এইচ এম ফরিদুল আলম শাহীন, কক্সবাজার
প্রকাশ : ২৯ এপ্রিল ২০২৫ ১২:২৮ পিএম
ভয়াল ২৯ এপ্রিল স্মরণ
আজ ২৯ এপ্রিল উপকূলের স্বজন হারানোর শোকাবহ বেদনাদায়ক দিন। ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল ছিল অন্ধকার ও বিভীষিকাময় এক রাত। দেশের চট্টগ্রাম, কক্সবাজারসহ দক্ষিণ-পূর্ব উপকূলীয় অঞ্চলে ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে লণ্ডভণ্ড হয়ে যায় সবকিছু। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের পর আর কোনো দিন এত মানুষের প্রাণহানি ও এত ব্যাপক ধ্বংস হয়নি। ওই রাতের ঘূর্ণিঝড় শুধু প্রকৃতির রূঢ় রূপ নয়, এটি ছিল মানবিক অব্যবস্থাপনা, দুর্বল অবকাঠামো, অসচেতনতা এবং তথ্য-যোগাযোগের ঘাটতির নির্মম প্রতিচ্ছবি।
এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে একটি নিম্নচাপ সৃষ্টি হয়, যা ধীরে ধীরে সুপার সাইক্লোনে রূপ নেয়। ২৯ এপ্রিল রাত ৮টা থেকে ১২টার মধ্যে এটি ‘ক্যাটাগরি-৫’ মাত্রার ঘূর্ণিঝড় হিসেবে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার উপকূলে আঘাত হানে। বাতাসের গতি ছিল ঘণ্টায় প্রায় ২৫০ কিলোমিটার, সাথে ১৫ থেকে ২০ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস। নিম্নাঞ্চল ও চরাঞ্চলগুলো সম্পূর্ণ ডুবে যায়, বহু মানুষ ঘরের ভেতরেই প্রাণ হারান। ঘূর্ণিঝড়টি প্রায় ৩০০ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে তাণ্ডব চালায় এবং কোটি মানুষের জীবনে গভীর ক্ষত সৃষ্টি করে।
ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা: সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, ভোলা, নোয়াখালী, পটুয়াখালী, বরগুনা ও লক্ষ্মীপুর জেলার উপকূলীয় নিম্নাঞ্চল, চরাঞ্চল ও দ্বীপসমূহ। কক্সবাজারের মহেশখালী ও কুতুবদিয়া দ্বীপ এলাকা ২০ ফুট জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হয়। চকরিয়া, পেকুয়ার বহু গ্রাম নিশ্চিহ্ন ও বহু মানুষ নিখোঁজ হয়। উপকূলের ১৯টি জেলা কমবেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। চরম মানবিক বিপর্যয় ও সামাজিক ধ্বংস নেমে আসে।
সরকারি হিসাবে মৃতের সংখ্যা প্রায় ১ লাখ ৩৮ হাজার হলেও বিভিন্ন সংস্থা ও সংবাদমাধ্যম এই সংখ্যা ২ লাখের কাছাকাছি বলে দাবি করে। বহু মানুষ নিখোঁজ ছিলেন এবং অনেক মৃতদেহ উদ্ধার করা যায়নি। প্রায় ১০ লক্ষ পরিবার গৃহহীন হয়। ১৫ লক্ষ একর ফসলি জমি ধ্বংস হয়। লক্ষাধিক গবাদিপশু মারা যায়। শত শত স্কুল, মসজিদ, ক্লিনিক ভেঙে পড়ে। বিশুদ্ধ পানির অভাবে কলেরা, ডায়রিয়া, টাইফয়েডসহ নানা রোগ ছড়িয়ে পড়ে। শিশুদের জন্য দুধ, ওষুধ ও খাবার অনুপলব্ধ ছিল।
সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনী, রেড ক্রিসেন্ট, এনজিও এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো যৌথভাবে উদ্ধার কার্যক্রম চালায়। দুর্গম এলাকায় হেলিকপ্টার ও নৌকা দিয়ে খাদ্য ও ওষুধ পাঠানো হয়। যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, সৌদি আরব, ইউএনডিপি, রেড ক্রসসহ অনেক দেশ বিপুল সহায়তা দেয়। তবে যেসব এলাকায় সড়ক যোগাযোগ ছিল না, সেখানে সহায়তা পৌঁছাতে দেরি হয়। বহু শিক্ষার্থী পড়াশোনা থেকে ছিটকে পড়ে। অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, মসজিদ-মন্দির ধ্বংস হয়। স্বাস্থ্যকেন্দ্র ও হাসপাতাল ধ্বংস হওয়ায় জরুরি চিকিৎসা পাওয়া যায়নি।
বহু মানুষ জীবনের প্রথম স্বাস্থ্যসেবা পায় আন্তর্জাতিক মেডিকেল ক্যাম্প থেকে। ধাপে ধাপে ঘরবাড়ি, রাস্তা, সেতু, স্কুল ও হাসপাতাল পুনঃনির্মাণ করা হয়। তবে এখনো প্রশ্ন রয়ে গেছে পরবর্তী ঘূর্ণিঝড়ের জন্য আমরা কতটা প্রস্তুত? এদিকে উপকূলের মানুষের প্রস্তাবনা- টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণ, ভূমিকম্প-ঘূর্ণিঝড় প্রতিরোধী আশ্রয়কেন্দ্র, ডিজিটাল সতর্কবার্তা নিশ্চিতকরণ, ম্যানগ্রোভ বন সুরক্ষা, জরুরি সাড়া দল গঠন, বিশুদ্ধ পানি ও স্বাস্থ্য সুরক্ষা, দুর্যোগ শিক্ষা ও মহড়া, বিকল্প জীবিকার ব্যবস্থা। শুধুমাত্র অবকাঠামো নয়, দরকার কার্যকর নীতি, সমন্বিত পরিকল্পনা ও জনগণের অংশগ্রহণ।
স্থানীয় প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি, স্বেচ্ছাসেবী ও গণমাধ্যমের দায়িত্ব বাড়াতে হবে।পরিবেশবাদীদের মতে, পরিবেশ ধ্বংসকারী উন্নয়ন প্রকল্প পরিহার করা জরুরি। ২৯ এপ্রিল ১৯৯১ শুধুই একটি তারিখ নয় এটি একটি জাতীয় ট্র্যাজেডি ও শিক্ষার দিন। আমরা গড়ব এমন বাংলাদেশ যেখানে উপকূল হবে নিরাপদ, মানুষ হবে সচেতন এবং প্রতিটি জীবন থাকবে সুরক্ষিত ও মর্যাদাপূর্ণ। শুধু তাই নয়, দূর্যোগ থেকে বাঁচতে বন্ধ করতে হবে পাহাড় কাটা, বন উজাড়, নদী ও খাল দখল। পরিবেশ রক্ষায় কঠোর আইন প্রয়োগ ও বাস্তবায়ন করতে হবে। বন্ধ নৌপথ সচল করতে হবে। দখল ও দূষণের শিকার নদী, খাল, বিল ও জলাধার পুনরুদ্ধার ও প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন করতে হবে।
ভোরের আকাশ/এসএইচ