সরকারকে সাধুবাদ জানাচ্ছে বিএনপিসহ রাজনৈতিক দলগুলো
নির্বাচন, পররাষ্ট্রনীতি ও সংস্কার প্রশ্নে সর্বমহলে প্রশংসায় ভাসছে প্রফেসর ড. মোহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। সরকারের এক বছর পূর্তিতে নির্বাচনী ট্রেনে দেশকে তুলে দেওয়ার পাশাপাশি একমুখী নতজানু পররাষ্ট্রনীতি থেকে বের হয়ে আসার পাশাপাশি কাক্সিক্ষত ক্ষেত্রে সংস্কারে প্রস্তাবনা নজর কেড়েছে সবার। সবমিলে অন্তর্বর্তী সরকারের কার্যক্রম ঘিরে অনেকের মাঝে সন্দেহ সংশয় থাকলেও নির্বাচনী ঘোষণায় কেটে গেছে সব উদ্বেগ। দেশের সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপিসহ অধিকাংশ রাজনৈতিক দল সরকারের কার্যক্রমে সন্তোষ প্রকাশ করেছে। এর সাথেই চিহ্নিত করা হয়েছে এক বছরে সরকারের মোটা দাগের সফলতাগুলো। গত এক বছরের চালচিত্র ঘেটে দেখা যাচ্ছে, জুলাই অভ্যুত্থানের পরবর্তী ফ্যাসিবাদের উত্থান ঠেকানোর পাশাপাশি দুর্নীতি-অনিয়মসহ নানা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয়েছে অন্তর্বর্তী সরকারকে। গত বছরজুড়ে দাবি দাওয়ার আড়ালে বিভিন্ন সময়ে ফ্যাসিবাদের দোসরা আন্দোলন-সংগ্রামের নামে নানামুখী ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে সরকার উৎখাতে তৎপরতা ছিল চোখে পড়ারমতো। ড. ইউনূস যখন অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নেন, তখন দেশ এক গভীর অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল। রাজনৈতিক অভ্যুত্থানের পর প্রশাসন, অর্থনীতি ও সমাজজুড়ে তৈরি হয় শূন্যতা। সেই মুহূর্তে গত এক বছরে মোকাবিলা করতে হয়েছিল প্রায় পৌনে দুইশ’টি আন্দোলন। এর মধ্যে ভারতীয় আধিপত্যবাদের বিরামহীন নগ্ন হস্তক্ষেপকে সচেতনভাবেই পাশকাটিয়ে যেতে হয়েছে সরকারকে। এ সময় বিশ^ গণমাধ্যমকে প্রফেসর ইউনূস বলেছেন ‘ভারতে শেখ হাসিনাকে চুপ থাকতে হবে’।বিশ্লেষকদের ভাষায় অন্তর্বর্তী সরকারের সতর্কতা ও কঠোর পদক্ষেপের কারণে কোনো চক্রান্তই হালে পানি পায়নি। জুলাই অভ্যুত্থানের পর দেশর পররাষ্ট্র নীতির বাঁক বদলের কারণেই এতটা সাহসী উচ্চারণ সম্ভব ছিল। কারণে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে পরিচালিত ফ্যাসিস্ট শাসনের সব কিছু ছিল ভারতীয় নতজানু পররাষ্ট্রনীতির প্রতিফলন, যা এদেশের সাধারণ ছাত্র জনতা মেনে নেয়নি।রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অভিমত, গত এক বছর অন্তর্বর্তী সরকারের মোটা দাগের সফলতার তালিকার শীর্ষে রয়েছে নতজানু পররাষ্ট্রনীতির গন্ডি থেকে বের হয়ে বাংলাদেশী পররাষ্ট্রনীতিতে দেশ পরিচালনার অঙ্গীকার। সরকার এমন কূটনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, যা সব দেশের সঙ্গে পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও পারস্পরিক সম্পর্কের ভিত্তিতে গঠনমূলক, ভারসাম্যপূর্ণ ও বাস্তবসম্মত, এবং যা বাংলাদেশের দীর্ঘমেয়াদি জাতীয় স্বার্থ রক্ষা করবে।এ প্রসঙ্গে পররাষ্ট্র বিষয়ক উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন বলেন, গত এক বছর বাংলাদেশ একটি ভারসাম্যপূর্ণ ও বাস্তবমুখী পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করেছে। যেখানে জাতীয় স্বার্থ ও পারস্পরিকতা অগ্রাধিকার পেয়েছে এবং একই সঙ্গে বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক প্রধান শক্তিগুলোর সঙ্গে গঠনমূলক সম্পর্ক রক্ষা করা হয়েছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।উপদেষ্টা বলেন, এই ভারসাম্যপূর্ণ কূটনীতি গত এক বছরে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির সফলতার মূল কেন্দ্রবিন্দু ছিল এবং অন্তর্বর্তী সরকারের আন্তর্জাতিক কৌশলে এটাই চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করছে। বর্তমান প্রশাসন ‘বাংলাদেশ-কেন্দ্রিক’ একটি কৌশল নিচ্ছে যা ‘আলোকিত স্বার্থবোধ’-এর ভিত্তিতে গঠিত।ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক বিষয়ে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন বলেন, বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ)-এর হাতে মানুষ হত্যার ঘটনায় বাংলাদেশ এরইমধ্যে আরও জোরালো ভাষায় প্রতিবাদ জানিয়েছে এবং এসব ঘটনার বিরুদ্ধে স্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন নিন্দা জানিয়েছে।উপদেষ্টা আরও বলেন, বাংলাদেশ সীমান্ত হত্যার বিরুদ্ধে শক্ত প্রতিবাদ অব্যাহত রাখবে। তৌহিদ সীমান্তে অনিয়মিতভাবে ‘পুশ-ইন’ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন, যেখানে শুধু বাংলাদেশি নয়, ভারতীয় বাংলা ভাষাভাষী নাগরিকদেরও ঠেলে পাঠানো হচ্ছে।তিনি বলেন, ‘এমনকি পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীও এতে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। এতে প্রমাণ হয় যে এই পদ্ধতি সঠিক নয়।পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করা : তৌহিদ হোসেন বলেন, বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিতে পাকিস্তানের প্রতি কোনো ধরনের নীতি পরিবর্তনের ইঙ্গিত নেই। সরকারের সাম্প্রতিক উদ্যোগ কেবল কূটনৈতিক সম্পর্ক স্বাভাবিক করার উদ্দেশ্যে নেওয়া, যাতে বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থ সুরক্ষিত থাকে।চীনের সঙ্গে সম্পর্ক : পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের সম্পর্কের দীর্ঘস্থায়িত্ব ও ধারাবাহিকতা পুনর্ব্যক্ত করেছেন। তিনি বলেন, ১৯৭৫ সালে আনুষ্ঠানিক কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের পর থেকে ধারাবাহিকভাবে সরকার পরিবর্তন হলেও বাংলাদেশ-চীন দ্বিপক্ষীয় অংশীদারিত্ব স্থিতিশীলই থেকেছে।যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক : পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন পুনর্ব্যক্ত করেন যে, বৈশ্বিক পরাশক্তিগুলোর মধ্যে ক্রমবর্ধমান ভূ-রাজনৈতিক মেরুকরণের মধ্যেও বাংলাদেশ একটি ভারসাম্যপূর্ণ পররাষ্ট্রনীতির প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে চলেছে।কূটনৈতিক মিশন সম্প্রসারণ : গত এক বছরে ঢাকা তার বৈশ্বিক কূটনৈতিক উপস্থিতি বৃদ্ধির চেষ্টা করেছে, যার অংশ হিসেবে নিউজিল্যান্ডে একটি নতুন হাইকমিশন এবং মালয়েশিয়ার জহর বাহরুতে একটি কনস্যুলেট খোলার প্রস্তুতি চলছে। মালয়েশিয়ায় অভিবাসী বাংলাদেশিদের সহায়তায় পেনাং-এ আরেকটি কনস্যুলেট খোলার পরিকল্পনাও রয়েছে।এছাড়া, আরও ছয়টি দূতাবাস ও কনস্যুলেটের অনুমোদন দিয়েছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়, যা দ্বিপক্ষীয় সম্পৃক্ততা জোরদার এবং প্রবাসীদের কনস্যুলার সেবা নিশ্চিত করার সরকারের প্রতিশ্রুতি প্রতিফলিত করে। সবচেয়ে জরুরি প্রস্তাবগুলোর মধ্যে রয়েছে চীনের গুয়াংজুতে একটি কনস্যুলেট এবং আয়ারল্যান্ডে একটি পূর্ণাঙ্গ দূতাবাস।প্রবাসী কল্যাণে সংস্কার : পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, মধ্যপ্রাচ্য ও মালয়েশিয়ায় প্রবাসী বাংলাদেশি শ্রমিকদের দুর্ভোগ লাঘব করা বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান অগ্রাধিকারগুলোর একটি। তিনি পাসপোর্ট ইস্যু সংক্রান্ত সেবা উন্নয়নের জন্য নেওয়া নানা উদ্যোগের কথা উল্লেখ করেন। উদাহরণস্বরূপ, ওমানের ক্ষেত্রে, এখন ই-পাসপোর্ট সরাসরি আবেদনকারীর বাড়িতে পৌঁছে যাচ্ছে ওমান পোস্টের মাধ্যমে, ফলে দ্বিতীয়বার ব্যক্তিগতভাবে যেতে হচ্ছে না। পাশাপাশি ভেঙ্গে পড়া প্রশাসন, আইন বিভাগ, বিচার বিভাগ ও নির্বাহী বিভাগসহ অর্থনীতির পাশাপাশি চ্যালেঞ্জিং খাতগুলোর সংস্কারের গুরুত্বকপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে সরকার। এই এক বছরে অনিয়ম, দুর্নীতিমুক্তদেশ গঠনেও সরকারের গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি রয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার গত সেপ্টেম্বরে সংবিধান, নির্বাচন, বিচার, পুলিশ, জনপ্রশাসন, দুর্নীতি দমন, মিডিয়া, স্বাস্থ্য, শ্রমিক অধিকার, নারী অধিকার এবং স্থানীয় সরকার সংক্রান্ত ১১টি কমিশন গঠন করে। কমিশনগুলো তাদের প্রতিবেদন সরকারের কাছে জমা দিয়েছে। গত ২৫ মে ক্যাবিনেট ডিভিশন নির্বাচন, বিচার, দুর্নীতি দমন, পুলিশ এবং জনপ্রশাসন সংক্রান্ত ১২১টি তাৎক্ষণিক বাস্তবায়নযোগ্য সংস্কার প্রস্তাবে পদক্ষেপ গ্রহণ করার জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের ওপর নির্দেশনা রয়েছে। আরও কয়েকটি বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের অগ্রগতি আছে, সেগুলো হচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রার সঞ্চিতিতে স্থিরতা নিয়ে আসা, ব্যাংক সেক্টরে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা, গার্মেন্টস সেক্টরে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা, এনবিআরকে পুনর্গঠন করা ইত্যাদি। সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই দেশের দক্ষিণ ও উত্তরাঞ্চলে ভয়াবহ বন্যায় কৃষি উৎপাদন বিপুল ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফলে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়ার আশঙ্কা ছিল। তবে সংশ্লিষ্ট সংস্থা ও কর্তৃপক্ষের যথাযথ পদক্ষেপ, বাজার মনিটরিং এবং মধ্যস্বত্বভোগীদের নিয়ন্ত্রণের কারণে তা রোধ করা সম্ভব হয়েছিল। বিশেষ করে এবারের পবিত্র রমজান মাস থেকে বাজার স্থিতিশীল ছিল। প্রবাসী বাংলাদেশিদের সরকারের প্রতি গভীর আস্থার ফলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভেও স্থিতিশীলতা ফিরে এসেছে।গত অর্থবছরে ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে রেকর্ড ৩০৩৩ কোটি ডলার রেমিট্যান্স এসেছে, যা রপ্তানি আয়কে প্রায় ৯ শতাংশ বাড়িয়ে দিয়েছে। ফলে টাকার মান শক্তিশালী হয়েছে। বহু বছর পর, টাকার মূল্য ডলারের বিপরীতে বাড়ছে। গত ১১ মাসে বৈদেশিক ঋণদাতাদের কাছে ৪ বিলিয়ন ডলার সুদ ও মূলধন পরিশোধ করা হয়েছে, যা দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। এর পরেও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ছে।এদিকে, স্বৈরাচারী সরকারের অপরাধকর্মের বিচারের কার্যক্রম চলমান রয়েছে। শেখ হাসিনা, আসাদুজ্জামান খান কামাল, ওবায়দুল কাদের, চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন, জুনাইদ আহেমদ পলকসহ আরো বেশ কিছু ব্যক্তির বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচার প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। বাংলাদেশের প্রতিবেশী ভারত স্বৈরাচারী সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক তেমন একটা ভালো যাচ্ছে না। কারণ ভারত তাদের মতো করে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার ব্যবহার করতে ব্যর্থ শুধুমাত্র প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মোহাম্মদ ইউনুসের কারণে। তিনি কোন রাষ্ট্র বা কারো কাছে মাথা নত করেনি। তবে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক উন্নয়ন হয়েছে এবং চীনের সঙ্গেও সম্পর্ক নতুন গতি পেয়েছে। গত ২৯ জুলাই একটি সংবাদ সম্মেলনে চীনের রাষ্ট্রদূত কর্তৃক গত ১০ বছরে বিরোধী দলগুলোর সঙ্গে চীনের সম্পর্ক গড়ার বিষয়ে পতিত সরকারের পক্ষ থেকে নিষেধাজ্ঞা ছিল বলে জানানো হয়।বৃহস্পতিবার সচিবালয়ে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বৈঠক শেষে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব মোহাম্মদ শফিকুল আলম জানান, অন্তর্বতী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার (গত বছরের ৮ আগস্ট) পর থেকে গত ৩১ জুলাই পর্যন্ত অনুষ্ঠিত ৪১টি উপদেষ্টা পরিষদ-বৈঠকে ১৯৪টি সারসংক্ষেপ উপস্থাপন করা হয়েছে। এসব বৈঠকে নেওয়া ৩১৫টি সিদ্ধান্তের মধ্যে বাস্তবায়ন হয়েছে ২৪৭টি (বাস্তবায়ন হার ৭৮ দশমিক ৪১ শতাংশ)।তিনি জানান, স্বাধীনতার পর এটি যেকোনো সরকারের জন্য একটি রেকর্ড। প্রেস সচিব আরও জানান, সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নাধীন আছে ৬৮টি। এ সময়ে অধ্যাদেশ প্রণয়ন হয়েছে ৫৬টি। অধ্যাদেশ প্রক্রিয়াধীন আছে ১০টি। নীতি, নীতিমালা, কর্মকৌশল, কর্মপরিকল্পনা অনুমোদন হয়েছে ছয়টি। দ্বিপাক্ষিক ও আন্তর্জাতিক চুক্তি প্রটোকল অনুমোদন বা অনুসমর্থন হয়েছে ২৩টি। উপদেষ্টা পরিষদের জন্য সারসংক্ষেপ উপস্থাপন হয়েছে ১৯৪টি।গত এক বছরে অন্তর্বর্তী সরকারের উল্লেখ্যযোগ্য ১২টি সেরা সাফাল্য : ৫ আগস্ট ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর ৮ আগস্ট গঠিত হয় অন্তর্বর্তী সরকার। গত এক বছরে অন্তর্বর্তী সরকারের উল্লেখ্যযোগ্য ১২টি সেরা সাফাল্যর কথা তুলে ধরে ফেসবুকে একটি পোস্ট দেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম।শান্তি ও স্থিতিশীলতা পুনঃপ্রতিষ্ঠা : জুলাই বিপ্লবের পর দেশে শান্তি ও শৃঙ্খলা ফিরেছে। যার ফলে নৈরাজ্য ও প্রতিশোধের চক্র বন্ধ হয়েছে। অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নৈতিক নেতৃত্ব ছিল এই স্থিতিশীলতার মূল চালিকা শক্তি, যা জাতিকে সহিংসতা নয়; বরং পুনর্মিলন ও গণতন্ত্রের পথে পরিচালিত করেছে।অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার : ধ্বংসপ্রাপ্ত অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে বড় ভূমিকা রেখেছে এই সরকার। খাদ্য মূল্যস্ফীতি প্রায় ১৪ শতাংশ থেকে প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে। সামগ্রিক মূল্যস্ফীতি ৮.৪৮ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়েছে (যা ৩৫ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন), রেমিট্যান্সে রেকর্ড ৩০.৩৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, রপ্তানি ৯ শতাংশ বৃদ্ধি, বহু বছর পর টাকার মান ডলারের বিপরীতে বেড়েছে এবং ব্যাংক খাত স্থিতিশীল হয়েছে।বাণিজ্য ও বিনিয়োগে অগ্রগতি : যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সফল শুল্ক আলোচনা সম্পন্ন হয়েছে। অনেক বিশেষজ্ঞ বলেছিলেন, দুর্বল সরকার এটি পারবে না। কিন্তু এই সরকার সেটি করে দেখিয়েছে। উল্লেখযোগ্য পরিমাণ সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ অর্জন (যেমন হানদা গ্রুপের ২৫ কোটি ডলারের টেক্সটাইল বিনিয়োগে ২৫ হাজার কর্মসংস্থান), এবং আগের সরকারের চেয়ে দ্বিগুণ এফডিআই প্রবাহ। চীনা বিনিয়োগকারীরাও বাংলাদেশে আগ্রহ দেখাচ্ছেন।গণতান্ত্রিক সংস্কার ও জুলাই সনদ : সংস্কার কমিশন গঠন, ৩০টির বেশি রাজনৈতিক দলের মধ্যে জাতীয় ঐক্য তৈরি এবং ঐতিহাসিক জুলাই সনদ চূড়ান্ত করা হয়েছে, যা প্রাতিষ্ঠানিক জবাবদিহিতা ও ভবিষ্যতে ফ্যাসিবাদের ফিরে আসা রোধে সুরক্ষা দিচ্ছে। জুলাই সনদ গণতন্ত্রের নতুন যুগের সূচনা করবে বলে আশা করা হচ্ছে।জুলাই হত্যাযজ্ঞের বিচার : জুলাই-আগস্টে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের স্বচ্ছ বিচার শুরু হয়েছে, যাতে দোষীদের জবাবদিহির আওতায় আনা হচ্ছে এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা পাচ্ছে। এখন পর্যন্ত চারটি প্রধান বিচার কার্যক্রম শুরু হয়েছে। শেখ হাসিনার বিচারও শুরু হয়েছে।নির্বাচন পরিকল্পনা ও সংস্কার : ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে অবাধ, সুষ্ঠু ও উৎসবমুখর নির্বাচনের তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছে। প্রবাসী, নতুন ভোটার এবং নারীদের অন্তর্ভুক্তির প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। নাগরিক মতামতের জন্য ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম চালু হচ্ছে। প্রায় ৮ লাখ পুলিশ, আনসার ও সেনা মোতায়েনের পরিকল্পনা করা হয়েছে যাতে শান্তিপূর্ণ নির্বাচন নিশ্চিত করা যায়।প্রাতিষ্ঠানিক ও আইনগত সংস্কার : বিচার বিভাগ : সংস্কারমুখী নিয়োগের মাধ্যমে স্বাধীনতা নিশ্চিত। পুলিশ : মানবাধিকার সেল, বডিক্যাম, স্বচ্ছ জিজ্ঞাসাবাদ কক্ষ এবং জাতিসংঘ মানদণ্ডের প্রতিবাদ ব্যবস্থা। আইন : দেওয়ানি ও ফৌজদারি কার্যবিধিতে ব্যাপক পরিবর্তন, গ্রেপ্তারের ১২ ঘণ্টার মধ্যে পরিবারকে জানানো বাধ্যতামূলক, আইনজীবী ও চিকিৎসা সহায়তা নিশ্চিত, অনলাইন জিডি চালু।সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ও ইন্টারনেট অধিকার : দমনমূলক সাইবার নিরাপত্তা আইন বাতিল, সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে সব মামলা প্রত্যাহার, সমালোচনার স্বাধীনতা নিশ্চিত এবং ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ইন্টারনেট অধিকারকে মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।বৈদেশিক নীতি পরিবর্তন : একদেশভিত্তিক নির্ভরতা থেকে সরে এসে বহুমুখী বৈদেশিক নীতিতে রূপান্তর। যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিভিন্ন অংশীদারের সঙ্গে বাণিজ্য, বিনিয়োগ, চিকিৎসা সহায়তা ও সংকট ব্যবস্থাপনায় সহযোগিতা বৃদ্ধি। সার্ক পুনরুজ্জীবন এবং আসিয়ান সদস্যপদ অর্জনে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।প্রবাসী ও শ্রমিক অধিকার : সংযুক্ত আরব আমিরাত ভিসা পুনরায় চালু ও মালয়েশিয়ায় মাল্টিপল অ্যান্ট্রি ভিসা নিশ্চিত হয়েছে। উপসাগরীয় অঞ্চলে অনিবন্ধিত শ্রমিকদের বৈধকরণ, ১ লাখ তরুণকে জাপানে পাঠানোর পরিকল্পনা এবং ইতালি, দক্ষিণ কোরিয়া ও সার্বিয়াতে আরও শ্রমিক পাঠানোর প্রক্রিয়া চলছে।শহীদ ও আহত বিপ্লবীদের সহায়তা : জুলাই অভ্যুত্থানের সব শহীদ ও আহতদের তালিকা প্রণয়ন করা হয়েছে। ৭৭৫ শহীদ পরিবারের জন্য প্রায় ১০০ কোটি টাকা সঞ্চয়পত্র ও ভাতা, এবং ১৩,৮০০ আহত বিপ্লবীদের জন্য ১৫৩ কোটি টাকা সহায়তা দেওয়া হয়েছে। গুরুতর আহতদের বিদেশে উন্নত চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।সমুদ্র ও অবকাঠামো উন্নয়ন : বঙ্গোপসাগরকে জাতীয় সম্পদ ঘোষণা করে ‘জলভিত্তিক অর্থনীতি’ গড়ে তোলার পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। চট্টগ্রাম বন্দর দক্ষতা বৃদ্ধি (+২৫০ কনটেইনার/দিন), উপকূলীয় উন্নয়ন পরিকল্পনা, গভীর সমুদ্র মৎস্য ও শিল্প প্রকল্পে বৈশ্বিক অংশীদারদের নিয়ে কাজ করছেন।এছাড়া, জাতিকে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে জনবান্ধব সরকার উপহার দেওয়ার লক্ষ্যে ইতিমধ্য ইসিকে সব ধরনের নির্দেশনা দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার।ভোরের আকাশ/এসএইচ