মাথায় কিস্তির বোঝা
এস,এম সিপার, নাজিরপুর (পিরোজপুর) প্রতিনিধি
প্রকাশ : ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ০৭:১৬ পিএম
ছবি: ভোরের আকাশ
কিস্তির বোঝা মাথায় নিয়েই প্রতিনিয়ত নদীতে জাল ফেলছে জেলেরা কিন্তু পাওয়া যাচ্ছে না কাঙ্খিত ইলিশের দেখা। ভরা মৌসুমেও পিরোজপুরের নদীগুলোতে দেখা মিলছে না ইলিশের, হতাশায় দিন কাটছে জেলেদের। স্থানীয় জেলেরা বলছে, ঝাটকা ও অবৈধ জাল দিয়ে মাছ ধরার কারণেই ইলিশ শূন্য হয়ে পড়েছে নদীগুলো। সঠিকভাবে যদি জাটকা রক্ষা করা না যায় তাহলে আগামীতে ইলিশের ঐতিহ্য হারাবে এই জেলা।
পিরোজপুরের প্রধান বড় নদী কালিগঙ্গা, কচা, বলেশ্বর। দূর থেকে দেখলে মনে হবে সারি সারি নৌকা নিয়ে জেলেরা ইলিশ আহরণে ব্যস্ত সময় পার করছে, ঝাঁকে ঝাঁকে ধরা পড়ছে কচা ও কালী গঙ্গার সুস্বাদু ইলিশ, কিন্তু জেলেদের কাছে গেলেই ফুটে উঠে বাস্তব চিত্র। দু তিন দিন ধরে জেলেরা জাল ফেললেও দেখা মিলছে না প্রত্যাশিত ইলিশের। মাঝেমধ্যে দু একটা ইলিশের দেখা মিললেও আকারে খুবই ছোট হাওয়ায় জেলেদের কপালে যেন চিন্তার ভাঁজ। একমাত্র সম্বল নৌকা ও জাল নিয়ে জীবিকা নির্বাহের জন্য কাংখিত ইলিশের আশায় জাল ফেললেও হতাশা নিয়েই বাড়ি ফেরেন জেলেরা।
দক্ষিণের জেলা পিরোজপুরে কচা কালিগংগা বলেশ্বর সন্ধ্যা সহ বেশ কয়েকটি নদী রয়েছে। বছর কয়েক আগেও এই নদীগুলোতেই ধরা পড়তো ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ কিন্তু বর্তমানে জেলেদের জালে দেখা মিলছে না কাঙ্খিত ইলিশের।
পিরোজপুরের কালিগংগা ও কচা নদীর মোহনায় সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, জেলেরা ইলিশ আহরণে ব্যস্ত সময় পার করছে কিন্তু দীর্ঘসময় জাল ফেলে ইলিশের আশায় নির্দিষ্ট সময় পরে জাল উঠালেও দেখা পাচ্ছে না কাঙ্খিত ইলিশের। কয়েকজন জেলের সাথে কথা বলে জানা যায়, গত কয়েকদিন ধরে এভাবেই জাল ফেলছেন জেলেরা কিন্তু তাদের জালে ধরা পড়ছে না কাঙ্খিত ইলিশ হতাশায় দিন কাটছে তাদের। এদিকে দু-একজন কাঙ্খিত মাছ না পেয়ে বলেন, পরিবার নিয়ে না খেয়ে থাকতে হয় তার উপরে আছে আবার এনজিওর কিস্তির চাপ। কিছু জেলেরা অবৈধভাবে মাছ ধরায় নদীতে এখন ইলিশ কমে গিয়েছে। তবে মৎস্য কর্তৃপক্ষ যদি সঠিক উদ্যোগ নেয় তাহলে আবার নদীতে মাছ পাওয়া সম্ভবনা রয়েছে।
পিরোজপুরের ইলিশের বাজার খ্যাত চড়খালী ফেরি ঘাটের দুই প্রান্তে বিকেল হলেই বসে ইলিশের বাজার। ভান্ডারিয়া, চরখালি, মঠাবারিয়ার স্থানীয়রা সহ খুলনা বরিশাল গামী যাত্রীরা ইলিশের বাজার দেখে লোভ সামলাতে না পেরে ক্রয় করে থাকেন ইলিশ। বর্তমানে পিরোজপুরে ইলিশ শূন্য হওয়ার কারণে এ বাজারেও দেখা মেলে না পর্যাপ্ত ইলিশের। ক্রেতারা ইলিশ কিনতে এসে প্রায়ই ফিরে যান শূন্য হাতে। এখানে কিছু ইলিশ পাওয়া গেলেও দাম আকাশচুম্বী। ১ থেকে দেড় কেজি ওজনের প্রতি কেজি ইলিশ বিক্রি হয় ২৬০০ টাকা থেকে শুরু করে ৩২০০ টাকা পর্যন্ত। ৫০০ গ্রাম থেকে এক কেজি পর্যন্ত ওজনের ইলিশ বিক্রি হয় ১৪০০ টাকা থেকে শুরু করে ২৪০০ টাকা পর্যন্ত। যা কিনা সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে। নদীতে পর্যাপ্ত ইলিশ না থাকায় এবং অতিরিক্ত দামের কারণে ইলিশের স্বাদ নিতে পারছে না এ জেলার মানুষেরা। সঠিকভাবে জাটকা সংরক্ষণ সহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা এবং ইলিশের অতিরিক্ত দাম নেয়ার কারণ খতিয়ে দেখার দাবি স্থানীয়দের।
স্থানীয়রা বলছে অবৈধ জাল এবং জাটকা মাছ ধরার কারণে ইলিশ শূণ্য হয়ে পড়েছে এ জেলার নদীগুলো। জেলা মৎস্য বিভাগ ইলিশ সংরক্ষণে যে পদক্ষেপ নিয়ে থাকে তা যথেষ্ট নয়। কয়েক বছর আগেও যে পরিমাণ মাছ জালে ধরা পড়তো এখন তার দেখা মিলে না। সারাদিন জাল ফেলেও দেখা মিলছে না ইলিশের। বাজারে কিছু ইলিশ পাওয়া গেলেও দাম সাধারণ মানুষের ক্রয়-ক্ষমতার বাইরে। শুধু দামের কারণেই এই জেলার অধিকাংশ মানুষ ইলিশের স্বাদ থেকে দূরে রয়েছে।
কালিগংগা নদীতে ইলিশ ধরতে আসা মাহতাব উদ্দিন বলেন, আগে আমরা অনেক মাছ পেতাম, কয়েক বছর হল আগের মত মাছ পাই না। মাছ না পাওয়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে বাধা জাল, চরগড়া, কারেন্ট জাল সহ বিভিন্ন অবৈধ জাল দিয়ে মাছ ধরার কারণে বর্তমানে ইলিশ মাছ পাওয়া যাচ্ছে না। সারাদিন জাল বেয়ে মাছ না পেয়ে বাড়ি ফিরতে হয়। প্রায়ই পরিবার নিয়ে না খেয়ে থাকতে হয়। এর উপরে আবার এনজিওর কিস্তি। ঘর ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া ছাড়া এখন কোন উপায় নেই। জাটকা সংরক্ষণে সরকার কঠিন পদক্ষেপ না নিলে এই নদীতে আর মাছ হবে না।
জেলে আব্দুল জলিল বলেন, বাধা জালে মাছ মেরে ফেলে, এ কারণেই আমরা ইলিশ পাই না। বর্তমানে ইলিশের ভরা মৌসুম কিন্তু জালে ইলিশ ধরা পড়ছে না। নদীতে এখন আর আগের মত ইলিশ নেই।
পিরোজপুর বেকুটিয়া ইলিশ বাজারে ইলিশ কিনতে এসেছেন ইয়াসমিন আক্তার তিনি বলেন, ভেবেছিলাম এবছর ভালো ইলিশ পাওয়া যাবে এবং দামটা নাগালের মধ্যেই থাকবে কিন্তু সেরকমটা হয়নি। একে তো ইলিশ বাজারে কম তার উপরে গতবছরের তুলনায় দাম অনেক বেশি। গত বছর যে মাছ ১০০০ টাকায় কিনেছি এবছর একই ওজনের মাছ কেজি প্রতি ৬ থেকে ৭০০ টাকা বেশি। যা সাধারণ মানুষের কয় ক্ষমতার বাইরে।
বেকুটিয়ার ইলিশ বাজারে মাছ কিনতে এসেছেন কন্টেন্ট ক্রিয়েটর হাসিফ। তিনি বলেন, বর্তমানে মাছের দাম অনেক বেশি। দুটি মাছ কিনেছি এক কেজি ৬০০ গ্রাম ওজন হয়েছে। দাম রেখেছে ২৭০০ টাকা। মাছের দাম বেশি মনে হচ্ছে।
ইলিশ বিক্রেতা সোহেল আকন বলেন, বর্তমানে যে পরিমাণ মাছ পাওয়ার কথা, সে পরিমাণে মাছ পাচ্ছে না জেলেরা। তাই মাছের দাম একটু বেশি। মধ্যবিত্ত এবং গরিব মানুষের ক্রয় ক্ষমতা মধ্যে মাছের দাম নেই। বাজারে মাছ কম এ কারণে দামটা একটু বেশি। কত বছর কেজির ওজনের মাছের দাম ছিল ১৬০০ টাকার মত কিন্তু এবছর দাম বেড়ে প্রায় ২৪০০ থেকে ২৫০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
ইলিশ বিক্রেতা আলামিন ইসলাম বলেন, ভরা মৌসুমেও জেলেরা ইলিশ পাচ্ছে না। যাও দু-একটি ওঠে আকারে ছোট। মাঝেমধ্যে কয়েকটি মাছ পাওয়া যায় তাও তো সামান্য। গতবছর এই সময়ে যে পরিমাণ মাছ দেখেছি এবছর তা দেখছি না। তাই দামটাও একটু বেশি।
জেলা মৎস্য কর্মকর্তা সঞ্জীব সন্নামত বলেন, পূর্বে পিরোজপুরের নদনদী গুলোতে নাব্রতা সংকট ছিল না, এ কারণে পর্যাপ্ত ইলিশের দেখা মিলতো। বর্তমানে নদীগুলোতে নাব্যতা সংকট ডুবোচর দেখা দিয়েছে।
ভোরের আকাশ/জাআ