মো. রেজাউল করিম, পীরগঞ্জ (রংপুর)
প্রকাশ : ০৭ এপ্রিল ২০২৫ ০৩:৩১ পিএম
৬০ বছরেও আলো দেখেনি দেশের প্রথম লৌহখনি
৬ দশকেও আলোর মুখ দেখেনি দেশের প্রথম বিশ্বমানের লৌহখনি। রংপুর জেলার পীরগঞ্জ উপজেলার শানেরহাট ইউনিয়নের ভেলামারি পাথারে ১৯৬৪ সালে এই খনির অস্তিত্ব নিশ্চিত করে তৎকালিন পাকিস্তান সরকারের খনিজ সম্পদ বিভাগ। ১৯৯৯ সালে পুনরায় খনন শুরু করেছিল জিওলজিক্যাল সার্ভে অব বাংলাদেশ (জিএসবি)। কিন্তু আজও লৌহ উত্তোলনের পদক্ষেপ নেয়নি কোনো সরকারই।
এই খনি থেকে লোহা উত্তোলনের দীর্ঘদিনের দাবি পীরগঞ্জবাসীর। জিএসবি ও পেট্রোবাংলা থেকে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, শানেরহাট ও মিঠিপুর ইউনিয়নের মাঝামাঝিতে বিশাল একটি এলাকার নাম ভেলামারি পাথার। এখানেই অবস্থান সেই খনির। ৬০ বছর আগে খনি এলাকা চিহ্নিত করে সেই জমিতে কংক্রিটের ঢালাই করে রাখা হয় অনুসন্ধান করা চারটি কূপের মুখ। সেই কংক্রিটের ঢালাই ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সেখানে।
জেসবি ও পেট্রোবাংলা সূত্র জানায়, ১৯৬৪ সালের ৬ সেপ্টেম্বর পাক-ভারত যুদ্ধের পর স্যাটেলাইটের মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী তৎকালীন পাকিস্তান খনিজসম্পদ বিভাগের একদল বিশেষজ্ঞ বিমান ও গাড়িবহর নিয়ে এই ভেলামারি পাথারে আসে। প্রায় ছয় বর্গ কিলোমিটার আয়তনের এই পাথারে তারা লৌহ খনির অবস্থান নিশ্চিত করতে এ্যারোমেটিক সার্ভে পরিচালনা করে। উড়োজাহাজের নিচে একটি বিশাল শক্তিশালী চুম্বক ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। এরপর উড়োজাহাজটি ট্রি লেবেলে পাথারের ওপর দিয়ে উড়ে যেতে থাকে।
একপর্যায়ে উড়োজাহাজে ঝুলন্ত চুম্বকটি ভেলামারি পাথারে ছোট পাহাড়পুর গ্রামের আবুল ফজল ও আবদুল ছাত্তার নামে দুই ব্যক্তির মালিকানাধিন জমির ওপর এসে আকর্ষিত হয়। এই আকর্ষণ উড়োজাহাজটিকে বারবার মাটির দিকে টেনে নিচে নামাতে চেষ্টা করে। পরে অন্যান্য পরীক্ষার পর তৎকালীন পাকিস্তানের খনিজ বিজ্ঞানীরা এখানে লোহার খনির অস্তিত্ব নিশ্চিত করেন। পরে উৎস হিসেবে ওই জমির ওপর কংক্রিটের ঢালাই করে চিহ্ন দিয়ে চলে যান।
সূত্র জানায়, পরের বছর পাকিস্তান খনিজসম্পদ বিভাগ চিহ্নিত স্থানে খনন কাজ শুরু করে। প্রায় আট মাস ধরে তারা ভেলামারি এলাকার পাশের কেশবপুর, ছোট পাহাড়পুর, প্রথমডাঙ্গা, পবনপাড়া, সদরা কুতুবপুর পর্যন্ত বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে অসংখ্য স্থানে পাইপ বসিয়ে লোহার খনির সন্ধান করে নিশ্চিত হন। অনুসন্ধানের সময় পাইপের ভেতর দিয়ে মাটির গভীরে বোমা বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। বোমার বিস্ফোরণে ওই এলাকার অনেক মাটির কুয়া ভেঙে যায় সেসময়। দ্বিতীয় দফায় পাইপের মাধ্যমে জরিপ কাজ সম্পন্ন করা হয়।
১৯৬৭ সালের শেষের দিকে পাকিস্তান খনিজ সম্পদ বিভাগের কর্মকর্তাসহ একদল বিদেশী খনিজ বিশেষজ্ঞ রংপুরে আসেন। তারা অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতির বিশাল বহর ও পরিবার পরিজনসহ স্থানীয় পানবাজার উচ্চ বিদ্যারয় মাঠে অস্থায়ী ক্যাম্প করে লোহার উপাদান উত্তোলন করে। মাটির ৯’শ ফুট নিচ থেকে ২২ হাজার ফুট পর্যন্ত পাইপ বসিয়ে লোহার উন্নতমানের স্তরের সন্ধান পায়। এর বিস্তৃতি প্রায় ১০ বর্গ কিলোমিটার। টানা এক বছরের বেশি সময় ধরে ব্যাপক অনুসন্ধান শেষ করে ভেলামারিতে বোরিংকৃত চারটি মূল পাইপের উৎসমুখে কংক্রিটের ঢালাইয়ের দিয়ে বন্ধ করে ক্যাম্প গুটিয়ে চলে যান। এ সময় তারা বলে যান, লৌহ অপরিপক্ক অবস্থায় আছে। তারা ধারনা কওে বলেন, আগামি ২০ থেকে ২৫ বছরের মধ্যেই এটি উত্তোলন যোগ্য হতে পারে। সেই হিসেবে ৪২ বছর আগে লোহা খনিটি পরিপক্কতা লাভ করেছে এই খনিটি বর্তমানে উত্তোলনযোগ্য।
বাংলাদেশ ভূতাত্ত্বিক জরিপ অধিদফতর দ্বিতীয়বারের মতো ১৯৯৯ সালের মাঝামাঝি সময়ে ভেলামারি পাথারে লোহার খনির অনুসন্ধান কাজ শুরু করেন। কিন্তু তারা পূর্বে আবিষ্কৃৃত লৌহ খনির উৎসমুখ ভেলামারি হতে প্রায় ৪ কিলোমিটার দূরে বড় পাহাড়পুর গ্রামের পূর্ব প্রান্তে পরীক্ষামূলক খনন করে কোনো রিপোর্ট প্রকাশ না করেই চলে যান। ওই রিপোর্ট পরে পরিপূর্ণভাবে প্রকাশও হয়নি। ২০২৩ সালের শেষের দিকে খনিটির মূল উৎস থেকে প্রায় ৪ কি.মি. দুরে কাশিমপুর গ্রামে ড্রিলিংয়ের মাধ্যমে কূপ খনন করে। তবে সেখানে কি পাওয়া গেছে তা প্রকাশ করেনি জেএসবি।
জিএসবি সূত্র নিশ্চিত করেছে, সেখানে অনুসন্ধান চালিয়ে উন্নতমানের আয়রন কোর (লোহা আকরিক) পাওয়া গেছে। কিন্তু সেখানে আয়রন কোরের রিজার্ভ কম হওয়ায় লৌহ উত্তোলনের সিদ্ধান্তে আসতে পারেনি জিএসবি। কারণ হিসেবে বলেছেন, রিজার্ভের পরিমান ইকোনমিক্যালি ভায়াবোল না হওয়ায় খনি থেকে লৌহ উত্তোলন করা সম্ভব হচ্ছে না। যে পরিমাণ খরচ হবে তা রিজার্ভ দিয়ে পুষিয়ে নেয়া সম্ভব হবে না বলেও উল্লেখ করেছেন তারা। লৌহখনির অবস্থান নিশ্চিত করে অনুসন্ধান চললেও উত্তোলনের কোনো উদ্যোগ নেয়নি জিএসবি।
ভূতাত্ত্বিক জরিপ বিভাগ থেকে পাওয়া তথ্য মতে, লৌহখনিটি এখন পরিপক্কতা অর্জন করেছে। অথচ পেট্রোবাংলা ড্রিলিং করে কূপ খনন করে এখনো অনুসন্ধান কার্যক্রম চালাচ্ছে। চলতি বছরেও নাকি কূপ খনন করবে জিএসবি।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. বদরুদ্দোজা মিয়া বলেন, বাংলাদেশে প্রথম লৌহসহ আরো কিছু মিনারেলের ট্রেস পাওয়া গেছে রংপুরের পীরগঞ্জে। এখনও মাইনিং পর্যায়ে যাওয়ার মত যথেষ্ট তথ্য-উপাত্ত নাই। ভেলামারী পাথারে আরও একটি ড্রিলিংয়ের পরিকল্পনা চলছে।
পেট্রো বাংলার সাবেক পরিচালক মকবুল-ই-এলাহী চৌধুরী মশগুল বলেন, ১৯৬৪ সালে বাংলাদেশে প্রথম লৌহখনি আবিষ্কৃত হয় পীরগঞ্জে, যা পেট্রো বাংলায় ‘পীরগঞ্জ-১’ ফাইল নামে সংরক্ষিত আছে।
ভোরের আকাশ/এসএইচ