পাহাড়ে সাতরঙা উৎসব

পাহাড়ে সাতরঙা উৎসব

ভোরের আকাশ প্রতিবেদক

প্রকাশ : ২ সপ্তাহ আগে

আপডেট : ২ সপ্তাহ আগে

পাহাড়ে সাতরঙা উৎসব

পাহাড়ে সাতরঙা উৎসব

নতুন বছরকে বরণ ও পুরোনো বছরকে বিদায় জানাতে প্রতিবছর ‘বৈসাবি’ উৎসব পালন করে থাকেন পাহাড়ে বসবাসরত ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠেী। শুক্রবার থেকে শুরু হয়েছে পাহাড়িদের প্রধান এ সামাজিক উৎসব। পার্বত্য চট্টগ্রামের আনাচে-কানাচে এরই মধ্যে বৈসাবি উৎসবের রং লেগেছে। বর্ণিল সাজে সেজেছে পাহাড়। ঘরে ঘরে আনন্দের ধ্বনি। বসেছে আনন্দ-উল্লাস আর নাচ-গানের আসর।

পুরনো বছরের বিদায় ও নতুন বছরের আগমনের উৎসব বৈসাবিকে ঘিরে নতুন সাজে সেজেছে পাহাড়ি জনপদ বান্দরবান। তঞ্চঙ্গ্যা সম্প্রদায়ের ঐতিহ্যবাহী ঘিলা খেলার মধ্য দিয়ে জেলায় জেলায় আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হবে এ উৎসব। পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে প্রতিবছরের ন্যায় এবারও রাজধানীতে বসবাসরত পাহাড়ি তরুণ-তরুণী, বৃদ্ধ, জায়া-জননীরা মিলেমিশে প্রাণের এ উৎসবে অংশ নিতে যাচ্ছে।  

শনিবার রাজধানীতে বৈসাবি শোভাযাত্রা অনুষ্ঠিত হবে। বেইলি রোডের পার্বত্য কমপ্লেক্স হতে রমনা পার্কের লেকে ফুল ভাসানোর মধ্য দিয়ে পাহাড়ি-বাঙালিরা মেতে উঠবে ‘বৈসাবি’ উৎসবে। চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা ও তঞ্চঙ্গ্যা তরুণ-তরুণীদের রং-বেরঙের সাজ আনন্দ বাড়িয়ে দেবে কয়েকগুণ। জনশ্রুতি রয়েছে, বৈসাবির শিকড় মূলত দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বৌদ্ধ সংস্কৃতির সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত। থাইল্যান্ড, মিয়ানমার, লাওস ও কম্বোডিয়া একই সময়ে নববর্ষ উদযাপিত হয়-যা ‘সংক্রান’ নামে পরিচিত।

ধারণা করা হয়, শত শত বছর আগে আরাকান ও বার্মা (বর্তমান মিয়ানমার) থেকে মারমা জনগোষ্ঠী পার্বত্য চট্টগ্রামে আসার সময় তাদের সাংগ্রাই উৎসব সঙ্গে নিয়ে আসে। একইভাবে চাকমা ও ত্রিপুরাদের নিজস্ব সংস্কৃতি ও উৎসবও ধীরে ধীরে একসঙ্গে মিলিত হয়ে ‘বৈসাবি’ নামকরণ হয়েছে।

চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরা বৃহত্তর মঙ্গোলয়েড জনগোষ্ঠীর অন্তর্গত। বৈশাখ মাসে তিব্বত থেকে শুরু করে বাংলাদেশ পর্যন্ত নতুন বছর শুরু হয়। পার্বত্য এলাকার জনগোষ্ঠীর সবাই নিজেদের নববর্ষ পালন করে থাকে এ সময়টিতে। বৈসাবি নামটি তিনটি জনগোষ্ঠীর উৎসবের আদ্যক্ষর নিয়ে তৈরি হয়েছে। চাকমাদের ‘বিঝু’, মারমাদের ‘সাংগ্রাই’ ও ত্রিপুরাদের ‘বৈসু’-এই তিন উৎসব সমন্বয়ে ‘বৈসাবি’। তবে শুধু বৈসাবি পাহাড়ের সব সম্প্রদায়ের নববর্ষ ও চৈত্র সংক্রান্তির অনুষ্ঠানের বহুমাত্রিকতাকে প্রকাশ করে না।

বর্ষবরণ ও বর্ষবিদায় উৎসবকে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর লোকজন ভিন্ন ভিন্ন নামে পালন করে। চাকমারা বিঝু, মারমারা সাংগ্রাই, ত্রিপুরারা বৈসু, তঞ্চঙ্গ্যারা বিসু হিসেবে পালন করে ‘বৈসাবি’ উৎসবকে। বছরের শেষ দুই দিন ও নতুন বছরের প্রথম দিন এই উৎসব পালন করা হয়। বিঝু চাকমা সম্প্রদায়ের অন্যতম প্রধান আনন্দ-উৎসব। বাংলা বছরের শেষ দুই দিন ও নববর্ষের দিন এই উৎসব পালন করা হয়। ১২ এপ্রিল পালন করা হয় ফুলবিঝু।

এদিন ভোরের আলো ফোটার আগেই ছেলেমেয়েরা বেরিয়ে পড়ে ফুল সংগ্রহের জন্য। সংগৃহীত ফুলের একভাগ দিয়ে বুদ্ধকে পূজা করা হয়, আর অন্যভাগ জলে ভাসিয়ে দেওয়া হয়। বাকি ফুলগুলো দিয়ে ঘরবাড়ি সাজানো হয়। চৈত্র মাসের শেষ দিন অর্থাৎ ১৩ এপ্রিল পালন করা হয় মূল বিঝু। এদিন সকালে বুদ্ধমূর্তি স্নান করিয়ে পূজা করা হয়। ছেলে-মেয়েরা তাদের বৃদ্ধ ঠাকুরদা-ঠাকুরমা এবং দাদু-দিদাকে স্নান করায় এবং আশীর্বাদ নেয়। এদিন ঘরে ঘরে পোলাও, পায়েস, পাচনসহ (বিভিন্ন রকমের সবজির মিশ্রণে তৈরি এক ধরনের তরকারি) অনেক সুস্বাদু খাবার রান্না করা হয়।

১৪ এপ্রিল বাংলা নববর্ষের প্রথম দিন পালন করা হয় গোজ্যেপোজ্যে দিন (অবসর বা বিশ্রাম নেয়ার সময়)। রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান পাহাড়ে বসবাসকারী জনপদগুলো এ দিনে মেতে ওঠে ভিন্ন এক আনন্দে। বড় কোনো গাছ থাকলে তার নিচে প্রদীপ জ্বালিয়ে তাকে সম্মান জানানো হয় এ দিনে। বিঝু উৎসব চলাকালে কোনো জীবিত প্রাণী হত্যা করা নিষেধ রয়েছে চাকমা সম্প্রদায়ের মধ্যে।

চৈত্র মাসের শেষ দুইদিন এবং বৈশাখ মাসের প্রথম দিন এই তিন দিনব্যাপী পালিত হয় ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের অন্যতম প্রধান উৎসব বৈসু। প্রথম দিনকে বলা হয় হারি বৈসু, দ্বিতীয় দিনকে বৈসুমা এবং তৃতীয় বা শেষ দিনটিকে বলা হয় বিসি কতাল। মূলত আগামী দিনের সুখ ও সমৃদ্ধির জন্য সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করা হয়ে থাকে এ দিনে। হারি বৈসুতে ভোরবেলায় গাছ থেকে ফুল তোলার হিড়িক পড়ে যায়। সেই ফুল দিয়ে বাড়িঘর সাজানো ও পবিত্র স্থানগুলোতে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়। বৈসাবি উৎসবের জনপ্রিয় খাবার ‘গণত্মক বা পাচন’ রান্না হবে প্রায় সব ত্রিপুরাদের ঘরে। ২৫ থেকে ৩০ ধরনের সবজির মিশ্রণে রান্না করা হয় এ বিশেষ সবজি।

এছাড়া পিঠা, সেমাই, মুড়ি-মুড়কি, চানাচুর, বিভিন্ন ধরনের ফল ও ঠাণ্ডা পানীয় তো থাকছেই। ত্রিপুরা ও মারমাদের পানি উৎসব প্রায় কমবেশি অনেকের কাছে জনপ্রিয়। এটি বৈসাবি উৎসবেরই একটি অংশ। এই উৎসবে সবাই পরস্পরের দিকে পানি ছুঁড়ে আনন্দ উল্লাসে মেতে ওঠেন, যেন গত বছরের সব দুঃখ, গ্লানি ও পাপ ধুয়ে যায়। এর আগে হয় জলপূজা। এর মাধ্যমে পরস্পরের বন্ধন আরো দৃঢ় হয়। মারমা সম্প্রদায়ের মধ্যে তাদের প্রিয় মানুষটির দিকে পানি ছিটানোর মাধ্যমে সবার সামনে ভালোবাসা প্রকাশ করা হয়। ভালোবাসার এমন বর্ণাঢ্য উচ্ছ্বাস ও অনুভূতি ‘গান্ধর্ব্য’ কেবল বৈসাবি উৎসবেই শোভা পায়।

বান্দরবানের তঞ্চঙ্গ্যা জনগোষ্ঠী তিন দিনব্যাপী ঐতিহ্যবাহী বিষু উৎসব পালন করে থাকে। এদিন সাংগু নদীতে কলাপাতায় ভক্তি ও শ্রদ্ধাভরে গঙ্গাদেবীর পূজা করে থাকেন তারা। ঘিলা খেলার মাধ্যমে তঞ্চঙ্গ্যা জনগোষ্ঠীর বিষু উৎসব শুরু হয়। সঙ্গে থাকে ২০ থেকে ৩০ পদের সবজি দিয়ে ঐতিহ্যবাহী পাচন রান্না আর ভোজন। বান্দরবানের মারমা সম্প্রদায় এবার চার দিনব্যাপী সাংগ্রাই উৎসবের আয়োজন করেছে।

উৎসবকে ঘিরে দুদিনব্যাপী পানিখেলা, পিঠা তৈরি, বলীখেলা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানসহ নানা আয়োজন চলবে। সাংগ্রাই উৎসবের মূল আকর্ষণ-মৈত্রী পানিবর্ষণ জলকেলি উৎসব অনুষ্ঠিত হবে। মারমা তরুণ-তরুণীরা মেতে উঠবে জলকেলি বা পানি ছিটানো খেলায়। এছাড়া দিনব্যাপী চলবে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। বৌদ্ধ বিহারসমূহে (ক্যায়াং) অনুষ্ঠিত হবে মঙ্গল প্রদীপ প্রজ্বালন। এই সময় হাজার হাজার প্রদীপ প্রজ্জ্বালনের মাধ্যমে পাহাড়ি নারী-পুরুষরা প্রার্থনায় দেশ ও জাতির মঙ্গল কামনা করবেন। অসমের জাতীয় উৎসব হলো বিহু। বিহু সমাজের সবাই এই উৎসব উদযাপন করে থাকে। এর মূল অংশ হলো কৃষি ভিত্তিক উৎসব। বি শব্দটির অর্থ প্রার্থনা এবং শু শব্দের অর্থ শান্তি ও সমৃদ্ধি। বিশু শব্দ থেকে বিবর্তনের ধারায় বিহু শব্দের উৎপত্তি। জনশ্রুতি আছে বিহু মূলত আসামের চুটিয়া উপজাতিদের মধ্যে প্রচলিত।

এক্ষেত্রে হু শব্দটি তারা দান অর্থে ব্যবহার করে থাকে। পার্বত্য চট্টগ্রামে অসম জাতি চৈত্র সংক্রান্তিতে বিহু উৎসব উদযাপন করে থাকে। বান্দরবানে ম্রো সম্প্রদায় চৈত্র সংক্রান্তিতে পালন করে চাংক্রান উৎসব। প্রতিবছর বর্ষবরণ উপলক্ষে ম্রো সম্প্রদায়ের পিঠা উৎসব, ঐতিহ্যবাহী খেলাধুলা ও তাদের তৈরি বিশাল আকারের বাঁশের প্লোং বাঁশি বাদ্যযন্ত্র উৎসবের আকর্ষণকে বহুমাত্রায় বাড়িয়ে দিয়েছে।এছাড়া উৎসব ঘিরে পানিখেলা, তৈলাক্ত বাঁশে বেয়ে ওঠা, লাঠি দিয়ে শক্তি প্রদর্শন প্রতিযোগিতা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন রয়েছে।

ভোরের আকাশ/এসএইচ

  • শেয়ার করুন-

সংশ্লিষ্ট

পাহাড়ে সাতরঙা উৎসব

পাহাড়ে সাতরঙা উৎসব

রুদ্ধ হতে পারে রাজনীতির পথ

রুদ্ধ হতে পারে রাজনীতির পথ

ধর্ষণের শাস্তি হোক মৃত্যুদণ্ড ও অঙ্গ কর্তন!

ধর্ষণের শাস্তি হোক মৃত্যুদণ্ড ও অঙ্গ কর্তন!

মন্তব্য করুন