নেপথ্যে আমদানি নির্ভরতা
আমদানি নির্ভরতা ও কারিগরি ত্রুটির কারণে দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন খাতে দিন দিন সংকট বাড়ছে। আর জ্বালানি সংকটে দেশের ১৩৫টি বিদ্যুৎকেন্দ্রের মধ্যে ১৫টির উৎপাদন পরোপুরি বন্ধ এবং কারিগরি ত্রুটিতে অচল রয়েছে আরও পাঁচটি কেন্দ্র, অর্থাৎ ২০টি কেন্দ্রের উৎপাদন বন্ধ রয়েছে। এছাড়া কিছু কেন্দ্র সক্ষমতার তুলনায় কম উৎপাদন চলছে। আর গ্যাস সংকটে সাড়ে চার হাজার মেগাওয়াটের মতো বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ রয়েছে। ফলে দেশে ব্যবহার করা বিদ্যুৎ এর একটি বড় অংশ আমদানি করা বিদ্যুতের ওপর নির্ভরশীল হচ্ছে। এছাড়া ভারতের আদানি গ্রুপের বিদ্যুতের ওপর বাংলাদেশের নির্ভরশীলতা বেশি হওয়ায় এই কেন্দ্র থেকে সরবরাহ বন্ধ থাকলে দেশজুড়ে এবং উল্লেখযোগ্যভাবে উত্তরাঞ্চলে ব্যাপক লোডশেডিং দেখা দেয়।বিশেষজ্ঞদের মতে, সঠিক উৎপাদন পরিকল্পনার মাধ্যমে সমপরিমাণ প্রচেষ্টায় দেশেই আরো বেশি পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব। আর উৎপাদন বাড়লে আমদানি নির্ভরতা অনেকাংশে কমানো সম্ভব হবে। এজন্য ভবিষ্যতে যে সরকার আসবে, তাদের উচিত এ বিষয়ে একটি সমন্বিত পরিকল্পনা গ্রহণ এবং আমদানি নির্ভরতা থেকে বেরিয়ে আসার প্রচেষ্টা নেওয়া।এদিকে, ক্রমাগত আমদানি বিদ্যুৎ ক্রয়ের পরিমাণও বাড়াচ্ছে বাংলাদেশ। চলতি বছরের শুরুতে আমদানি বিদ্যুৎ ক্রয়ে দৈনিক খরচ হতো ১৭ কোটি টাকা, যা এপ্রিল মাসে বেড়ে দাঁড়ায় ২৫ কোটি টাকা এবং চলতি অক্টোবর মাসে তা গড়ে ৩০ কোটি টাকায় পৌঁছেছে। অন্যদিকে, আওয়ামী সরকারের আমলে ‘নিজেদের ঘরানা’র লোকদের সুবিধা ও ব্যবসা দিতে নিজস্ব উৎপাদন সক্ষমতা বৃদ্ধি ও সঠিক পরিকল্পনা গ্রহণ না করে আমদানি’র ওপর জোর দেওয়া হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। আর এক্ষেত্রে সাবেক বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নাসরুল হক বিপু তার ‘নিজস্ব সিন্ডিকেট’ কে অনৈতিকভাবে সুবিধা দিয়েছে এবং ব্যাপক দুর্ণীতি করেছে বলেও ব্যাপক অভিযোগ রয়েছে।জ্বালানি বিদ্যুৎ ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, দেশের দৈনিক গড় বিদ্যুৎ চাহিদা প্রায় ১৫ হাজার মেগাওয়াট। বর্তমানে বাংলাদেশ ভারত ও নেপাল থেকে মোট ২,৬৯৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করছে। এর উৎসগুলো হলো ভেড়ামারা থেকে ১,০০০ মেগাওয়াট, ত্রিপুরা থেকে ১৬০ মেগাওয়াট, আদানি পাওয়ার থেকে ১,৪৯৬ মেগাওয়াট এবং নেপাল থেকে ১৪ মেগাওয়াট। বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) দৈনিক উৎপাদনের হিসাব অনুযায়ী, জ্বালানি তেলভিত্তিক ১০টি বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন সম্পূর্ণ বন্ধ রয়েছে।এ কেন্দ্রগুলো হচ্ছে-রূপসা (১০৫ মেগাওয়াট), মধুমতী (১০০ মেগাওয়াট), চৌমুহনী (১১৩ মেগাওয়াট), সাইদপুর (১৫০ মেগাওয়াট), সাইদপুর (২০ মেগাওয়াট), গাগনগর (১০২ মেগাওয়াট), মেঘনাঘাট (১০৪ মেগাওয়াট), পতেঙ্গা (৫০ মেগাওয়াট), শিকলবাহা (১০৫ মেগাওয়াট), কর্ণফুলী পাওয়ার লিমিটেড (১০০ মেগাওয়াট)।এছাড়া তেলভিত্তিক আরও কয়েকটি কেন্দ্রের উৎপাদন সক্ষমতার তুলনায় বর্তমানে বেশ কম। যদিও তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্ষেত্রে সরকার প্রয়োজন অনুসারে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে থাকে এবং প্রয়োজন ছাড়া যথাসম্ভব কম উৎপাদন করার চেষ্টা করে। অন্যদিকে, কারিগরি কারণে উৎপাদন সম্পূর্ণ বন্ধ রয়েছে আরও পাঁচটি কেন্দ্রের।সেগুলো হলো-শিকলবাহা (১০৫ মেগাওয়াট), আশুগঞ্জ (২২৫ মেগাওয়াট), শাহজিবাজার (৩৩০ মেগাওয়াট), বাঘাবাড়ী (১০০ মেগাওয়াট) ও বড়পুকুরিয়া (২৭৫ মেগাওয়াট)। পাশাপাশি প্রাকৃতিক গ্যাস ছাড়াও ফার্নেস তেলভিত্তিক প্রায় ১০টি বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন বন্ধ রয়েছে। তেল সংকটের কারণে উৎপাদন কমিয়েছে আরও ১৮টি কেন্দ্র।জানা গেছে, বর্তমানে প্রাকৃতিক গ্যাসের অভাবে বর্তমানে সম্পূর্ণ বন্ধ রয়েছে ১৫টি কেন্দ্রের বিদ্যুৎ উৎপাদন। এগুলো হচ্ছে- ঘোড়াশাল রিপাওয়ারড ইউনিট ৪ (৪১০ মেগাওয়াট), ঘোড়াশাল ইউনিট ৫ (২১০ মেগাওয়াট), ঘোড়াশাল ইউনিট ৭ (৩৬৫ মেগাওয়াট), ঘোড়াশাল (১০৮ মেগাওয়াট), টঙ্গী (৮০ মেগাওয়াট), সিদ্ধিরগঞ্জ (১২০ মেগাওয়াট), মেঘনাঘাট (৩৩৫ মেগাওয়াট), মেঘনাঘাট (৫৮৩ মেগাওয়াট), মেঘনাঘাট জেরা (৭১৮ মেগাওয়াট), চিটাগং (৪২০ মেগাওয়াট), কর্ণফুলী পাওয়ার লিমিটেড (১১০ মেগাওয়াট), আশুগঞ্জ (৪৫০ মেগাওয়াট), ফেঞ্চুগঞ্জ (৯৭ মেগাওয়াট), বাঘাবাড়ী (৭১ মেগাওয়াট) ও সিরাজগঞ্জ ইউনিট ২-৩ (২২৫ মেগাওয়াট)। ফলে সার্বিক বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতার একটি বড় অংশ জ্বালানি ঘাটতিতে রয়েছে, যা দেশের অর্থনীতি, উৎপাদন, রপ্তানিতে সংকট বাড়াতে পারে এবং জনজীবনে বিরুপ প্রভাবেরও আশঙ্কা রয়েছে। এ ব্যাপারে বিদ্যুৎ সচিব ফারজানা মমতাজ ভোরের আকাশ’কে বলেন, বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় জ্বালানির ঘাটতি নিরসনে কাজ করছে সরকার। তবে, বিদ্যুৎ আমদানি বৃদ্ধির এখন কোনো পরিকল্পনা নেই উল্লেখ করে বিদ্যুৎ সচিব বলেন, সঠিক পরিকল্পনা থাকলে সমপরিমাণ প্রচেষ্টা দেশে দিয়েই যথেষ্ট পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব, তাহলে আর আমদানি করতে হতো না।তিনি বলেন, ভবিষ্যতে যে সরকার আসবে, তাদের উচিত এ বিষয়ে একটি সমন্বিত পরিকল্পনা গ্রহণ করা-যাতে আমদানি করা বিদ্যুতের ওপর নির্ভরশীলতা না থাকে।উল্লেখ্য, বিদ্যুৎ উৎপাদনে দেশে সাধারণত প্রাকৃতিক গ্যাস, ফার্নেস অয়েল, কয়লা, এলএনজি ব্যবহার করা হয়। তবে দেশের অধিকাংশ বিদ্যুৎকেন্দ্র গ্যাসভিত্তিক। প্রাকৃতিক গ্যাস ছাড়া বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য ফার্নেস অয়েল, এলএনজি এবং ক্ষেত্রবিশেষে কয়লাও আমদানি করতে হয়। ফলশ্রুতিতে, দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন এখন অনেকটাই আমদানির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে।বিদ্যুৎ চাহিদা ও আমদানির চিত্রদেশের দৈনিক গড় বিদ্যুৎ চাহিদা প্রায় ১৫ হাজার মেগাওয়াট। বর্তমানে এই চাহিদার ১৬ শতাংশ পূরণ করা হচ্ছে আমদানি করা বিদ্যুতের মাধ্যমে। বর্তমানে বাংলাদেশ ভারত ও নেপাল থেকে মোট ২,৬৯৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করছে। এর উৎসগুলো হলো- ভেড়ামারা থেকে ১,০০০ মেগাওয়াট, ত্রিপুরা থেকে ১৬০ মেগাওয়াট, আদানি পাওয়ার থেকে ১,৪৯৬ মেগাওয়াট এবং নেপাল থেকে ১৪ মেগাওয়াট।জ্বালানি খাতের আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক প্রতিষ্ঠান ইনস্টিটিউট ফর এনার্জি ইকোনমিকস অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল অ্যানালাইসিসের (আইইইএফএ) তথ্যমতে, ২০১৯-২০ থেকে ২০২৩-২৪ অর্থবছর পর্যন্ত দেশে মোট বিদ্যুৎ ব্যবহারে আমদানি বিদ্যুতের পরিমাণ ৪০ শতাংশ থেকে বেড়ে প্রায় ৬২ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।জানা গেছে, ২০১৯-২০ অর্থবছরে বাংলাদেশে মোট বিদ্যুতের ব্যবহার ছিল ৭১ হাজার ৪১৯ মিলিয়ন কিলোওয়াট ঘণ্টা, যার মধ্যে আমদানি করা বিদ্যুতের পরিমাণ ৩৯ দশমিক ৯ শতাংশ। ২০২০-২১ অর্থবছরে ৮০ হাজার ৪২৩ মিলিয়ন কিলোওয়াট বিদ্যুতের ব্যবহার হয়েছে, যার মধ্যে আমদানি করা বিদ্যুতের পরিমাণ ৫০ শতাংশ। ২০২১-২২ অর্থবছরে ৮৫ হাজার ৬০৭ মিলিয়ন কিলোওয়াট বিদ্যুতের মধ্যে ৫৫ শতাংশ, ২০২২-২৩ অর্থবছরের ৮৮ হাজার ৪৫০ মিলিয়ন কিলোওয়াটের ৫৬ দশমিক ৫ শতাংশ এবং ২০২৩-২৪ অর্থবছরে প্রায় এক লাখ মিলিয়ন কিলোওয়াট ঘণ্টা বিদ্যুতের মধ্যে প্রায় ৬২ শতাংশ বিদ্যুতই আমদানি করা বিদ্যুৎ।জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ড. ইজাজ হোসেন ভোরের আকাশ’কে বলেন, বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রগুলোতে ঠিকমতো জ্বালানি সরবরাহ না হওয়ায় চাহিদা মেটাতে বিদ্যুৎ আমদানি করতে হচ্ছে, যা দেশের অর্থনীতির জন্য একটি বাড়তি চাপ। বিদ্যুৎ আমদানির পরিকল্পনা আগের আওয়ামী লীগ সরকারের করা বলে উল্লেখ করেন তিনি।তিনি বলেন, নবায়নযোগ্য জ্বালানি নিয়ে সঠিক পরিকল্পনা থাকলে এতদিনে আরো অন্তত দুই হাজার মেগাওয়াট বাড়তি বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব হতো, যার মাধ্যমে কিছু ঘাটতি মেটানো সম্ভব হতো। কিন্তু সরকার পরিকল্পনা করলেও তা বাস্তবায়ন করতে পারেনি।জানা গেছে, নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে বাংলাদেশ এখনও অনেক পিছিয়ে রয়েছে। তবে সার্বিক বিদ্যুৎ উৎপাদনে এ খাতের ভূমিকা সামান্য। বর্তমানে ১৩টি সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে গড়ে ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হচ্ছে। আর বায়ুশক্তিভিত্তিক দুটি কেন্দ্র (কক্সবাজার ৬০ মেগাওয়াট ও সিরাজগঞ্জ ২ মেগাওয়াট) থেকে কোনো বিদ্যুৎ উৎপাদিত হচ্ছে না।সুত্র জানায়, ‘নবায়নযোগ্য জ্বালানি নীতি-২০২৫’ অনুযায়ী, সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে নবায়নযোগ্য উৎস থেকে মোট বিদ্যুতের চাহিদার ২০ শতাংশ এবং ২০৪০ সালের মধ্যে ৩০ শতাংশ পূরণ করার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। এর অংশ হিসেবে চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে তিন হাজার মেগাওয়াট ছাদ সৌরবিদ্যুৎ (রুফটপ সোলার) উৎপাদনের কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছে।তবে, নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে লক্ষ্য অর্জনের সম্ভাব্যতা নিয়ে আইইইএফএ-এর সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে তিন হাজার মেগাওয়াট রুফটপ সোলার উৎপাদনের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন কঠিন হতে পারে। কারণ, ২০০৮ সালের জুন থেকে ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত বাংলাদেশ মাত্র ২৪৫ মেগাওয়াট রুফটপ সোলার উৎপাদনের ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে পেরেছে।জ্বালানি বিশেষজ্ঞদের মতে, বিদ্যুৎ খাতের এই আমদানি নির্ভরতা আর্থিক বোঝা বাড়ানোর পাশাপাশি জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিতে সরকারকে বাড়তি নজর দিতে হবে। পাশাপাশি বিদ্যুৎ উৎপাদন ও সরবরাহের সকল ক্ষেত্রে দুর্নীতি-অনিয়ম কঠোরভাবে রোধ করতে হবে। এছাড়া আমদানিনির্ভরতা কমাতে সরকারের সঠিক নীতিমালা প্রণয়ন এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানির ওপর গুরুত্ব দেওয়া জরুরি বলেও মনে করেন তারা।ভোরের আকাশ/এসএইচ