তাকী মোহাম্মদ জোবায়ের
প্রকাশ : ১৯ মে ২০২৫ ০৮:৩৪ এএম
ভারতের আমদানি বিধিনিষেধ, বিপাকে রপ্তানিকারকরা
ভারত স্থলবন্দর দিয়ে সাতটি পণ্য আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করায় বাংলাদেশের রপ্তানি খাতে জটিলতা সৃষ্টির পাশাপাশি দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্কের টানাপোড়েনও প্রকাশ্যে এসেছে। এটিকে পাল্টাপল্টি পদক্ষেপ হিসেবে দেখছেন বিশ্লেষকরা যেটি ভারতের তরফ থেকেই শুরু হয়েছিল। কোনো পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই গত মাসের শুরুতে তৃতীয় দেশে রপ্তানি পণ্য পাঠানোর ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে দেওয়া ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা প্রত্যাহার করে নিয়েছিলো দেশটি। এমনকি এর কোনো কারণও ব্যাখ্যা করেনি, যেটি অনুসৃত কূটনৈতিক শিষ্টাচারের মধ্যে পড়ে। এর কিছুদিনের মধ্যে বাংলাদেশ স্থলবন্দর দিয়ে ভারতীয় সূতা আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা ঘোষণা করে।
এরপর গত শনিবার ভারতের শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এক আদেশে বাংলাদেশের সাত ধরনের পণ্য স্থলবন্দর দিয়ে আমদানি বন্ধের নির্দেশ দিয়েছে। ভারত থেকে বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের অর্ধেকই আসে এই পণ্যগুলো থেকে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই সংকটের সমাধান কূটনৈতিক আলোচনার মাধ্যমেই সম্ভব।
ভারতের এই নিষেধাজ্ঞার কারণে দেশটিতে বাংলাদেশের রপ্তানিকারকরা প্রতিযোগিতা সক্ষমতা হারিয়ে বাজার হারানোর আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। পাশাপাশি দেশটির সঙ্গে বাণিজ্যঘাটতি আরও বড় হওয়ার শঙ্কা থেকে বিশেষজ্ঞরা পরামর্শ দিয়েছেন, ভারত থেকে যেসব পণ্য আমদানি করা হয় সেগুলোর বিকল্প উৎস খুঁজে বের করার জন্য।
বাংলাদেশ গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ভারতে ১৫৭ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে। বিপরীতে ভারত থেকে আমদানি করেছে ৯০০ কোটি মার্কিন ডলারের পণ্য। প্রতিবেশী দেশটির সঙ্গে বিদ্যমান বাণিজ্যঘাটতির পরিমাণ ৭৪৩ কোটি ডলার বা ৯০ হাজার ৬৫০ কোটি টাকা।
এই নিষেধাজ্ঞার ফলে ভারতে বাংলাদেশের রপ্তানি কমে যাবে বলে জানিয়েছেন বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন। তিনি বলেন, ধারণা করা হচ্ছে- বাংলাদেশ সমুদ্র ও স্থলবন্দর দিয়ে ভারতীয় সুতা আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপের পর এ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে ভারত।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলছেন, বিষয়টি নিতান্তই অর্থনৈতিক নয় বরং এতে দুই দেশের সম্পর্কের টানাপোড়েনের প্রতিফলন ঘটেছে। ফলে এ সংকটের সমাধান রাজনৈতিকভাবেই করতে হবে বলে তিনি উল্লেখ করেছেন।
অর্থনীতি বিশ্লেষক মো. মাজেদুল হক ভোরের আকাশকে বলেন, নতুন বিধিনিষেধে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্যঘাটতি আরও বাড়বে তাতে সন্দেহ নেই। তাই দেশটির সঙ্গে বাণিজ্যঘাটতি কমানো ও খাদ্য নিরাপত্তার স্বার্থে এখুনি বিকল্প উৎসের সন্ধান করতে হবে বাংলাদেশকে। পাশাপাশি অর্থনৈতিক কূটনীতির মাধ্যমে দুই দেশের সমস্যা সমাধানের কথা বলেছেন তিনি।
ভারতের শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন ডিরেক্টরেট জেনারেল অব ফরেন ট্রেড (ডিজিএফটি) শনিবার যে বিধিনিষেধ আরোপ করেছে তাতে বলা হয়েছে, কোনো স্থলবন্দর দিয়ে বাংলাদেশ থেকে কোনো ধরনের পোশাক পণ্য ভারতে ঢুকতে পারবে না।
এছাড়া এই আদেশে ফল, ফলের-স্বাদযুক্ত পানীয় ও কার্বোনেটেড ড্রিংকস; বেকারি, চিপস, ন্স্যাকস এবং কনফেকশনারিতে তৈরি প্রক্রিয়াজাত খাবার; তুলা ও সুতার ঝুট; পিভিসিসহ বিভিন্ন প্লাস্টিক পণ্য এবং কাঠের তৈরি আসবাবপত্র আসাম, মেঘালয়, ত্রিপুরা, মিজোরাম এবং পশ্চিমবঙ্গের চেংড়াবান্ধা ও ফুলবাড়ী দিয়ে ভারতের আমদানি বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। তবে মাছ, এলপিজি, ভোজ্যতেল ও পাথর আমদানি বহাল রেখেছে দেশটি।
সেসঙ্গে ভারতের ওপর দিয়ে ভুটান ও নেপালে বাংলাদেশি পণ্যের রপ্তানিও অব্যাহত থাকার কথা জানিয়েছে তারা। তাছাড়া তৈরি পোশাক এখন থেকে কেবল কলকাতা ও মুম্বাইয়ের নভসেবা সমুদ্রবন্দর দিয়ে ভারতে প্রবেশ করতে পারবে। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশ থেকে ভারতে সবচেয়ে বেশি রপ্তানি হয় তৈরি পোশাক।
গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ভারতে ৫৪ কোটি ৮৮ লাখ ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি করেছেন বাংলাদেশের উদ্যোক্তারা। ভারত স্থলপথে বাংলাদেশ থেকে তৈরি পোশাক আমদানি নিষিদ্ধ করায় এক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা করছেন বাংলাদেশের রপ্তানিকারকেরা। এছাড়া ভারতের নতুন বিধিনিষেধের কারণে কৃষি প্রক্রিয়াজাত খাদ্য রপ্তানিতে বড় ধরনের প্রভাব পড়বে বলে বলছেন খাতটির রপ্তানিকারকরা।
গত অর্থবছর ভারতে ১৫ কোটি ৬৮ লাখ ডলারের কৃষি প্রক্রিয়াজাত পণ্য রপ্তানি হয়েছে। এছাড়া গত অর্থবছর বাংলাদেশ থেকে ভারতে ৪ কোটি ৪০ লাখ ডলারের প্লাস্টিক পণ্য, ৩ কোটি ১৩ লাখ ডলারের তুলা ও তুলার সুতার ঝুট ও ৬৫ লাখ ডলারের আসবাব রপ্তানি হয়। এসব পণ্যের অধিকাংশই স্থলবন্দর ব্যবহার করে রপ্তানি হয়ে আসছে।
এদিকে গত বছর বাংলাদেশ থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ৩৮ বিলিয়ন ডলারের পোশাক রপ্তানি করা হয়েছে। এর মধ্যে এক বিলিয়ন ডলারের বেশি পণ্য রপ্তানি হয়েছে ভারতের বন্দর ব্যবহার করে, যা ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধার আওতায় পেয়েছিলো বাংলাদেশ।
বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা বিশেষ করে পোশাক খাতের ব্যবসায়ীরা বলছেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভারতে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানি বাড়ছিলো। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর হিসাবে দেখা গেছে, চলতি অর্থবছরের ১০ মাসেই গত বছরের পুরো রপ্তানির পরিমাণ ছাড়িয়ে গেছে। ভারতে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে ১৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে।
এছাড়া সেভেন সিস্টার্স হিসেবে পরিচিত উত্তরপূর্ব ভারতের রাজ্যগুলোতেও বাংলাদেশি পণ্যের বাজার সম্প্রসারিত হয়েছে। এই রাজ্যগুলোকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন কোম্পানি নতুন বিনিয়োগের পরিকল্পনাও করছিলেন। এখন ভারতের নতুন বিধিনিষেধে এর দুটিই ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে ধারণা করছেন ব্যবসায়ীদের অনেকে। কারণ তৈরি পোশাকস্থল বন্দরের পরিবর্তে সমুদ্রবন্দর দিয়ে পাঠাতে হলে খরচ ও সময় দুটি বেশি লাগবে।
তৈরি পোশাক শিল্পের মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সাবেক পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল ভোরের আকাশকে বলেন, আসলে যা হচ্ছে সেটি কোনো দেশের জন্যই ভালো হচ্ছে না। ব্যবসার জায়গাটা ব্যবসায়ের মতো রাখা উচিত। এতে উভয় দেশের অর্থনীতির জন্যই ভালো। দুই দেশের রাজনৈতিক দূরত্বের প্রভাব ব্যবসায়ীদের ওপর আসা উচিত নয়।
তিনি বলেন, সরকারের দায়িত্ব ব্যবসায়ীদের জন্য পরিবেশ তৈরি করে দেওয়া। দুই দেশের সমস্যা কীভাবে সমাধান করা হবে সেটি রাজনীতিবিদ ও সরকারের দায়িত্বশীলরাই ঠিক করবেন।
এদিকে বিজিএমইএর সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট ফয়সাল সামাদ বলেছেন, ভারতের এ সিদ্ধান্তে উভয় দেশের জন্যই ক্ষতির কারণ হবে। স্থলবন্দর দিয়ে পণ্য পাঠালে আমাদের খরচ ও সময় কম লাগে। সমুদ্রবন্দর ব্যবহার করে পণ্য পাঠালে ব্যয় বাড়বে, আবার সময়ও অনেক বেশি লাগবে। কিন্তু এতে যে শুধু আমাদের ক্ষতি হবে তা নয়, ভারতীয় আমদানিকারকদেরও তো খরচ বাড়বে।
ওদিকে বাংলাদেশের অন্তর্র্বর্তী সরকারের বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন গতকাল ঢাকায় সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, নতুন বিধিনিষেধের বিষয়টি ভারত এখনো বাংলাদেশ সরকারকে আনুষ্ঠানিকভাবে জানায়নি। তবে ভারতই বাংলাদেশে বেশি রপ্তানি করে বলে স্থলবন্দরকেন্দ্রিক বিধিনিষেধে বাংলাদেশের চেয়ে ভারতীয় ব্যবসায়ীরাই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। অবশ্য আলোচনার মাধ্যমে সমস্যাটির সমাধান করা সম্ভব বলেও তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
ভারতের নতুন বিধিনিষেধের কারণে বেশি বিপাকে পড়বেন সেভেন সিস্টার্স নামে খ্যাত ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যে রপ্তানিকারকরা। কারণ, ওইসব রাজ্যে এসব পণ্য পাঠাতে প্রথমে কলকাতা পাঠাতে হবে। পরে পুরো বাংলাদেশের সীমান্ত ঘুরে আসাম, মেঘালয়, করিমগঞ্জ ও আগরতলায় যাবে পণ্যের চালান।
নতুন ব্যবস্থায় সেভেন সিস্টার্সের ওইসব পণ্য স্থলপথে পাঠাতে হলে সাতক্ষীরার ভোমরা ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের সোনামসজিদ স্থলবন্দরই ভরসা। এর মানে, ফলের ড্রিংকস, কার্বোনেটেড ড্রিংকস, বিস্কুট, কেক, চিপস, স্ন্যাকস এসব পণ্য আসাম, ত্রিপুরা, মেঘালয়ে পাঠাতে হলে প্রথমে পণ্যের চালান পশ্চিমবঙ্গে তথা কলকাতা যাবে।
পরে কলকাতা থেকে সড়ক বা রেলপথে প্রায় ১ হাজার ২০০ কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে ওই পণ্য যেতে হবে ত্রিপুরার আগরতলায়। অবশ্য আসামের গুয়াহাটি, করিমগঞ্জ কিংবা মেঘালয়ের শিলংয়ে পণ্যের চালান পাঠাতে আরও কম পথ পাড়ি দিতে হবে।
এছাড়া সমুদ্রপথে পণ্য পাঠাতে হলে চট্টগ্রাম বন্দর বা মোংলা বন্দর থেকে কলকাতার হলদিয়া বন্দরে পাঠাতে হবে। তারপর সেখান থেকে সেভেন সিস্টার্স রাজ্যে নিয়ে যেতে হবে।
এদিকে ভারতের এই সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের রপ্তানিকারকদের জন্য চ্যালেঞ্জ তৈরি করলেও, এটি দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য ও কূটনৈতিক সম্পর্কের গতিপথ নির্ধারণ করবে বলেও মন্তব্য করেছেন বিশ্লেষকরা। তারা বলেছেন, বাণিজ্য বৈচিত্র্য ও কূটনৈতিক আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করতে হবে।
ভোরের আকাশ/এসএইচ