এস,এম সিপার, নাজিরপুর (পিরোজপুর) প্রতিনিধি
প্রকাশ : ২৭ জুলাই ২০২৫ ০৩:২৬ পিএম
ছবি: ভোরের আকাশ
ভাসমান সবজি চাষ কীভাবে শুরু হয়েছিল, নির্দিষ্ট করে কেউ কিছু বলতে পারেননি। মুগারঝোড় গ্রামের কৃষক মো. ফেরদাউস (৫০) বলেন, ‘ছোটবেলা থেকেই ভাসমান সবজি চাষ করে আসছি। আমাদের বাবা-দাদারা এইভাবে চাষ করতেন।
পিরোজপুরের নাজিরপুরের প্রত্যন্ত এলাকা দেউলবাড়ী দোবড়া, কলার দোয়ানিয়া ও মালিখালী ইউনিয়নের অধিকাংশই বিল। এখানকার বাসিন্দারা বছরের প্রায় ছয় মাস পানিবন্দি থাকে। এক মৌসুমের ফসলে তাদের অভাব-অনটনের মধ্যে থাকতে হয়। তবে তাদের বিকল্প আয়ের পথ খুলে দিয়েছে ভাসমান সবজি চাষ। লাভজনক হওয়ায় সহস্রাধিক কৃষক এ পদ্ধতিতে সবজি চাষ করছেন। বর্তমানে এ উপজেলায় ১৮০ হেক্টর জলাশয়ে ভাসমান সবজি চাষ হচ্ছে। দুইশ’ বছরেরও আগে থেকে চলে আসা এ বিরল কৃষি পদ্ধতি আজ দেশ ছাড়িয়ে বিশ্ব স্বীকৃতি অর্জন করেছে।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে ওই স্বীকৃতিপত্র বাংলাদেশ কৃষি মন্ত্রণালয়ের কাছে হস্তান্তর করেছে। কৃষি বিশেষজ্ঞরাও বর্তমানে জলমগ্ন জলাভূমিতে এ ধরনের বিশেষ পদ্ধতির চাষাবাদের প্রশিক্ষণসহ কৃষকদের ব্যাপকভাবে উৎসাহিত করছেন।
নাজিরপুর উপজেলা সদর থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার উত্তরে বৈঠাকাটা বাজার সন্নিহিত মুগারঝোর গ্রামের জলাভূমিসহ বিলাঞ্চলের ১৮০ হেক্টর জমিতে নয়নাভিরাম ব্যতিক্রমী এ চাষাবাদের ব্যাপকতা দেখা মেলে। ভাসমান বেড তৈরি: বর্ষার শুরু অর্থাৎ আষাঢ় থেকে কার্তিক পর্যন্ত এ পাঁচ মাস কৃষকদের ভাসমান ধাপের ওপর ৪১ প্রজাতির শাক-সবজির চারা উৎপাদন ও তা বিক্রির সময়। আষাঢ়ে এসব গ্রামের নিচু জমি পানিতে প্লাবিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কৃষকরা নেমে পড়ে ধাপ চাষে। কচুরিপানা, দুলালীলতা, শ্যাওলা, টেপাপানা, গুঁড়িপানা ইত্যাদি জলজ উদ্ভিদের সঙ্গে খড়কুটা এবং নারিকেলের ছোবড়াগুঁড়া মিলিয়ে স্তরে স্তরে সাজিয়ে তৈরি করা হয় ভাসমান বীজতলা বা ধাপ। যা পচে তৈরি হয় জৈবসার। ১০০-১৮০ ফুট লম্বা, ৫-৬ ফুট চওড়া এবং এক-দেড় ফুট পুরু বীজতলা পানিতে তৈরি হয়, যা থাকে ৮-১০ ফুট পানিতে ভাসমান।
পুরুষরা ধাপ তৈরি, চারা স্থাপন, পরিচর্যা ও চারা বিক্রির কাজ করে। নারীরা ও ছোট ছেলেমেয়েরা বাড়িতে বসে চারা তৈরির প্রাথমিক স্তর অর্থাৎ বীজের অঙ্কুরোদ্গম ঘটানোর কাজ করে। শ্যাওলা, নারিকেলে ছোবড়া ও কেঁচো সার ইত্যাদি দিয়ে ছোট ছোট বল আকারের বস্তু তৈরি করে থাকে। স্থানীয় ভাষায় একে টেমা বা দৌল্লা বলে। এর মধ্যে বীজ রেখে অঙ্কুরোদ্গম ঘটানো হয়। যা পরে ভাসমান বীজতলা বা ধাপের উপর স্থাপন করে নির্দিষ্ট সময় পরিচর্যার পর চারায় পরিণত করা হয়।
সরজমিন দেখা যায়, বিলাঞ্চলের বিলের পানির উপর ভাসমান বেডে শসা, কাঁকরোল, মিষ্টিকুমড়া, লাউ, বেগুন, টমেটো, পেঁপে, মরিচের চারা এ ছাড়া লালশাক, পালংশাক, মুলাসহ নানা প্রকার সবজির সমারোহ। বিলের পানি ছাড়াও এই পদ্ধতিতে বাড়ির পাশে জলাশয়ে সবজি চাষ করা হচ্ছে।
সরজমিন আরও দেখা যায়, শীতের সিজনে বিলের পানি অনেকটা কমে গেছে এবং এ সবজি চারা বিক্রি করার পরে এখানেই রোপণ করা হবে বো?রো ধান। মুগারঝোর গ্রামের ইব্রাহীম (৬০) বলেন, এলাকার অধিকাংশ জমিতে এক ফসল হয়। বছরে প্রায় ৬ মাস পানিতে তলিয়ে থাকে। আগে অভাব অনাটন লেগেই থাকতো।
পরে ভাসমান সবজি চাষ শুরু করার পরে এখন আর আমাদের পেছনে ফিরে তাকানো লাগে না। এই সবজি চারা এবং সবজি তোলা হলেই বিরি ধান রোপণ করা হবে। এবার ২০টি বেডে সবজি চারা চাষ করেছি। বেড প্রতি তৈরি করতে খরচ হয়েছে ১১ হাজার টাকা, চারা বিক্রি গেল বছরের তুলনায় এ বছর দাম কিছু বৃদ্ধি থাকায় আশাকরি বেড প্রতি ২০ হাজার টাকার চারা বিক্রি করতে পারবো। দেউলবাড়ী গ্রামের রাজে আলী বলেন ‘সপ্তাহে দু’দিন গাওখালী ভাসমান নৌকায় হাট এবং গাওখালী বাজারে সবজি নিয়ে বিক্রি করি। কখনো কখনো ব্যবসায়ীরা এসে বাড়ি থেকেই সবজি কিনে নিয়ে যান। বিষমুক্ত হওয়ায় প্রচুর চাহিদা রয়েছে এসব সবজির। এখান থেকে সবজি এবং চারা ট্রাকে এবং নদী পথে বিভিন্ন জায়গায় চলে যায়, ঢাকায়ও রয়েছে এর ব্যাপক চাহিদা।
এ বিষয়ে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ইসরাতুন্নেছা এশা বলেন, উপজেলায় এ বছর প্রায় ১৮০ হেক্টর জমিতে ২১৭৫টি ভাসমান বেড রয়েছে। পরিবেশবান্ধব ও জৈব পদ্ধতিতে এ ফসল আবাদ করা হয়। চাষের খরচ তুলনামূলকভাবে খুবই কম। সেচের প্রয়োজন পড়ে না। খুব কম সার ও বালাইনাশক ব্যবহার করে ফসল উৎপাদন করা যায়
ভোরের আকাশ/জাআ