সরকারি কর্মচারীদের বিশেষ সুবিধা
আকতার হোসেন
প্রকাশ : ০৪ জুন ২০২৫ ০৮:৫২ এএম
ছবি: সংগৃহীত
আগামী জুলাই থেকে সরকারি চাকরিজীবীদের বিশেষ প্রণোদনার হার বিদ্যমান ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে সরকার। ১০ম থেকে ২০তম গ্রেডভুক্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এই ৫ শতাংশসহ মোট ১৫ শতাংশ এবং ১ম থেকে ৯ম গ্রেডভুক্ত কর্মকর্তারা মোট ১০ শতাংশ হারে বিশেষ প্রণোদনা পাবেন। গতকাল মঙ্গলবার অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে এ বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে। এই বৃদ্ধির ফলে সরকারি চাকরিজীবীদের মধ্যে ১ম গ্রেড থেকে ৯ম গ্রেডভুক্ত কর্মকর্তারা অতিরিক্ত ৫ শতাংশ এবং ১০ম গ্রেড থেকে ২০তম গ্রেডভুক্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা অতিরিক্ত ১০ শতাংশ হারে বিশেষ প্রণোদনা পাবেন।
এতে সরকারের বাড়তি প্রায় ৭ হাজার কোটি টাকা ব্যয় হবে। এর আগে উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিবেচনায় নিয়ে ২০২৪ সালের নির্বাচনের আগে ২০২৩ সালের জুলাই থেকে সরকারি চাকরিজীবীদের বার্ষিক ৫ শতাংশ ইনক্রিমেন্টের পাশাপাশি অতিরিক্ত ৫ শতাংশ হারে বিশেষ প্রণোদনা ঘোষণা করেছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
সরকারি চাকরিজীবীদের বিশেষ প্রণোদনা বৃদ্ধির ঘোষণা সম্পর্কে জানতে চাইলে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন, মূল্যস্ফীতির চাপ সবার ওপর বাড়ছে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি নিয়েছে। এরকম সময়ে সরকার তার কর্মীদের বিশেষ সুবিধা বাড়ালে সেটি মূল্যস্ফীতিকে উসকে দিতে পারে। কারণ এর আগে বিভিন্ন হিসাব থেকে দেখা গেছে, সরকারি চাকরিজীবীদের বিশেষ সুবিধা বাড়ালে প্রায় ৭ হাজার কোটি টাকা বাড়তি ব্যয় হবে। এতে বৈষম্যও বাড়তে পারে। কারণ ব্যক্তি খাত বেতন বাড়াবে না।
তিনি বলেন, এরকম পরিস্থিতিতে সামাজিক নায্যতা নিশ্চিত করতে সরকারকে অন্যান্য পদক্ষেপও নিতে হবে, যাতে বেসরকারি খাতের মানুষদের করের চাপ কমে। বেসরকারি খাতে নিয়োজিতদের ব্যয়ের চাপ কমাতে সরকারি সেবা কম খরচে ও বিনামূল্যে পাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।
রাষ্ট্রপতির আদেশক্রমে অর্থ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব দিলরুবা শাহীনা স্বাক্ষরিত প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, সরকারি চাকরি আইন, ২০১৮ এর ১৫ ধারায় প্রদত্ত ক্ষমতাবলে জাতীয় বেতনস্কেলের আওতাভুক্ত সরকারি-বেসামরিক, স্বশাসিত এবং রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলো, ব্যাংক, বীমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ ও পুলিশ বাহিনীতে নিয়োজিত কর্মচারী এবং পুনঃস্থাপনকৃত পেনশনাররাসহ পেনশনভোগী ব্যক্তিদের জন্য ১ জুলাই ২০২৫ তারিখ থেকে বেতনগ্রেড ভেদে (গ্রেড ১ এবং তদূর্ধ্ব থেকে গ্রেড ৯ পর্যন্ত) ১০ শতাংশ এবং (গ্রেড ১০ থেকে গ্রেড ২০ পর্যন্ত) ১৫ শতাংশ হারে ‘বিশেষ সুবিধা’ প্রদান করা হলো।
এ ‘বিশেষ সুবিধা’ চাকরিরতদের ক্ষেত্রে ন্যূনতম ১০০০ টাকা এবং পেনশন ভোগীদের ক্ষেত্রে ন্যূনতম ৫০০ টাকা হারে প্রদেয় হবে। এ বিশেষ সুবিধা নিম্নরূপভাবে কার্যকর হবে- ১ জুলাই ২০২৫ তারিখ থেকে প্রতিবছর ১ জুলাই তারিখে প্রাপ্য মূল বেতনের ওপর গ্রেড ১ ও তদূর্ধ্ব থেকে গ্রেড ৯ এর অন্তর্ভুক্ত চাকরিরত কর্মচারীরা ১০ শতাংশ হারে এবং গ্রেড ১০ থেকে গ্রেড ২০ এর অন্তর্ভুক্ত চাকরিরত কর্মচারীরা ১৫ শতাংশ হারে ‘বিশেষ সুবিধা’ প্রাপ্য হবেন।
অবসর-উত্তর ছুটিতে (পিআরএল) থাকা কর্মচারীরা পিআরএল গমনের পূর্বকালীন সর্বশেষ প্রাপ্ত মূল বেতনের ভিত্তিতে উপর্যুক্ত (ক) অনুচ্ছেদে বর্ণিত গ্রেডভিত্তিক হারে ‘বিশেষ সুবিধা’ প্রাপ্য হবেন। পেনশন পুনঃস্থাপনকৃত কর্মচারীরাসহ সরকার থেকে পেনশন গ্রহণকারী কর্মচারীরা পেনশনের বিদ্যমান অংশের ওপর উপর্যুক্ত (ক) অনুচ্ছেদে বর্ণিত গ্রেডভিত্তিক হারে ‘বিশেষ সুবিধা’ প্রাপ্য হবেন। যেসব অবসর গ্রহণকারী কর্মচারী তাদের গ্রস পেনশনের ১০০ শতাংশ অর্থাৎ সম্পূর্ণ অংশ সমর্পণ করে এককালীন আনুতোষিক উত্তোলন করেছেন এবং এখনো পেনশন পুনঃস্থাপনের জন্য উপযুক্ত হননি, তাদের ক্ষেত্রে এ ‘বিশেষ সুবিধা’ প্রযোজ্য হবে না।
জাতীয় বেতনস্কেলে নির্ধারিত কোনো গ্রেডে সরকারি কর্মচারী চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের ক্ষেত্রে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের অব্যবহিত পূর্বে সর্বশেষ আহরিত তার মূল বেতনের ভিত্তিতে এ সুবিধা প্রযোজ্য হবে। তবে শর্ত থাকে যে এরূপ চুক্তিভিত্তিক নিয়োজিত ব্যক্তি পেনশনভোগী হলে পেনশনের বিদ্যমান অংশ অথবা চুক্তিভিত্তিক নিয়োজিত হওয়ার অব্যবহিত পূর্বের সর্বশেষ আহরিত মূল বেতনের ভিত্তিতে যেকোনো এক ক্ষেত্রে এ সুবিধা প্রাপ্য হবেন।
সাময়িক বরখাস্তকৃত কর্মচারীরা সাময়িক বরখাস্ত হওয়ার তারিখের অব্যবহিত পূর্বের মূল বেতনের ৫০ শতাংশ (অর্ধেক) এর ওপর উপর্যুক্ত (ক) অনুচ্ছেদে বর্ণিত গ্রেডভিত্তিক হারে ‘বিশেষ সুবিধা’ প্রাপ্য হবেন; এবং বিনা বেতনে ছুটিতে (লিভ উইদাউট পে) থাকাকালীন কর্মচারীরা এ ‘বিশেষ সুবিধা’ প্রাপ্য হবেন না।
প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, সরকারের রাজস্ব বাজেট থেকে প্রদত্ত অনুদানে পরিচালিত প্রতিষ্ঠান ব্যতীত অন্যান্য স্বশাসিত সংস্থা ও রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান এবং ব্যাংক, বীমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মচারীদের ক্ষেত্রে যারা জাতীয় বেতনস্কেল ২০১৫ এর আওতাভুক্ত, এ ‘বিশেষ সুবিধা’ প্রদান বাবদ প্রয়োজনীয় ব্যয় সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর নিজস্ব বাজেট থেকে মেটাতে হবে। অর্থ বিভাগের আদেশ নং ০৭.০০.০০০০.১৬১,৯৯.০১০,২৩-১৩২, তারিখ: ১৮/০৭/২০২৩ বাতিল করা হলো বলেও এতে উল্লেখ করা হয়। প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, জনস্বার্থে এ প্রজ্ঞাপন জারি করা হলো এবং ১ জুলাই ২০২৫ তারিখ থেকে এটি কার্যকর হবে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সরকারি কর্মচারীদের জন্য মহার্ঘ ভাতা নয়, ঘোষণা করা হয়েছে বিশেষ সুবিধা। সরকারের ঘোষণা অনুসারে, ১ জুলাই ২০২৫ তারিখ থেকে বেতন গ্রেডভেদে গ্রেড-১ ও তদূর্ধ্ব থেকে গ্রেড-৯ পর্যন্ত ১০ শতাংশ এবং গ্রেড-১০ থেকে গ্রেড-২০ পর্যন্ত ১৫ শতাংশ হারে ‘বিশেষ সুবিধা’ দেওয়া হবে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগের প্রজ্ঞাপনে এই তথ্য জানানো হয়েছে।
আরও বলা হয়েছে, এই বিশেষ সুবিধা চাকরিরত ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে ন্যূনতম ১ হাজার টাকা ও পেনশনভোগীদের ক্ষেত্রে ন্যূনতম ৫০০ টাকা হবে। জাতীয় বেতন স্কেলের আওতাভুক্ত সরকারি-বেসামরিক, স্বশাসিত, রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলো, ব্যাংক, বীমা, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ ও পুলিশ বাহিনীতে নিয়োজিত কর্মচারী ও পেনশনভোগীদের (পুনঃস্থাপনকৃত) জন্য এই বিশেষ সুবিধা কার্যকর হবে। গত সোমবার ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে সরকারি কর্মচারীদের জন্য বিশেষ সুবিধা বৃদ্ধির প্রস্তাব করেন অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ।
তিনি বাজেট বক্তৃতায় বলেন, ২০১৫ সালের পর বেতনকাঠামো না হওয়ার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে এবারের বাজেটে সরকারি কর্মচারীদের জন্য বিশেষ সুবিধার পরিমাণ বৃদ্ধির প্রস্তাব করছি। দীর্ঘদিন ধরে সরকারি কর্মচারীদের মহার্ঘ ভাতার বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হচ্ছে।
অর্থ উপদেষ্টা সাংবাদিকদের জানিয়ে ছিলেন, মহার্ঘ ভাতার বিষয়টি অ্যাকটিভলি কনসিডার করছি। একটা কমিটিকে দায়িত্ব দিয়েছি। তারা এটা নিয়ে কাজ করছে। মহার্ঘ ভাতা হওয়ার চান্স মোটামুটি। হয়তো একটু সময় লাগবে। শেষমেশ মহার্ঘ ভাতা নামে নয়, সরকারি কর্মচারীদের বিশেষ সুবিধা নামে এই অতিরিক্ত ভাতা দেওয়া হচ্ছে।
প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, অবসরোত্তর ছুটিতে (পিআরএল) থাকা কর্মচারীরা পিআরএলে যাওয়ার আগপর্যন্ত সর্বশেষ প্রাপ্ত মূল বেতনের ভিত্তিতে বর্ণিত গ্রেডভিত্তিক হারে ‘বিশেষ সুবিধা’ পাবেন। পেনশন পুনঃস্থাপনকৃত কর্মচারীরা সরকার থেকে পেনশন গ্রহণকারী কর্মচারীদের পেনশনের বিদ্যমান অংশের ওপর বর্ণিত গ্রেডভিত্তিক হারে বিশেষ সুবিধা পাবেন। যেসব অবসর গ্রহণকারী কর্মচারী মোট পেনশনের ১০০ শতাংশ অর্থাৎ সম্পূর্ণ অংশ সমর্পণ করে এককালীন আনুতোষিক উত্তোলন করেছেন এবং এখনো পেনশন পুনঃস্থাপনের উপযুক্ত হননি, তাদের ক্ষেত্রে এ বিশেষ সুবিধা প্রযোজ্য হবে না। এ ছাড়া বিনা বেতনে ছুটিতে থাকা কর্মচারীরা এই বিশেষ সুবিধা পাবেন না।
উল্লেখ্য, ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট বক্তব্যে অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ সরকারি চাকরিজীবীদের বিশেষ প্রণোদনা বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছেন। সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ২০১৫ সালের পর থেকে কোনো বেতন কাঠামো না হওয়ার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে সরকারি কর্মচারীদের বিশেষ সুবিধা বাড়ানোর প্রস্তাব করছি।
বাজেট ডকুমেন্ট অনুযায়ী, ২০২৫-২৬ অর্থবছরে সরকারি চাকরিজীবীদের মধ্যে অফিসারদের মূল বেতন হিসেবে ব্যয় হবে ১৩ হাজার ৩৪২ কোটি টাকা, কর্মচারীদের বেতন বাবদ ব্যয় হবে ৩০ হাজার ১ কোটি টাকা। আর অফিসার ও কর্মচারীদের বিভিন্ন ভাতা বাবদ ব্যয় হবে ৪০ হাজার ৭৭১ কোটি টাকা। সেই হিসাবে ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন-ভাতায় বরাদ্দ করা হয়েছে মোট ৮৪ হাজার ১১৪ কোটি টাকা।
চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে অফিসারদের বেতন বাবদ বরাদ্দ রয়েছে ১২ হাজার ২১৭ কোটি টাকা, কর্মচারীদের বেতন বাবদ ২৮ হাজার ৬৭৫ কোটি টাকা এবং কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ভাতা বাবদ ৩৮ হাজার ৩৫৫ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটে এ খাতে ৮১ হাজার ৫৮০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হলেও সংশোধিত বাজেটে তা কমিয়ে ৭৯ হাজার ২৪৭ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে।
মূলত ২০২৫-২৬ অর্থবছরে প্রায় ৫০ হাজার সরকারি চাকরিজীবী অবসরে যাবেন। ফলে পেনশনার সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াবে ৮.৫০ লাখ। এ কারণে পেনশন খাতে সরকারের ব্যয় বেশি বাড়লেও বিশেষ প্রণোদনা বাড়ানো সত্ত্বেও বেতন-ভাতায় বরাদ্দের পরিমাণ সে তুলনায় বাড়ছে না।
ভোরের আকাশ/এসএইচ