উত্তেজনার পারদ চড়ছে

ভারত-পাকিস্তান বিরোধ

উত্তেজনার পারদ চড়ছে

নিখিল মানখিন

প্রকাশ : ১ দিন আগে

আপডেট : ৮ মিনিট আগে

উত্তেজনার পারদ চড়ছে

উত্তেজনার পারদ চড়ছে

মুখোমুখি অবস্থানে ভারত ও পাকিস্তান। এই দুই প্রতিবেশী রাষ্ট্রের বৈরি সম্পর্ক অনেকটা ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক ঘটনাবহুল। সম্পর্ক স্বাভাবিক করার পথে এসেছে একের পর এক বাধা ও সাংঘর্ষিক ঘটনা। সর্বশেষ গত মঙ্গলবার ভারত-শাসিত কাশ্মিরে বন্দুকধারীদের হামলার পর দু’দেশের সম্পর্ক তলানিতে পৌঁছেছে। পাকিস্তানের সঙ্গে সিন্ধু পানিবণ্টন, স্থলসীমান্ত বন্ধসহ পাঁচ সিদ্ধান্ত নিয়েছে ভারত। পাল্টা সিদ্ধান্ত গ্রহণে পাকিস্তানও পিছিয়ে নেই।

সিদ্ধান্তের অংশ হিসেবে ভারতের সঙ্গে সিমলা চুক্তি বাতিল এবং ওয়াঘাহ সীমান্ত বন্ধের ঘোষণা দিয়েছে ইসলামাবাদ। নিজেদের আকাশে ভারতীয় মালিকানাধীন অথবা ভারত পরিচালিত সব বিমান প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা ও ভারতের সঙ্গে সব ধরনের বাণিজ্য বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছে দেশটি। আর দু’টি দেশই প্রতিপক্ষের নাগরিকদের ভিসা বাতিল এবং ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে  নিজ নিজ দেশে ফিরে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছে। সব মিলিয়ে যুদ্ধাংদেহী হয়ে উঠেছে দক্ষিণ এশিয়ার পারমাণবিক পারমাণবিক শক্তিধর দেশ দু’টি।

গত মঙ্গলবার ভারত-শাসিত  কাশ্মীরের জনপ্রিয় পর্যটন স্পট পহেলগামে পর্যটকদের একটি গ্রুপের ওপর বন্দুকধারীরা গুলি চালায়। এতে এখন পর্যন্ত ২৬ জনের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করা হয়েছে। আহত হয়ে হাসপাতালে আছেন অনেকে। পাকিস্তানভিত্তিক নিষিদ্ধ সংগঠন লস্কর-ই-তৈয়েবার সহযোগী সংগঠন দ্য রেজিস্ট্যান্স ফ্রন্ট (টিআরএফ) গত মঙ্গলবার বিকালের হামলার দায় স্বীকার করেছে। পহেলগাম এলাকাটি ‘ভারতের সুইজারল্যান্ড’ হিসেবে পরিচিত। হামলার ঘটনা ঘটেছে বাইসরনে। এটি পহেলগাম থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে পর্বতের মাঝে একটি জায়গা।

কড়া হুঁশিয়ারি ভারতের 
বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে (রয়টার্স, বিবিসি, দ্য হিন্দুস্তান টাইমস, এএফপি) প্রকাশিত প্রতিবেদনসমূহে বলা হয়েছে, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি গতকাল বৃহস্পতিবার কাশ্মীরে পর্যটকদের ওপর প্রাণঘাতী হামলার কড়া প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, হামলাকারী ও তাদের মদদদাতাদের খুঁজে বের করে শাস্তি দেওয়া হবে। ওই হামলায় অংশ নেওয়া বন্দুকধারীদের মধ্যে দুজন পাকিস্তানি নাগরিক বলে শনাক্ত করেছে ভারতীয় পুলিশ।

হামলাকারীদের পরিচয় বা পাকিস্তানের নাম উল্লেখ না করে মোদি বলেন, ‘আমরা হামলাকারীদের ‘পৃথিবীর শেষ প্রান্ত পর্যন্ত’ তাড়া করে খুঁজে বের করব।’ এদিকে, পাকিস্তানের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ স্থলসীমান্ত বন্ধের ঘোষণা দিয়েছে ভারত।

দেশটির পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিসরি নয়াদিল্লিতে সাংবাদিকদের বলেন, আটারি-ওয়াঘা সীমান্ত অবিলম্বে বন্ধ করে দেওয়া হবে। তিনি জানান, যাদের কাছে বৈধ নথি রয়েছে তারা পহেলা মে এর আগে পাকিস্তানে ফিরতে পারবেন। পাকিস্তানের সঙ্গে সিন্ধু পানি বণ্টন চুক্তিও স্থগিত ঘোষণা করেছে দেশটি।

গত বুধবার প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি নেতৃত্বাধীন দেশটির মন্ত্রিসভার নিরাপত্তা বিষয়ক কমিটির জরুরি বৈঠকে এ চুক্তি বাতিলের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। ওই বৈঠকে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে মোট পাঁচটি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। সিদ্ধান্তগুলো হলো- সিন্ধু পানিবণ্টন চুক্তি স্থগিত ঘোষণা।

ভারত বলছে, পাকিস্তান যতদিন সীমান্তে সন্ত্রাস বন্ধ না করবে এবং সন্ত্রাসবাদকে সমর্থন ত্যাগ না করবে ততদিন এটি স্থগিত থাকবে। ১৯৬০ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর করাচিতে তৎকালীন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু ও পাকিস্তানি প্রেসিডেন্ট ফিল্ড মার্শাল আইয়ূব খান সিন্ধু পানিবণ্টন চুক্তি স্বাক্ষর করেছিলেন। বিশ্বব্যাংকের মধ্যস্থতায় বহুল আলোচিত এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। অবিলম্বে আটারি-ওয়াঘা সীমান্ত বন্ধ করে দেওয়া হবে। যাদের বৈধ নথি রয়েছে তারা ১ মে এর আগে সীমান্ত অতিক্রম করতে পারবেন।

সার্ক ভিসা এক্সেম্পশন স্কিম (এসভিইএস) এর আওতায় পাকিস্তানি নাগরিকদের ভারতে ভ্রমণের অনুমতি দেওয়া হবে না। পাকিস্তানি নাগরিকদের অতীতে জারি করা যেকোনো এসভিইএস ভিসা বাতিল বলে গণ্য হবে। এসভিইএস ভিসায় বর্তমানে ভারতে থাকা পাকিস্তানি নাগরিকদেরও ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ভারত ছাড়তে বলা হয়েছে।

নয়াদিল্লিতে পাকিস্তানি হাইকমিশনের সামরিক, নৌ ও বিমান উপদেষ্টাদের ‘পার্সোনা নন গ্রাটা’ ঘোষণা করা হয়েছে। ভারত ছাড়ার জন্য এক সপ্তাহ সময় পাবেন তারা। ইসলামাবাদের ভারতীয় হাইকমিশন থেকে প্রতিরক্ষা, নৌ ও বিমান উপদেষ্টাদের প্রত্যাহার করে নিচ্ছে ভারত। সংশ্লিষ্ট হাইকমিশনের এই পদগুলো বাতিল ঘোষণা করা হয়েছে। উভয় হাইকমিশন থেকে সার্ভিস অ্যাডভাইজারের পাঁচজন সাপোর্ট স্টাফকেও প্রত্যাহার করার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। হাইকমিশনের সামগ্রিক লোকবল ৫৫ থেকে কমিয়ে ৩০ জনে নামিয়ে আনার সিদ্ধান্ত হয়েছে, যা ১ মে এর মধ্যে কার্যকর হবে।

ভারতের কূটনৈতিক পদক্ষেপের কঠোর জবাব দেবে পাকিস্তান’
ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের পহেলগামে বন্দুকধারীদের হামলায় ২৬ জন নিহত হওয়ার ঘটনার পর ভারতের নেওয়া কূটনৈতিক পদক্ষেপের তীব্র সমালোচনা করেছে পাকিস্তান। সেই সঙ্গে কঠোর পাল্টা জবাব দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফ। গতকাল বৃহস্পতিবার শেহবাজ শরিফের কার্যালয় থেকে জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের (এনএসসি) এক জরুরি বৈঠকের পর আনুষ্ঠানিক বিবৃতি প্রকাশ করা হয়।

এতে বলা হয়, পাকিস্তান জোরালোভাবে ভারতের ওই ঘোষণা প্রত্যাখ্যান করছে যাতে সিন্ধু নদের জলচুক্তিকে স্থগিত করা হয়েছে বলে দাবি করা হয়েছে। সিন্ধু জলচুক্তি অনুযায়ী, পাকিস্তানের প্রাপ্ত পানিপ্রবাহ বন্ধ বা অন্যদিকে প্রবাহিত করার যে কোনো প্রচেষ্টা ‘যুদ্ধ ঘোষণা’ হিসেবে বিবেচিত হবে ও পূর্ণ শক্তি প্রয়োগ করে তার উপযুক্ত জবাব দেওয়া হবে।

বিবৃতিতে আরও বলা হয়েছে, ভারতের পক্ষ থেকে পাকিস্তানে সন্ত্রাসে উসকানি, সীমান্ত অতিক্রম করে হত্যাকাণ্ড, আন্তর্জাতিক আইন ও কাশ্মীর বিষয়ে জাতিসংঘের প্রস্তাবসমূহ অমান্য করা বন্ধ না করা পর্যন্ত পাকিস্তান সমস্ত দ্বিপক্ষীয় চুক্তি- যার মধ্যে ‘শিমলা চুক্তি’ অন্তর্ভুক্ত, স্থগিত রাখার অধিকার রাখে।

পাকিস্তান সরকার ওয়াগাহ সীমান্ত চেকপয়েন্ট ‘তাৎক্ষণিকভাবে’ বন্ধ করার ঘোষণা দিয়েছে। ভারতের সঙ্গে এই গুরুত্বপূর্ণ সীমান্ত দিয়ে যে কোনো ধরনের ট্রানজিট বা যাতায়াত ‘ব্যতিক্রম ছাড়াই’ স্থগিত করা হয়েছে। এর ফলে, সীমান্তবর্তী ব্যবসা, পর্যটন ও সাংস্কৃতিক বিনিময় কার্যক্রম মারাত্মকভাবে ব্যাহত হবে বলে মনে করা হচ্ছে। দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা সার্কের ভিসা ছাড় সুবিধা ওতায় পাকিস্তানে অবস্থানরত ভারতীয় নাগরিকদের প্রতি কড়া বার্তা দিয়েছে ইসলামাবাদ।

বিবৃতিতে বলা হয়, পাকিস্তান ভারতীয় নাগরিকদের সব ভিসা স্থগিত করেছে। বর্তমানে যেসব ভারতীয় পাকিস্তানে অবস্থান করছেন, তাদের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে এই দেশ ত্যাগ করতে হবে। তবে শিখ তীর্থযাত্রীরা এই নির্দেশের বাইরে থাকবেন। ভারতের প্রতিরক্ষা, নৌবাহিনী এবং বিমানবাহিনীর কর্মকর্তাদের ইসলামাবাদ থেকে বহিষ্কারের ঘোষণা দিয়েছে ইসলামাবাদ। তাদের ‘পারসোনা ননগ্রাটা’ ঘোষণা করে পাকিস্তান জানায়, তারা আর এই দেশে গ্রহণযোগ্য নয়।

পাকিস্তান আরও জানিয়েছে, ভারতীয় সব ধরনের এয়ারলাইনসের জন্য দেশটির আকাশসীমা ‘তাৎক্ষণিকভাবে বন্ধ’ করে দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি, ভারতের সঙ্গে সব বাণিজ্য; এমনকি- কোনো তৃতীয় দেশের মাধ্যমে পরিচালিত বাণিজ্যও ‘পূর্ণভাবে স্থগিত’ ঘোষণা করেছে পাকিস্তান।

পাকিস্তানের বিবৃতিতে পহেলগামে পর্যটকদের প্রাণহানিতে পাকিস্তান উদ্বিগ্ন হলেও, ভারত ঘোষিত পদক্ষেপগুলোকে ‘একপাক্ষিক, অবিচারমূলক, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, অত্যন্ত দায়িত্বহীন এবং আইনি ভিত্তিহীন’।

বিবৃতিতে আরও বলা হয়, এ ঘটনায় পাকিস্তানকে দায়ী করার চেষ্টা অবান্তর, যুক্তিহীন ও অবাস্তব। কোনো বিশ্বাসযোগ্য তদন্ত বা প্রমাণ ছাড়াই এমন অভিযোগ তোলা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক।

পাকিস্তান আরও অভিযোগ করেছে, কাশ্মীর অঞ্চলে দীর্ঘদিন ধরে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর ওপর নিপীড়ন চালিয়ে আসছে ভারত। বিবৃতিতে বলা হয়, কাশ্মীরে ভারতীয় দমননীতি এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের ইতিহাস স্পষ্ট। এমন অবস্থায় ভারতের পক্ষ থেকে পাকিস্তানকে ‘সন্ত্রাসবাদে’ মদদদাতা হিসেবে চিহ্নিত করা মূলত দৃষ্টিপাত ঘোরানোর একটি প্রচেষ্টা।

শরিফের কার্যালয় থেকে আরও বলা হয়, ভারত যেন এই ধরনের মর্মান্তিক ঘটনার রাজনৈতিক ফায়দা তুলতে না চায় ও নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হওয়ার দায় সম্পূর্ণভাবে স্বীকার করে। এর আগে হামলার ঘটনায় পাকিস্তানের পক্ষ থেকেও নিন্দা প্রকাশ করা হয়েছে। দেশটির গণমাধ্যম জিও নিউজের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘অবৈধভাবে দখলকৃত জম্মু-কাশ্মীর’র পেহেলগামে হামলার ঘটনায় পাকিস্তান উদ্বিগ্ন।

দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র জানিয়েছেন, পেহেলগামে হামলায় ২৬ জন নিহতের ঘটনায় পাকিস্তান নিন্দা প্রকাশ করছে। নিহতের পরিবারের প্রতিও সমবেদনা প্রকাশ করছে পাকিস্তান। কাশ্মীরের পহেলগামে সন্ত্রাসী হামলার পর পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতের একাধিক পদক্ষেপ নেওয়ার সিদ্ধান্তকে শিশুসুলভ বলে বিবৃতি দিয়েছেন পাকিস্তানের উপ-প্রধানমন্ত্রী ইসাক দার। গতকাল বৃহস্পতিবার বিবিসি উর্দু এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানিয়েছে।  

সংবাদমাধ্যমটি জানায়, পাকিস্তানের একটি বেসরকারি চ্যানেলে ইসাক দার বলেছেন, “ভারতের ঘোষণাগুলো শিশুসুলভ এবং এতে গুরুত্বের অভাব রয়েছে।”

তিনি আরও বলেন, ভারত প্রতিটি ঘটনার জন্য পাকিস্তানকে দায়ী করে এবং অতীতের মতো এবারও পাকিস্তানকে দোষারোপ করার চেষ্টা করা হয়েছে। আমরা বৈঠকে ভারতকে যোগ্য জবাব দেব, এই জবাব কম 
হবে না।

পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী খাজা আসিফ পাকিস্তানি সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, “এই হামলার সঙ্গে পাকিস্তানের কোনো সম্পর্ক নেই। এগুলো সবই তাদের দেশীয় বিদ্রোহ। তাদের বিভিন্ন রাজ্যে সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ চলছে। একটা নয়, দুটো নয় কয়েক ডজন রাজ্যে- নাগাল্যান্ড থেকে কাশ্মীর, দক্ষিণে, ছত্তিশগড়ে, মণিপুরে।” তবে তিনি জানিয়েছেন, পাকিস্তান ‘সন্ত্রাসের’ বিরুদ্ধে। তিনি বলেছেন, “পাকিস্তান সব সময় যে কোনো ধরনের সন্ত্রান্সের বিরুদ্ধে।”

ভারতে নিযুক্ত পাকিস্তানের সাবেক হাই কমিশনার আব্দুল বাসিত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্স-এ (সাবেক টুইটার) লিখেছেন , ‘আমি আত্মবিশ্বাসী যে ভারতের যেকোনো ধরনের দুঃসাহসিক কাজ ব্যর্থ করতে পাকিস্তান সবভাবে প্রস্তুত। আমার কোনো সন্দেহ নেই যে এবার পাকিস্তানের তরফে যথাযোগ্য জবাব দেওয়া হবে।’

পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতের সামরিক পদক্ষেপের আশঙ্কা বাড়ছে
বিবিসি’র প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পহেলগামের ঘটনার জবাব দিতে দিল্লি দ্রুত বেশ কয়েকটা সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছে। আরও তাৎপর্যপূর্ণভাবে, ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং ‘কঠোর জবাব’ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। অপরাধীদের বিরুদ্ধেই নয়, ভারতের মাটিতে ‘ঘৃণ্য কাজের’ নেপথ্যে থাকা ‘মাস্টারমাইন্ডদের’ বিরুদ্ধেও কড়া ব্যবস্থা নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তিনি।

বিশেষজ্ঞদের মতে, এই মুহূর্তে প্রশ্ন এটা নয় যে সন্ত্রাসী হামলার জবাবে ভারতের পক্ষ থেকে সামরিক প্রতিক্রিয়া দেখা যাবে কি না। প্রশ্ন হলো সেটা কখন হবে, তার মাত্রা কী হবে এবং তার ফলে কী মূল্য দিতে হতে পারে।

সামরিক ইতিহাসবিদ শ্রীনাথ রাঘবন বলেছেন, “আমরা সম্ভবত একটা দৃঢ় প্রতিক্রিয়া দেখতে পাব যা ঘরোয়া দর্শক এবং পাকিস্তানে থাকা অভিনেতা- দুই পক্ষকেই একটা বার্তা দেবে। ২০১৬ সাল থেকে, বিশেষত ২০১৯ সালের পর থেকে এই জাতীয় ঘটনার ক্ষেত্রে প্রতিশোধমূলক যে ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে, তা হলো আন্তঃসীমান্ত হামলা বা বিমান হামলা। কাজেই সরকারের পক্ষে এখন সেই মাত্রার নিচে কোনো কাজ করা কঠিন হয়ে পড়বে। অনুমান করা যায়, পাকিস্তানও আগের মতোই জবাব দেবে। এক্ষেত্রে বরাবরের মতোই যে ঝুঁকিটা থেকে যায় সেটা হলো, হিসাবে ভুল- যা উভয় পক্ষেরই হতে পারে।’

পররাষ্ট্রনীতি বিশ্লেষক মাইকেল কুগেলম্যান মনে করেন, সর্বশেষ হামলায় ভারতীয় বেসামরিক নাগরিকদের নিশানা করার মতো ঘটনা এবং এতগুলো মানুষের মৃত্যু পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতের সামরিক প্রতিক্রিয়ার জোরালো সম্ভাবনার ইঙ্গিত দেয়। দিল্লি যদিও পাকিস্তানের জড়িত থাকার মাত্রা নির্ধারণ করতে পারে বা নিছকই ধরে নেয় যে তারা (পাকিস্তান) জড়িত- দুই ক্ষেত্রেই কিন্তু এই সম্ভাবনা থাকে।’

তিনি আরও বলেন, ‘ভারতের জন্য এই জাতীয় প্রতিক্রিয়ার প্রধান সুবিধা হবে রাজনৈতিক দিক থেকে। কারণ জোরালো জবাব দেওয়ার জন্য তাদের ওপর ভারতীয় জনসাধারণের প্রবল চাপ থাকবে। আরেকটা সুবিধা হলো, যদি প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে সফলভাবে সন্ত্রাসী লক্ষ্যবস্তুকে নির্মূল করা সম্ভব হয়, তাহলে তা প্রতিরোধ ব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং ভারতবিরোধী হুমকিকে হ্রাস- দুই-ই করতে পারে। আর অসুবিধা হলো, এটা একটা গুরুতর সংকট সৃষ্টি করতে পারে, এমনকি সংঘাতের ঝুঁকিও।’

যুক্তরাষ্ট্রের ‘ইউনিভার্সিটি অ্যাট অ্যালবানি’র ক্রিস্টোফার ক্ল্যারি মনে করেন, কোনো গোপন অভিযান চালানো হলে, দায় অস্বীকার করার সুযোগ থেকে যায়। কিন্তু সেই পদক্ষেপ মানুষকে দেখানোর যে একটা রাজনৈতিক প্রয়োজন রয়েছে, সেটাকে মেটাতে পারে না। এই পরিস্থিতিতে ভারতের সামনে দুটো সম্ভাব্য পথ খোলা থাকবে বলে উল্লেখ করেছেন তিনি।

তবে তিনি জানিয়েছেন, এই জাতীয় প্রতিটা প্রতিক্রিয়ামূলক পদক্ষেপ কিন্তু পাল্টা প্রতিক্রিয়ার ঝুঁকি বহন করে, যেমনটা এর আগেও দেখা গেছে। কোনো পথই ঝুঁকিমুক্ত নয়। যুক্তরাষ্ট্রও বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়েছে এবং সংকট ব্যবস্থাপনায় সাহায্য করতে তারা ইচ্ছুক বা সক্ষম নাও হতে পারে।  ভারত-পাকিস্তান সংকটের সবচেয়ে বড় ঝুঁকি হলো, দুই পক্ষই পরমাণু শক্তিধর। এই সত্যিটা দুই দেশের পক্ষ থেকে নেওয়া প্রতিটা সিদ্ধান্তের ওপর দীর্ঘ প্রভাব ফেলে। সেটা শুধু সামরিক কৌশল তৈরির সময় নয়, বরং রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।

সামরিক ইতিহাসবিদ শ্রীনাথ রাঘবন বলেন, ‘পারমাণবিক হাতিয়ার একইসঙ্গে বিপজ্জনক এবং নিয়ন্ত্রক (কাউকে বাধা দেওয়া বা নিয়ন্ত্রণে রাখার দিক থেকে)। এটা দুই পক্ষের নীতিনির্ধারকদের সতর্কতার সঙ্গে কাজ করতে বাধ্য করে। যে কোনো প্রতিক্রিয়া সুনির্দিষ্ট এবং লক্ষ্যবস্তুকে নিশানা করে হতে হবে। পাকিস্তান পাল্টা জবাব দিতে পারে এবং তারপর সেখান থেকে সরে এসে আবার অন্য পথ অনুসরণ করতে পারে।’

দেশভাগ ও ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনার ৭৫ বছর
আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থা রয়টার্স’র এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কাশ্মীর নিয়ে দুই পারমাণবিক শক্তিধর দেশের বিরোধও পুরোনো। সাম্প্রতিক জঙ্গি হামলা সে বিরোধকে আরও উসকে দিয়েছে। দেশভাগের এ ৭৫ বছরে দুই প্রতিদ্বন্দ্বী দেশের উত্তেজনা এখনও থামেনি। ৭৫ বছর আগে ব্রিটিশ শাসকদের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে ভারত উপমহাদেশ। কিন্তু ব্রিটিশরা ভাগ করে দিয়ে যায় ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি দেশে। এই বিভক্তি দেশ দুটির মধ্যে গভীর ক্ষত সৃষ্টি করে যার রেশ এখনও বিদ্যমান। 

দেশভাগের এ ৭৫ বছরে দুই প্রতিদ্বন্দ্বী দেশের উত্তেজনা থামেনি, বরং বেড়েছে। সেরকমই কিছু উত্তেজনাপূর্ণ ও রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ সময়গুলোর মধ্যে রয়েছে ১৯৪৭ সলের ভারত উপমহাদেশ বিভাজন, ১৯৪৯ সালের কাশ্মীর বিভাজন, ১৯৬৫ সালের দ্বিতীয় যুদ্ধ, ১৯৭১ সালের বাংলাদেশের জন্ম, ১৯৭৪ সালের পারমাণবিক অস্ত্র প্রতিযোগিতা, ১৯৮৯ সালের কাশ্মীরে বিদ্রোহ, ১৯৯৯ সালের কারগিল সংঘাত, ২০০৮ সালের মুম্বাই হামলা, ২০১৯ সালের  কাশ্মীরের স্বায়ত্তশাসন প্রত্যাহার।

ভোরের আকাশ/এসএইচ

  • শেয়ার করুন-

সংশ্লিষ্ট

উত্তেজনার পারদ চড়ছে

উত্তেজনার পারদ চড়ছে

দেশে দেশে অস্থিরতা

দেশে দেশে অস্থিরতা

ভারতে ভিসা জালিয়াতির বিরুদ্ধে কড়া পদক্ষেপ মার্কিন দূতাবাসের

ভারতে ভিসা জালিয়াতির বিরুদ্ধে কড়া পদক্ষেপ মার্কিন দূতাবাসের

গাজায় ২৪ ঘণ্টায় ইসরাইলি হামলায় নিহত আরও ৪০ ফিলিস্তিনি

গাজায় ২৪ ঘণ্টায় ইসরাইলি হামলায় নিহত আরও ৪০ ফিলিস্তিনি

মন্তব্য করুন