সন্তানের পড়ালেখার খরচ চালাতে রাজমিস্ত্রির কাজ করছেন মা
সন্তানের পড়াশোনার খরচ চালাতে রাজমিস্ত্রির সহযোগী হিসেবে কাজ করেন মা সুপ্রিতা পণ্ডিত। বিয়ের এক বছর যেতে না যেতেই সুপ্রিতার গর্ভে এক মাসের সন্তান রেখেই চলে যান পাষণ্ড স্বামী। এরপর কেটে গেছে এক যুগ, কিন্তু কোনোদিন খোঁজ-খবর নেননি স্ত্রী-সন্তানের। তখন থেকেই সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে করে যাচ্ছেন অমানবিক পরিশ্রম।নেত্রকোণার দুর্গাপুর উপজেলার পৌর শহরের দক্ষিণপাড়া আশ্রয়ণ প্রকল্পে বসবাস করেন সংগ্রামী এই নারী সুপ্রিতা পণ্ডিত। তার বাবা পরিতোষ মণ্ডল, মা কাজলী পণ্ডিত। তাদের বাড়ি দুর্গাপুর উপজেলার পাইকপাড়া গ্রামে।প্রায় ১২ বছর আগে জেলার কলমাকান্দা উপজেলার গলুয়া গ্রামের সুকেশ দেবনাথের সঙ্গে বিয়ে হয় সুপ্রিয়ার। বিয়ের বছর না পেরোতেই এক মাসের গর্ভবতী স্ত্রী রেখেই নিরুদ্দেশ হন স্বামী সুকেশ। পরবর্তীতে খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন অন্যত্র বিয়ে করেছেন তার স্বামী। কিন্তু বিয়ের পর সুকেশ আর কোনো খোঁজ নেয়নি স্ত্রী-সন্তানের। নিজে সন্তান সম্ভাব্য ও তার বৃদ্ধ মাকে নিয়ে পড়ে যান অথৈ সাগরে!স্বামী চলে যাওয়ার পর সুপ্রিতা কোলজুড়ে আসে তার মেয়ে ত্রয়ী পণ্ডিত। ছোট্ট মেয়ে ও বৃদ্ধ মায়ের দায়িত্ব কাঁধে নিয়েই জীবন যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন সুপ্রিতা। বর্তমানে সংসারের খরচ ও মেয়ের লেখাপড়ার খরচ মেটাতে বেছে নিয়েছেন নির্মাণ শ্রমিকের মতো কঠিন পেশা। প্রথমে অন্যের বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করে কোনো রকম সংসার চালালেও, দিনে দিনে মেয়ের লেখাপড়ার খরচ বেড়ে যাওয়ায় ঝিয়ের কাজ ছেড়ে রাজমিস্ত্রির কাজে যোগ দিয়েছেন তিনি। প্রতিদিন পারিশ্রমিক হিসেবে ৪০০ টাকা পান তিনি। তাও প্রতিদিন কাজ জোটে না। এই সামান্য আয় দিয়ে মেটাতে হয় মেয়ের লেখাপড়ার খরচ ও সংসারের অন্যান্য প্রয়োজন।এত পরিশ্রমের কাজ কেন করেন জানতে চাইলে সুপ্রিতা বলেন, একটি মেয়ে আছে আমার। তাকে মানুষ করার জন্যই এত কষ্ট। কারণ কষ্ট না করলে কেষ্ট মেলে না। বাচ্চা মানুষ করতে গেলে কাজকর্ম করেই মানুষ করতে হবে। আমার স্বামী যেহেতু আমাকে ফেলে রেখে আরেকটি বিয়ে করেছে। এখন মেয়ের দায়িত্ব আমার ওপর পড়েছে। মেয়ের বাবা তাকে ফেলে রেখে চলে গিয়েছে, কিন্তু আমি তো তাকে ফেলে যেতে পারব না। আমি তো তাকে দশ মাস গর্ভে ধারণ করেছি। এখন অপারগ হয়ে রাজমিস্ত্রিদের সঙ্গে তাদের সহযোগী হিসেবে কাজ করি। এখান থেকে যা পাই, তাই দিয়ে আমার মেয়ে এবং বৃদ্ধা মাকে নিয়ে দিন পার করছি। সরকারের কাছে এটাই আমার আবেদন, আমাকে যেন একটু সহযোগিতা করে।আক্ষেপ নিয়ে সুপ্রিতা বলেন, স্বামী সেই যে গেল আর কোনো যোগাযোগ আমার সঙ্গে সে করেন করে নাই। শুনেছি তাদের বাড়িতে সে মাঝে মাঝে আসে। কিন্তু আমাকে বা আমার মেয়েকে কখনো দেখতে আসেনি, কোন ধরনের যোগাযোগ করেনি। আমি কাউকে আর ডেকে আনবো না। তবে সে যদি নিজে থেকে আমার কাছে আবার আসে, তাহলে আমি তাকে ফিরিয়ে দেবো না।যাদের সঙ্গে সুপ্রিতা কাজ করেন সে দলের মিস্ত্রি আব্দুল কাদির বলেন, এই মহিলাকে কাজে নেওয়ার মূল কারণ হলো, তিনি কোথাও তেমন কোনো কাজ পান না। তাদের অভাবের সংসার, তার একটা মেয়েকে পড়াশোনা করাচ্ছে, তার বৃদ্ধ মা তার সঙ্গে থাকে। তার স্বামী তাকে ফেলে রেখে চলে গিয়েছে, এই দুরবস্থার মধ্যে তিনি যেন আমাদের সঙ্গে কাজ করে দুটো টাকা ইনকাম করতে পারে, এ জন্যই তাকে কাজে নেওয়া। কাজ করতে গিয়ে মহিলা হিসেবে তিনি কিছু সমস্যায় পড়েন, তারপরও আমরা এগুলো মানিয়ে নিয়েছি তাকে একটু সহযোগিতা করার জন্য।ছাত্রী হিসেবে স্কুল ও এলাকায় সবসময় সুনাম রয়েছে সুপ্রিতার মেয়ে ত্রয়ীর। বর্তমানে সে স্থানীয় একটি বিদ্যালয়ের ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়াশোনা করছে। ভোর থেকেই সুপ্রিতা রান্নার সব কাজ সেরে মেয়েকে স্কুলে পাঠিয়ে বেরিয়ে পড়েন, বাড়ি ফেরেন সন্ধ্যা বেলায়। তবে এ কাজে তার সহকর্মীরাও তাকে সহযোগিতা করছেন বলে জানিয়েছেন। প্রতিবেশীরা বলছেন, এই সংগ্রামী মহিলার আচার-আচরণ খুবই ভালো। অনেক কষ্ট করে মেয়েকে লালন পালনসহ পড়ালেখা চালিয়ে যাচ্ছেন।আশ্রয়ণ প্রকল্পের বাসিন্দা জাহানারা বেগম বলেন, সুপ্রিতা অনেক দরিদ্র মানুষ, সে অনেক কষ্ট করে জীবন যাপন করে। তার ছোট বাচ্চাটা পড়াশোনা করাচ্ছে খুব কষ্ট করে। সেই কত বছর আগে মেয়েটাকে তার মায়ের পেটে রেখেই তার বাবা চলে যায়। সেই থেকে দেখছি, সে এখন পর্যন্ত কষ্ট করেই যাচ্ছে। একটি ঘরে সুপ্রিতা, তার মা এবং তার মেয়ে এই তিনজন বসবাস করে। রাজমিস্ত্রি সহকারী হিসেবে কাজ করে সে কোনো রকম দিন পার করছে। আমি চাই সুপ্রিতার মেয়েটা পড়াশুনা করে ভালো কিছু করুক, তার মায়ের কষ্টের প্রতিদান দিক। তাহলে হয়তো ভবিষ্যতের সে একটু শান্তিতে থাকতে পারবে।ত্রয়ী বলে, আমি পুলিশ অফিসার হয়ে মায়ের দেখাশোনা করতে চাই। মা ছোটবেলা থেকেই আমাকে লালন পালন করেছে, অনেক কষ্ট করেছে। আমি শুনেছি আমার বাবা আমাকে মায়ের পেটে রেখে চলে গিয়েছে। আমার বাবা চলে গিয়েছে তাতে কি হয়েছে? আমার মা আমার পাশে সব সময় রয়েছে। আমি বড় হয়ে মাকে সহযোগিতা করব।সুপ্রিয়া পন্ডিতকে সহযোগিতার বিষয়ে আশ্বাস দিয়ে সদ্য বিদায়ী দূর্গাপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. নাভিদ রেজয়ানুল কবীর বলেন, আমরা জানতে পেরেছি দুর্গাপুর উপজেলায় একজন দুস্থ মায়ের বিষয়ে, তার নাম সুপ্রিয়া। আমরা উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তার সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। জেলা প্রশাসকের নির্দেশনা অনুযায়ী আমরা তাকে নিজেদের ব্যবস্থাপনায় জেলা পর্যায়ে তাকে সহযোগিতা করব। একই সঙ্গে তার চাহিদা কি কি রয়েছে ,তা আমরা জেনে, উপজেলা পর্যায়েও তাকে সহযোগিতা করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করব।তিনি আরও জানান, শুধু সুপ্রিয়া নয়, আমরা বিভিন্ন সময়ে অসহায় দুস্থ লোকের খোঁজ পাচ্ছি এবং আমার সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি তাদেরকে সহযোগিতা করার জন্য। সামনের দিনগুলোতেও যদি এরকম কোনো অসহায় দুস্থ ব্যক্তিদের খোঁজ পাই, আমরা সরকারি বিভিন্ন সহযোগিতা তাদেরকে দেওয়ার চেষ্টা করব।ভোরের আকাশ/মো.আ.