শুল্ক সিদ্ধান্তে অটল ট্রাম্প
নিখিল মানখিন
প্রকাশ : ০৮ এপ্রিল ২০২৫ ১১:০২ এএম
দেশে দেশে অস্থিরতা
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের আরোপ করা শুল্কের প্রভাবে টালমাটাল বিশ্ব। বেড়েছে অস্থিরতা। শোনা যাচ্ছে বাণিজ্যযুদ্ধের পদধ্বনি। বইছে সমালোচনার ঝড়। শঙ্কায় রয়েছেন রপ্তানিকারক ও শিল্প উদ্যোক্তারা। ধস নেমেছে খোদ যুক্তরাষ্ট্রসহ অনেক দেশের শেয়ারবাজারে। অর্ধ শতাধিক দেশের পুনর্বিবেচনার আকুতির পাশাপাশি ঘটছে পাল্টা শুল্কারোপের ঘটনা। পাল্টা শুল্ক তিন মাস স্থগিতের অনুরোধ করে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে চিঠি দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ক্রয়াদেশ স্থগিত শুরু করেছে যুক্তরাষ্ট্রের অনেক প্রতিষ্ঠান।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, একের পর এক সভা করে পরিস্থিতি সামাল দেয়ার হিসেব-নিকেষ কষতে ব্যস্ত অনেক দেশ। কিন্তু আরোপিত শুল্কে ট্রাম্পের অটল অবস্থান অনেক দেশের এই হিসেব-নিকেষ জটিল করে তুলছে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে পড়বে দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব। আরোপিত শুল্ক থেকে সরে আসতে নারাজ ডোনাল্ড ট্রাম্প।
ইতোমধ্যে ৫০টি দেশ বাণিজ্যিক সম্পর্ক নিয়ে আলোচনার জন্য হোয়াইট হাউসে ধর্ণা দিয়েছে বলে একাধিক আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন ট্রাম্পের এক শীর্ষ অর্থনৈতিক উপদেষ্টা। এমনিতেই মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের শুল্ক পাল্টা শুল্ক ঘোষণার পর রীতিমতো কাঁপতে শুরু করেছে বিশ্ব অর্থনীতি। আর কাউকে ছাড় দেবে না যুক্তরাষ্ট্র ট্রাম্পের এমন ঘোষণা সামরিক যুদ্ধের চেয়েও ভয়াবহ অর্থনীতি ‘যুদ্ধ’র ইঙ্গিত মিলছে।
করোনাকালে বিশ্ব অর্থনীতি মন্দার কবলে পড়েছিল। সেই নাজুক পরিস্থিতি সামলাতে না সামলাতেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বৈশ্বিক অর্থনীতিকে নাজুক করে তোলে। অর্থনীতির এই ক্ষতের মধ্যেই আমদানি করা সব পণ্যে ১০ শতাংশ বেজলাইন ট্যারিফ বা ন্যূনতম শুল্ক আরোপ করেছে ট্রাম্প প্রশাসন। দেশভেদে এই হার ওঠানামা করছে। বেশ কয়েকটি দেশের ক্ষেত্রে এই শুল্ক হার ৫০ শতাংশের ওপর চলে যাচ্ছে। বাংলাদেশি পণ্যের ওপরে ৩৭ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। আগে এ হার ছিল ১৫ শতাংশ।
গত বুধবার যুক্তরাষ্ট্রের স্থানীয় সময় বিকেল চারটায় হোয়াইট হাউসে সংবাদ সম্মেলনে নতুন এ শুল্ক আরোপের ঘোষণা দেন তিনি। কোন দেশের ওপর কত হারে পারস্পরিক শুল্ক আরোপ হবে, সংবাদ সম্মেলনে তার একটি তালিকা তুলে ধরেন ট্রাম্প। তার যুক্তি, নতুন এই ‘রিসিপ্রোকাল ট্যারিফ’ বা পাল্টা শুল্ক ব্যবস্থা যুক্তরাষ্ট্রকে ‘আবার সম্পদশালী’ করবে। ধারণা করা হচ্ছে, নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে প্রায় ১০০টি দেশের ওপর আরোপ করা এই শুল্ক বিশ্বব্যাপী অর্থনীতিতে বড় ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে।
বাংলাদেশ ট্রাম্প-শুল্ক প্রভাব : যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের পাল্টা শুল্কের কারণে বিশ্ববাণিজ্য এখন টালমাটাল। এতে বাংলাদেশের প্রায় এক হাজার রপ্তানিকারকের কপালেও দুশ্চিন্তার ভাঁজ তৈরি হয়েছে। নতুন শুল্কের কারণে পণ্যের চাহিদা কমলে কিংবা ক্রয়াদেশ অন্যত্র স্থানান্তরিত হলে দেশের বিপুলসংখ্যক প্রতিষ্ঠান ক্ষতির মুখে পড়তে পারে। এসব প্রতিষ্ঠানের অধিকাংশই তৈরি পোশাক কারখানা।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, সর্বশেষ ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশের ৭ হাজার ৫৬১টি প্রতিষ্ঠান বিশ্বের ২১২টি দেশে পণ্য রপ্তানি করেছে। প্রচ্ছন্ন ও নমুনা পণ্য বাদে মোট রপ্তানি হয়েছে ৪ হাজার ২৬৯ কোটি মার্কিন ডলারের পণ্য। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে ৭৬৬ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে ২ হাজার ৩২৬টি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান।
যুক্তরাষ্ট্রে পণ্য রপ্তানি করে বাংলাদেশের এমন প্রায় এক হাজার প্রতিষ্ঠান কতটা সংকটে আছে, সেটি এবার পর্যালোচনা করে দেখা যাক। সে দেশে পণ্য রপ্তানিকারক ২ হাজার ৩২৬ প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ৯৫৭টিই করেছে মোট রপ্তানির এক-চতুর্থাংশের বেশি। গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাজারটিতে এসব প্রতিষ্ঠানের সম্মিলিত রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৫৯৫ কোটি ডলার। ফলে ৩৭ শতাংশ পাল্টা শুল্কের প্রভাবে যুক্তরাষ্ট্র থেকে রপ্তানি ক্রয়াদেশ কমলে এসব প্রতিষ্ঠান বড় ধরনের ব্যবসায়িক ক্ষতির মুখে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
এই ৯৫৭ প্রতিষ্ঠানের ঝুঁকি আবার সমান নয়-কারও বেশি, কারও কম। তবে উচ্চ ঝুঁকিতে আছে ২৮০টি প্রতিষ্ঠান। কারণ, তারা নিজেদের উৎপাদিত শতভাগ পণ্যই যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে রপ্তানি করে। যদিও তাদের সম্মিলিত রপ্তানির পরিমাণ কম, মাত্র ৩৫ কোটি ডলার। উচ্চ মধ্যম ঝুঁকিতে রয়েছে ২৩৬টি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান। তাদের মোট রপ্তানির ৭৬-৯৯ শতাংশের গন্তব্যই যুক্তরাষ্ট্র। গত অর্থবছর এই প্রতিষ্ঠানগুলোর সম্মিলিত রপ্তানির পরিমাণ ছিল ২২৭ কোটি ডলার। যদি বাংলাদেশি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোকে চীন বা ভিয়েতনামের রপ্তানিকারকদের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হয়, তাহলে কিছুটা সুবিধা পাওয়া যেতে পারে। আবার ভারত-পাকিস্তানের সঙ্গে হলে ঝুঁকি থাকবে।
বাংলাদেশি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোর নেতারা জানান, তুলনামূলক কম ঝুঁকিতে আছে এক হাজার ৩৬৯ রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান। তাদের অবশ্য মোট রপ্তানি পণ্যের ১-২৫ শতাংশের গন্তব্য যুক্তরাষ্ট্র। গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এসব প্রতিষ্ঠানের সম্মিলিত রপ্তানির পরিমাণ ছিল ১৮২ কোটি ডলার। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের মোট পণ্য রপ্তানির ৮৭ শতাংশই ছিল তৈরি পোশাক; যার মূল্য ৬৬৯ কোটি মার্কিন ডলার। ১ হাজার ৮১০টি প্রতিষ্ঠান গত অর্থবছর যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি পোশাক রপ্তানি করেছে। এ জন্যই ট্রাম্পের পাল্টা শুল্ক নিয়ে পোশাকশিল্পেই দুশ্চিন্তা বেশি।
তৈরি পোশাকের পর যুক্তরাষ্ট্রে দ্বিতীয় প্রধান রপ্তানি খাত হচ্ছে ক্যাপ। গত অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে সে দেশে ৩৩ কোটি ডলারের ক্যাপ রপ্তানি হয়েছে। এর মধ্যে শুধু যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি হয়েছে ২২ কোটি ৫২ লাখ ডলারের পণ্য। তার মানে মোট ক্যাপ রপ্তানির ৬৮ শতাংশের গন্তব্য যুক্তরাষ্ট্র। এই বাজারে পণ্য রপ্তানিতে তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে চামড়ার জুতা।
গত অর্থবছরে দেশ থেকে সব মিলিয়ে চামড়ার জুতা রপ্তানি হয় প্রায় ৫৫ কোটি ডলারের। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে চামড়ার জুতা রপ্তানি হয়েছে ১৮ কোটি ডলারের জুতা। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রে শীর্ষ রপ্তানি পণ্যের মধ্যে রয়েছে হোমটেক্সটাইল, পরচুলা, জুতা ছাড়া চামড়াজাত পণ্যসামগ্রী। এদিকে, ঢাকার সাভারের এসেন্সর ফুটওয়্যার অ্যান্ড লেদার প্রোডাক্টস নামের প্রতিষ্ঠান চলতি সপ্তাহে তিন লাখ মার্কিন ডলারের চামড়ার ব্যাগ যুক্তরাষ্ট্রে পাঠাতে জাহাজীকরণের প্রস্তুতি নিচ্ছিল। কিন্তু গত রোববার সকালে ক্রেতা প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা বার্তা পাঠিয়ে পণ্য জাহাজীকরণ না করার নির্দেশনা দেন। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন এসেন্সর ফুটওয়্যার অ্যান্ড লেদার প্রোডাক্টসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) কে এম মুশফিকুর রহমান।
বিশ্বপরিস্থিতি : বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনসমূহ বলছে, যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাংকিং জায়ান্ট জেপি মরগান ভবিষ্যদ্বাণী করেছে যে ট্রাম্পের শুল্ক ঘোষণার পর যুক্তরাষ্ট্র এবং বৈশ্বিক মন্দার আশঙ্কা ৬০ শতাংশ। এই অস্থিরতার বিষয়ে প্রশ্ন করলে মার্কিন বাণিজ্যমন্ত্রী হাওয়ার্ড লুটনিক রোববার সিবিএস নিউজকে জানান, ‘সব ধরনের আমদানির উপর ১০ শতাংশ ‘বেসলাইন’ শুল্ক, যা একদিন আগে কার্যকর হয়েছে, তা সামনের দিনগুলোতে অবশ্যই বহাল থাকবে।’
তালিকায় থাকা প্রায় ৬০টি দেশের উপর উচ্চতর শুল্ক ৯ এপ্রিল থেকে কার্যকর হওয়ার কথা রয়েছে। এই শুল্ক সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে, লুটনিক বলেন, সবকিছুই কার্যকর হবে। তিনি (ট্রাম্প) যা ঘোষণা করেছেন তার সবই বাস্তবায়ন হবে এবং তিনি রসিকতা করে কিছু করেননি।
ট্রাম্পের এক শীর্ষ অর্থনৈতিক উপদেষ্টা কেভিন হ্যাসেটও দাবি করেছেন যে ৫০টিরও বেশি দেশ আলোচনা শুরু করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছে। অন্যদিকে, ইন্দোনেশিয়া এবং তাইওয়ান বলেছে যে যুক্তরাষ্ট্র ওই দুই দেশ থেকে আমদানির ওপর ৩২ শতাংশ শুল্ক আরোপের ঘোষণা দেওয়ার বিপরীতে প্রতিশোধমূলক পাল্টা শুল্ক আরোপ করবে না তারা।
সংবাদ সংস্থা এএফপি এবং নিউ ইয়র্ক টাইমসের একটি চিঠি অনুসারে, ভিয়েতনামের নেতা, টো ল্যাম, ট্রাম্পকে অনুরোধ করেছেন, যেন যুক্তরাষ্ট্রে ভিয়েতনামী পণ্য রপ্তানির ওপর ৪৬ শতাংশ শুল্ক আরো অন্তত ৪৫ দিন পর আরোপ করা হয়। এক কথায় তিনি শুল্ক আরোপ বিলম্বিত করতে বলেছেন। তবে, চীন শুক্রবার ঘোষণা করেছে যে তারা বৃহস্পতিবার থেকে সমস্ত মার্কিন পণ্য আমদানির ওপর ৩৪ শতাংশ শুল্ক আরোপ করবে।
যুক্তরাজ্যের ডাউনিং স্ট্রিটের এক মুখপাত্র বলেছেন, স্টারমার এবং কানাডার নতুন প্রধানমন্ত্রী মার্ক কার্নি এক ফোনালাপে একমত হয়েছেন ‘একটি সর্বাত্মক বাণিজ্য যুদ্ধ কারো জন্যই লাভজনক নয়’। সোমবার ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ওয়াশিংটন ডিসিতে বাণিজ্য আলোচনার জন্য ট্রাম্পের সাথে দেখা করবেন বলে আশা করা হচ্ছে।
ট্রাম্পের শুল্কারোপের প্রভাব এরইমধ্যে বিশ্ববাজারে পড়তে শুরু করেছে। ট্রাম্পের পাল্টা শুল্কের ঘোষণায় দেশে দেশে শেয়ারবাজারে ধস নেমেছে। যুক্তরাষ্ট্রসহ তাইওয়ান, দক্ষিণ কোরিয়া, চীন, জাপান, অস্ট্রেলিয়া, ভিয়েতনামের মতো দেশের শেয়ারবাজার ধাক্কা খেয়েছে বড়সড়। যুক্তরাষ্ট্রের শেয়ার সূচক নাসডাক ফিউচার্সের পতন হয়েছে ৩ দশমিক ৩ শতাংশ। প্রযুক্তি খাতের বড় ৭টি প্রতিষ্ঠানের বাজার মূলধন কমেছে ৭৬০ বিলিয়ন বা ৭৬ হাজার কোটি ডলার। অ্যাপলের আইফোনের সিংহভাগ উৎপাদিত হয় চীনে। অ্যাপলের শেয়ারের দাম কমেছে ৭ শতাংশ।
এছাড়া ট্রাম্পের ঘোষণার জেরে এসঅ্যান্ডপি ৫০০ ফিউচার্স কমেছে ২ দশমিক ৭ শতাংশ, এফটিএসই ফিউচার্স কমেছে ১ দশমিক ৬ শতাংশ, ইউরোপিয়ান ফিউচার্স কমেছে প্রায় ২ শতাংশ। টোকিওর নিক্কেই (টোকিও স্টক এক্সচেঞ্জের স্টক মার্কেট সূচক) প্রাথমিকভাবে ৩ দশমিক ৯ শতাংশ কমে যায়।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে শহরগুলোতে ট্রাম্পবিরোধী বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়েছে, যা জানুয়ারিতে প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নেওয়ার পর দেশব্যাপী সবচেয়ে বড় প্রতিবাদ হিসেবে দেখা হচ্ছে। বস্টন, শিকাগো, লস অ্যাঞ্জেলেস, নিউইয়র্ক এবং ওয়াশিংটন ডিসিসহ বিভিন্ন শহরে কয়েক লক্ষ মানুষ বিক্ষোভে অংশ নেয়। তারা সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিভিন্ন ইস্যুতে ট্রাম্পের নীতির বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
বেশি ভুগবে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো : প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প শতাধিক দেশের পণ্যে উচ্চহারে যে শুল্কারোপের ঘোষণা দিয়েছেন, তাতে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়বে বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন। কারণ এ অঞ্চলের অনেক দেশেরই পণ্য রপ্তানির শীর্ষ গন্তব্য যুক্তরাষ্ট্র।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা সংস্থা দ্য উইলসন সেন্টারের দক্ষিণ এশিয়া ইনস্টিটিউট পরিচালক মাইকেল কুগেলম্যান সিএনএনকে বলেন, বিশ্বের সব চেয়ে জনবহুল দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে দক্ষিণ এশিয়ার ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কা। এ দেশগুলো নানা রকমের অর্থনৈতিক চাপের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। এ অঞ্চলের প্রচুর দুর্বলতা রয়েছে। ফলে ট্রাম্প প্রশাসনের চড়া শুল্ক দারুণভাবে আঘাত করবে।
সংবাদমাধ্যমটি লিখেছে, দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে শ্রীলঙ্কার ওপর সবচেয়ে বেশি ৪৪ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। দেশটি এখনও আর্থিক সংকট কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছে, যে সংকটের কারণে ২০২২ সালের মাঝামাঝিতে আন্দোলন বিক্ষোভের মধ্যে দিয়ে পতন হয় গোটাবায়া রাজাপাকসে সরকারের। দেশটি এখনও নির্ভর করছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণ প্যাকেজের ওপর।
নয়াদিল্লির ‘কাউন্সিল ফর সোশ্যাল ডেভেলপমেন্টের’ অধ্যাপক বিশ্বজিৎ ধর সিএনএন’কে বলেন, বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কার পণ্য যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশে বাধা পেলে মারাত্মক প্রভাব পড়বে। ভারতের ক্ষমতাসীন দলের রাজনীতিবিদ ও ‘কনফেডারেশন অফ অল ইন্ডিয়া ট্রেডার্সের’ প্রধান প্রবীণ খান দেলওয়াল বলেন, আমেরিকা ও ভারতের বাণিজ্যে কীভাবে শুল্কের প্রভাব কমিয়ে আনা যায়, সেজন্য সরকার ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলবে।
সম্প্রতি ভূমিকম্পে বিপর্যস্ত মিয়ানমারের ওপরও ৪৪ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। বাংলাদেশের পার্শ্ববর্তী এ দেশটিতে চার বছর ধরে গৃহযুদ্ধ লেগে আছে। ভূমিকম্পে ৩ হাজারের বেশি মানুষের প্রাণহানির মধ্যেই সরকারি বাহিনী বিদ্রোহীদের ওপর বিমান হামলা চালিয়েছে।
সিএনএন জানিয়েছে, সর্বনিম্ন ১০ শতাংশ শুল্কের চেয়েও বেশি আরোপ করা হয়েছে দুর্দশাগ্রস্ত পাঁচটি দেশের পণ্যের ওপর। এর মধ্যে ডিআর কঙ্গো ১১ শতাংশ, মাদাগাস্কার ৪৭ শতাংশ, মোজাম্বিক ১৬ শতাংশ, মালাউই ১৮ শতাংশ ও সিরিয়া ৪১ শতাংশ। বিশ্বের সবেচেয় দারিদ্র্য ২৬টি দেশের মধ্যে রয়েছে এ পাঁচটি দেশ। বিশ্ব ব্যাংকের হিসাবে, এই দেশগুলো বৈশ্বিক অর্থনীতির মাত্র ০.৫ শতাংশ। কিন্তু বিশ্বের মোট গরিবের ৪০ শতাংশই রয়েছে এ পাঁচটি দেশে। দক্ষিণ আফ্রিকা উপকূলের মাদাগাস্কারে আড়াই কোটি মানুষের বাস। সেখানকার ৮০ শতাংশের বেশি মানুষ চরম দারিদ্র্য, যাদের আয় দৈনিক ২ দশমিক ১৫ ডলারের কম। এ দেশটির দ্বিতীয় বড় রপ্তানি বাজার হলো যুক্তরাষ্ট্র। ২০২৪ সালে মাদাগাস্কার যুক্তরাষ্ট্রে ৮০ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি করে, যার মধ্যে রয়েছে ভ্যানিলা, পোশাক, টাইটেনিয়াম ও কোবাল্ট।
ভেনিজুয়েলারও সবথেকে বড় বাণিজ্য অংশীদার যুক্তরাষ্ট্র। অর্থ সংকট ও মানবিক বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে যাওয়া এ দেশটির ওপরও ট্রাম্প প্রশাসন ১৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছে। যুক্তরাষ্ট্র ২০২৪ সালে ৬০০ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি করে দক্ষিণ আমেরিকার এ দেশটি থেকে।
ভোরের আকাশ/এসএইচ
শুল্ক সিদ্ধান্তে অটল ট্রাম্প
নিখিল মানখিন
প্রকাশ : ১ সপ্তাহ আগে
আপডেট : ১ সপ্তাহ আগে
দেশে দেশে অস্থিরতা
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের আরোপ করা শুল্কের প্রভাবে টালমাটাল বিশ্ব। বেড়েছে অস্থিরতা। শোনা যাচ্ছে বাণিজ্যযুদ্ধের পদধ্বনি। বইছে সমালোচনার ঝড়। শঙ্কায় রয়েছেন রপ্তানিকারক ও শিল্প উদ্যোক্তারা। ধস নেমেছে খোদ যুক্তরাষ্ট্রসহ অনেক দেশের শেয়ারবাজারে। অর্ধ শতাধিক দেশের পুনর্বিবেচনার আকুতির পাশাপাশি ঘটছে পাল্টা শুল্কারোপের ঘটনা। পাল্টা শুল্ক তিন মাস স্থগিতের অনুরোধ করে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে চিঠি দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ক্রয়াদেশ স্থগিত শুরু করেছে যুক্তরাষ্ট্রের অনেক প্রতিষ্ঠান।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, একের পর এক সভা করে পরিস্থিতি সামাল দেয়ার হিসেব-নিকেষ কষতে ব্যস্ত অনেক দেশ। কিন্তু আরোপিত শুল্কে ট্রাম্পের অটল অবস্থান অনেক দেশের এই হিসেব-নিকেষ জটিল করে তুলছে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে পড়বে দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব। আরোপিত শুল্ক থেকে সরে আসতে নারাজ ডোনাল্ড ট্রাম্প।
ইতোমধ্যে ৫০টি দেশ বাণিজ্যিক সম্পর্ক নিয়ে আলোচনার জন্য হোয়াইট হাউসে ধর্ণা দিয়েছে বলে একাধিক আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন ট্রাম্পের এক শীর্ষ অর্থনৈতিক উপদেষ্টা। এমনিতেই মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের শুল্ক পাল্টা শুল্ক ঘোষণার পর রীতিমতো কাঁপতে শুরু করেছে বিশ্ব অর্থনীতি। আর কাউকে ছাড় দেবে না যুক্তরাষ্ট্র ট্রাম্পের এমন ঘোষণা সামরিক যুদ্ধের চেয়েও ভয়াবহ অর্থনীতি ‘যুদ্ধ’র ইঙ্গিত মিলছে।
করোনাকালে বিশ্ব অর্থনীতি মন্দার কবলে পড়েছিল। সেই নাজুক পরিস্থিতি সামলাতে না সামলাতেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বৈশ্বিক অর্থনীতিকে নাজুক করে তোলে। অর্থনীতির এই ক্ষতের মধ্যেই আমদানি করা সব পণ্যে ১০ শতাংশ বেজলাইন ট্যারিফ বা ন্যূনতম শুল্ক আরোপ করেছে ট্রাম্প প্রশাসন। দেশভেদে এই হার ওঠানামা করছে। বেশ কয়েকটি দেশের ক্ষেত্রে এই শুল্ক হার ৫০ শতাংশের ওপর চলে যাচ্ছে। বাংলাদেশি পণ্যের ওপরে ৩৭ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। আগে এ হার ছিল ১৫ শতাংশ।
গত বুধবার যুক্তরাষ্ট্রের স্থানীয় সময় বিকেল চারটায় হোয়াইট হাউসে সংবাদ সম্মেলনে নতুন এ শুল্ক আরোপের ঘোষণা দেন তিনি। কোন দেশের ওপর কত হারে পারস্পরিক শুল্ক আরোপ হবে, সংবাদ সম্মেলনে তার একটি তালিকা তুলে ধরেন ট্রাম্প। তার যুক্তি, নতুন এই ‘রিসিপ্রোকাল ট্যারিফ’ বা পাল্টা শুল্ক ব্যবস্থা যুক্তরাষ্ট্রকে ‘আবার সম্পদশালী’ করবে। ধারণা করা হচ্ছে, নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে প্রায় ১০০টি দেশের ওপর আরোপ করা এই শুল্ক বিশ্বব্যাপী অর্থনীতিতে বড় ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে।
বাংলাদেশ ট্রাম্প-শুল্ক প্রভাব : যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের পাল্টা শুল্কের কারণে বিশ্ববাণিজ্য এখন টালমাটাল। এতে বাংলাদেশের প্রায় এক হাজার রপ্তানিকারকের কপালেও দুশ্চিন্তার ভাঁজ তৈরি হয়েছে। নতুন শুল্কের কারণে পণ্যের চাহিদা কমলে কিংবা ক্রয়াদেশ অন্যত্র স্থানান্তরিত হলে দেশের বিপুলসংখ্যক প্রতিষ্ঠান ক্ষতির মুখে পড়তে পারে। এসব প্রতিষ্ঠানের অধিকাংশই তৈরি পোশাক কারখানা।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, সর্বশেষ ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশের ৭ হাজার ৫৬১টি প্রতিষ্ঠান বিশ্বের ২১২টি দেশে পণ্য রপ্তানি করেছে। প্রচ্ছন্ন ও নমুনা পণ্য বাদে মোট রপ্তানি হয়েছে ৪ হাজার ২৬৯ কোটি মার্কিন ডলারের পণ্য। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে ৭৬৬ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে ২ হাজার ৩২৬টি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান।
যুক্তরাষ্ট্রে পণ্য রপ্তানি করে বাংলাদেশের এমন প্রায় এক হাজার প্রতিষ্ঠান কতটা সংকটে আছে, সেটি এবার পর্যালোচনা করে দেখা যাক। সে দেশে পণ্য রপ্তানিকারক ২ হাজার ৩২৬ প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ৯৫৭টিই করেছে মোট রপ্তানির এক-চতুর্থাংশের বেশি। গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাজারটিতে এসব প্রতিষ্ঠানের সম্মিলিত রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৫৯৫ কোটি ডলার। ফলে ৩৭ শতাংশ পাল্টা শুল্কের প্রভাবে যুক্তরাষ্ট্র থেকে রপ্তানি ক্রয়াদেশ কমলে এসব প্রতিষ্ঠান বড় ধরনের ব্যবসায়িক ক্ষতির মুখে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
এই ৯৫৭ প্রতিষ্ঠানের ঝুঁকি আবার সমান নয়-কারও বেশি, কারও কম। তবে উচ্চ ঝুঁকিতে আছে ২৮০টি প্রতিষ্ঠান। কারণ, তারা নিজেদের উৎপাদিত শতভাগ পণ্যই যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে রপ্তানি করে। যদিও তাদের সম্মিলিত রপ্তানির পরিমাণ কম, মাত্র ৩৫ কোটি ডলার। উচ্চ মধ্যম ঝুঁকিতে রয়েছে ২৩৬টি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান। তাদের মোট রপ্তানির ৭৬-৯৯ শতাংশের গন্তব্যই যুক্তরাষ্ট্র। গত অর্থবছর এই প্রতিষ্ঠানগুলোর সম্মিলিত রপ্তানির পরিমাণ ছিল ২২৭ কোটি ডলার। যদি বাংলাদেশি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোকে চীন বা ভিয়েতনামের রপ্তানিকারকদের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হয়, তাহলে কিছুটা সুবিধা পাওয়া যেতে পারে। আবার ভারত-পাকিস্তানের সঙ্গে হলে ঝুঁকি থাকবে।
বাংলাদেশি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোর নেতারা জানান, তুলনামূলক কম ঝুঁকিতে আছে এক হাজার ৩৬৯ রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান। তাদের অবশ্য মোট রপ্তানি পণ্যের ১-২৫ শতাংশের গন্তব্য যুক্তরাষ্ট্র। গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এসব প্রতিষ্ঠানের সম্মিলিত রপ্তানির পরিমাণ ছিল ১৮২ কোটি ডলার। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের মোট পণ্য রপ্তানির ৮৭ শতাংশই ছিল তৈরি পোশাক; যার মূল্য ৬৬৯ কোটি মার্কিন ডলার। ১ হাজার ৮১০টি প্রতিষ্ঠান গত অর্থবছর যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি পোশাক রপ্তানি করেছে। এ জন্যই ট্রাম্পের পাল্টা শুল্ক নিয়ে পোশাকশিল্পেই দুশ্চিন্তা বেশি।
তৈরি পোশাকের পর যুক্তরাষ্ট্রে দ্বিতীয় প্রধান রপ্তানি খাত হচ্ছে ক্যাপ। গত অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে সে দেশে ৩৩ কোটি ডলারের ক্যাপ রপ্তানি হয়েছে। এর মধ্যে শুধু যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি হয়েছে ২২ কোটি ৫২ লাখ ডলারের পণ্য। তার মানে মোট ক্যাপ রপ্তানির ৬৮ শতাংশের গন্তব্য যুক্তরাষ্ট্র। এই বাজারে পণ্য রপ্তানিতে তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে চামড়ার জুতা।
গত অর্থবছরে দেশ থেকে সব মিলিয়ে চামড়ার জুতা রপ্তানি হয় প্রায় ৫৫ কোটি ডলারের। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে চামড়ার জুতা রপ্তানি হয়েছে ১৮ কোটি ডলারের জুতা। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রে শীর্ষ রপ্তানি পণ্যের মধ্যে রয়েছে হোমটেক্সটাইল, পরচুলা, জুতা ছাড়া চামড়াজাত পণ্যসামগ্রী। এদিকে, ঢাকার সাভারের এসেন্সর ফুটওয়্যার অ্যান্ড লেদার প্রোডাক্টস নামের প্রতিষ্ঠান চলতি সপ্তাহে তিন লাখ মার্কিন ডলারের চামড়ার ব্যাগ যুক্তরাষ্ট্রে পাঠাতে জাহাজীকরণের প্রস্তুতি নিচ্ছিল। কিন্তু গত রোববার সকালে ক্রেতা প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা বার্তা পাঠিয়ে পণ্য জাহাজীকরণ না করার নির্দেশনা দেন। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন এসেন্সর ফুটওয়্যার অ্যান্ড লেদার প্রোডাক্টসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) কে এম মুশফিকুর রহমান।
বিশ্বপরিস্থিতি : বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনসমূহ বলছে, যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাংকিং জায়ান্ট জেপি মরগান ভবিষ্যদ্বাণী করেছে যে ট্রাম্পের শুল্ক ঘোষণার পর যুক্তরাষ্ট্র এবং বৈশ্বিক মন্দার আশঙ্কা ৬০ শতাংশ। এই অস্থিরতার বিষয়ে প্রশ্ন করলে মার্কিন বাণিজ্যমন্ত্রী হাওয়ার্ড লুটনিক রোববার সিবিএস নিউজকে জানান, ‘সব ধরনের আমদানির উপর ১০ শতাংশ ‘বেসলাইন’ শুল্ক, যা একদিন আগে কার্যকর হয়েছে, তা সামনের দিনগুলোতে অবশ্যই বহাল থাকবে।’
তালিকায় থাকা প্রায় ৬০টি দেশের উপর উচ্চতর শুল্ক ৯ এপ্রিল থেকে কার্যকর হওয়ার কথা রয়েছে। এই শুল্ক সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে, লুটনিক বলেন, সবকিছুই কার্যকর হবে। তিনি (ট্রাম্প) যা ঘোষণা করেছেন তার সবই বাস্তবায়ন হবে এবং তিনি রসিকতা করে কিছু করেননি।
ট্রাম্পের এক শীর্ষ অর্থনৈতিক উপদেষ্টা কেভিন হ্যাসেটও দাবি করেছেন যে ৫০টিরও বেশি দেশ আলোচনা শুরু করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছে। অন্যদিকে, ইন্দোনেশিয়া এবং তাইওয়ান বলেছে যে যুক্তরাষ্ট্র ওই দুই দেশ থেকে আমদানির ওপর ৩২ শতাংশ শুল্ক আরোপের ঘোষণা দেওয়ার বিপরীতে প্রতিশোধমূলক পাল্টা শুল্ক আরোপ করবে না তারা।
সংবাদ সংস্থা এএফপি এবং নিউ ইয়র্ক টাইমসের একটি চিঠি অনুসারে, ভিয়েতনামের নেতা, টো ল্যাম, ট্রাম্পকে অনুরোধ করেছেন, যেন যুক্তরাষ্ট্রে ভিয়েতনামী পণ্য রপ্তানির ওপর ৪৬ শতাংশ শুল্ক আরো অন্তত ৪৫ দিন পর আরোপ করা হয়। এক কথায় তিনি শুল্ক আরোপ বিলম্বিত করতে বলেছেন। তবে, চীন শুক্রবার ঘোষণা করেছে যে তারা বৃহস্পতিবার থেকে সমস্ত মার্কিন পণ্য আমদানির ওপর ৩৪ শতাংশ শুল্ক আরোপ করবে।
যুক্তরাজ্যের ডাউনিং স্ট্রিটের এক মুখপাত্র বলেছেন, স্টারমার এবং কানাডার নতুন প্রধানমন্ত্রী মার্ক কার্নি এক ফোনালাপে একমত হয়েছেন ‘একটি সর্বাত্মক বাণিজ্য যুদ্ধ কারো জন্যই লাভজনক নয়’। সোমবার ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ওয়াশিংটন ডিসিতে বাণিজ্য আলোচনার জন্য ট্রাম্পের সাথে দেখা করবেন বলে আশা করা হচ্ছে।
ট্রাম্পের শুল্কারোপের প্রভাব এরইমধ্যে বিশ্ববাজারে পড়তে শুরু করেছে। ট্রাম্পের পাল্টা শুল্কের ঘোষণায় দেশে দেশে শেয়ারবাজারে ধস নেমেছে। যুক্তরাষ্ট্রসহ তাইওয়ান, দক্ষিণ কোরিয়া, চীন, জাপান, অস্ট্রেলিয়া, ভিয়েতনামের মতো দেশের শেয়ারবাজার ধাক্কা খেয়েছে বড়সড়। যুক্তরাষ্ট্রের শেয়ার সূচক নাসডাক ফিউচার্সের পতন হয়েছে ৩ দশমিক ৩ শতাংশ। প্রযুক্তি খাতের বড় ৭টি প্রতিষ্ঠানের বাজার মূলধন কমেছে ৭৬০ বিলিয়ন বা ৭৬ হাজার কোটি ডলার। অ্যাপলের আইফোনের সিংহভাগ উৎপাদিত হয় চীনে। অ্যাপলের শেয়ারের দাম কমেছে ৭ শতাংশ।
এছাড়া ট্রাম্পের ঘোষণার জেরে এসঅ্যান্ডপি ৫০০ ফিউচার্স কমেছে ২ দশমিক ৭ শতাংশ, এফটিএসই ফিউচার্স কমেছে ১ দশমিক ৬ শতাংশ, ইউরোপিয়ান ফিউচার্স কমেছে প্রায় ২ শতাংশ। টোকিওর নিক্কেই (টোকিও স্টক এক্সচেঞ্জের স্টক মার্কেট সূচক) প্রাথমিকভাবে ৩ দশমিক ৯ শতাংশ কমে যায়।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে শহরগুলোতে ট্রাম্পবিরোধী বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়েছে, যা জানুয়ারিতে প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নেওয়ার পর দেশব্যাপী সবচেয়ে বড় প্রতিবাদ হিসেবে দেখা হচ্ছে। বস্টন, শিকাগো, লস অ্যাঞ্জেলেস, নিউইয়র্ক এবং ওয়াশিংটন ডিসিসহ বিভিন্ন শহরে কয়েক লক্ষ মানুষ বিক্ষোভে অংশ নেয়। তারা সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিভিন্ন ইস্যুতে ট্রাম্পের নীতির বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
বেশি ভুগবে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো : প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প শতাধিক দেশের পণ্যে উচ্চহারে যে শুল্কারোপের ঘোষণা দিয়েছেন, তাতে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়বে বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন। কারণ এ অঞ্চলের অনেক দেশেরই পণ্য রপ্তানির শীর্ষ গন্তব্য যুক্তরাষ্ট্র।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা সংস্থা দ্য উইলসন সেন্টারের দক্ষিণ এশিয়া ইনস্টিটিউট পরিচালক মাইকেল কুগেলম্যান সিএনএনকে বলেন, বিশ্বের সব চেয়ে জনবহুল দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে দক্ষিণ এশিয়ার ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কা। এ দেশগুলো নানা রকমের অর্থনৈতিক চাপের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। এ অঞ্চলের প্রচুর দুর্বলতা রয়েছে। ফলে ট্রাম্প প্রশাসনের চড়া শুল্ক দারুণভাবে আঘাত করবে।
সংবাদমাধ্যমটি লিখেছে, দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে শ্রীলঙ্কার ওপর সবচেয়ে বেশি ৪৪ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। দেশটি এখনও আর্থিক সংকট কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছে, যে সংকটের কারণে ২০২২ সালের মাঝামাঝিতে আন্দোলন বিক্ষোভের মধ্যে দিয়ে পতন হয় গোটাবায়া রাজাপাকসে সরকারের। দেশটি এখনও নির্ভর করছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণ প্যাকেজের ওপর।
নয়াদিল্লির ‘কাউন্সিল ফর সোশ্যাল ডেভেলপমেন্টের’ অধ্যাপক বিশ্বজিৎ ধর সিএনএন’কে বলেন, বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কার পণ্য যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশে বাধা পেলে মারাত্মক প্রভাব পড়বে। ভারতের ক্ষমতাসীন দলের রাজনীতিবিদ ও ‘কনফেডারেশন অফ অল ইন্ডিয়া ট্রেডার্সের’ প্রধান প্রবীণ খান দেলওয়াল বলেন, আমেরিকা ও ভারতের বাণিজ্যে কীভাবে শুল্কের প্রভাব কমিয়ে আনা যায়, সেজন্য সরকার ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলবে।
সম্প্রতি ভূমিকম্পে বিপর্যস্ত মিয়ানমারের ওপরও ৪৪ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। বাংলাদেশের পার্শ্ববর্তী এ দেশটিতে চার বছর ধরে গৃহযুদ্ধ লেগে আছে। ভূমিকম্পে ৩ হাজারের বেশি মানুষের প্রাণহানির মধ্যেই সরকারি বাহিনী বিদ্রোহীদের ওপর বিমান হামলা চালিয়েছে।
সিএনএন জানিয়েছে, সর্বনিম্ন ১০ শতাংশ শুল্কের চেয়েও বেশি আরোপ করা হয়েছে দুর্দশাগ্রস্ত পাঁচটি দেশের পণ্যের ওপর। এর মধ্যে ডিআর কঙ্গো ১১ শতাংশ, মাদাগাস্কার ৪৭ শতাংশ, মোজাম্বিক ১৬ শতাংশ, মালাউই ১৮ শতাংশ ও সিরিয়া ৪১ শতাংশ। বিশ্বের সবেচেয় দারিদ্র্য ২৬টি দেশের মধ্যে রয়েছে এ পাঁচটি দেশ। বিশ্ব ব্যাংকের হিসাবে, এই দেশগুলো বৈশ্বিক অর্থনীতির মাত্র ০.৫ শতাংশ। কিন্তু বিশ্বের মোট গরিবের ৪০ শতাংশই রয়েছে এ পাঁচটি দেশে। দক্ষিণ আফ্রিকা উপকূলের মাদাগাস্কারে আড়াই কোটি মানুষের বাস। সেখানকার ৮০ শতাংশের বেশি মানুষ চরম দারিদ্র্য, যাদের আয় দৈনিক ২ দশমিক ১৫ ডলারের কম। এ দেশটির দ্বিতীয় বড় রপ্তানি বাজার হলো যুক্তরাষ্ট্র। ২০২৪ সালে মাদাগাস্কার যুক্তরাষ্ট্রে ৮০ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি করে, যার মধ্যে রয়েছে ভ্যানিলা, পোশাক, টাইটেনিয়াম ও কোবাল্ট।
ভেনিজুয়েলারও সবথেকে বড় বাণিজ্য অংশীদার যুক্তরাষ্ট্র। অর্থ সংকট ও মানবিক বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে যাওয়া এ দেশটির ওপরও ট্রাম্প প্রশাসন ১৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছে। যুক্তরাষ্ট্র ২০২৪ সালে ৬০০ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি করে দক্ষিণ আমেরিকার এ দেশটি থেকে।
ভোরের আকাশ/এসএইচ