নিখিল মানখিন
প্রকাশ : ০৬ এপ্রিল ২০২৫ ১০:১১ এএম
আরেক যুদ্ধের মুখে বিশ্ব
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের শুল্ক পাল্টা শুল্ক ঘোষণার পর রীতিমতো কাঁপতে শুরু করেছে বিশ্ব অর্থনীতি। আর কাউকে ছাড় দেবে না যুক্তরাষ্ট্র ট্রাম্পের এমন ঘোষণা সামরিক যুদ্ধের চেয়েও ভয়াবহ অর্থনীতি ‘যুদ্ধ’র ইঙ্গিত মিলছে। করোনাকালে বিশ্ব অর্থনীতি মন্দার কবলে পড়েছিল। সেই নাজুক পরিস্থিতি সামলাতে না সামলাতেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বৈশ্বিক অর্থনীতিকে নাজুক করে তোলে। অর্থনীতির এই ক্ষতের মধ্যেই আমদানি করা সব পণ্যে ১০ শতাংশ বেজলাইন ট্যারিফ বা ন্যূনতম শুল্ক আরোপ করেছে ট্রাম্প প্রশাসন। দেশভেদে এই হার ওঠানামা করছে। বেশ কয়েকটি দেশের ক্ষেত্রে এই শুল্ক হার ৫০ শতাংশের ওপর চলে যাচ্ছে। বাংলাদেশি পণ্যের ওপরে ৩৭ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। আগে এ হার ছিল গড়ে ১৫ শতাংশ।
গত বুধবার যুক্তরাষ্ট্রের স্থানীয় সময় বিকেল চারটায় হোয়াইট হাউসে এক সংবাদ সম্মেলনে নতুন এ শুল্ক আরোপের ঘোষণা দেন তিনি। কোন দেশের ওপর কত হারে পারস্পরিক শুল্ক আরোপ হবে, সংবাদ সম্মেলনে তার একটি তালিকা তুলে ধরেন ট্রাম্প। তার যুক্তি, নতুন এই ‘রিসিপ্রোকাল ট্যারিফ’ বা পাল্টা শুল্ক ব্যবস্থা যুক্তরাষ্ট্রকে ‘আবার সম্পদশালী’ করবে। ধারণা করা হচ্ছে, নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে প্রায় ১০০টি দেশের ওপর আরোপ করা এই শুল্ক বিশ্বব্যাপী অর্থনীতিতে বড় ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের এই শুল্কারোপের জবাবে কোন কোন দেশ পাল্টা শুল্কারোপ আবার কোন কোন দেশ সমঝোতার পথে হাঁটছে। চীনের পণ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ৩৪ শতাংশ শুল্কারোপের চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যেই বেইজিং যুক্তরাষ্ট্রের পণ্যে পাল্টা আরও ৩৪ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছে। একইসঙ্গে ট্রাম্পের নীতির জবাবে যুক্তরাষ্ট্রের ১১টি কোম্পানির বাণিজ্য চীনে বন্ধ করে দিয়েছেন সি চিন পিং। বেশ কিছু খনিজ পদার্থের রপ্তানিতেও রাশ টানা হয়েছে। চীনের এই পদক্ষেপে বিশ্ব অর্থনীতিতে নতুন করে ধাক্কা লাগবে বলে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। ট্রাম্পের শুল্কনীতির প্রতিশোধ নিতে গিয়ে অন্য দেশগুলোও যদি চীনের পদাঙ্ক অনুসরণ করে, তবে সার্বিকভাবে সারা বিশ্বের অর্থনীতি আরও দুর্বল হয়ে পড়বে।
অনেক দেশ ডোনাল্ড ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্তকে ‘বাণিজ্য যুদ্ধ’ হিসেবে আখ্যায়িত করছে। অর্থনীতিবিদরা সতর্ক করেছেন, এই বাণিজ্য যুদ্ধ শুরু হলে তাতে কেউ-ই জয়ী হবে না। আরেক অর্থনীতি ‘যুদ্ধ’র মুখে পড়বে বিশ্ব। কিন্তু ডোনাল্ড ট্রাম্প শুল্ক আরোপের ঘোষণার এই দিনটিকে যুক্তরাষ্ট্রের ‘অর্থনৈতিক স্বাধীনতা দিবস’ হিসাবে অভিহিত করে বলেন, ‘আমরা একটি স্বাধীন ও সুন্দর জাতি হতে যাচ্ছি। এই দিনটিকে আপনারা ভবিষ্যতে স্মরণ করবেন। আপনারাই তখন বলবেন, ‘তিনি ( ট্রাম্প) সঠিক ছিলেন। এই দিনটি আমাদের ইতিহাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিন।’
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে এমন অস্থিরতা আর কখনো তৈরি হয়নি বলে বলে অভিমত অর্থনীতিবিদদের। তাদের মতে, যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক ঘোষণার পর কিছু দেশ পাল্টা ব্যবস্থা নিয়েছে। যার কারণে বাণিজ্যযুদ্ধ আরও তীব্র হতে পারে। আবার কিছু দেশ সমঝোতার চেষ্টা করছে, যার কারণে পরিস্থিতি কিছুটা প্রশমিত হতে পারে। সামগ্রিকভাবে বিশ্ব অর্থনীতিতে বড় ধরনের প্রভাব পড়ছে এবং ভবিষ্যৎ এখনো অনিশ্চিত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যে বহুপক্ষীয় বাণিজ্য ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল, এর মধ্য দিয়ে তার অবসানের পথ প্রশস্ত হলো। সেই সঙ্গে অর্থনীতিতে মন্দার আশঙ্কা আছে।
কোন দেশের ওপর কত শুল্ক, আমদানিতে ন্যূনতম ১০ শতাংশ : মার্কিন অর্থনীতিকে পুনর্গঠনের জন্য অন্যান্য দেশের উপর ‘ন্যূনতম ১০ শতাংশ বেসলাইন শুল্ক’ ঘোষণা করেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। এই শুল্ক যা শনিবার থেকে কার্যকর হয়েছে। যেসব দেশ শুধুমাত্র এই বেসলাইন শুল্কর মুখোমুখি হবে, সেগুলো হলো যুক্তরাজ্য, সিঙ্গাপুর, ব্রাজিল, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, তুরস্ক, কলম্বিয়া, আর্জেন্টিনা, এল সালভাদও, সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং সৌদি আরব। এছাড়া আগামী ৯ এপ্রিল থেকে আরো প্রায় ৬০টি ওপর উচ্চতর শুল্ক আরোপ শুরু হবে। এই দেশগুলো দীর্ঘদিন ধরে মার্কিন পণ্যের ওপর উচ্চ শুল্ক আরোপ করেছিল।
এদিকে, গত ৩ এপ্রিল থেকেই বিদেশে প্রস্তুতকৃত অটোমোবাইলের ওপর ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ শুরু হয়েছে। আর যুক্তরাজ্যর ওপর ১০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হলেও ইউরোপিয়ান ইউনিয়নভুক্ত সকল দেশের পণ্য আমদানিতে ২০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। বাংলাদেশের পণ্যের ওপর নতুন করে ৩৭ শতাংশ হারে শুল্ক আরোপ করা হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের অফিস অব দ্য ইউনাইটেড স্টেট ট্রেড রিপ্রেজেন্টেটিভ, যা ইউএসটিআর নামে পরিচিত। তাতে বলা হয়েছে, ২০২৪ সালে বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল আনুমানিক ১০ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার। গত বছর যুক্তরাষ্ট্র থেকে ২ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে বাংলাদেশে। আর ২০২৪ সালে বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে পণ্য রপ্তানি হয়েছে প্রায় সাড়ে ৮ বিলিয়ন ডলারের মতো।
ঢাকায় অবস্থিত মার্কিন দূতাবাসের তথ্য বলছে, যুক্তরাষ্ট্রের যেসব পণ্য বাংলাদেশে রপ্তানি হয় তার মধ্যে রয়েছে কৃষিপণ্য (খাদ্যশস্য, বীজ, সয়াবিন, তুলা, গম এবং ভুট্টা), যন্ত্রপাতি এবং লোহা ও ইস্পাত পণ্য। আর বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের আমদানি পণ্যের মধ্যে আছে তৈরি পোশাক, জুতা, টেক্সটাইল সামগ্রী ও কৃষিপণ্য।
ট্রাম্পের নতুন শুল্ক পরিকল্পনায় দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর পণ্য আমদানিতে যুক্তরাষ্ট্র সর্বনিম্ন ১০ শতাংশ থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ ৪৮ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক আরোপ করেছে। তাদের মধ্যে চীন ৩৪ শতাংশ, ভিয়েতনাম ৪৬ শতাংশ, তাইওয়ান ৩২ শতাংশ, ইন্দোনেশিয়া ৩২ শতাংশ, জাপান ২৪ শতাংশ, দক্ষিণ কোরিয়া ২৫ শতাংশ, থাইল্যান্ড ৩৬ শতাংশ, মালয়েশিয়া ২৪ শতাংশ, কম্বোডিয়া ৪৯ শতাংশ, বাংলাদেশ ৩৭ শতাংশ, ভারত ২৬ শতাংশ, পাকিস্তান ২৯ শতাংশ, সিঙ্গাপুর ১০ শতাংশ, নেপাল ১০ শতাংশ, ফিলিপাইন ১৭ শতাংশ, শ্রীলঙ্কা ৪৪ শতাংশ, মিয়ানমার ৪৪ শতাংশ এবং লাওস ৪৮ শতাংশ।
শুল্ক আরোপ করে ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, অন্যান্য দেশ যুক্তরাষ্ট্রকে ‘বাজেভাবে’ ব্যবহার করেছে এবং আমেরিকান পণ্যের ওপর অসম শুল্ক আরোপ করেছে। এটিকে তিনি ‘প্রতারণার’ সঙ্গে তুলনা করেছেন। অন্যান্য দেশ অসম শুল্ক আরোপ করার কারণে যুক্তরাষ্ট্রও তাদের ওপর এই পাল্টা শুল্ক আরোপ করছে। তবে ট্রাম্প বলছেন,‘ যুক্তরাষ্ট্রের আরোপিত শুল্ক অন্যদের আরোপিত শুল্কের প্রায় অর্ধেক। সুতরাং, সেই হিসাবে পুরোপুরি পাল্টা শুল্ক হচ্ছে না। তবে হ্যাঁ, আমি তা করতে পারতাম। কিন্তু এটি করলে অনেক দেশের জন্য কঠিন হয়ে যেত। আমি তা করতে চাইনি।’
তিন দেশ নিয়ে আলোচনা : এদিকে তিনটি দেশের সঙ্গে শুল্ক নিয়ে আলোচনা চলছে যুক্তরাষ্ট্রে। মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভারত, ইসরায়েল ও ভিয়েতনামের সঙ্গে সমঝোতা আলোচনা করছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প।এর মধ্যে ভিয়েতনামের সঙ্গে আলোচনার কথা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিজেই জানিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। তার দাবি, সমঝোতার স্বার্থে মার্কিন পণ্য থেকে শুল্ক একেবারে তুলে নিতেও রাজি ভিয়েতনাম। বাকি দুই দেশের কথা অবশ্য ট্রাম্প কিছু বলেননি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ট্রাম্প লিখেছেন, ‘ভিয়েতনামের কমিউনিস্ট পার্টির জেনারেল সেক্রেটারি তো ল্যামের সঙ্গে এইমাত্র খুব ইতিবাচক আলোচনা হলো। তিনি আমাকে বলেছেন, যদি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সমঝোতা হয়, তারা মার্কিন পণ্যে শুল্কের পরিমাণ একেবারে শূন্য করে দিতে প্রস্তুত। আমাদের পক্ষ থেকে তাকে ধন্যবাদ জানিয়েছি। বলেছি, খুব শিগগির আমাদের দেখা হবে।’
শেয়ার বাজারে বড় পতন : কয়েক দিন ধরেই ট্রাম্পের পাল্টা শুল্ক নিয়ে জল্পনাকল্পনা চলছিল। ট্রাম্পের সিদ্ধান্তের পর সারা বিশ্বের শেয়ারবাজারে একযোগে ধস নামে। চীন ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের পণ্যে পাল্টা শুল্ক আরোপ করেছে। অন্যান্য দেশ সেই পথে হাঁটলে পরিস্থিতির আরও অবনতি হতে পারে। গত বুধবার বাংলাদেশের সময় গভীর রাতে শুল্ক ঘোষণার পরে গত বৃহস্পতিবার যুক্তরাষ্ট্রে সূচক ডাও জোনসের পতন হয় ১ হাজার ৪০০ পয়েন্টের বেশি। ২০২০ সালে করোনার পর সূচকের এত বড় পতন আর হয়নি। তার জের গত শুক্রবার পড়েছে ভারতের শেয়ার সূচকে। সেদিন সেনসেক্সের পতন হয় ৯৩০ দশমিক ৬৭ পয়েন্ট; সূচকটি থামে ৭৫ হাজার ৩৬৪ দশমিক ৬৯ পয়েন্টে। একইভাবে নিফিটও ৩৪৫ দশমিক ৬৫ পয়েন্ট পড়ে থিতু হয় ২২ হাজার ৯০৪ দশমিক ৪৫ পয়েন্টে। বাজার মূলধন কমেছে ১০ লাখ কোটি রুপির। পাশাপাশি পড়েছে ফ্রান্স, জার্মানি, জাপান, অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশের শেয়ারবাজার। চীনসহ কিছু দেশে লেনদেন বন্ধ থাকায় প্রভাব বোঝা যায়নি। তবে বেইজিংয়ের পাল্টা শুল্কের জেরে গত শুক্রবার যুক্তরাষ্ট্রে বাজার খোলার পরে ডাও ১ হাজার ৭০০ পয়েন্ট নেমেছে।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, শুল্কের প্রভাব নিয়ে অন্যান্য দেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রকেও লড়াই করতে হবে। তারা স্বনির্ভর নয়। এ পরিস্থিতিতে শেষমেশ প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প শুল্কবিষয়ক সিদ্ধান্তের কিছুটা প্রত্যাহার করবেন; কিন্তু তা না হওয়া পর্যন্ত সূচক অস্থিরই থাকবে। ট্রাম্পের শুল্কের ঘোষণার জেরে বৃহস্পতিবার ডলার সূচক ১ দশমিক ৬ শতাংশ কমে ১০২ দশমিক শূন্য ৩-এ নেমে আসে; অক্টোবর মাস শুরুর পর যা সর্বনিম্ন। সেদিন বিশ্বের প্রায় সব কটি প্রধান মুদ্রার বিপরীতে ডলারের দরপতন হয়। তবে আজ শনিবার ডলারে সূচকের মান কিছুটা বেড়ে ১০২ দশমিক ৮৯-এ উঠেছে।
অর্থনৈতিক ক্ষতি ও মন্দা : মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের শুল্কনীতির সমালোচনা করেছে জাতিসংঘ। সংস্থাটির বাণিজ্য ও উন্নয়ন সংস্থার (ইউএনসিটিএডি) সেক্রেটারি জেনারেল বা মহাসচিব রেবেকা গ্রিনস্প্যান বলেন, ট্রাম্পের এই নীতি বিশ্ব উন্নয়নের পরিপন্থি। এই নীতির ফলে সবচেয়ে বিপদে পড়বেন দুর্বল ও দরিদ্র মানুষেরা। সার্বিকভাবে বিশ্ব অর্থনীতিতে এর প্রভাব পড়তে চলেছে বলেও মনে করছে জাতিসংঘ।
বিবৃতিতে রেবেকা বলেন, অবাধ বাণিজ্য উন্নয়ন ও বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত করে। সে কারণে বাণিজ্য নিয়ে অস্থিরতা ও অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করা উচিত নয়। বর্তমান পরিস্থিতিতে ব্যবসা-বাণিজ্যে যেসব চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হয়, তা মোকাবিলায় নতুন বাণিজ্যনীতি প্রয়োজন। নতুন বাণিজ্যনীতিতে বর্তমান চ্যালেঞ্জগুলোর প্রতিফলন থাকা দরকার। ভবিষ্যৎ ও উন্নয়নের বিষয়টি মাথায় রেখেই নতুন বাণিজ্যনীতি প্রণয়ন করতে হবে; দরিদ্র ও দুর্বলদের রক্ষা করতে হবে। এখন পারস্পরিক সহযোগিতার সময়; উত্তেজনা আরও বৃদ্ধি করার মানে হয় না।’
বিশ্বজুড়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া : যুক্তরাষ্ট্রের সব পণ্যতে নতুন শুল্ক আরোপের সিদ্ধান্তকে ‘বিশ্ব অর্থনীতির জন্য বড় আঘাত’ বলে মন্তব্য করেছেন ইউরোপীয় কমিশনের প্রধান উরসুলা ভন ডার লেইন। এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, আমদানির ওপর নতুন শুল্ক আরোপের কারণে অনিশ্চয়তা বাড়বে, যা বিশ্বজুড়ে লাখো মানুষের জন্য মারাত্মক পরিণতি ডেকে আনবে। দুর্বল ও ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলো সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ইউরোপীয় কমিশনের প্রধান প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, ইউরোপ ঐক্যবদ্ধভাবে পদক্ষেপ নেবে এবং সতর্ক করে দিয়েছেন যে, যদি আলোচনা ব্যর্থ হয় তাহলে ইউরোপীয় ইউনিয়ন-যারা ২০ শতাংশ শুল্কের আওতায় পড়েছে-তারা পাল্টা ব্যবস্থা গ্রহণের প্রস্তুতি নিচ্ছে।
ইতালির প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলোনি বলেছেন, সিদ্ধান্তটি ভুল হয়েছে। তবে তিনি বাণিজ্য যুদ্ধ প্রতিরোধ করতে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে একটি চুক্তির বিষয়ে কাজ করবেন বলে জানিয়েছেন। স্পেনের প্রধানমন্ত্রী পেদ্রো সানচেজও এক প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, স্পেন একটি উন্মুক্ত বিশ্বের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকবে।
আয়ারল্যান্ডে টাওইসেক মিচেল মার্টিন বলেছেন, ট্রাম্পের সিদ্ধান্ত ভীষণ দুঃখজনক এবং কারো জন্যই লাভজনক নয়। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ এলিসি প্রাসাদে নতুন শুল্ক আরোপের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়িক খাতের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করবেন বলে ফরাসি প্রেসিডেন্টের দপ্তর থেকে জানানো হয়েছে। তাইওয়ান, যারা যুক্তরাষ্ট্রে পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে ৩২ শতাংশ শুল্কের মুখোমুখি হতে যাচ্ছে, তারা এই পদক্ষেপকে অত্যন্ত অযৌক্তিক বলে অভিহিত করেছে। তাইওয়ানের প্রধানমন্ত্রী চো জং তাই বলেছেন, তারা যুক্তরাষ্ট্রের কাছে গুরুতর প্রতিবাদ জানাবে।
বিশ্বব্যাপী বাণিজ্য যুদ্ধ ‘একটি বাস্তবতায়’ পরিণত হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন দক্ষিণ কোরিয়ার অন্তর্বর্তীকালীন প্রেসিডেন্ট হান ডাক-সু। তিনি বলেছেন, তার সরকার বাণিজ্য সংকট কাটানোর উপায় খুঁজে দেখবে, কারণ পূর্ব এশিয়ার এই দেশটির ওপর ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। জাপান বলেছে, তাদের ওপর ২৪ শতাংশ শুল্ক আরোপ করার বিষয়টি অত্যন্ত দুঃখজনক এবং এটি বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা এবং মার্কিন-জাপান চুক্তিগুলো লঙ্ঘন করতে পারে। অন্যদিকে থাইল্যান্ড বলেছে, তারা তাদের ওপর ৩৬ শতাংশ শুল্ক আরোপ নিয়ে আলোচনা করবে।
ইসরায়েলের স্থানীয় সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের এই ঘোষণার আগেই যেখানে ইসরায়েলের অর্থনৈতিক কর্মকর্তারা আমেরিকা থেকে আমদানিকৃত পণ্যের উপর সব শুল্ক বাতিল করেছিলেন, এখন তাদের ওপর ১৭ শতাংশ শুল্ক আরোপ হওয়ায় তারা সম্পূর্ণভাবে হতবাক হয়ে পড়েছেন। যে দেশগুলো সর্বনিম্ন ১০ শতাংশ বেসলাইন শুল্কের আওতায় পড়েছে, সেইসব দেশের নেতারাও ট্রাম্পের এমন পদক্ষেপের বিরুদ্ধে তাদের প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী অ্যান্থনি আলবেনিজ বলেছেন, এই অন্যায় শুল্ক আরোপের জন্য আমেরিকানদের সবচেয়ে বড় মূল্য দিতে হবে। ডাউনিং স্ট্রিটের একটি সূত্র বিবিসিকে জানিয়েছে, যুক্তরাজ্যের ওপর কম শুল্ক আরোপ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তির জন্য দেশটির সরকারের সাম্প্রতিক প্রচেষ্টার প্রতিফলন ঘটিয়েছে।
বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী জোনাথন রেনল্ডস বলেছেন, “সরকার যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একটি অর্থনৈতিক চুক্তি নিয়ে আলোচনার ব্যাপারে আগ্রহী, যা দুই দেশের মধ্যে বিদ্যমান ন্যায্য এবং ভারসাম্যপূর্ণ বাণিজ্য সম্পর্ককে শক্তিশালী করবে।” দক্ষিণ আমেরিকার সবচেয়ে বড় অর্থনীতির দেশ, ব্রাজিল বুধবার কংগ্রেসে একটি আইন অনুমোদন করেছে অর্থনৈতিক প্রতিদান আইন-যা ট্রাম্পের আরোপ করা ১০ শতাংশ শুল্কের বিরুদ্ধে লড়াই করবে।
তবে ট্রাম্পের ঘোষণার কিছুক্ষণ পরই, মার্কিন অর্থমন্ত্রী স্কট বেসেন্ট দেশগুলোকে সতর্ক করেছেন যে, তারা যেন প্রতিশোধ না নেয়। তারা যেন মার্কিন সরকারের এই সিদ্ধান্ত মেনে নেয়। ফক্স নিউজকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি আরও বলেন, কারণ যদি আপনি প্রতিশোধ নেন, তাহলে পরিস্থিতি উত্তেজিত হবে।
ভোরের আকাশ/এসএইচ