সবার দৃষ্টি পাল্টা শুল্কে
পাল্টা শুল্কারোপ সহনীয় পর্যায়ে রাখতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের চূড়ান্ত আলোচনার সেই প্রতীক্ষিত দিন আজ। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তৃতীয় দফা বৈঠকে বসছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রকে কিছু কৌশলগত প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। পাল্টা শুল্ক নিয়ে দরকষাকষির অংশ হিসেবে এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ২৫টি বোয়িংসহ বেশকিছু পণ্য কেনার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে সরকার। এই ‘স্ট্র্যাটেজিক ডিল’ শেষ পর্যন্ত ওয়াশিংটনের মন জয়ে একটি কার্যকর ‘ট্রাম্পকার্ড’ হিসেবে কাজ করতে পারে বলে মনে করছেন নীতিনির্ধারকরা।তবে ‘আর কোনো সময় নয়, আর কোনো ছাড় নয়’- গত রোববার মার্কিন বাণিজ্যমন্ত্রীর এমন মন্তব্যও বাংলাদেশকে ভাবিয়ে তুলেছে। আবার ইউরোপীয় পণ্যে শুল্ক কমিয়ে ১৫ শতাংশ করার বিষয়টি বাংলাদেশের আস্থার মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছে। দুই দফায় আনুষ্ঠানিক বৈঠক করলেও মাঝখানে সরকার কিছু সময় নষ্ট করেছে বলে ব্যবসায়ী ও অর্থনীতিবিদেরা অভিযোগ করেছেন। বাংলাদেশের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের বাড়তি শুল্ক ১ আগস্ট থেকে কার্যকর হতে যাচ্ছে। মাঝে সময় মাত্র পাঁচ দিন। এর মধ্যে সমঝোতা না হলে বাংলাদেশি পণ্যে ৩৫ শতাংশ অতিরিক্ত শুল্ক বসাবে যুক্তরাষ্ট্র। হাতে মাত্র তিনদিন বাকি থাকলেও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে এখনো কোনো আনুষ্ঠানিক চুক্তিতে পৌঁছাতে পারেনি বাংলাদেশ।গত রোববার ‘ফক্স নিউজ সানডে’ অনুষ্ঠানে যুক্তরাষ্ট্র জানিয়ে দিয়েছে- আগামী ১ আগস্ট থেকেই নতুন শুল্ক কার্যকর হবে। এ বিষয়ে আর সময় বাড়ানো হবে না। দেশটির বাণিজ্যমন্ত্রী হাওয়ার্ড লাটনিক বলেন, ‘আর কোনো সময় নয়, আর কোনো ছাড় নয়। ১ আগস্ট থেকেই শুল্ক আদায় শুরু হবে। আমরা এগিয়ে যাবো।’ইতোমধ্যে যুক্তরাজ্য, জাপান, ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়া ও ভিয়েতনাম যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সমঝোতায় পৌঁছেছে। সর্বশেষ ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গেও একটি চুক্তির ঘোষণা দিয়েছেন ট্রাম্প। তবে বিশ্বের বেশিরভাগ দেশ এখনো কোনো চুক্তিতে পৌঁছাতে পারেনি। এই পাঁচটি দেশ যে হারে শুল্কে সম্মত হয়েছে, তা গত এপ্রিলে ঘোষিত ১০ শতাংশ ভিত্তি শুল্কের চেয়েও বেশি। তবে, যেসব দেশ এখনো চুক্তি করেনি, তাদের ওপর যেই মাত্রার শুল্ক আরোপের হুমকি দেওয়া হয়েছিল, তার তুলনায় এসব শুল্ক অনেকটাই কম।বাংলাদেশের পক্ষে বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীনের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল গতকাল সোমবার সন্ধ্যায় যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশ্যে ঢাকা ত্যাগ করেন। তারা ইউএসটিআরের (মার্কিন বাণিজ্য প্রতিনিধি দপ্তর) কর্মকর্তাদের সঙ্গে তিন দিনব্যাপী বৈঠকে বসবেন। আলোচনায় মার্কিন শুল্কহার, বাজারে প্রবেশাধিকার এবং আমদানি-রপ্তানির ভারসাম্য নিয়ে সরাসরি দরকষাকষি হবে।সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে, পাল্টা শুল্ক কমাতে বাংলাদেশ ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রকে কিছু কৌশলগত প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের বোয়িং কোম্পানি থেকে ২৫টি বিমান কেনার অর্ডার, প্রতিবছর ৭ লাখ টন গম আমদানির চুক্তি এবং তুলা ও সয়াবিন আমদানির পরিমাণ তিনগুণ বৃদ্ধির ঘোষণা। এছাড়া বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ৩০ কোটি ডলারের ভোজ্যতেল আমদানির পরিমাণ বাড়িয়ে ১০০ কোটি ডলারে উন্নীত করার প্রতিশ্রুতিও দেওয়া হয়েছে।এ বিষয়ে নানা কৌশলে বাণিজ্য সচিব মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘আমাদের ইমিডিয়েট কিছু এয়ারক্রাফট দরকার, আমাদের দুয়েক বছরের মধ্যে দরকার, হয়ত আমরা দুয়েক বছরের মধ্যে কিছু পাব। আমাদের বিমানের তো বহর বাড়াতে হবে। সেই পরিকল্পনা সরকারের বেশ আগে থেকেই ছিল। আমরা এ বছরে রেসিপ্রোকাল ট্যারিফ ইস্যুতে আবার নতুন করে এই আদেশগুলো দিয়েছি, আগে ১৪টা ছিল, পরে ২৫টা করেছি।’সাংবাদিকদের প্রশ্নে জবাবে সচিব বলেন, ‘বোয়িংয়ের ব্যবসাটা কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র সরকার করে না। বোয়িং কোম্পানি করে। আমরা ২৫টি বোয়িং কেনার জন্য অর্ডার দিয়েছি। এরকম অর্ডার ভারত দিয়েছে ১০০টা। ভিয়েতনাম দিয়েছে ১০০টা, ইন্দোনেশিয়া দিয়েছে ৫০টা। এরকম বিভিন্ন দেশ দিয়েছে। বোয়িং কোম্পানির ক্যাপাসিটি অনুযায়ী এগুলো সরবরাহ করবে। সুতরাং এগুলো সরবরাহ করতে তারা অনেক সময় নেবে।’কবে নাগাদ বাংলাদেশ উড়োজাহাজ পাবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ব্যবসার ধরন অনুযায়ী প্রথম আদেশ যারা দেয়, তাদেরটা আগে সরবরাহ করে। অথবা প্রতিষ্ঠানের নিয়ম অনুযায়ী সরবরাহ করে।’যুক্তরাষ্ট্র থেকে কৃষিপণ্য আমদানি বাড়ানোর উদ্যোগের কথা জানিয়ে সচিব বলেন, ‘আপনারা জানেন যে আমরা গম ক্রয়ের জন্য তাদের সাথে চুক্তি করেছি। আমাদের সয়াবিন যারা আমদানি করে, ওইটা প্রাইভেট সেক্টরে, তারাও প্রচেষ্টা নিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র থেকে অধিক হারে সয়াবিন আমদানি করার চিন্তা করছে। সেজন্য তারা বসবে। আমরা যখন ইউএসটিআরের সঙ্গে আলোচনায় বসব, তখন আমাদের ব্যক্তিখাতের যে ব্যবসায়ীরা, তারাও বসবেন ওই সমস্ত অ্যাসোসিয়েশনের সঙ্গে। আশা করি যে সেখানে তাদের মধ্যেও একটা সমঝোতা হবে।’বাণিজ্যসচিব আরও বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের দেওয়া প্রতিটি অনুচ্ছেদের জবাব আমরা দিয়েছি। এখন সময় এসেছে সরাসরি আলোচনার। চীনের বাজার থেকে সরিয়ে নেওয়া কিছু উৎপাদন বাংলাদেশে আসার সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছে, সেটি ধরতে চাই।’আশাবাদী নন ব্যবসায়ী নেতা ও অর্থনীতিবিদরাসম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র থেকে পণ্য কেনার এসব চুক্তিকে শুল্ক আলোচনার ‘উদ্দীপক’ হিসেবে সরকার মনে করলেও ততটা আশাবাদী নয় বেসরকারি খাত, অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞরা। তারা মনে করছেন, দরকষাকষিতে বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে। দুই দফায় আনুষ্ঠানিক বৈঠক করলেও মাঝখানে সরকার কিছু সময় নষ্ট করেছে। এ কারণে সরকারের উদ্যোগ নিয়ে রপ্তানিকারকদের মধ্যে হতাশা তৈরি হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র শেষ পর্যন্ত শুল্ক না কমালে ক্ষতি মুখে পড়বে সামগ্রিক রপ্তানি খাত।তৈরি পোশাকখাতের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি মাহমুদ হাসান খান বলেন, ‘সরকার কিছু উদ্যোগ নিচ্ছে। তবে এটি পরিষ্কারভাবে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে তুলে ধরার জন্য লবিস্ট নিয়োগ দেওয়ার কথা ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল। কিন্ত আগে সেটা না করে শেষ মুহূর্তে অনানুষ্ঠানিকভাবে লবিস্ট নিয়োগ করতে চাওয়া হয়েছিল। কাজটি করতে দেরি হওয়ায় এখন সেটি হয়নি।’স্নোটেক্স গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এসএমএম খালেদ বলেন, ‘যদি শুল্কহার প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলোর সঙ্গে সমতাভিত্তিক হয়, তাহলে বাংলাদেশ এখনো টিকে থাকার সুযোগ পাবে। কিন্তু তার জন্য সময় খুবই সীমিত। এখনই সরকারের পক্ষ থেকে কঠোর ও দৃশ্যমান কূটনৈতিক প্রচেষ্টা না চালালে দেশের সবচেয়ে বড় রপ্তানি খাতের ভিত্তি নড়ে যেতে পারে।’পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি মাহমুদ হাসান খান বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দরকষাকষিটা চালু রাখতে আমরা লবিস্ট নিয়োগ করতে চাই। লবিস্ট নিয়োগপ্রক্রিয়া শেষ করতে সাত দিন লেগে যেতে পারে। দেশ থেকে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (পিআরআই) এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে।’বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রির (বিসিআই) সভাপতি আনোয়ার-উল-আলম চৌধুরী লবিস্ট নিয়োগের ব্যাপারে ভরসা না পাওয়ার কথা জানালেন। তিনি বলেন, লবিস্ট কোনো সংগঠনের জন্য কাজ করবে না, করবে দেশের জন্য। লবিস্ট নিয়োগ করতে গেলে সরকারের অনুমোদন লাগবে। আর এনডিএ থাকার কারণে সরকার তা চাইবে না। ফলে এ ব্যাপারে আশা কম।বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান বলেন, বাংলাদেশের দরকষাকষির অভিজ্ঞতা নেই। পাল্টা শুল্ক বিষয়ে অন্য দেশের তুলনায় আমাদের দরকষাকষি হতাশ করেছে। যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে পাল্টা শুল্ক আরোপ করেছে তাতে বোঝা যায়, তারা ডব্লিউটিও’র নিয়ম খুব একটা মেনে চলছে না।সিপিডি’র সম্মাননীয় ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, পাল্টা শুল্ক নিয়ে সরকার ভেবেছিল, আলাপ-আলোচনা করে সমাধান করে ফেলবে। এ নিয়ে সরকারের এক ধরনের কৃতিত্ব নেওয়ার মানসিকতা ছিল। দরকষাকষির সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যক্তিরা ভেবেছিলেন, পাল্টা শুল্ককে ১০ শতাংশ বা শূন্য শতাংশে নামিয়ে আনতে পারবেন। সরকারি পর্যায়ে এমন আত্মবিশ্বাস ও অতি আত্মবিশ্বাসের খেসারত দিচ্ছি।তিনি বলেন, আমাদের প্রতিযোগী দেশগুলো শুল্ক আলোচনায় কোন অবস্থায় থাকছে, সেটি আমাদের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এ বিষয়ে খেয়াল রাখতে হবে। পাশাপাশি অশুল্ক বাধা ও ভূ-রাজনৈতিক কৌশলের নানা ইস্যু আছে। সেখানে আমাদের সার্বভৌমত্ব, অন্য দেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক- এসব আমরা কতটুকু করতে পারব, কতটুকু পারব না, তা-ও বিবেচনায় আনতে হবে।ভোরের আকাশ/এসএইচ