কক্সবাজার প্রতিনিধি
প্রকাশ : ০৭ অক্টোবর ২০২৫ ০৭:৫৪ পিএম
ছবি: ভোরের আকাশ
ফানুস উৎসবে আকাশ রাঙানোর পর এবার শুভ প্রবারণা পূর্ণিমা উপলক্ষে রামুর বাঁকখালী নদীতে অনুষ্ঠিত হলো বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের ঐতিহ্যবাহী ‘কল্প জাহাজ’ ভাসানো উৎসব। শত বছরের ঐতিহ্য বহন করা এই উৎসবে নদীতে একে একে ভাসানো হয় দৃষ্টিনন্দন পাঁচটি কল্প জাহাজ।
মঙ্গলবার (৭ অক্টোবর) দুপুর থেকে কক্সবাজারের রামু উপজেলার পূর্ব রাজারকুল ঘাটে এ উৎসব শুরু হয়, যা বিকেলের মধ্যেই পরিণত হয় জনসমুদ্র আর বর্ণিল মিলনমেলায়। বাঁকখালী নদীর দুই পাড়ে হাজারো মানুষের অংশগ্রহণে উৎসবটি হয়ে ওঠে প্রাণবন্ত।
দৃষ্টিনন্দন কারুকাজে সজ্জিত কল্প জাহাজ প্রতিটি কল্প জাহাজ তৈরি করা হয়েছে বাঁশ, কাঠ, বেত ও রঙিন কাগজ দিয়ে। জাহাজগুলোয় ফুটিয়ে তোলা হয়েছে হাঁস, ময়ূর, হাতি, জাদি প্রভৃতি প্রাণীর অবয়ব। কয়েকটি জাহাজ ছিল কাঠের নৌকার ওপর, আবার দুটি ইঞ্জিনচালিত নৌকায়ও বসানো হয়েছিল শিল্পকর্ম। প্রতিটি জাহাজ ছিল নিজস্ব বৈশিষ্ট্যে অনন্য, নিখুঁত নির্মাণশৈলীতে ভরপুর।
ভাসমান জাহাজগুলোয় বৌদ্ধ কীর্তন, বাদ্যযন্ত্রের তালে তালে নাচ-গান চলতে থাকে। শিশু-কিশোর থেকে বৃদ্ধ পর্যন্ত সকলেই উচ্ছ্বাসে মেতে ওঠে। নদীর দুই পাড়জুড়ে গান-বাজনা, কীর্তন ও ফানুস ওড়ানোর দৃশ্য ছিল মনোমুগ্ধকর।
স্থানীয় সৌরভ বড়ুয়ার ভাষ্যমতে, প্রায় দুইশ বছর আগে পার্শ্ববর্তী দেশ মিয়ানমারের মং রাজ ম্রাজংব্রান নামক রাজা মুরহন ঘা এলাকায় প্রথম এ উৎসবের প্রচলন করেন। পরে এটি রামুতে স্থানান্তরিত হয়ে শত বছরের ঐতিহ্য হিসেবে রূপ নেয়।
তিনি জানান, প্রবারণা পূর্ণিমার পটভূমি বৌদ্ধ ধর্মে এক অনন্য ঘটনা স্মরণে এই উৎসব পালিত হয়। বুদ্ধ যখন রাজগৃহ থেকে বৈশালী যাচ্ছিলেন, তখন দেবতা, ব্রহ্মা ও নাগরা বুদ্ধকে পূজা করেন। সেই অলৌকিক ঘটনার স্মরণে প্রতীকীভাবে ‘স্বর্গের জাহাজ’ ভাসিয়ে বুদ্ধকে পূজা করার সংস্কৃতি চালু হয়।
বিকেল ৩টার দিকে উৎসবের প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন অন্তর্বর্তীকালীন ধর্ম উপদেষ্টা আ ফ ম খালিদ হোসেন। তিনি বলেন, ‘‘বাংলাদেশ সব ধর্ম ও বর্ণের মানুষকে নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষা করে সবাইকে নিয়ে একসাথে থাকতে হবে।”
তিনি এসময় উৎসব আয়োজনে এক লক্ষ টাকা অনুদান দেন এবং বৌদ্ধ মন্দির ও গির্জার সংস্কারে বিশেষ অনুদানের আশ্বাস দেন।
অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. আ. মান্নান, পুলিশ সুপার মো. সাইফুদ্দিন শাহীন, কক্সবাজার-৩ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা লুৎফুর রহমান কাজল।
লুৎফুর রহমান কাজল বলেন, ‘‘বৌদ্ধদের এই ২০০ বছরের পুরোনো উৎসব আমাদের জাতীয় সংস্কৃতির অংশ। বিএনপি সবসময় অসাম্প্রদায়িক চিন্তা ধারণ করে এবং বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের পাশে ছিল, আছে, থাকবে।”
উৎসবের উদ্বোধন করেন একুশে পদকপ্রাপ্ত বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ড. সুকোমল বড়ুয়া। তিনি বলেন, ‘‘শত বছর ধরে চলে আসা এই উৎসব শুধু বৌদ্ধদের নয়, এটি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির প্রতীক। এখানে সকল ধর্মের মানুষ অংশ নেয়, এটাই বাংলাদেশের শক্তি।”
উদযাপন পরিষদের সভাপতি মিথুন বড়ুয়া বোথামের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এই উৎসবে স্মৃতি বড়ুয়া নামে একজন বলেন, ‘‘আমি প্রতি বছর শ্বশুরবাড়িতে এসে প্রবারণা উদযাপন করি। কিন্তু জাহাজ ভাসানোর এই আয়োজন সত্যিই অসাধারণ, এক অন্যরকম অভিজ্ঞতা।”
আয়োজকদের মতে, প্রতিটি জাহাজ নির্মাণে খরচ হয় প্রায় দুই লক্ষ টাকা করে। এবার অনুদান কিছুটা কম হলেও উপস্থিত দর্শনার্থী ও প্রশাসনের সক্রিয় অংশগ্রহণে উৎসবটি সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে।
ভোরের আকাশ/জাআ