ডিপ ফ্রিজে মিলল নারীর লাশ
মাহমুদ সালেহীন খান
প্রকাশ : ১৬ অক্টোবর ২০২৫ ০১:১২ এএম
ছবি: তাসলিমা বেগম ও তার স্বামী নজরুল
রাজধানীর কলাবাগানে গৃহবধূ তাসলিমা বেগমকে হত্যার পর হাত-পা বেঁধে চাদরে মুড়িয়ে মাছ-মাংস দিয়ে ঢেকে ফ্রিজে লুকিয়ে রেখেছিলেন স্বামী নজরুল ইসলাম। স্ত্রীর বাবার বাড়ির সম্পত্তি নিয়ে বিরোধকে কেন্দ্র করে নজরুল এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছেন বলে দাবি করছেন নিহতের স্বজনরা।
তাদের অভিযোগ, বাবার বাড়িতে পাওয়া সম্পত্তি স্বামীর নামে লিখে না দেওয়ায় তাসলিমাকে হত্যা করেন নজরুল। পরে সন্তানদের ফুপুর বাসায় পাঠিয়ে দিয়ে মরদেহের হাত-পা বেঁধে, চাদর পেঁচিয়ে এবং ওপরে মাছ-মাংস দিয়ে ডিপ ফ্রিজে লুকিয়ে আত্মগোপন করেন।
পুলিশ জানান, পারিবারিক দ্বন্দ্বে এই হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। গত সোমবার রাত সাড়ে ১১টার দিকে কলাবাগান প্রথম লেনের ২৪ নম্বর বাসার ৬/বি নম্বর ফ্ল্যাট থেকে তাসলিমা বেগমের মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। এ ঘটনায় নিহতের ভাই নাঈম হোসেন বাদী হয়ে কলাবাগান থানায় একটি মামলা করেন।
চাঞ্চল্যকর ওই হত্যাকাণ্ডের দুই দিন পর পুলিশ নজরুলকে গ্রেপ্তার করে। তার ব্যাপারে বিস্তারিত জানাতে গতকাল বুধবার ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারে প্রেস ব্রিফিং ডাকা হয়। সেখানে কথা বলেন রমনা বিভাগ উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মো. মাসুদ আলম।
পুলিশের সুরতহাল প্রতিবেদন অনুযায়ী, তাসলিমার কপাল ও মাথায় ধারালো অস্ত্রের একাধিক কোপের চিহ্ন রয়েছে।
মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, তাসলিমাকে হত্যার পর নজরুল হাত-পা-মুখ বেঁধে, বিছানার চাদর দিয়ে পেঁচিয়ে ফ্রিজে লুকিয়ে রেখে নিজে গাড়ি চালিয়ে আত্মগোপনে চলে যান।
নিহতের স্বজনরা জানান, হত্যাকাণ্ডের পুরো ঘটনাটি ঠান্ডা মাথায় ঘটিয়েছে নজরুল। স্ত্রীকে হত্যার পর হাত-পা বেঁধে ডিপ ফ্রিজের ভেতর মরদেহ লুকিয়ে রেখে ওপরে মাছ-মাংস দিয়ে ঢেকে দেয়। এরপর ভোরে তার সন্তানদের ঘুম থেকে তুলে বলে, তোমাদের মা অন্য পুরুষের সঙ্গে পালিয়ে গেছে। আমি তোমাদের মা’কে খুঁজতে যাচ্ছি। তোমরা আপাতত ফুপুর বাসায় বেড়াতে যাও।
তাসলিমার ভাই নাজমুল হোসেন বলেন, আমরা ভাই-বোন বাবার যে সম্পত্তি পেয়েছি, সেই সম্পত্তি লিখে দিতে আমার বোনকে চাপ দিত তার স্বামী। কয়েক দিন ধরে ১০ কাঠা জায়গা লিখে দিতে আমার বোনকে অনেক মারধর করে নজরুল।
গত রোববার রাতে আমার বোনকে মেরে হাত-পা বেঁধে ফ্রিজে মাছ মাংস দিয়ে ডেকে রাখে। পরে ভোরে আমার ভাগ্নিদের ঘুম থেকে ডেকে বলে, তোমার মা অন্য এক লোকের সঙ্গে চলে গেছে। তোমরা তোমাদের ফুপুর বাসায় বেড়াতে যাও, আমি তোমাদের মা’কে খুঁজে আসি। এ কথা বলে আমার বোনের স্বামী আমার ভাগ্নিদের তার ফুপুর বাসায় রেখে আসে। বড় ভাগ্নি বিষয়টি জানালে আমরা তাকে খুঁজতে বের হয়ে কয়েক দফায় আমার বোনের স্বামীকে ফোন দেই। কিন্তু তিনি আমাদের ফোন ধরেননি। পরে বাসায় গিয়ে দেখি তালা দেওয়া।
সোমবার সন্ধ্যায় আমরা কলাবাগান থানা পুলিশ নিয়ে বাসায় গিয়ে তালা ভেঙে ভেতরে ঢুকে সব জায়গায় অনেক খোঁজাখুঁজি করি। একপর্যায়ে বাসার দেয়ালে রক্ত দেখতে পাই। ডিপ ফ্রিজের নিচ দিয়ে রক্ত পরে জমাট বেঁধে থাকতে দেখি। তখন ফ্রিজ খুলে ভেতরে রক্ত দেখতে পাই। উপরে মাছ-মাংস দিয়ে নিচে আমার বোনের হাত-পা বাঁধা লাশ ঢেকে রাখতে দেখি। পরে পুলিশ ফ্রিজ থেকে আমার বোনকে বের করে আনে।
এ ঘটনায় আমার ছোট ভাই নাঈম কলাবাগান থানায় একটি হত্যা মামলা করেছে। মামলার বাদী নিহতের ছোট ভাই নাঈম বলেন, ‘২০০৪ সালে আমার বোনের বিয়ে হয়। ১৯, ১৬ ও ৫ বছর বয়সী তাদের তিনটি মেয়ে আছে। ২১ সেপ্টেম্বর বাড়িতে গিয়ে আমার বোন তাসলিমার উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া সম্পত্তি নিজের নামে লিখে দেওয়ার জন্য চাপ দেন নজরুল ইসলাম। আমরা তাতে রাজি হয়নি। এতে রাগ করে আমার বোনকে নিয়ে ঢাকায় ফিরে যান এবং পরে আমার বোন ও ভাগ্নিদের সঙ্গে আমাদের কাউকে যোগাযোগ করতে দেননি।’
নাঈম আরও বলেন, নজরুল ইসলাম আমার বোনকে মোবাইল ব্যবহার করতে দিত না। এসএসসি পরীক্ষা দেওয়ার পর বড় ভাগ্নিকে মাদরাসায় ভর্তি করে। সেখানে হেদায়াতুন নাহু পর্যন্ত পড়াশোনা করে। এরপর থেকে তার লেখাপড়া বন্ধ। মেজ ভাগ্নিও ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত পড়ার পর তারও লেখাপড়া বন্ধ করে দেয়। আর ছোট ভাগ্নি আমাদের কাছে গাজীপুরে থাকত, সে ক্লাস ওয়ানে পড়ে।
নজরুলের বাসার নিরাপত্তারক্ষী বাবুল হাওলাদার বলেন, গত সোমবার সকাল ৮টা ১ মিনিটে দুই মেয়েকে নিয়ে নজরুল ইসলাম ব্যক্তিগত গাড়িতে করে বাসা থেকে বের হন। এরপর আর ফিরে আসেননি। তার আগে রোববার রাত সাড়ে ১০টার দিকে গাড়ি নিয়ে বাসায় প্রবেশ করেন। তিনি ৬ তলার একটি ফ্ল্যাটে চার মাস আগে ভাড়া এসেছেন। স্ত্রী-সন্তানদের তেমন বের হতে দেখা যায়নি। তারা কখনো বের হলে নজরুল ইসলাম সঙ্গে করে নিয়ে বের হতেন। তাদের কখনো স্কুল-কলেজে যেতে দেখিনি।’
কলাবাগান থানার ওসি ফজলে আশিক বলেন, ‘পারিবারিক দ্বন্দ্ব থেকে এ হত্যাকাণ্ড ঘটেছে বলে প্রাথমিক তদন্তে জানা গেছে।’
ওসি আরও জানান, ‘স্ত্রী পরকীয়া করে বলে সন্দেহ করত নজরুল। এটা নিয়ে সবসময় গণ্ডগোল লেগে থাকত। আমরা ধারণা করছি বাচ্চারা রাতে পাশের রুমে ঘুমিয়ে যাওয়ার পরই এ হত্যাকাণ্ড হয়েছে।’
ফজলে আশিক আরও বলেন, ‘নজরুল তেমন কিছু করেন না। ব্যাংকে কিছু টাকা আছে, সেখান থেকে ইন্টারেস্ট তুলে সংসার চালাতেন।’ স্ত্রী তাসলিমা আক্তারের সঙ্গে নজরুল ইসলামের দীর্ঘদিন ধরে কলহ চলছিল। অন্য কোনো পুরুষের সঙ্গে তাসলিমার সম্পর্ক আছে বলে সন্দেহ করতেন নজরুল।
তিনি আরও সন্দেহ করছিলেন, তার সম্পত্তি হাতিয়ে নিতে পারেন তাসলিমা। এই দুই সন্দেহ থেকে নজরুল তার স্ত্রী তাসলিমাকে হত্যা করে লাশ ডিপ ফ্রিজে রাখেন। রাজধানীর কলাবাগানে তাসলিমা হত্যা মামলায় তার স্বামী নজরুলকে গ্রেপ্তারের পর
গতকাল দুপুরে এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্যগুলো জানায় পুলিশ। ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) মিডিয়া সেন্টারে এই সংবাদ সম্মেলন করা হয়।
সংবাদ সম্মেলনে ডিএমপির রমনা বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) মাসুদ আলম বলেন, গত মঙ্গলবার রাতে রাজধানীর বংশালের নবাবপুর রোড এলাকায় অভিযান চালিয়ে নজরুলকে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তারের পর নজরুলকে প্রাথমিকভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদে তিনি উল্লিখিত তথ্য দিয়েছেন। নজরুল-তাসলিমা দম্পতির বাসা কলাবাগান এলাকায়। তাদের দুই সন্তান আছে।
ডিসি মাসুদ আলম বলেন, জিজ্ঞাসাবাদে নজরুল বলেছেন, তাসলিমাকে সন্দেহ করতেন তিনি। অন্য কোনো পুরুষের সঙ্গে তাসলিমার সম্পর্ক আছে বলে তিনি সন্দেহ করছিলেন। তার সম্পত্তি স্ত্রী হাতিয়ে নিতে পারেন, এমন সন্দেহও কাজ করছিল। এই সন্দেহ থেকে তিনি স্ত্রীকে প্রতিনিয়ত মানসিক ও শারীরিকভাবে নির্যাতন করতেন।
গত রোববার রাতে বাসায় ফিরে নজরুল দেখেন, ফ্ল্যাটের দরজার তিনটি লকের মধ্যে দুটি খোলা। সন্দেহ থেকে তিনি উত্তেজিত হন। রাত ১২টার দিকে তিনি ঘুমন্ত স্ত্রীকে দা দিয়ে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে হত্যা করেন। লাশ গামছা দিয়ে বেঁধে, বিছানার চাদর ও ওড়না দিয়ে মুড়িয়ে বাসার ডিপ ফ্রিজে লুকিয়ে রাখেন। রক্তমাখা তোশক উল্টিয়ে, মেঝে পরিষ্কার করে, নিজের জামাকাপড় ধুয়ে আলামত গোপনের চেষ্টা করেন।
ডিসি মাসুদ আলম বলেন, পরদিন সকালে নজরুল বড় সন্তানকে জানান, তার মা অন্য এক ব্যক্তির সঙ্গে পালিয়ে গেছেন। এ সময় বড় সন্তান ঘরের দেয়ালে রক্তের দাগ দেখতে পায়। এরপর নজরুল তার দুই সন্তানকে নানার বাড়িতে রেখে আসার কথা বলেন। কিন্তু তিনি সন্তানদের নিয়ে যান রাজধানীর আদাবরে তাদের ফুফুর বাসায়। সন্তানদের রেখে নজরুল প্রাইভেট কারে পালিয়ে যান। সন্দেহ হলে তাসলিমার ছোট ভাই নাঈম হোসেনসহ এই দম্পতির দুই সন্তান গত সোমবার সন্ধ্যায় কলাবাগান থানায় অভিযোগ দেন।
অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে কলাবাগান থানা-পুলিশের একটি দল ফ্ল্যাটটিতে যায় বলে জানান ডিসি মাসুদ আলম। তিনি বলেন, পুলিশ দরজার তালা ভেঙে ফ্ল্যাটে প্রবেশ করে। একপর্যায়ে ডিপ ফ্রিজ খোলে তারা। ফ্রিজের ওপরের দিকে থাকা মাছ-মাংস সরালে চাদর দিয়ে প্যাঁচানো অবস্থায় তাসলিমার লাশ পাওয়া যায়।
এ ঘটনায় গত সোমবার রাতে তাসলিমার ছোট ভাই নাঈম বাদী হয়ে কলাবাগান থানায় একটি হত্যা মামলা করেন।
সংবাদ সম্মেলন জানানো হয়, মামলার পর পুলিশ সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করে। গোয়েন্দা তথ্যসহ প্রযুক্তির সহায়তায় কলাবাগান থানা-পুলিশ নজরুলের অবস্থান শনাক্ত করে তাকে গ্রেপ্তার করে।
ভোরের আকাশ/এসএইচ