ভোরের আকাশ প্রতিবেদক
প্রকাশ : ১৮ মে ২০২৫ ১০:৩৩ এএম
শব্দ দূষণে বধির হওয়ার ঝুঁকিতে দেড় কোটি মানুষ
বেসরকারি উন্নয়ন গবেষণা সংস্থা বারসিকের গবেষণায় বলা হয়েছে শব্দ দূষণের কারণে দেশের কম করে দেড় কোটি মানুষ বধির হওয়ার ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। এ ভয়াবহ ঝুঁকি থেকে রক্ষায় সচেতনতা সৃষ্টিতে ব্যাপক কর্মসূচি নিয়েছে সংস্থাটি। তারই ধারাবাহিকতায় শনিবার (১৭ মে) মিরপুর ২ নম্বরের শেরে-বাংলানগর ক্রিকেট স্টেডিয়ামের ভিআইপি গেটে ঢাকা শহরের শব্দ দূষণ রোধে এক মানববন্ধনের আয়োজন করে সংস্থাটি। মানববন্ধনে মিরপুর এলাকার আপামর জনসাধারণসহ প্রায় ৫৫ জন প্রতিনিধি অংশ নেন।
এতে সভাপতিত্ব করেন মিরপুর ‘ট’ ব্লকের বাসিন্দা মোসাম্মাদ সোনিয়া বেগম এবং অনুষ্ঠানের সঞ্চালনা করে বারসিকের সমন্বয়কারী মো. জাহাঙ্গীর আলম। মানববন্ধনের ধারণাপত্র পাঠ করে বারসিকের সহকারী কর্মসূচি কর্মকর্তা হেনা আক্তার রুপা।
বারসিক সমন্বয়কারী জাহাঙ্গীর আলম বলেন, আমরা সকলেই জানি শব্দ দূষণ দিন দিন আমাদের জীবনকে অচল করে দিচ্ছে। যানবাহনের হর্ন বন্ধ করলে নগরের তিনভাগে দুইভাগ শব্দ দূষণ বন্ধ হয়ে যাবে। হাইড্রোলিক হর্ন একেবারেই বন্ধ করে দেওয়া দরকার এবং যারা অকারণে শব্দ দূষণ করে তাদেরকে আইন অনুযায়ী জরিমানা অব্যাহত রাখা উচিত। আমরা জানি উচ্চশব্দ মানবদেহে রক্তচাপ ও হৃদকম্পন বাড়িয়ে দেয়, এবং মাংসপেশির সংকোচন করে।
এছাড়া শ্রবণশক্তি কমে আসে বা বধির হওয়ার মতো অবস্থা হয়। আমরা দেখি, প্রতি বছর নববর্ষ পালনের নামে অগনিত বাজি ফুটিয়ে, ফানুস উড়িয়ে বড় বড় শহরকে আলোকিত এবং শব্দে নগরীতে পরিণত করা হয়। ফল হিসেবে দেখা যায় শহরের অগনিত পাখির মৃত্যুঘটে শুধু মব্দের কারণে। এই হোলি খোলা বন্ধ করতে হবে। সকল যানবাহনকে আইনের মধ্যে থেকে তাদের যানবাহন পরিচালনা করতে বাধ্য করতে হবে। না হয়ে নগরের অধিকাংশ মানুষ বধির হয়ে যেতে পারে।
মানববন্ধনের ধারণাপত্রে বারসিকের সহকারী কর্মসূচি কর্মকর্তা হেনা আক্তার রুপা বলেন, শব্দদূষণ এই শহরে আমাদের নিত্যদিনের সঙ্গী। ভোর থেকে শুরু হওয়া শব্দের অত্যাচার চলে গভীর রাত অবধি। সিগন্যাল ছাড়তে না ছাড়তেই; কে কার চেয়ে বেশি জোরে হর্ন বাজাবেনÑ চলতে থাকে সেই প্রতিযোগিতা। মানুষের নিরাপদ শব্দসীমা ৪০-৬০ ডেসিবেল হলেও বাস্তবতা হচ্ছে নীরব এলাকাতেই দূষণের মাত্রা ৮৫ ডেসিবেলের বেশি। মাত্রাতিরিক্ত যানবাহনের শব্দ দূষণে ২০৪৫ সালের মধ্যে শ্রবণশক্তি হারাতে পারেন দেশের দেড় কোটি মানুষ। ভয়াবহ এই দশা থেকে বেরিয়ে আসতে, সড়কে শৃঙ্খলা ফেরানোসহ শব্দের মাত্রা কমিয়ে আনার পরামর্শ দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।
সম্প্রতি প্রকাশিত জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচির (ইউএনএপি) ‘ফ্রন্টিয়ারস ২০২২ : নয়েজ, ব্লেজেস অ্যান্ড মিসম্যাচেস [ঋৎড়হঃরবৎং ২০২২: ঘড়রংব, ইষধুবং ধহফ গরংসধঃপযবং]’ শীর্ষক সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী শব্দ দূষণে বিশ্বের শীর্ষ শহরগুলোর তালিকায় রয়েছে বাংলাদেশের দুটি শহর। একটি আমাদের প্রাণের শহর ঢাকা এবং অন্যটি বাংলাদেশের অন্যতম প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী মহানগরী রাজশাহী।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, আবাসিক এলাকার জন্য অনুমতিযোগ্য শব্দের মাত্রা ৫৫ ডিবি (ডেসিবেল) এবং বাণিজ্যিক এলাকার জন্য ৭০ ডিবি। সেখানে ঢাকায় শব্দের মাত্রা ১১৯ ডেসিবল এবং রাজশাহীতে ১০৩ ডেসিবল পাওয়া গেছে।
গবেষণায় দেখা গেছে, কয়েক বছর ধরে ঢাকা শহরের প্রায সব ব্যস্ত এলাকাতেই শব্দ গ্রহণযোগ্য মাত্রার চেয়ে অনেক বেশি। ঢাকা ছাড়াও অন্যান্য জেলা শহরের শব্দ দূষণের উৎসগুলো বৃদ্ধি পাচ্ছে। বায়ু দূষণ অধ্যায়ন কেন্দ্র (ক্যাপস) এর মতে ঢাকা শহরের ১২১টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে প্রায় ৪৭টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের খবয় (এলইকিউ) মান ছিল ৮০ ডেসিবেলের বেশি।
এছাড়াও মিরপুর ১ বাস স্ট্যান্ড, আজিমপুর মোড়, জিপিও মোড়, মালিবাগ রেলগেট, উত্তর বাড্ডা মোড়, আবুল হোটেল মোড়, ফার্মগেট মোড়ে শব্দের মানমাত্রা ৯০ ডেসিবলের ওপরে পাওয়া গিয়েছে। যদিও শব্দ দূষণ রোধে দেশে আইন আছে। সেই আইনে জেল-জরিমানার বিধানও আছে। তবে তার প্রয়োগ হয় কতটা, তা নিয়ে বিশেষ তথ্য পাওয়া যায় না।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ইউনিসেফ ও বিশ্বব্যাংকের গবেষণায় দেখা গিয়েছিল, বাংলাদেশে প্রায় ৩০টি জটিল রোগের অন্যতম প্রধান উৎস শব্দ দূষণ। ক্রমাগত বাড়তে থাকা শব্দের মাত্রা আগামীতে অসুস্থ প্রজন্ম জন্ম দিবে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা। আকস্মিক উচ্চশব্দ মানবদেহে রক্তচাপ ও হৃদকম্পন বাড়িয়ে দেয়, মাংসপেশির সংকোচন করে এবং পরিপাকে বিঘ্ন ঘটায়।
এ ছাড়া শ্রবণশক্তি কমে আসে বা বধির হওয়ার মতো অবস্থা হয়। মাথাব্যথা, বদহজম, অনিদ্রা, মনোযোগ কমে যাওয়া, মেজাজ খিটখিটে হওয়া, অযথা বিরক্তিবোধ এমনকি নানাবিধ মানসিক চাপ সৃষ্টি হতে পারে বলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা। অন্যদিকে উচ্চশব্দ শিশু, গর্ভবতী মা, হৃদরোগীর জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। শব্দ দূষণের ফলে শিশুদের মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, আকস্মিক উচ্চশব্দ মানবদেহের রক্তচাপ ও হৃৎকম্পন বাড়িয়ে দেয়, মাংসপেশির সংকোচন করে, পরিপাকে বিঘ্ন ঘটায়, শিরা ও স্নায়ুতন্ত্রের ওপর প্রচণ্ড চাপ দেয়।
সম্মিলিত উদ্যোগই শব্দ দূষণের মতো একটি সামাজিক সংকট থেকে উত্তরণ ঘটাতে পারে। এজন্য সুনির্দিষ্ট সুপারিশসমূহ মধ্যে-বিধিমালা সংজ্ঞা অনুযায়ী চিহ্নিত জোনসমূহে (নীরব, আবাসিক, বাণিজ্যিক, শিল্প ও মিশ্র) সাইনবোর্ড স্থাপন করে তা মান্যতার ব্যাপারে নিয়মিত মনিটরিং করতে হবে। যেসব এলাকায় শব্দ দূষণের পরিমাণ তুলনামূলকভাবে বেশি সেসব এলাকাতে নিয়মিত ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করতে হবে। কয়েক বছরে দেখা যাচ্ছে ঢাকা শহরের আবাসিক এলাকাসমূহে ধীরে ধীরে বাণিজ্যিকরণ হচ্ছে যা ফলে শব্দ দূষণের পরিমাণ বাড়ছে। এক্ষেত্রে আবাসিক এলাকা সমূহকে বাণিজ্যিক এলাকায় রূপান্তরিত না করা একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ হতে পারে।
পরিবেশ অধিদপ্তরের সঙ্গে বাংলাদেশ পুলিশ, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ, স্থানীয় সরকার এবং বাণিজ্য মন্ত্রণালয়সহ অন্যান্য প্রশাসনিক দপ্তরের সমন্বয় সাধন করতে হবে। শব্দদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা, ২০০৬-এর শতভাগ বাস্তবায়ন, যানবাহনে ব্যবহৃত হাইড্রোলিক হর্ন আমদানি বন্ধ করা, হর্ন বাজানোর শাস্তি বৃদ্ধি ও চালকদের শব্দ সচেতনতা যাচাই করে লাইসেন্স প্রদান করা শব্দ দূষণ কমাতে বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারে।
বিশেষ করে হাসপাতাল ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সামনে হর্ন না বাজানোর জন্য কঠোর ব্যবস্থাগ্রহণ করতে হবে। বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের আওতায় পরিবেশ ক্যাডার ও পরিবেশ পুলিশ নিয়োগ দিতে হবে। যানবাহনের চাপ কামানোর জন্য, গণপরিবহন ব্যবস্থা উন্নত করার মাধ্যমে ব্যক্তিগত যানবাহনের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
এর মাধ্যমে আমাদের এই মরণব্যধি শব্দদূষণ থেকে আমাদের কিছুটা রেহাই দিতে পারে। এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন, বারসিক প্রতিনিধি এশা আক্তার লাবন্য, কারিতাস প্রতিনিধি জসীম উদিন, সুশীল সমাজ প্রতিনিধি দুলাল কর, ব্যবসায়ী মুস্তাফিজুর রহমান প্রমুখ।
ভোরের আকাশ/এসএইচ