নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ : ০৯ মার্চ ২০২৫ ১১:১৫ এএম
শক্তি জানান দিচ্ছে জামায়াতে ইসলামী
এম. সাইফুল ইসলাম : ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচনের দিনক্ষণ ঠিক না হলেও প্রার্থী ঘোষণা দিয়ে মাঠে নেমেছে জামায়াত ইসলামী। দলটির মনোনীত প্রার্থীরা ইতোমধ্যেই প্রচার-প্রচারণা শুরু করে দিয়েছেন। মূলত দলটির সাংগঠনিক ভিত্তি জানান দেওয়া এবং নির্বাচনি প্রচারণায় এগিয়ে থাকতেই দলটির এমন উদ্যোগ বলে জানা গেছে। এরইমধ্যে হাতেগোনা কিছু আসন বাদে মোটামুটি দেশের বেশিরভাগ জায়গায় দলটির প্রার্থী ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। যা ‘প্রাথমিক বাছাই’ হিসেবে উল্লেখ করা হচ্ছে দলটির পক্ষ থেকে। এই প্রাথমিক বাছাই প্রার্থীরা ভোটের প্রচারে নেমে পড়েছেন। গত বছরের ৫ আগস্টের পর পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে দলটির প্রার্থীরা বেশ সাড়া পাচ্ছেন বলেও দাবি দলটির। তবে নির্বাচনে কোনো জোটে যদি জামায়াত যোগ দেয়, তাহলে দলটির প্রার্থী তালিকা বড় ধরনের পরিবর্তনও আসতে পারে।
দলটির কেন্দ্রীয় সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার বলছেন জামায়াত প্রার্থী তালিকা এখনো চূড়ান্ত করেনি। যা শুনতে পাচ্ছেন সেটা মূলত প্রাথমিক বাছাই। এ বাছাইয়ে মনোনীতরা জনগণের কাছে ইসলাম ও দলের দাওয়াত নিয়ে যাচ্ছেন। এখানে যারা ভালো করবেন তারাই পরবর্তীতে চূড়ান্ত প্রার্থী হবেন। এছাড়া নির্বাচনে জোট গঠনসহ বেশ কিছু বিষয় রয়েছে। যা কোনো কিছুই চূড়ান্ত নয়। ফলে চূড়ান্ত মনোনয়নের আগে আসলে কাউকে চূড়ান্ত প্রার্থী ঘোষণা করা হয়েছে এটি বলা সঠিক হবে না।
জানা গেছে, গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার পতনের মধ্য দিয়ে দীর্ঘদিন পর স্বস্তি ফেরে জামায়াতের নেতাকর্মীদের মধ্যে। আওয়ামী লীগের শাসনামলের পুরো সময়টাই দলটির ওপর দিয়ে নানা নির্যাতনের খড়গ নেমেছিল। হামলা-মামলা ও শীর্ষ নেতাদের বিচারের নামে হত্যা করা হয়েছে বলেও অভিযোগ দলটির। সে অবস্থার পরিবর্তনের পর ধর্মভিত্তিক দলটি এখন বেশ ফুরফুরে অবস্থায় রাজনীতির মাঠে নামে। পট পরিবর্তনের পর সংগঠনকে শক্তিশালী করার পাশাপাশি বেদখল বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ফিরে পাওয়ার কাজেও মাঠে নামে জামায়াত ইসলামী। এখন দলটির প্রধান টার্গেট হচ্ছে আগামী সংসদ নির্বাচন। সে লক্ষ্যে প্রার্থী বাছাই করার কাজ শুরু করে দিয়েছে। এরই অংশ হিসেবে বিভিন্ন সংসদীয় আসনে প্রাথমিকভাবে প্রার্থীতা ঘোষণা করা হয়েছে। এছাড়াও দল গোছানোর জন্য রাজনৈতিক কর্মসূচির পাশাপাশি সামাজিক ও নানামুখী কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে দলটি।
বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস নির্বাচনের কোনো রোডম্যাপ ঘোষণা করেননি। তিনি বারবার বলছেন করলেও কম সংস্কার চাইলে ডিসেম্বর আর বেশি সংস্কার চাইলে আগামী বছরের জুনের মধ্যেই জাতীয় নির্বাচন। তবে, জুলাই আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্র নেতারা বারবার বলছেন, কার্যকর একটি সংস্কার বা ‘ফ্যাসিস্ট’ শেখ হাসিনাসহ অপরাধীদের বিচারের আগ পর্যন্ত দেশে নির্বাচন হতে দেওয়া হবে না। তাদের এই বক্তব্যে জামায়াতেরও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সায় মিলেছে। তাই নির্বাচন নিয়ে বেশ ধোঁয়াশাও সৃষ্টি হয়েছে।
দলটির কেন্দ্রীয় দপ্তর সূত্র বলছে জেলা কমিটি গঠন শেষ হওয়ার পরপরও জানুয়ারি থেকে দলটি আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলটির প্রার্থীদের প্রামিক বাচাই প্রক্রিয়া শুরু করে। যা এখনো অব্যাহত রয়েছে। ইতোমধ্যেই বেশিরভাগ আসনের প্রাথমিক প্রার্থী তালিকা বাছাই করা হয়েছে।
জামায়াতের দলীয় সূত্র বলছে অন্যান্য দলের সঙ্গে জামায়াতের প্রার্থী তালিকা প্রকাশের পদ্ধতিগত বেশ পার্থক্য রযেছে। তৃণমূলের ভোটের মাধ্যমেই দলটির প্রার্থী নির্বাচন করা হয়ে থাকে। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। এবার কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের সদস্য ও নির্বাচনি বোর্ড পরিচালনার সভাপতি অধ্যক্ষ ইজ্জত উল্লাহর নেতৃত্বাধীন একটি টিম সারাদেশে নির্বাচনি আসনে গিয়ে দলের ‘রোকনদের’ মতামত নিয়ে প্রার্থী বাছাই করেছেন।
ঘোষিত প্রার্থী তালিকা অনুযায়ী দলটির আমির ডা. শফিকুর রহমান নির্বাচন আগামী নির্বাচনে দুটি আসনে ভোট করতে চান তিনি। নিজ বাড়ি সুনামগঞ্জ হওয়ায় সেখানকার একটি আসনের পাশাপাশি ঢাকা-১৫ আসনে নির্বাচন করবেন। এর আগেও তিনি ঢাকা-১৫ আসনে প্রার্থী ছিলেন। অন্যদিকে দলের সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার খুলনা-৫, নায়েবে আমির অধ্যাপক মুজিবুর রহমান রাজশাহী-১, ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মো. তাহের কুমিল্লা-১১, আ ন ম শামসুল ইসলামকে চট্টগ্রাম-১৫ আসনের প্রার্থী হিসেবে মনোনীত করা হয়েছে।
এছাড়া সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আজাদ কক্সবাজার-২, অ্যাডভোকেট এহসানুল মাহবুব জোবায়ের সিলেট-১, প্রচার বিভাগের সেক্রেটারি মতিউর রহমান আকন্দ ময়মনসিংহ-৫, নির্বাহী পরিষদের সদস্য ও নির্বাচনি বোর্ড পরিচালনার সভাপতি অধ্যক্ষ ইজ্জত উল্লাহ সাতক্ষীরা-১, ঢাকা মহানগর উত্তরের আমির মুহাম্মদ সেলিম উদ্দিন সিলেট-৬ আসনে ও ঢাকা মহানগর দক্ষিণের আমির নুরুল ইসলাম বুলবুল চাঁপাইনবাবগঞ্জ-৩ আসন থেকে নির্বাচন করবেন।
এছাড়া দলটির আলোচিত প্রার্থীদের মধ্যে পটুয়াখালী-২ (বাউফল) আসনে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ জামায়াতের সেক্রেটারি ড. শফিকুল ইসলাম মাসুদ, পিরোজপুর-১ (ইন্দুরকানী-সদর-নাজিরপুর) আসনে মাসুদ সাঈদী, পিরোজপুর-২ (ভান্ডারিয়া-কাউখালী-স্বরূপকাঠী) আসনে শামীম সাঈদী, সুনামগঞ্জ-২ আসন থেকে আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনিরের নাম রয়েছে। এভাবে বেশিরভাগ আসনে নিজেদেরকে প্রার্থীদের পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে দলটি। এদিকে, কবে জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে সেটি এখন নিশ্চিত করে বলা কারও পক্ষেও সম্ভব নয়। তাই অনেকের প্রশ্ন এতো আগে-ভাগেই কেন জামায়াত প্রার্থী তালিকা প্রকাশ করেছে? এ প্রশ্নের উত্তর জানতে জামায়াতের কেন্দ্রীয় থেকে শুরু করে মাঠ পর্যায় পর্যন্ত দৈনিক ভোরের আকাশ-এর পক্ষ থেকে অনুসন্ধান চালানো হয়।
এ বিষয়ে জামায়াতের কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য নির্বাহী পরিষদের সদস্য ও কেন্দ্রীয় নির্বাচন পরিচালনা কমিটির দায়িত্বে থাকা অধ্যক্ষ ইজ্জত উল্লাহ দৈনিক ভোরের আকাশকে বলেন, আসলে আমরা প্রাথমিক একটা তালিকা করেছি। এটি চূড়ান্ত নয়। নির্বাচনের দিনক্ষণ চূড়ান্ত হলে আমরা প্রার্থী তালিকাও চূড়ান্ত করবো। নির্বাচনে অন্য কোনো দলের সঙ্গে জোট হতে পারে কিনা প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আগামী নির্বাচন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সুতরাং কোনো কিছুই আমরা উড়িয়ে দিচ্ছি না।
যশোর জেলা জামায়াতের আমীর অধ্যাপক গোলাম রসুল দৈনিক ভোরের আকাশকে বলেন, গত প্রায় ১৬ বছর জামায়াতে ইসলামী স্বাভাবিকভাবে রাজনৈতিক কাজ করতে পারেনি। ৫ আগস্টের পর স্বাভাবিক রাজনীতির পরিবেশ আমরা পাচ্ছি। আমরা ইসলামের দাওয়াতের পাশাপাশি দলীয় কর্মকাণ্ড মানুষের কাছে পৌঁছে দিচ্ছি। মানুষ আমাদেরকে ব্যাপকভাবে সাড়া দিচ্ছেন। যেহেতু সামনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে আলোচনা চলছে, তাই দল প্রাথমিক প্রার্থী বাছাই কাজ করছে। বাছাইয়ে মনোনীত প্রার্থীরা মানুষের কাছে যাচ্ছেন। নিজেদেরকে পরিচিত করছেন। মানুষও সাড়া দিচ্ছেন। দুর্নীতি ও চাঁদাবাজমুক্ত দেশ গড়তে জামায়াতের কোনো বিকল্প নেই এটা এখন মানুষের কাছে পরিষ্কার।
তবে উপজেলা ও বিভিন্ন ইউনিটের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছেÑ পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগসহ দলটির সমমনারা এখন রাজনীতির বাইরে। এছাড়া সংসদ নির্বাচনের আগে ছাত্ররা নতুন রাজনীতিক দল গঠন করেছে। নির্বাচনে শক্ত অবস্থায় থাকা বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থীরাও নিজ নিজ এলাকায় নানা কর্মসূচি দিয়ে মাঠে রয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে দলটি প্রচার-প্রচারণায় এগিয়ে থাকতে চায়। পাশাপাশি দলের সাংগঠনিক শক্ত ভিত্তি জানান দিতেই সবার আগেই জামায়াত নির্বাচনের মাঠে। প্রার্থী ঘোষণার মাধ্যমে অন্যান্য দলের কাছে বিশেষ বার্তা পৌঁছাতে দলটির এমন উদ্যোগ।
এদিকে, বারবার সংসদ নির্বাচনে নিজস্ব প্রতীক ‘দাড়িপাল্লা’ নিয়ে ভোট করে নির্বাচিত হয়ে জাতীয় সংসদে প্রতিনিধিতও¡ করেছে জামায়াত। তবে একটি রিট মামলার পর জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল করে ২০১৩ সালের ১ আগস্ট রায় দেন হাইকোর্ট। ওই বছরের ২ নভেম্বর হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হওয়ার পর জামায়াত ওই আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করে। যদিও জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল করে ২০১৮ সালের ৭ ডিসেম্বর প্রজ্ঞাপন জারি করে ইসি। তারপর থেকে দলটির আর নিবন্ধন নেই। আপিল বিভাগে জামায়াতের নিবন্ধনের বিষয়টি এখনো বিচারাধীন। তবে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের ঠিক আগ মুহূর্তে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করে যে প্রজ্ঞাপন জারি করেছিল তা প্রত্যাহার করেছে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। ফলে দল হিসেবে স্বাভাবিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে জামায়াতের জটিলতা কেটেছে। তবে নিবন্ধন না থাকায় দলীয় ব্যানারে ও প্রতীকে ভোট করতে সমস্যায় পড়তে হতে পারে দলটিকে।
ভোরের আকাশ/মি