগুলো?
অনুসন্ধানে জানা যায়, গত ২০২১ সালের ৮ ডিসেম্বর জেলা সদরের মনসাপাড়া এলাকায় অরক্ষিত লেভেল ক্রসিংয়ে একটি দ্রুতগামী ট্রেনের চাকায় ছিন্নভিন্ন হয় একই পরিবারের ৩ ভাই-বোনের কোমল দেহ। শুধু তাই নয়, তাদের বাঁচাতে এগিয়ে এসে নিকেজেও শেষ রক্ষা করতে পারেননি স্থানীয় যুবক শামীম হোসেন। অবশেষে ওইদিন তিনিও ঢলে পড়েছিলেন মৃত্যুর কোলে।
স্থানীয়রা বলছেন, লোমহর্ষক ওই ঘটনার কয়েকদিন পর এই এলাকায় পরিদর্শনে আসেন তৎকালীন আ.লীগ সরকারের রেলপথ মন্ত্রী অ্যাড.নুরুল ইসলাম সুজন। ভুক্তভোগী পরিবার দুটিকে নামমাত্র অনুদান দিয়ে স্থানীয়দের শুনিয়েছিলেন ব্যাপক আশার বাণী। আ.লীগ শাসনামলে ওই ঘটনার প্রায় ৩ বছর অতিবাহিত হলেও বাস্তবায়ন হয়নি তার কোনটিও।
এদিকে, জেলা সদরের দারোয়ানী রেল স্টেশনের পাশেই রয়েছে একটি অরক্ষিত লেভেল ক্রসিং। গেল ২০২২ সালের ২৬ জানুয়ারি ওই লেভেল ক্রসিংয়ের ওপর ট্রেন ও ব্যাটারি চালিত অটোরিকশার সংঘর্ষ হয়। এ দিনও প্রাণহানি হয় ৪ ইপিজেড নারী কর্মীসহ ৫ জনের।
স্থানীয়রা অভিযোগ করে বলেন, দারোয়ানীর অদুরেই দীর্ঘ এক যুগেরও বেশি সময় ধরে বন্ধ থাকা খয়রাত নগর স্টেশনটির পাশেই রয়েছে একটি লেভেল ক্রসিং। ওই লেভেল ক্রসিং এর ওপর দিয়ে যানবাহনসহ প্রতিদিন গড়ে যাতায়াত করে ইপিজেডকর্মীসহ প্রায় ৫০ হাজার মানুষ। নানা অনাকাঙ্খিত দুর্ঘটনায় প্রাণহানীর পর স্থানীয়দের উদ্যোগে ওই লেভেল ক্রসিংয়ে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে দুইজন গেইটম্যানকে। চিলাহাটি থেকে সৈয়দপুর এ রেলপথে প্রতিদিন ৬টি আন্ত:নগর ট্রেন চলচল করলেও, কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি নেই এসব অরক্ষিত লেভেল ক্রসিং এ। অরক্ষিত এসব লেভেল ক্রসিংয়ে শুধু মাত্র একটি সতর্কতামূলক সাইনবোর্ড লাগিয়েই দায় সারছেন তারা।
রেলওয়ে জেলা পুলিশের দেওয়া তথ্য বলছে, গেল ৪ বছরে ট্রেনে কাটা পড়ে প্রাণহানী হয়েছে শিশুসহ অর্ধশত নারী-পুরুষের। এর মধ্যে ২০২৩ সালে ২৪ জন ও ২০২৪ সালে ১৩ জন।
রেল বিভাগের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, জেলার ডোমার উপজেলার চিলাহাটি রেলওয়ে স্টেশন থেকে সৈয়দপুর উপজেলার সৈয়দপুর রেলওয়ে স্টেশন পর্যন্ত প্রায় ৭০ কিলোমিটারের রেলপথে বৈধ লেভেল ক্রোসিং রয়েছে মোট ৩৬টি। এর মধ্যে গেইটম্যান দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে ১৩টি।
জানতে চাইলে, রেলওয়ে বিভাগের সহকারী নির্বাহী প্রকৌশলী আবু জাফর মো. রাকিব জানান, গত ২০১২ সাল থেকে লেভেল ক্রসিংয়ের জন্য কোন বরাদ্দ হয়নি। তবে প্রস্তাব দেয়া আছে, বরাদ্দ পেলে কাজ শুরু হবে। নীলফামারী জজ আদালতের আইনজীবী ও পিএইডি গবেষক অ্যাড. জাহাঙ্গীর আলম সরকার বলেন, ঝুঁকিপূর্ণ এসব লেভেল ক্রসিং এর পাশে শুধু মাত্র একটি সাইনবোর্ডই যথেষ্ট নয়, অনাকাঙ্খিত দুর্ঘটনা এড়াতে এসব লেভেল ক্রসিং এ একজন দায়িত্বরত ব্যক্তিরও প্রয়োজন আছে বলে মনে করছেন তিনি।
নীলফামারী জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ নায়িরুজ্জামান বলেন, ‘খুব শিগগিরই সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে এসব সমস্যার সমাধান করা হবে।’
প্রতি বছরই উল্লেখযোগ্য হারে প্রাণহানি হলেও বিগত সরকারের আমলে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় থেকে এসব অরক্ষিত লেভেল ক্রসিংগুলো রক্ষণা-বেক্ষণের দৃশ্যমান কোনো কার্যক্রম দেখেনি স্থানীয়রা। প্রাণহানি থেকে বাঁচতে দুর্ঘটনাপ্রবন ঝুঁকিপূর্ণ এসব লেভেল ক্রসিংগুলো সুরক্ষিত করতে প্রধান উপদেষ্টার হস্তক্ষেপ কামনা করছেন তারা।
ভোরের আকাশ/আজাসা