মাজাহারুল ইসলাম
প্রকাশ : ০১ অক্টোবর ২০২৫ ১২:২৯ এএম
প্রতীকী ছবি
গণহত্যার দায়ে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধ করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। একই সঙ্গে দলটির নিবন্ধন স্থগিত করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। বিচার প্রক্রিয়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত আওয়ামী লীগ কোনো নির্বাচনে অংশ নিতে পারছেন না। কাজেই দলটির অস্তিত্বহীনতায় দেশে ভোটের মাঠে যে শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে, সেটি পূরণের জন্য নানা কৌশল গ্রহণ করছে দেশের বিদ্যমান রাজনৈতিক দলগুলো। আগামী ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় সংসদ নির্বাচন পূর্ব ভোটের মাঠে চলছে এই নিয়ে হিসাব-নিকাশ ও চুলচেরা বিশ্লেষণ। আওয়ামী লীগের অনুপস্থিতিতে কোন দিকে ঝুঁকছে দলটির কর্মী-সমর্থকদের ভোট, এটাই এখন প্রশ্ন।
এমন পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক বিশ্লেষকসহ রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা ধারণা করছেন, রাজনীতির মাঠে ১৯৮৬ সালের পূর্ব থেকেই আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির মধ্যে একটা গভীর সখ্যতা গড়ে উঠে। রাজনীতির ধারাবাহিকতায় গত ১৫ বছর তারা একই সেতুবন্ধনে ঐক্যবদ্ধ ছিল। কোনো মামলা বা সহিংসতার অভিযোগ নেই- এমন ক্লিন ইমেজের আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীকে জাতীয় পার্টিতে (জাপা) যোগ দিয়ে দলীয় মনোনয়ন দেওয়ার কথাও জানিয়েছেন দলটির শীর্ষ পর্যায়ের এক নেতা।
এটিও আওয়ামী সমর্থকদের ভোট পাওয়ার জন্য জাতীয় পার্টির একটি স্ট্যান্টবাজি মনে করছেন রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা। কাজেই আওয়ামী লীগ বিহীন ভোটের মাঠে দলটির সমর্থকদের ভোট জাতীয় পার্টির দিকে যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। তবে, জাতীয় পার্টি যদি নির্বাচনের মাঠ থেকে ছিটকে পড়ে, সে ক্ষেত্রে বিএনপি ও ১৪ দলীয় জোটের বাকি যে দলগুলো অথাৎ বাম ঘরনার রাজনৈতিক দলগুলো ১২ দলীয় জোটের প্রার্থীদের দিকে চলে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকছে আওয়ামী সমর্থকদের সিংহভাগ ভোট- এমনটাই ভাবছেন রাজনৈতিক মহল।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা এটাও মনে করছেন, বিএনপি ও জামায়াত আওয়ামী সমর্থকদের ভোট প্রত্যাশা করলেও মাঠের চিত্র ভিন্ন। আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গ সংগঠনের কর্মী-সমর্থকরা তাদের ব্যবসা-বাণিজ্যসহ নিজেদের টিকিয়ে রাখার জন্য বিএনপি ও জামায়াতের সঙ্গে মিলেমিশে থাকার চেষ্টা করছে। তবে মিলেমিশে থাকা আর অন্তরের চিত্র এক নয়। নৌকায় ভোট দেওয়ার অভ্যস্ত আওয়ামী সমর্থকরা কখনোই বিএনপি অথবা জামায়াতে ইসলামীকে ভোট দিবে না। প্রথমত, বিএনপিকে ভোট না দেওয়ার কারণ আওয়ামী লীগের অপকর্মের বিরুদ্ধে সব সময় বিএনপি আন্দোলন সংগ্রাম করে আসছে। এমনকি শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার দেশ থেকে পালাতে বাধ্য হওয়ার পিছনে মুখ্য ভূমিকা ছিল বিএনপির। ছাত্র-জনতার কোটার আন্দোলনকে এক দফায় টেনে নিয়ে আসে বিএনপি।
অপরদিকে, জামায়াতকে আওয়ামী লীগের ভোট দেওয়ার সম্ভাবনাও ক্ষীণ। তবে, ব্যবসা-বাণিজ্য টিকিয়ে রাখার পাশাপাশি নির্যাতন-নীপিড়ন এড়িয়ে থাকার লক্ষ্যে কিছু আওয়ামী সমর্থক রয়েছে অর্থাৎ দলটির ১% থেকে ৩% ভোটার তাদের ভোট বিএনপি ও জামায়াত পেতে পারে।
বিশ্লেষকদের ধারনা, রাজনৈতিক মাঠের চিত্র বিশ্লেষণে দেখা যায়, জামায়াত কখনো জাতীয় পার্টির সঙ্গে, কখনো বিএনপির সঙ্গে আবার কখনো আওয়ামী লীগের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে ছিল। এছাড়া, বিএনপির সঙ্গে জামায়াত ঐক্যবদ্ধ হয়ে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে আন্দোলন করলেও গত ১৫ বছর রাজনৈতিক কৌশল নিয়ে আওয়ামী লীগ ও তাদের অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীদের সঙ্গে থেকেই দলীয় কার্যক্রম করেছে। সেক্ষেত্রে দলটির সঙ্গে কিছুটা হলেও সখ্যতা রয়েছে জামায়াতের। পাশাপাশি ভারতের সঙ্গে লবিং করে আওয়ামী সমর্থকদের ভোট আদায়ের চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে জামায়াতে ইসলামী- এমনটাই ধারণা বিশিষ্টজনদের। এনসিপিও আওয়ামী কর্মী-সমর্থকদের ভোট নিজের দিকে টানার চেষ্টায় আছে বলেই মনে করছেন দেশের এই রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
আওয়ামী লীগের একটি বিশাল ও সুগঠিত ভোটব্যাংক রয়েছে- বিশেষ করে শহরাঞ্চল, গ্রামাঞ্চলের বিভিন্ন এলাকায় এবং নির্দিষ্ট শ্রেণি-পেশার জনগোষ্ঠীর মধ্যে। এই ভোটারদের সামনে এখন কঠিন প্রশ্ন : তারা কি আগামী নির্বাচনে ভোট দেবেন? দলে নিষেধাজ্ঞা থাকা অবস্থায় তারা কাকে সমর্থন করবেন? নাম প্রকাশ না করার শর্তে আওয়ামী লীগের একনিষ্ট এক সমর্থক বলছেন, আপনারা কি ভুলে গিয়েছেন আওয়ামী লীগের সময় যখন বিএনপি ভোট কেন্দ্রে যায়নি, তারা ভোটকে বয়কট করেছিলেন, তেমনিভাবে আওয়ামী লীগ ছাড়া নির্বাচন করলে তারা ভোট কেন্দ্রে না যাওয়ার সম্ভাবনা থাকছে।
তিনি আরও বলেন, স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াতকে কোন দিন ভোট দেব না। তবে জাতীয় পার্টি দীর্ঘ দিন আওয়ামী লীগের সঙ্গে ছিল বলেও তাদের দিকে সফট কর্ণার থাকবে আওয়ামী কর্মী-সমর্থকদের। বিএনপি মনে করছে, আওয়ামী লীগের নেতাসহ অনেকেই ভোট দেওয়া থেকে বিরত থাকতে পারে। তবে দলটির সমর্থকরা ভোট দিতে কেন্দ্রে আসবে। স্বাধীনতার পক্ষের দল হিসেবে বিএনপি, আওয়ামী সমর্থকদের ভোট আশা করে। একইসঙ্গে একাত্তরের বিতর্কিতদের আওয়ামী সমর্থকদের ভোট দিবে না বলেও মনে করছেন তারা। কেননা ধর্মভিত্তিক কোনো দলকে আওয়ামী লীগের সমর্থকদের ভোট দেওয়ার সম্ভাবনা কম। জয়ের সম্ভাবনা না থাকলে তারা বামপন্থি প্রার্থীকেও ভোট দিতে আগ্রহী হবেন না।
জাতীয় পার্টির বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে, আওয়ামী লীগের ভোটসহ সুইং ভোটারদের ভোটের দিকে দৃষ্টি রয়েছে দলটির। তারা মনে করছে, দীর্ঘ রাজনৈতিক পরিক্রমায় আওয়ামী লীগের সঙ্গে গভীর সখ্যতা রয়েছে জাতীয় পার্টির। জলন্ত উদাহরণ ১৯৮৬ সালের জাতীয় পার্টির একতরফা নির্বাচনকে বৈধতা দেওয়ার লক্ষ্যে আওয়ামী লীগ ঐ নির্বাচনে অংশ নেয়। তারই ধারাবাহিকতায় গত ১৬ বছর আওয়ামী লীগের সঙ্গে সখ্যতার সুবাধে জাতীয় পার্টি সরকারে এবং বিরোধী দলে থেকে সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করেছে।
সে দৃষ্টিকোন থেকে তারাই আওয়ামী সমর্থক ভোটারদের ভোট পাওয়ার প্রত্যাশা করছেন। আওয়ামী লীগের সমর্থক হলেও যার বিরুদ্ধে কোনো মামলা বা সহিংসতার অভিযোগ নেই এবং রাজনৈতিক অঙ্গনে ‘ক্লিন ইমেজ’ রয়েছে, সেই ব্যক্তি জাতীয় পার্টিতে (জাপা) যোগ দিয়ে দলীয় মনোনয়ন পেতে পারেন বলে জানিয়েছেন দলের কো-চেয়ারম্যান মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কাজী মো. মাহবুবুর রহমান বলেছেন, ধরা যায়, ৮২ সাল থেকেই আওয়ামী লীগের দীর্ঘ জীবনের রাজনৈতিক সঙ্গী হলো জাতীয় পার্টি। ৮৬ সালে জাতীয় পার্টির একতরফা নির্বাচনে অংশ নেওয়ার মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগের সখ্যতা ফুঠে উঠেছে রাজনৈতিক অঙ্গনে। এরই ধারাবাহিকতায় গত ১৫ বছর আওয়ামী লীগের সঙ্গে নজিরবিহীন সেতুবন্ধনে ঐক্যবদ্ধ ছিল জাতীয় পার্টি। কখনো সরকারের অংশ, আবার কখনো বিরোধী দলের ভূমিকায় ছিল এই দলটি।
আওয়ামী লীগ ভোটের মাঠ থেকে ছিটকে পড়ায় তাদের কর্মী ও সমর্থকদের আস্থার স্থল হচ্ছে জাতীয় পার্টি। কাজেই জাতীয় পার্টি নির্বাচনের মাঠে থাকলে আওয়ামী সমর্থকদের ভোট জাতীয় পার্টির পক্ষে যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। আর কোন কারণে জাতীয় পার্টি নির্বাচন থেকে বাদ পড়ে তাহলে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের সঙ্গী বাম ঘরনাসহ ১২ দলীয় রাজনৈতিক জোটের প্রার্থীদের দিকে চলে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকছে আওয়ামী সমর্থকদের সিংহভাগ ভোট।
সম্প্রতি জাতীয় পার্টি দুইটি অংশে বিভক্তি হওয়ায় ভোটের মাঠ কতটুকু ধরে রাখতে সক্ষম হবে বলে মনে করেন-এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের দোসর হিসেবে নির্বাচনের আগমূহূর্তে দলটি যাতে ভোটের মাঠ থেকে ছিটকে না পড়ে, সেই কৌশলও থাকতে পারে দলটির। তবে ভোটের আগেই জাতীয় পার্টি এক হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলেও মনে করছেন তিনি।
আওয়ামী সমর্থকদের ভোট বিএনপি অথবা জামায়াতের দিকে আসবে কি না-জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই অধ্যাপক বলেন, আওয়ামী কর্মী-সমর্থকদের ভোট বিএনপি ও জামায়াতের প্রত্যাশা অনুযায়ী পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। গত বছর ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে দলটির প্রধানসহ নেতারা দেশ থেকে পলায়ন করেছে। তারপরও যারা দেশে রয়েছে তাদের কিছু অংশ ব্যবসা-বাণিজ্য টিকিয়ে রাখোর লক্ষ্যে বিএনপি অথবা জামায়াতের সঙ্গে মিলেমিশে থাকবে বা থাকছে। কেউ আবার দল দুইটির রাজনৈতিক মিছিল-মিটিংসহ কর্মকাণ্ডের সঙ্গেও থাকবে। কিন্তু ভোটের বেলায় থাকবে ভিন্ন চিত্র। কারণ ভোটতো গোপনে দিবে। জামায়াত মনে করতে পারে আওয়ামী লীগের ভোট তারা পাবে, কিন্ত না।
তিনি বলেন, বিএনপি বা জামায়াতের সঙ্গে প্রকাশ্যে বা গোপনে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ও সমর্থকরা সম্পর্ক রেখে চললেও ভোটের বেলায় দলটির গোপন নিদের্শনা মতে ভোট দিবে। গোপনে ভোট দিবে, কাকে দিবে, কোনো দলকে, তা জানার সুযোগ থাকছে না। সম্পর্ক রেখে চললেও আওয়ামী সমর্থকদের ভোট দেওয়ার ক্ষেত্রে হিসাব-নিকাশ থাকছে অনেক।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক, রাজনীতি বিশ্লেষক ড. দিলারা চৌধুরী বলেছেন, সারাদেশে আওয়ামী লীগের কর্মী-সমর্থকদের একটা বিশাল অংকের ভোট রয়েছে। এছাড়া, তরুণ ভোটারও রয়েছে প্রায় সাড়ে ৩ কোটি। এই ভোট যে দিকে যাবে, সেই দল ভোটের মাঠে ভালো করবে মনে করছেন তিনি।
ড. দিলারা চৌধুরী বলেন, আওয়ামী সমর্থকরা কোনো জায়গায় ভোট দিবে এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিএনপি ও জাতীয় পার্টি দুইদলই আওয়ামী লীগের কর্ম-সমর্থকদের ভোট পাবে। বিএনপি আওয়ামী লীগের ভোট টানার চেষ্টায় কৌশল নিয়েছে। তবে, আমি মনে জাতীয় পার্টির সঙ্গে আওয়ামী লীগের গভীর সখ্যতা থাকায় দলটির কর্মী-সমর্থকরা জাতীয় পার্টিকে ভোট দেওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বেশী। জামায়াতও চেষ্টা করছে। জামায়াত মাইনরিটির কমিউনিটির মধ্যে কমিটিও করেছে।
এমনকি শ্রীরাধা দত্তের সঙ্গে জামায়াত নেতা সৈয়দ আবদুল্লাহ মো. তাহের এক সাক্ষাৎকারে বলছেন, আমরা ভারতের সঙ্গে কাজ করতে আগ্রহী আছি। জামায়াত ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের মধ্য দিয়ে আওয়ামী সমর্থকদের ভোট পাওয়ার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে।
আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের সঙ্গে থাকা বাম ঘরনাসহ ১২ দলীয় রাজনৈতিক জোটের প্রার্থীদের ভোট পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে কি না-এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আসলে কি সবাই চায় ক্ষমতার সঙ্গে থাকতে, কোনো কারণে জাতীয় পাটি যদি ভোটের মাঠে না থাকে, তাহলে আওয়ামী সমর্থকদের ভোট বিএনপি দিকে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
ভোরের আকাশ/এসএইচ