চট্টগ্রাম প্রতিনিধি
প্রকাশ : ২৭ অক্টোবর ২০২৫ ০১:৫৬ পিএম
ছবি: ভোরের আকাশ
রাউজান উপজেলা এখন আতঙ্কের জনপদ। অস্ত্রের ঝনঝনানির সঙ্গে বেড়েছে সন্ত্রাসীদের তৎপরতা। ঘটছে একের পর এক খুনের ঘটনা। তবে এতকিছুর পরও নেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিশেষ কোনো অভিযান। এতে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে অপরাধীরা। তবে পুলিশ বলছে, আধিপত্যবিস্তারের চেষ্টাই বেশিরভাগ হত্যাকাণ্ড। রয়েছে রাজনৈতিক অর্ন্তকোন্দল।
বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদের তথ্য বলছে, ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ১৫ মাসে রাউজানে অন্তত অন্তত ১৭টি খুনের ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনার মধ্যে রয়েছ- গুলি করে খুন, পিটিয়ে খুন, অপহরণের পর খুন, নিখোঁজ হওয়ার পর মরদেহ উদ্ধার। প্রায় প্রতিটি খুনের পেছনে রয়েছে রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব, ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব কিংবা আধিপত্য বিস্তার সামনে এসেছে।
সর্বশেষ শনিবার (২৫ অক্টোবর) বিকেল ৪টার দিকে রাউজান পৌরসভার ৯নম্বর ওয়ার্ডের পশ্চিম রাউজান চারাবটতল কায়কোবাদ চৌধুরী জামে মসজিদের পাশে চান মিয়া চৌধুরী সড়কে গুলিতে খুন হন দুর্ধর্ষ ডাকাত আলম (৪৫)। সম্প্রতি তিনি ১২ বছর কারাভোগ শেষে জামিনে বের হয়েছেন।
গত ৭ অক্টোবর বিকেলে রাউজান-হাটহাজারীর সীমান্তবর্তী চট্টগ্রাম-কাপ্তাই মহাসড়কের মদুনাঘাট ব্রিজের দক্ষিণ পাশে চট্টগ্রাম ওয়াসার পানি শোধনাগারের সামনে হেলমেট পরে মোটরসাইকেলে করে আসা সন্ত্রাসীরা বিএনপি নেতা ব্যবসায়ী আবদুল হাকিমের প্রাইভেট কারকে লক্ষ্য করে এলোপাতাড়ি গুলি করে। এতে প্রাণ হারান আবদুল হাকিম। আহত হন তার গাড়ির চালক মো. ইসমাইল।
২৮ আগস্ট অপহরণের পর খুন হন আবদুল মান্নান (২৮)। এ ঘটনার তিনদিন পর ১ সেপ্টেম্বর একটি গলির ভেতর থেকে উদ্ধার করা হয় ইউসুফ মিয়া (৬৫) নামে এক ব্যক্তির মরদেহ। এরপর ১১ নভেম্বর চিকদাইরে হাফেজ আবু তাহের (৪৮) নিখোঁজ হওয়ার তিনদিন পর তার ক্ষতবিক্ষত মরদেহ উদ্ধার করা হয়।
২৪ জানুয়ারি নোয়াপাড়ায় প্রকাশ্যে গুলি করে খুন করা হয় মো. জাহাঙ্গীর আলমকে (৫৫)। ১৯ ফেব্রুয়ারি নোয়াপাড়ায় পিটিয়ে খুন করা হয় মুহাম্মদ হাসানকে (৩৫)। এরপর ১৫ মার্চ হলদিয়ায় ইফতার বিতরণ নিয়ে বিএনপির অভ্যন্তরীণ সহিংসতায় খুন হন কমর উদ্দিন জিতু (৩৬)।
২১ মার্চ পূর্বগুজরায় গরুচোর সন্দেহে জনতার হাতে গণপিটুনিতে নিহত হন মো. রুবেল (৩৫)। অভিযোগ রয়েছে, এই ঘটনার নেপথ্যে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতার অনুসারীদের উসকানি ছিল।
১ এপ্রিল পারিবারিক জমি নিয়ে বিরোধে খুন হন নূর আলম বকুল (৪৩)। ১৭ এপ্রিল পাহাড়তলী ইউনিয়নে মো. জাফরের (৪০) মরদেহ উদ্ধার করা হয়। একই মাসে বিএনপিকর্মী মানিক আবদুল্লাহ (৩৬) নিজ দলের লোকজনের হাতে গুলিতে নিহত হন।
২২ এপ্রিল রাউজান সদর ইউনিয়নের গাজিপাড়ায় গুলি করে খুন করা হয় ইব্রাহিমকে (২৮)। ৩ জুলাই উরকিরচরে কিশোরদের ধূমপান নিয়ে বিরোধ থামাতে গিয়ে তাদের হামলায় প্রাণ হারান মো. আলমগীর।
৬ জুলাই কদলপুরে অটোরিকশা থেকে নামিয়ে প্রকাশ্যে গুলি করে খুন করা হয় মুহাম্মদ সেলিমকে (৪০)।
১০ জুলাই বেতবুনিয়ার লুঙ্গিপাড়ায় উদ্ধার করা হয় দিদারুল আলমের (৪০) মরদেহ। তার মৃত্যু ‘রহস্যজনক’ বলে জনশ্রুতি আছে।
২৫ জুন কর্ণফুলী নদীর পাড়ে যুগীপাড়া বোট ঘাট এলাকায় বালিচাপা দেওয়া অবস্থায় পাওয়া যায় রুপন নাথের (৩৭) মরদেহ।
এছাড়া গত ১৪ মাসে রাউজানে বিএনপির দুই গ্রুপের আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষে আহত হয়েছেন তিন শতাধিক মানুষ। এখনও থেমে নেই হামলার ঘটনা।
১৮ জুলাই কদলপুর দক্ষিণ শমসেরপাড়ায় আবদুল নবীর ছেলে আবদুর রহিমকে পিটিয়ে হাত-পা ভেঙে দেয় দুর্বৃত্তরা। উত্তর জেলা বিএনপির সাবেক আহ্বায়ক গোলাম আকবর খোন্দকারের গাড়িবহরে হামলা, গাড়ি ভাঙচুর ও মোটরসাইকেল পুড়িয়ে দেওয়ার ঘটনায় উভয়পক্ষের অন্তত ৬০ জন আহত হন।
স্থানীয়রা বলছেন, অপরাধ করেও রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় পার পেয়ে যাচ্ছে অপরাধীরা। এ কারণে দিন দিন অপরাধীরা আরও বেপরোয়া হয়ে উঠছে। এছাড়া বিএনপির দুই কেন্দ্রীয় নেতার অন্তর্কোন্দলও রয়েছে।
নিহত স্বজনদের অভিযোগ, হত্যায় জড়িতরা এলাকায় প্রকাশ্যে ঘুরছে। কিন্তু পুলিশ তাদের ধরছে না। ফলে আতঙ্কে দিন কাটছে তাদের।
এ বিষয়ে রাউজান থানার ওসি মনিরুল ইসলাম ভূঁইয়া বলেন, ‘রাউজানে মূলত আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করেই বেশিরভাগ হত্যাকাণ্ড হয়েছে। অন্তত ৭টি খুনের ঘটনা ঘটেছে রাজনৈতিক বিরোধে। বাকিগুলো ব্যক্তিগত, জমি সংক্রান্ত, আত্মহত্যা, গণপিটুনি এবং পারিবারিক কলহের জেরে। ৬টি হত্যাকাণ্ডের মামলায় ৩০ জন আসামি গ্রেপ্তার করা হয়েছে । এসব মামলায় প্রায় ৮০-৯০ জন আসামি গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলেও দাবি করেন তিনি।
রাউজান-রাঙ্গুনিয়া সার্কেলের সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) মো. বেলায়েত হোসেন বলেন, ‘অপরাধীদের তৎপরতা বন্ধে আমদের কার্যক্রম পিছিয়ে নেই। শতাধিক সন্ত্রাসীকে আইনের আওতায় আনা হয়েছে। রাউজানে আইনশৃঙ্খলা স্বাভাবিক রাখতে আমাদের চেষ্টা অব্যাহত আছে।’
ভোরের আকাশ/তা.কা