কর্মসংস্থান সৃষ্টিই মূল চ্যালেঞ্জ
ছোট আয়তনের তুলনায় বিপুল জনসংখ্যার চাপ সামাল দিতে পারছে না বাংলাদেশ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমে অনেক আগেই স্থবিরতা নেমে এসেছে। বিষয়ে সরকারের আগ্রহও যেন কমে গেছে। কিন্তু জনসংখ্যাকে জনসম্পদে রূপ দিতেও পারছে না সরকার। মোট জনসংখ্যার দুই-তৃতীয়াংশই কর্মক্ষম অর্থাৎ বয়সের দিক দিয়ে তারা কাজের উপযোগী আছেন। কিন্তু দেশে নেই পর্যাপ্ত কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা। আবার দেশের গড় আয়ু বেড়ে যাওয়ায় শিশু ও বৃদ্ধদের মতো নির্ভরশীল মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধির শঙ্কা রয়ে গেছে। অতীতে চীন-জাপানের মতো দেশগুলো তাদের বাড়তি কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীকে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনে সাফল্যের সঙ্গে ব্যবহার করতে পারলেও বাংলাদেশ সেটা কতটা কাজে লাগাতে পারছে তা নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা। এমন অবস্থার মধ্যদিয়ে আজ পালিত হচ্ছে বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস। আর দিবসটি উপলক্ষে দেওয়া বানীতে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস উন্নত ভবিষ্যৎ বিনির্মাণে তরুণ প্রজন্মকে দক্ষ হিসেবে গড়ে তোলার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। গত ৭ জুলাই জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিল (ইউএনএফপিএ) জানিয়েছে, ২০২৫ সালে বাংলাদেশে জনসংখ্যা ১৭ কোটি ৫৭ লাখে দাঁড়িয়েছে। এদের মধ্যে কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা দুই-তৃতীয়াংশ, যা ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের সুফল অর্জনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ সুযোগ সৃষ্টি করেছে।ইউএনএফপিএ’র বাংলাদেশ প্রতিনিধি ক্যাথরিন ব্রিন কামকং প্রতিবেদন উন্মোচন করে বলেন, ২০২৫ সালে বাংলাদেশে জনসংখ্যা ১৭৫.৭ মিলিয়ন, যার অর্ধেক নারী এবং দুই-তৃতীয়াংশ (১১৫ মিলিয়ন) কর্মক্ষম। এটি ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের সুফল অর্জনের একটি সুযোগ।তিনি বলেন, জনসংখ্যার ৭ শতাংশ প্রায় ১.২ কোটি মানুষ ৬৫ বছর বা তার বেশি বয়সি, যা বয়স্ক জনগণের সংখ্যা বৃদ্ধির ইঙ্গিত দিচ্ছে।তরুণদের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বাংলাদেশের জনসংখ্যার ১৯ শতাংশ (প্রায় ৩৩ মিলিয়ন) কিশোর-কিশোরী এবং ১০ থেকে ২৪ বছর বয়সী তরুণের সংখ্যা প্রায় ৫০ মিলিয়ন যা জনসংখ্যার ২৮ শতাংশ। বাংলাদেশের মোট প্রজনন হার (টিএফআর) ২.১, যা মধ্যম স্তরে রয়েছে। তবে দেশের কিছু অঞ্চলে এখনও কিশোর বয়সে নারীদের গর্ভধারণের হার বেশি, যা বাল্যবিবাহ, জন্মনিরোধ ব্যবস্থার সীমিত ব্যবহার এবং যৌনশিক্ষার অভাবে হয়ে থাকে।২৪ বছরেও জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার তেমন কমেনি গত সাড়ে ২৪ বছরে দেশের জনসংখ্যার স্বাভাবিক হার প্রায় একই অবস্থানে ওঠানামা করছে। গত ২০০১ সালে জনসংখ্যার স্বাভাবিক বৃদ্ধির হার ছিল ১ দশমিক ৪৮ শতাংশ। জনসংখ্যার স্বাভাবিক বৃদ্ধির হার ২০১৮ সালে ১ দশমিক ৩৩ শতাংশ। ২০২৩ সালের হিসাব অনুযায়ী দেশের জনসংখ্যার স্বাভাবিক বৃদ্ধির হার ১ দশমিক ৩৩ শতাংশ, যা ২০২২ সালে ছিল ১ দশমিক ৪০ শতাংশ। আর ২০২৫ সালেও জনসংখ্যা বৃদ্ধির এই হার ১ দশমিক ৩২ শতাংশেই রয়ে গেছে।জনসংখ্যা জনসম্পদ, না বোঝা?ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা বাংলাদেশের জন্য বড় ধরনের বোঝা হয়ে দাঁড়াচ্ছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, আয়তনের তুলনায় বাংলাদেশের বর্তমান জনসংখ্যা এবং জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার বাংলাদেশের জন্য এক ভয়াবহ সতর্কবার্তা। বাংলাদেশে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম থেকে সরে গেছে সরকার। সরকারের নানা উদ্যোগ গ্রহণের পরও দেশের জনসংখ্যাকে প্রত্যাশিত মাত্রায় জনশক্তিতে রূপ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। বাংলাদেশে বর্তমানে মোট জনসংখ্যার বিপুল সংখ্যক যুবক কোন ধরনের শিক্ষা কার্যক্রম, প্রশিক্ষণ গ্রহণ অথবা কর্মের মধ্যে নেই। তারা পড়াশোনা যতটুকু করার করেছেন এবং বসে আছেন। জীবনের কোন পরিকল্পনা নেই, প্রচেষ্টা নেই কর্ম সুযোগ তৈরি করার। একটাই পরিকল্পনা, একটাই প্রত্যাশা যে কবে চাকরি হবে। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম শক্তিশালীকরণ, জনবলের দক্ষতা বৃদ্ধি, শিক্ষা ও জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন, জনশক্তি পরিকল্পনা, মানবসম্পদ রপ্তানি ও কর্মসংস্থানের স্থায়ী ক্ষেত্র তৈরি করার মাধ্যমে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা মোকাবিলা করা সম্ভব বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।দেশটিতে নির্ভরশীল জনগোষ্ঠীর চেয়ে কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা অনেক বেশি। এটি বলা হচ্ছে, ‘ডেমোগ্রাফিক ডেভিডেন্ট’ বা ‘জনমিতিক লভ্যাংশের বোনাসকাল’। বাংলাদেশ জনমিতিক লভ্যাংশের বোনাসকালের যুগে প্রবেশ করেছে ২০০৫ সালের পরে। তখন থেকে এটি ক্রমাগত ঊর্দ্ধমুখী, যা এখনো বজায় আছে।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্সেস বিভাগের অধ্যাপক মঈনুল ইসলাম বলেন, শ্রমশক্তির দিক দিয়ে বাংলাদেশ ভালো অবস্থানে থাকলেও এটা বেশিদিন পাওয়া যাবে না। আমাদের দেশে জনসংখ্যা নিয়ে যে প্রক্ষেপণ দেখা যাচ্ছে, ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের যে সুবিধা সেটা সর্বোচ্চ ২০৩৫ বা ২০৩৭ সাল পর্যন্ত এটা ঊর্দ্ধমুখী থাকবে। অর্থাৎ কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী বাড়তে থাকবে। কিন্তু এরপর এটা কমতে থাকবে। ২০৪৭ সালের দিকে গিয়ে দেখা যাবে, কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর চেয়ে নির্ভরশীল মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। তাহলে যেটা হবে জনসংখ্যা কাঠামোয় এখন যে পরিবর্তন যেটা ২০৩৭ সাল পর্যন্ত আমাদের অনকূলে থাকবে। কোনও দেশে শ্রমশক্তি বাড়লে সেটা ঐ দেশের অর্থনীতির চেহারা পাল্টে দিতে পারে। এজন্য দরকার হয় শ্রমশক্তি অর্থনীতিতে কাজে লাগানো। অর্থনীতিতে ব্যবহার করতে পারলেই সেটা ‘লভ্যাংশ’ হিসেবে বিবেচিত হবে।অধ্যাপক মঈনুল ইসলাম বলেন,‘অথনীতির যে বিদ্যমান প্রবৃদ্ধি সেটা আরও বাড়ানোটাই হচ্ছে জনমিতিক লভ্যাংশ। এটা তখনই বাড়বে যখন কর্মক্ষম লোকগুলোকে কাজে লাগানো যাবে। এজন্য তাদেরকে শ্রম বাজারে আনতে হবে, চাকরি দিতে হবে, মানসম্মত জীবন-যাপনের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে।’বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো বা বিবিএস-এর হিসেবে দেশটিতে এখন বেকারের সংখ্যা ২৫ লাখ ৯০ হাজার। যদিও বাস্তবে সংখ্যাটা আরও বেশি বলেই মত অর্থনীতিবিদদের। এছাড়া বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান বা বিআইডিএস-এর তথ্যানুযায়ী দেশে বেকারত্বের হার ৩ দশমিক ৬ শতাংশ। এর মধ্যে যুব বেকারত্বই প্রায় ৮০ শতাংশ। ফলে দেশটিতে ব্যাপক কর্মসংস্থান দরকার। কিন্তু কাজের সুযোগ যথেষ্ট তৈরি হচ্ছে না। মোটাদাগে এর তিনটি কারণ তুলে ধরেন বিশেষজ্ঞরা। সেগুলো হলো- কর্মমুখী শিক্ষায় ঘাটতি। গতানুগতিক শিক্ষা শেষে কাজ পাচ্ছে না তরুণরা। কারণ বাজারে যেসব কাজের চাহিদা, দেশের শিক্ষাপদ্ধতিতে তরুণদের মধ্যে সে দক্ষতা তৈরি হচ্ছে না। বিদেশে নতুন শ্রমবাজার সেভাবে উন্মুক্ত হচ্ছে না। ফলে বেকারদের একটা বড় অংশের গন্তব্য অভিবাসন। কিন্তু সেটার সুযোগ সবার নেই। আবার যারা শ্রমিক হিসেবে বিদেশে যাচ্ছেন, তাদের দক্ষতায়ও ঘাটতি থাকছে। ফলে তারা নিম্নমজুরির কাজ করছেন। এর ফলে রেমিটেন্সও কম আসছে। দেশে উদ্যোক্তা এবং বিনিয়োগ বান্ধব পরিবেশ উন্নত নয়। ফলে এখানে কোন চাকরিতে না গিয়ে যারা উদ্যোক্তা হতে চান, তারা যথেষ্ট পুঁজি পাচ্ছেন না এবং ব্যবসার পরিবেশেও ঘাটতি আছে।জানতে চাইলে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন, সরকারকে কর্মসংস্থানের জন্য নতুন নতুন সুযোগ তৈরি করতে হবে। এখানে তরুণদের যে দক্ষতা অর্জন হচ্ছে না, কাজ পাচ্ছে না এটার দায় শেষ পর্যন্ত রাষ্ট্রকেই নিতে হয়।তিনি আরও বলেন, ‘দেখুন বাংলাদেশে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কিন্তু হচ্ছে। কিন্তু সেটার সঙ্গে তাল মিলিয়ে কর্মসংস্থান তৈরি হচ্ছে না। কারণ এখানে বিনিয়োগ নেই। ব্যক্তিখাতে বিনিয়োগ, বৈদেশিক বিনিয়োগ আশানুরূপ হচ্ছে না। যার কারণে এই অবস্থা। তরুণদের যে শিক্ষাগত যোগ্যতা সেটা চাকরিতে কাজে লাগছে না। সবাই গতানুগতিক অনার্স, মাস্টার্সের পড়াশোনা করছে। অথবা বিবিএ-এমবিএ করছে। বাজারে তো এতো চাহিদা নেই। এজন্য দক্ষতা-ভিত্তিক মানবসম্পদ গড়ে তোলার উদ্যোগ নিতে হবে।’ বলছিলেন ফাহমিদা খাতুন।অর্থনীতিবিদ ও জনসংখ্যা বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বাংলাদেশে বাড়তি শ্রমশক্তি কাজে লাগিয়ে অর্থনীতির রূপান্তর ঘটানোর জন্য বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। এক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞরা প্রধানত দুটি খাতের কথা তুলে ধরছেন। একটি হচ্ছে, কর্মমুখী শিক্ষা। অপরটি হচ্ছে স্বাস্থ্য। কিন্তু দুটোতেই বাংলাদেশের বাজেটে সরকারি বরাদ্দ নামমাত্র। শিক্ষার ক্ষেত্রে এটা জিডিপির দুই শতাংশের কম, আর স্বাস্থ্যে সেটা এক শতাংশেরও নিচে।অর্থনীতি নিয়ে গবেষণা সংস্থা সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেল (সানেম) এর নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান বলেন, বাংলাদেশের এখন দরকার মানবসম্পদ উন্নয়নে মেগা প্রজেক্ট। আমাদের এখানে অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য যেমন মেগা প্রজেক্ট আছে। তেমনই সামাজিক উন্নয়নেও মেগা প্রকল্প দরকার। সেটা হবে স্বাস্থ্য এবং শিক্ষাখাতে।তিনি মনে করেন, আগামী কয়েক বছরে এই দুটো খাতে খুব বড় ধরনের বিনিয়োগ না হলে বিপুল তরুণ জনগোষ্ঠীকে হারিয়ে ফেলবে বাংলাদেশ।ভোরের আকাশ/এসএইচ