প্রশ্নের মুখে পিএসসি
জাহিদুল ইসলাম শিশির
প্রকাশ : ২১ জুলাই ২০২৫ ০২:০৪ পিএম
সংগৃহীত ছবি
ছাত্রলীগ ক্যাডারদের সরকারি চাকরিতে পুনর্বাসন ও তাদের বিশেষ সুবিধা দিতে একের পর এক বিধি তৈরি করেছিল ফ্যাসিস্ট আমলে দায়িত্বে থাকা পিএসসির কর্মকর্তারা। দেশের প্রচলিত আইন, চাকরি বিধিমালাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে একের পর এক তৈরি হয়েছিল সেসব বিধিমালা। সেই সব বিধি ও ক্ষমতার আওতায় নিয়োগ পাওয়া ছাত্রলীগের ক্যাডাররাই এখন নানাভাবে প্রশাসনের ভেতরে অস্থিরতা তৈরি করে সরকারের জন্য বিব্রতকর সব পরিস্থিতির জন্ম দিচ্ছে। এমনকি, তাদের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ মদদে ফ্যাসিস্ট দোসরদের হাতে তুলে দেয়া হচ্ছে সরকারের শত শত কোটি টাকার সামাজিক প্রকল্পের নানা কাজ, যা নানা ক্ষেত্রে সামাজিক অস্থিরতার কারণ হয়ে উঠছে।
অনুসন্ধ্যানে জানা যায়, ফ্যাসিস্ট সরকারের সময়ে পিএসসির নন-ক্যাডার বিধিমালা ও সেই সব বিধির আওতায় নিয়োগ প্রাপ্তদের দেয়া পদোন্নতিতে বিশেষ বিধি তৈরির ফলে বিদ্যমান প্রশাসনে চরম অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। একই সময়ে চাকরিতে যোগদানের পর দেখা যাচ্ছে ছাত্র লীগের বিশেষ কোটায় চাকরি পাওয়া ব্যক্তিটি কয়েক ধাপ অটো পদোন্নতি পেয়ে কোন কোন সংস্থার গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন হয়ে যাচ্ছেন। আর মেধায় চাকরি পাওয়া ব্যক্তিটি থেকে যাচ্ছেন কয়েক ধাপ নিচে। এ নিয়ে প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে চরম অসন্তোষ বিরাজ করছে।
তথ্যমতে, শেখ হাসিনার সরকার প্রশাসনসহ সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ছাত্রলীগের ক্যাডারদের নিয়োগ দেওয়ার উদ্দেশ্যে বিসিএস এর ভাইভাতে ২০০ নাম্বার সংযোজন করে। এরপরও শিক্ষার্থী হিসেবে যারা অত্যন্ত নিন্মমানের ছাত্রলীগ নেতাকর্মী, কোনভাবেই যাদের ক্যাডার সার্ভিসে যুক্ত করা সম্ভব হয়নি, তাদের জন্যে তৈরি করা হয় বিসিএস থেকে নন ক্যাডার নিয়োগ বিধিমালা ২০১০।
বিসিএস নন-ক্যাডার নিয়োগ বিধিমালা-২০১০ এর ৪(১) অনুযায়ী ‘কমিশন বিসিএস পরীক্ষার মাধ্যমে নিয়োগের জন্য প্রকাশিত বিজ্ঞপ্তিতে নন-ক্যাডার পদে নিয়োগের বিষয় কমিশনে সংশ্লিষ্ট পদের অনুরোধ পত্র প্রাপ্তির তারিখের ক্রমানুসারে নন-ক্যাডার পদের বিবরণ ও সংখ্যা উল্লেখ করিবে’- মর্মে বলা হয়, সরকারের নিকট থেকে শূন্যপদ পুরনের জন্য নিয়োগের অনুরোধপত্র প্রাপ্তির পরবর্তী বিসিএস বিজ্ঞপ্তিতে নন-ক্যাডার শূন্য পদের বিবরণী উল্লেখপূর্বক বিসিএস থেকে নন-ক্যাডার নিয়োগ দেওয়ার কথা বিধিমালাতে বলা হয়েছে। পিএসসির এই বিধিমালা অনুসরণ করে বিসিএস থেকে নন-ক্যাডার নিয়োগের ফলে ছাত্রলীগের যেসব পরীক্ষার্থীদের বয়স শেষ হয়ে যাচ্ছিল তাদের চাকরিতে প্রবেশে অনিশ্চয়তা দেখা দেয়। তাই পিএসসি আইন কানুনের তোয়াক্কা না করে যখন যেমন ইচ্ছা নন-ক্যাডার নিয়োগ দিয়েছে।
নন-ক্যাডার বিশেষ নিয়োগ বিধিমালা-২০১০ তৈরি হওয়ার পর ৩১, ৩২, ৩৩, ৩৪ তম বিসিএস বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়। যেখানে বিসিএস নন ক্যাডার নিয়োগ বিধিমালা-২০১০ এর ৪(১) অনুযায়ী কোন বিবরণ ছিল না। তারপর ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের চাকরি নিশ্চিত করে তাদেরকে নন-ক্যাডার নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ একজন ছাত্রলীগের নেতাকে ক্যাডার সার্ভিসে প্রবেশের সর্বশেষ চেষ্টার পরেও যখন সম্ভব হয়নি, তখন তাকে নন-ক্যাডার হিসেবে নিযোগ দেয়া হয়েছে। পিএসসি তার অপকর্ম ঢাকতে ২০১৪ সালে বিধিমালাতে সংযোজন করে এক স্বৈরশাসন নামা। ২৮, ২৯, ৩০ ৩৩ ও ৩৪ তম বিসিএস এর বিজ্ঞপ্তিতে বিধি অনুযায়ী নন-ক্যাডার পদের বিবরণ উল্লেখ না থাকলেও হাসিনা সরকার নন-ক্যাডার পদের সুনির্দিষ্ট পদের বিবরণ ও সংখ্যা উল্লেখক্রমে কমিশনকে অনুরোধ করা সাপেক্ষে ‘এই বিধিমালার অধীন প্রদত্ত সুবিধাদি প্রযোজ্য হইবে’- এই বিধি সংযোজন করে, নিয়োগপ্রাপ্ত ছাত্রলীগ সদস্যদের জ্যেষ্ঠতা দেওয়ার পথ তৈরি করে।
ব্যাপারটা এমন যেকোনো পরীক্ষার্থী কোন পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেনি, পরবর্তীতে এসে বলল, ‘আমি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করিনি তো কি হয়েছে, আপনারা মনে করেন আমি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেছি, যারা পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেছে তাদের যে সুবিধা দিবেন আমাকেও সেই একই সুবিধা দিতে হবে।’
সরকারি চাকরিতে কর্মরতদের অনেকেই বলছেন, এ ধরনের বিধি তৈরি করা আর সন্ত্রাসী করা অভিন্ন নয়। কেননা একটা বিধি লঙ্ঘন করে নিয়োগ আর এক বিধি সংযোজন করে তাদের জ্যেষ্ঠতা দেওয়ার পথ তৈরি করা হয়েছে। এরপর ৩৫, ৩৬, ৩৭, ৩৮, ৪০তম বিসিএস এর বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। যেখানে বিধি অনুযায়ী নন-ক্যাডার পদের সুনির্দিষ্ট বিবরণ উল্লেখ করা হয়নি। অর্থাৎ এই সকল বিসিএস এর বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের সময় পিএসসি এর কাছে কোন নন-ক্যাডার শূন্য পদের চাহিদা ছিল না। অথচ এই সকল বিসিএস থেকে নন-ক্যাডার নিয়োগ দেওয়া হযেছে। পিএসসি এর কাছে শূন্য পদের চাহিদা না থাকলেও নিয়োগ দেওয়া নিয়ে প্রশাসনে প্রশ্ন রয়েছে।
জানা যায়, ৩৮ তম বিসিএস এর বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত ২০.০৬.২০১৭ তারিখে, সেই বিজ্ঞপ্তিতে নন ক্যাডার নিয়োগ(বিশেষ) বিধিমালা-২০১০ এর ৪(১) অনুযায়ী নন-ক্যাডার পদের সুনির্দিষ্ট বিবরণ ছিল না। ২০১৮, ২০১৯ সালে যেসব নন-ক্যাডার দপ্তর থেকে শূন্য পদ পূরণের চাহিদা প্রেরণ করা হয়, সে সকল পদ পূরণের জন্য পিএসসির নিয়মিত নন-ক্যাডার নিয়োগের বিধিমালা অনুযায়ী স্বতন্ত্র উন্মুক্ত নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে।
এরপর প্রিলি, রিটেন, ভাইভা সম্পন্ন করে নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার পর চাকরি প্রার্থীরা সংশ্লিষ্ট দপ্তরে যোগদান করে। এরপর ৩৮তম বিসিএস এর ফলাফল ঘোষণা হয়। এসময় পিএসসি বুঝতে পারে ছাত্রলীগের অনেক নেতাকর্মী চাকরি পায়নি। তখন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের অনুরোধে পিএসসি নিজে বিভিন্ন দপ্তর থেকে চাহিদা সংগ্রহ করে। কোন কোন দপ্তর সেক্ষেত্রে চাহিদা প্রেরণও করে। সে সময় ৩৮ তম বিসিএস থেকে নন ক্যাডারে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের নিয়োগ দেওয়া হয়।
কিন্তু ২০২০ সালে যে চাহিদা পিএসসি বিভিন্ন দপ্তর থেকে পেয়েছে সেটার নিয়োগের জন্য পরবর্তী বিসিএস অর্থাৎ ৪১তম বিসিএস বিধি অনুযায়ী নেওয়ার কথা। সেটা না করে পিএসসি ৩৮তম বিসিএস থেকে নন-ক্যাডারে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের প্রশাসনে অনেকটাই গায়ের জোরে প্রবেশ করানো হয়। যা এখন সংশ্লিষ্ট দপ্তরের উন্মুক্ত নিয়োগপ্রাপ্তদের সাথে জ্যেষ্ঠতা নিয়ে জটিলতা সৃষ্টি করেছে এবং ৪১তম বিসিএস এর পরীক্ষার্থীদের অধিকার ক্ষুণ্ন করছে।
অনুসন্ধ্যানে জানা যায়, পিএসসি তাদের এই অপকর্ম ঢাকতে বিসিএস নন-ক্যাডার নিয়োগ বিধিমালা-২০১০ এর সংশোধন করে বিসিএস নন-ক্যাডার নিয়োগ বিধিমালা-২০২৩ তৈরি করে।
যেখানে ৪(১) এ বলা হয়, ‘কমিশন, সরকারের নিকট থেকে ক্যাডার পদের সহিত নন-ক্যাডার শূন্য পদে নিয়োগের অনুরোধ প্রাপ্তি সাপেক্ষে বিসিএস পরীক্ষার মাধ্যমে নিয়োগের জন্য প্রকাশিত বিজ্ঞপ্তিতে পুরণযোগ্য নন-ক্যাডার শূন্য পদের বিবরণী ও সংখ্যা প্রকাশ করবে’ মর্মে উল্লেখ করা হয়।
একই বিধিমালা ৪(৩) এ বলা হয়, ‘উপ-বিধি ৪(১) এ যা কিছুই থাকুক না কেন এই বিধিমালা কার্যকর হইবার পূর্বে নন-ক্যাডার পদে নিয়োগের জন্য অপেক্ষমাণ যে সকল বিসিএস পরীক্ষার জন্য প্রকাশিত বিজ্ঞপ্তিতে সুপারিশের বিষয় উল্লেখ ছিল, কিন্তু নন-ক্যাডার সুনির্দিষ্ট বিবরণ ও সংখ্যা উল্লেখ ছিল না। সেই ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ প্রার্থীদের ক্ষেত্রে সরকার কর্তৃক বিসিএস ওয়ারী নন-ক্যাডার পদের সুনির্দিষ্ট বিবরণ ও সংখ্যা উল্লেখক্রমে কমিশনকে অনুরোধ করা সাপেক্ষে এই বিধিমালার অধীন প্রদত্ত সুবিধাদি প্রযোজ্য হইবে।’
অর্থাৎ ৪ (১) বিধিমালাতে পদের বিবরণ দেওয়ার বাধ্যবাধকতা থাকলেও পিএসসি নিজেদের বিধি লঙ্ঘনের বিষয়টি প্রতিষ্ঠিত করতে পদের বিবরণ দেওয়া এবং পদের বিবরণ না দেওয়া এক করে ফেলে। বিষয়টিকে সাংবিধানিক একটি প্রতিষ্ঠানের জন্য চরম অবমাননাকর হিসেবে দেখছেন প্রশাসনের সাথে সংশ্লিষ্টরা। অনুসন্ধ্যানে বিসিএস নন-ক্যাডার (বিশেষ) নিয়োগ বিধিমালা-২০১০, ২০১৪ এর সংশোধনী এবং বিসিএস নন-ক্যাডার (বিশেষ) নিয়োগ বিধিমালা-২০২৩ এর বিধি ৪(১) অনুযায়ী অর্থাৎ সরকারি দপ্তর/ অধিদপ্তর থেকে শূন্য পদের চাহিদা প্রাপ্তির পর পরবর্তী বিসিএস থেকে সংশ্লিষ্ট নন-ক্যাডার পদের বিবরণ উল্লেখ করে সংশ্লিষ্ট বিসিএস থেকে নিয়োগ দেওয়ার কথা থাকলেও নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করে পূর্বের বিসিএস থেকে সে সব ছাত্রলীগের মেয়াদ উত্তীর্ণ ক্যাডারদের ভাইভায় ২০০ নাম্বার দিয়ে পুশ করে এগিয়ে নিয়ে আসা হয়েছিল, তাদেরকেই পরবর্তি সমযে সব নিয়ম ভেঙ্গে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি), শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর, স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর, সমাজসেবা অধিদপ্তর, পরিসংখ্যান বিভাগসহ সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
আর তাদের জেষ্ঠ্যতা দিতে ৪(৩) বিধি তৈরি করে সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কর্মকর্তাদের উপরে জ্যেষ্ঠতার দেওয়ার পথ তৈরি করেছে। এমনকি পিএসসির আওয়ামী চাটুকারিতা এমন পর্যায়ে ছিল যে, প্রকৌশল বিষয়ে পরীক্ষায় পাশ পর্যন্ত করেনি এমন বুয়েট, চুয়েট, কুয়েট, রুয়েট এবং ডুয়েট ছাত্রলীগের পরীক্ষার্থীদেরকে এলজিইডি, শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর, স্বাস্থ্য প্রকৌশলসহ বিভিন্ন প্রকৌশল দপ্তরের সহকারী প্রকৌশলী হিসেবে সুপারিশ করেছে।
অবশ্য এর পুরস্কার স্বরূপ তৎকালীন পিএসসির চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ সাদিক ২০২৪ সালের আওয়ামী লীগের পাতানো নির্বাচনে সুনামগঞ্জ-৪ আসন থেকে আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন পেয়ে সংসদ সদস্য বনে গিয়েছিলেন। কিন্তু সেসব আওয়ামী সাংসদ এবং ড. মোহাম্মদ সাদিকের মতো আওয়ামী পন্থী সরকারি আমলারা পালিয়ে গেলেও নিয়োগ প্রাপ্ত এসব ছাত্রলীগের ক্যাডাররা বিভিন্ন দপ্তরে তান্ডব চালাচ্ছে।
জানা যায়, পিএসসির পুশ প্রাইজ প্রাপ্তরা এখন বীরদর্পে সচিবালয় চষে বেড়াচ্ছে। যাকে দুর্ভাগ্যজনক হিসেবে বর্ণনা করছেন প্রশাসনের সাথে সংশ্লিষ্টরা। একই সাথে ফ্যাসিস্ট পুশ প্রাইজে নিয়োগ প্রাপ্তদের তালিকা ও তাদের কর্মকাণ্ড সামনে আনার দাবি জোরদার হতে শুরু করেছে।
ভোরের আকাশ/এসএইচ