মো. রেজাউর রহিম
প্রকাশ : ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ০৯:১১ এএম
ছবি: সংগৃহীত
বিশ্বের বিভিন্ন দেশের আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থার সঙ্গে তাল মিলিয়ে রাজধানী ঢাকার লোকজনের যাতায়াত ব্যবস্থার উন্নয়ন ও সহজসাধ্য এবং যানযটমুক্ত করতে আরো দুটি মেট্রোরেল প্রকল্পের কাজ চলমান রয়েছে। এ দুটি মেট্রোরেল প্রকল্প হচ্ছে-এমআরটি লাইন-৫ নর্দার্ন ও এমআরটি লাইন-১ রুট।
এ দুটি প্রকল্পের পরিষেবা লাইন স্থানান্তর কাজও ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে। এ দুটি মেট্রোরেল প্রকল্পের নির্মাণ ব্যয় দুই লাখ কোটি টাকার কাছাকাছি। যা সরকারের প্রক্কলনের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ।
এ প্রকল্প দুটির ঋণদাতা প্রতিষ্ঠান জাপানের উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা জাইকা’র সহায়তায় বাস্তবায়ন কাজ চলমান রয়েছে। তবে সরকার এ প্রকল্প দুটির নির্মাণ ব্যয় যতটা সম্ভব কমানোর উদ্যোগ নিয়েছে বলে অর্থ মন্ত্রণালয়সহ একাধিক সূত্রে জানা গেছে।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, এ দুই প্রকল্পের ঠিকাদারি কাজ পেয়েছে জাপানি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান। ঠিকাদারের প্রস্তাবনা অনুযায়ী ঢাকায় বাস্তবায়নাধীন দুটি মেট্রোরেল প্রকল্পের নির্মাণকাজ চলছে। অর্থ মন্ত্রলণালয়ের এক জন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, নির্ধারিত ব্যয়ে জাইকা প্রকল্পের বাস্তবায়নে আগ্রহী না হলে সেক্ষেত্রে উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে অন্য কোনো দেশের অভিজ্ঞ কোন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে প্রকল্প দুটির নির্মাণকাজ শেষ করার চিন্তাভাবনা সরকারের রয়েছে।
জানা গেছে, মেট্রোরেল প্রকল্পের ব্যয় কমানোর লক্ষ্যে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে একটি উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি দল সম্প্রতি জাপান সফরে গিয়ে জাইকা’র সঙ্গে বিষয়টি আলোচনাও করেছেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে মেট্রোরেলের নির্মাণ ব্যয় কয়েক গুণ বেশি। ফ্যাসিষ্ট আওয়ামী লীগ আমলে এ প্রকল্পের সাথে সংশ্লিষ্ট রাজনীতিক ও কর্মকর্তারা ব্যয় নির্ধারণের ক্ষেত্রে দেশের স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিয়েছেন। আর এ অবস্থায় বিদেশি ঋণে বিপুল ব্যয়ে আরও দুটি মেট্রোরেল প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হলে বাংলাদেশকে দীর্ঘদিন এ ঋণের বোঝা টানতে হবে।
মেট্রোরেল নির্মাণ ও পরিচালনাকারী ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানির (ডিএমটিসিএল) একাধিক নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কর্মকর্তা জানান, উত্তরা থেকে কমলাপুর পর্যন্ত মেট্রোরেলের নির্মাণ ব্যয় নিয়েই প্রশ্ন রয়েছে এবং এ প্রকল্পের আয় থেকে জাইকার ঋণ পরিশোধ করা সম্ভব হচ্ছে না।
সূত্র জানায়, আগের সরকার রাজধানীতে ২০৩০ সালের মধ্যে মোট ছয়টি মেট্রোরেল লাইন নির্মাণের পরিকল্পনা নিয়েছিল। এর মধ্যে চালু হওয়া উত্তরা থেকে কমলাপুর পর্যন্ত লাইন-৬ এর কাজ এখনও সমাপ্ত হয়নি। অর্থাৎ এ প্রকল্পের মতিঝিল থেকে কমলাপুর পর্যন্ত বাস্তবায়নাধীন। আর মেট্রোরেলের চলমান প্রকল্প দুটি হচ্ছে- এমআরটি লাইন-১ (কমলাপুর থেকে বিমানবন্দর ও কুড়িল থেকে পূর্বাচল) এবং এমআরটি লাইন-৫ (সাভারের হেমায়েতপুর থেকে গাবতলী, মিরপুর-১০ হয়ে গুলশান-ভাটারা পর্যন্ত)। সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, মেট্রোরেল প্রকল্পে জাইকা’র সহায়তা বাদ দিলে কিছু আর্থিক ক্ষতি হতে পারে, তবে যে কোন প্রকল্পে দেশের স্বার্থ ও সামর্থ্যওে বিষয়টি সর্বাগ্রে অগ্রাধিকার দেওয়া জরুরি।
ডিএমটিসিএল সূত্র জানায়, কমলাপুর থেকে বিমানবন্দর ও কুড়িল থেকে পূর্বাচল পর্যন্ত মেট্রোরেল নির্মাণে জাপানি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের প্রস্তাব অনুযায়ী ব্যয় দাঁড়াবে প্রায় ৯৪ হাজার কোটি টাকা। এ ক্ষেত্রে প্রতি কিলোমিটারে ব্যয় দাড়াবে প্রায় তিন হাজার কোটি টাকার ওপরে। আর অন্য প্রকল্প-এমআরটি লাইন-৫ (নর্দান রুট)-এর মোট দৈর্ঘ্য ২০ কিলোমিটার।
এর মধ্যে হেমায়েতপুর থেকে গাবতলী এবং নতুনবাজার থেকে ভাটারা পর্যন্ত সাড়ে ৬ কিলোমিটার উড়ালপথের মাধ্যমে হবে। এ বাকি অংশ হবে পাতালপথে। এ প্রকল্পে মোট স্টেশন থাকবে ১৪টি। ইতিমধ্যে এ প্রকল্পে পাওয়া প্রস্তাবনা অনুযায়ী এই প্রকল্পের ব্যয় দাঁড়াবে প্রায় এক লাখ কোটি টাকা। এক্ষেত্রে কিলোমিটার প্রতি মেট্রোরেলের ব্যয় তিন হাজার কোটি টাকার ওপরে দাড়াবে।
জানা গেছে, মেট্রোরেল প্রকল্পের খরচ কমানোর বিষয়ে জাইকার সঙ্গে আলোচনার জন্য গত ২৪ আগস্ট থেকে অর্থ উপদেষ্টার নেতৃত্বে প্রতিনিধি দল দুই সপ্তাহ টোকিও সফর করেন। সফরকালে প্রতিনিধি দল জাইকার প্রেসিডেন্ট ছাড়াও জাপান সরকারের সঙ্গে বৈঠক করে প্রকল্পের ব্যয় কমানো নিয়ে আলোচনা করেন। এসময় ব্যয় কমানোর জন্য বাংলাদেশের পক্ষ থেকে জাপানকে পর্যালোচনার কথাও বলা হয়েছে।
এদিকে, প্রতিনিধি দল দেশের ফেরার পর প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী শেখ মইনউদ্দিনের নেতৃত্বে একটি উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গঠন কওে ব্যয় পর্যালোচনার কাজ শুরু করারও উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। এতে ডিএমটিসিএলের এমডি ফারুক আহমেদসহ সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা থাকবেন। কমিটি অন্যান্য দেশের মেট্রোরেল নির্মাণ ব্যয়সহ দেশের পারিপার্শ্বিক বিষয় বিশ্লেষণ করে একটি যৌক্তিক ব্যয় প্রস্তাব করবে। নির্ধারিত এ ব্যয় জাপানের কাছে উস্থাপন করা হবে। তারা যদি এ ব্যয়ে প্রকল্প সম্পাদনে রাজি না হলে বাংলাদেশ অন্য কোনো দেশ বা সংস্থার অর্থায়নে নতুন অন্য অভিজ্ঞ এবং সামর্থ্যসম্পন্ন কোনো প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এসব মেট্রোরেল প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেবে সরকার।
এ বিষয়ে ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ ভোরের আকাশ’কে বলেন, এমনিতেই সরকারের ঋণ দিন দিন বাড়ছে। এরপর এ দুই প্রকল্পে প্রথমে প্রাক্কলিত ব্যয় থেকে পরে অনেক বাড়ানো হয়েছে। ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নের কারণে ব্যয় হয়তো সর্বোচ্চ ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ বাড়তে পারে।
কিন্তু বাস্তবে ব্যয় আরো অনেক বেশি বেড়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, সার্বিক অবস্থা বিবেচনা কওে দেশের স্বার্থে ব্যয় কমানোর জন্য পুনরায় পর্যালোচনা করার জন্য বাংলাদেশের পক্ষ থেকে জাইকাকে বলা হয়েছে। যদি জাইকা’র সাথে আমাদের সমঝোতা না হয় তাহলে অন্য কোনো দেশের কোনো প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এসব প্রকল্প বাবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হবে।
এ ব্যাপারে সড়ক পরিবহন ও সেতু উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বলেন, এত বাড়তি খরচে মেট্রোরেল নির্মাণ সম্ভব নয়-বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বিষয়টি জাইকাকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। জাপানের সঙ্গে আলোচনা করেই এসব প্রকল্প বাস্তবায়নের পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
উল্লেখ্য, জাইকা’র কারিগরি সহায়তায় সম্ভাব্যতা যাচাই এর পর আওয়ামী লীগ সরকার ২০১৯ সালে প্রকল্প দুটির ব্যয় ধরেছিল প্রায় ৯৪ হাজার কোটি টাকা। সরকারের প্রক্কলনে এমআরটি লাইন-১-এ ব্যয় ধরা হয়েছিল ৫২ হাজার ৫৬১ কোটি টাকা। এমআরটি লাইন-৫-এর ব্যয় ধরা হয় ৪১ হাজার ২৬১ কোটি টাকা। দুটি মেট্রোরেলই পাতাল ও উড়ালপথের সমন্বয়ে বাস্তবায়ন করা হবে। এমআরটি-১ নির্মাণ ও ট্রেন বগি ও অন্যান্য যন্ত্রাংশ কেনাসহ সব কাজ ১৪টি ভাগে (প্যাকেজে) বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এর মধ্যে ডিপো উন্নয়নের কাজ চলমান রয়েছে। জাপানি ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান এই কাজ বাস্তবায়ন করছে।
বুয়েটের পরিবহন বিশেষজ্ঞ ড. সামছুল হক বলেন, প্রতি কিলোমিটার মেট্রোরেল নির্মাণে তিন হাজার কোটি টাকা ব্যয়- যা হয়তো বিশ্ব রেকর্ড করবে। নিঃসন্দেহে এটি অতিমূল্যায়িত উন্নয়ন। তিনি আরও বলেন, নমনীয় ঋণের আড়ালে জাইকা অযৌক্তিক শর্ত চাপিয়ে দিয়েছে, যা বাংলাদেশের স্বার্থের জন্য ক্ষতিকর।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বিগত ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে প্রকল্প ব্যয় তুলনামুলকভাবে অনেক বেশি করে প্রাক্কলন করা হয়েছে। যা মুলত একশ্রেণির কর্মকর্তা এবং ক্ষমতাসীন অসৎ রাজনীতিবিদদের ব্যক্তিগত স্বার্থ রক্ষার্থে করা হয়েছে।
অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এসব ‘দুর্বৃত্তায়ন’ ও দেশের স্বার্থ নষ্ট করার প্রবণতা বন্ধ করার ব্যাপারে সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন, যা দেশের স্বার্থে ইতিবাচক বলে মনে করেন তারা।
ভোরের আকাশ/এসএইচ