সালেহ উদ্দিন আহমদ
প্রকাশ : ২৭ মার্চ ২০২৫ ০৫:২৫ পিএম
রুদ্ধ হতে পারে রাজনীতির পথ
দেখেশুনে মনে হচ্ছে বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটা অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এর ফলাফল এমন হতে পারে যে রাজনীতি পথ হারিয়েছে, অন্তত কিছুকালের জন্য হলেও এটা ঘটে যেতে পারে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান মুহাম্মদ ইউনূস বেশ কিছুদিন ধরেই বলছিলেন, ডিসেম্বরে নির্বাচন হবে। অবশ্য ২৫ মার্চ জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে ডিসেম্বরে স্থির থাকলেন না। বললেন, ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে নির্বাচন হবে। তবে সংসদ নাকি গণপরিষদ কোন নির্বাচন হবে তার বক্তব্যে সেটি খোলাসা হয়নি বলে মনে করছেন অনেকেই। সম্ভবত রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্যের ওপর তিনি সেটা ছেড়ে দেবেন। বর্তমানে সক্রিয় রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় দল বিএনপি বলছে, আগে জাতীয় সংসদ নির্বাচন করে গণতান্ত্রিকভাবে রাজনৈতিক সরকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। গণপরিষদ গঠন করার কোনো প্রয়োজন নেই বলে মনে করছে দলটি।
নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) বলছে, পাঁচটি সংস্কার কমিশনের সংবিধানসম্পর্কিত সংস্কারগুলো গণপরিষদে নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত জাতীয় সংসদ নির্বাচন মেনে নেবে না তারা। এই দলটি আগে চায় গণপরিষদ। সংসদ নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচনও তাদের দাবির একটি। জামায়াতে ইসলামী গণপরিষদ বনাম জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে এখন অবধি খুব স্পষ্ট মন্তব্য করেনি। জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেছেন, সরকারকে জাতীয় দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে তাড়াতাড়ি নির্বাচন দিতে হবে। কি ধরনের নির্বাচন চায় তারা সেটা খোলাসা করে বলেনি এই দলটি।
অন্যান্য দলগুলো কিছুটা টলোমলো, যারা বিএনপির ঘরানার, তারা বিএনপির সঙ্গেই সুর মিলিয়ে জাতীয় সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি জানিয়ে যাচ্ছে। জাতীয় সংসদ বা গণপরিষদ যে নির্বাচনই হোক না কেন, কারা এই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারবে, আরো সুক্ষ্মভাবে বলতে গেলে, কারা পারবে না, তা নিয়েও বিতর্ক চলছে। দুর্ভাগ্যবশত তর্ক-বিতর্কে সেনাবাহিনীকেও টেনে আনা হয়েছে। আর এই কাজটা করেছেন নবগঠিত রাজনৈতিক এনসিপির দুই নেতা হাসনাত আব্দুল্লাহ ও সারজিস আলম। এই দুই নেতা জুলাই অভ্যুত্থানের পর থেকে একের পর এক বিতর্কের জন্ম দিয়ে যাচ্ছেন। অথচ কোটাবিরোধী আন্দোলন শুরু হওয়ার কিছুকাল আগেও তারা ছিলেন ছাত্রলীগের নেতাকর্মী। সেনাপ্রধানের সঙ্গে বৈঠকের প্রসঙ্গ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশ করে হাসনাত যে বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন, সেখানে সারজিস আবার ভিন্নমত প্রকাশ করে বিতর্ককে উসকে দিয়েছেন। এই সব তর্ক-বিতর্কে ঘৃতাহুতি দিয়েছে পঞ্চগড়ে সারজিসের গাড়িবহর নিয়ে শোডাউনের ঘটনা। যে দল নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের কথা বলছে, সংস্কারে আনার প্রত্যয় ব্যক্ত করছে, সেই দলের নেতার এমন আচরণ খোদ দলের মধ্যেই বিতর্কের জন্ম দিয়েছে।
রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য এইসব সংস্কারের প্রস্তাব গ্রহণ বাধ্যতামূলক নয়। যেমন সংস্কারের ১৬৬টি সুপারিশের মধ্যে ১১৩টির সঙ্গে একমত হয়েছে এনসিপি। বাকিগুলো তারা বাতিল করে দিয়েছে। বিএনপি যে অস্থায়ী সরকারের অধীনে কোনো সংস্কারই চায় না, তা অনেকভাবে জানিয়ে দিয়েছে। তাদের নেতা তারেক রহমান আট দফা প্রস্তাব করেছেন, যেগুলো নীতিনির্ধারণীবিষয়ক সংস্কার শিল্প প্রতিষ্ঠান উন্নয়ন, স্বাস্থ্যসেবা উন্নয়ন, জিনিসপত্রের দাম কমানো ইত্যাদি। এখন কি হবে? আপনারা দেখেছেন, যখন রাস্তায় যানবাহন চলাচলের কোনো শৃঙ্খলা থাকে না, তখন গাড়িগুলো সোজাসুজি ডানে-বায়ে, আড়াআড়ি সবদিকে চলতে থাকে, যে যেদিকে যেতে চায়। অন্যদের অগ্রযাত্রা রুদ্ধ করে নিজেকে এগিয়ে নেওয়ার যে প্রবণতা সৃষ্টি হয়, তার কারণে সবারই এগুনো বন্ধ হয়ে যায়। এটাকে বলে ডেডলক বা অচলাবস্থাÑ মোদ্দা কথায় হ-য-ব-র-ল।
তখন ট্রাফিক পুলিশ আসে যানবাহন নিয়ন্ত্রণের জন্য। তারা একদিকের যানবাহনকে সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেয়, যেসব গাড়ি ইন্টারসেকশনে আড়াআড়ি আটকে রয়েছে তাদেরকে ক্লিয়ার করে, একদিকটা একটু হালকা হলে, অন্যদিকের গাড়িকে যেতে দেয়। এখন প্রশ্ন হলো কে হবেন আমাদের ট্রাফিক পুলিশ? আরো প্রশ্ন আছে, তিনি কোনদিকের ট্রাফিক আগে বন্ধ করবেন? আর তিনি চাইলেই কি বন্ধ করতে পারবেন? যারা সংস্কার নিয়ে কাগজ লিখেছেন, তারা কি এইসব সমাধানের পথ বাতলে দিয়েছেন? যখন সংস্কার গ্রহণ বাধ্যতামূলক নয়, তখন জাতীয় ঐকমত্য হবে কিভাবে? নির্বাচন নিয়েও প্রশ্ন আছে। যে নির্বাচনই হোক না কেন, একটা নির্বাচনি পরিবেশ লাগবে। যখন ছাত্র নেতারা হুমকি দেন ‘এটা হতে দেব না’, ‘এটা করতে পারবে না’, সেটা নির্বাচনি ভাষা হয় না। আপনি বলতে পারেন, আমাদের দলকে নির্বাচিত করুন, তাহলে আমরা ‘এটা’ হতে দেব না। কিন্তু অন্যরা নির্বাচিত হলে তাদেরকে ‘এটা’ করতে দেবেন না, সেটাতো গণতান্ত্রিক পদ্ধতি নয়।
ধরুন ইউনূস সরকার এনসিপির দাবি মেনে ‘গণপরিষদ’ নির্বাচন করল আগে। বিএনপি যে তা মানবে না, এটা অনুমান করার জন্য খুব বেশি দূরদৃষ্টির প্রয়োজন নেই। দলটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ওপর আস্থা হারাচ্ছে। নির্বাচনের সম্ভাব্য সময়সূচি নিয়ে প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্য ‘অস্পষ্ট’ মনে হচ্ছে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের কাছে। তিনি স্বাধীনতা দিবসের সকালে ঢাকার শেরেবাংলা নগরে প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের কবরে শ্রদ্ধা নিবেদনের পর সাংবাদিকদের সঙ্গে বলেছেন, ‘আমরা বার বার বলে আসছি যে স্পষ্ট রোডম্যাপ এবং দ্রুত নির্বাচন। তা না হলে যে সংকটগুলো সৃষ্টি হচ্ছে, এই সংকটগুলো কাটবে না।’
স্বাধীনতা দিবসের আগের দিন সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, ‘নির্বাচনের ব্যাপারে আমি আগেও বলেছি, আবারও বলছি, এ বছর ডিসেম্বর থেকে আগামী বছরের জুনের মধ্যে নির্বাচন হবে।’ এর প্রতিক্রিয়ায় বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘এটা অত্যন্ত অস্পষ্ট কথা। ডিসেম্বর থেকে জুন ছয় মাস। সুতরাং এটা কোনো রোড ম্যাপ দেওয়া হয়নি।’ বিএনপি ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য নির্বাচনের কথা বলছে নাÑ এমন মন্তব্য করে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘বিএনপি জাতির স্বার্থে, জাতিকে রক্ষা করার স্বার্থে, স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বকে রক্ষা করার স্বার্থেই নির্বাচনের কথা বলছে এবং নির্বাচিত সংসদ এবং সরকারের কথা বলছে।’
বিএনপি আবারও সংসদ নির্বাচনের কথা বলেছে। ধরা যাক, অন্তর্বর্তী সরকার বিএনপিকে বুঝিয়ে-শুনিয়ে এনসিপির দাবি অনুযায়ী সংসদের আগে গণপরিষদ নির্বাচন দিল। কিন্তু সেই নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে নির্বাচিত হয়ে আসার কোনো আলামত এনসিপির কর্মকাণ্ডে প্রতীয়মান হচ্ছে না। যদি তা-ই হয় সংস্কারের কী হবে? দল গঠনের আগে যতটা জনসমনর্থন পেয়েছিল, প্রতিষ্ঠার মাসখানেকের মধ্যে এনসিপি নামের নতুন দলটি তা-ও হারাতে বসেছে বলে মনে হচ্ছে। গণপরিষদে নির্বাচন আগে হলে এবং সেই নির্বাচনে যারা বিজয়ী হয়ে আসল, তারা যদি সংস্কার কমিশনগুলোর কোনো সংস্কার প্রস্তাবের সঙ্গেই একমত না হয়, তখন কি হবে? তারা বর্তমান শাসনতন্ত্রে ভালো কিছু কিছু পরিবর্তন করে গণপরিষদ ভেঙে দিতে পারে। আপনার-আমার বলার কিছুই বলার থাকবে না তখন, কারণ তাদেরকে নির্বাচিত করা হয়েছে জনগণের ভোটে, তারা আমাদের প্রতিনিধি, আমাদের ‘চাওয়া’ আমরা তাদের কাছে ভোট দিয়ে হস্তান্তর করেছি। সুতরাং যেই কপাল সেই মাথা। সংবিধানবিশেষজ্ঞ ড. কামাল হোসেন যা বলেছিলেন আগে ‘বিদ্যমান সংবিধানেই কাক্সিক্ষত পরিবর্তন করা যেতে পারে।’
আবার গণপরিষদ নির্বাচনের সময়ও ঝামেলা হতে পারে। যেসব প্রার্থী তার নির্বাচনি প্রচারে বলবেন, না সংস্কার কমিশনের সংস্কারে আমি একমত নই, তাদের উপর কি ‘মব’ হামলা হবে? তাহলে গণতান্ত্রিক নির্বাচন কিভাবে হবে? এইবার অন্যদিকটাও ভাবুন, ধরুন, ইউনূস সরকার জাতীয় সংসদ নির্বাচন দিলেন ডিসেম্বরে। একটা দল দুই তৃতীয়াংশ আসন পেল, সরকার গঠন করল। তারা এসে বলল, আমরাতো সংস্কার মানিনি। সুতরাং একই লোক ১০বার প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হতে দোষ কি? যেহেতু তাদের দুই তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা, এই ১০বার ক্ষমতায় থাকতে তারা হয়তো সবরকম চেষ্টা করবেন।
আমার আশঙ্কাগুলো হয়তো একটু বেশি বেশি মনে হবে, কিন্তু অমূলক বা অতিরঞ্জিত নয়। তবে রাজনীতিবিদরাও অনেক সময়ও যুক্তিসঙ্গত আচরণ করেন। এমনও হতে পারে রাজনীতিকরা সবাই বসে কিছু ব্যাপারে একমত হবেন। যেমন, কতগুলো সংস্কার সুস্থ নির্বাচনের জন্য অত্যন্ত জরুরি। নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন, স্বাধীন বিচার ব্যবস্থা, নির্বাচন কমিশনকে সরকারের কর্তৃত্ব থেকে দূরে রাখা, একজন দুইবারের বেশি প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না এইসব বিষয়গুলোকে অধ্যাদেশের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করার বিষয়ে সবাই একমত হতে পারেন। আরো একমত হতে পারেন, যেই ক্ষমতায় আসবে, এগুলোকে সংবিধানে সংযোজন করবে। এইরকম কিছু ন্যূনতম সংস্কার গ্রহণ করে নির্বাচন হতে পারে ঐকমত্যের ভিত্তিতে। তাহলে এই নতুন সংস্কারগুলো মেনে সুন্দর একটা গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হতে পারে।
সংস্কার নিয়ে এনসিপির আকাক্সক্ষাকে প্রশ্নবিদ্ধ না করেও এই মন্তব্য করা যায় যে তারা এখনও কোনো জাতীয় নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত নয়। তাদের ঘর গোছাতে এবং দল গোছাতে আরো সময় লাগবে। সুতরাং এখন যেকোনো নির্বাচন তাদের জন্য খুব সুফল আনবে না। ইউনূস সরকার ক্ষমতায় থাকলে তারা বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবে, তারা মুখে না বললেও তারাই যে কিংস পার্টি, এটা তাদের চেয়ে বেশি তো অন্য কারোর জানা নেই। এখনই থামতে না জানলে রাজনীতি কিছুকালের জন্য হলেও পথ রুদ্ধ হতে পারে। অবশ্য এনসিপির প্রধান নাহিদ ইসলামের একটা মন্তব্য খুবই প্রশংসার দাবি রাখে। মার্চের প্রথম সসপ্তাহে এএফপিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, ‘আশা করি আমরা এই নির্বাচনে জিতব, কিন্তু এটাই শেষ নির্বাচন নয়।’ নাহিদ আরো বলেছেন, ‘আগামী নির্বাচনের আমাদের দল সরকার গঠন করতে না পারলেও, আমরা এমন একটি রাজনৈতিক শক্তি তৈরি করছি, যা আগামী কয়েক দশক রাজনীতিতে সরব থাকবে।’ নাহিদের বক্তব্যের সারমর্ম কিন্তু জয়-পরাজয় যাই হোক এনসিপি তাদের রাজনীতি করে যাবে। আমাদের রাজনীতিতে কেউ এই কথা বুঝেনি যে ‘এটাই শেষ নির্বাচন নয়’। সবাই সবসময় বর্তমান নির্বাচনকেই শেষ নির্বাচন ভেবে যে করেই হোক ক্ষমতায় যেতে চেয়েছে। আশা করি, নাহিদ তার এই বিশ্বাসটা তার দলের সবার কাছে গ্রহণযোগ্য করে তুলবেন। তাদেরকে বিশ্বাস করতে হবে, এটাই শেষ নির্বাচন নয়। কোনো একটা নির্বাচনে তাদের বড় পরিসরের সংস্কারগুলোকে জনগণ ভোট দেবে এবং তাদেরকে ক্ষমতায় বসাবে, ততদিন তারা দলের জন্য শান্তিপূর্ণভাবে কাজ করে যাবেন। এটাই তাদেরকে সফলতা এনে দিতে পারে।
এবার যারা ক্ষমতায় যাবেন তাদেরকে বুঝতে হবে, ক্ষমতায় গিয়ে যেন ভবিষ্যতে অন্যদের ক্ষমতায় আসার পথ রুদ্ধ করার কারণ না হন। শেখ হাসিনা ১৫ বছর ধরে সেই চেষ্টাই করেছেন, সফল হননি। যদি কোনোভাবে অন্যদের পথ রুদ্ধ করা হয়, ভবিষ্যতের নাহিদরা আবার বিদ্রোহ করবে। এই উপলব্ধিটা আমাদের রাজনীতিবিদদের জন্য একান্ত জরুরি।
লেখক : রাজনীতি বিশ্লেষক।
ভোরের আকাশ/মি
সালেহ উদ্দিন আহমদ
প্রকাশ : ৪ দিন আগে
আপডেট : ৪ দিন আগে
রুদ্ধ হতে পারে রাজনীতির পথ
দেখেশুনে মনে হচ্ছে বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটা অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এর ফলাফল এমন হতে পারে যে রাজনীতি পথ হারিয়েছে, অন্তত কিছুকালের জন্য হলেও এটা ঘটে যেতে পারে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান মুহাম্মদ ইউনূস বেশ কিছুদিন ধরেই বলছিলেন, ডিসেম্বরে নির্বাচন হবে। অবশ্য ২৫ মার্চ জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে ডিসেম্বরে স্থির থাকলেন না। বললেন, ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে নির্বাচন হবে। তবে সংসদ নাকি গণপরিষদ কোন নির্বাচন হবে তার বক্তব্যে সেটি খোলাসা হয়নি বলে মনে করছেন অনেকেই। সম্ভবত রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্যের ওপর তিনি সেটা ছেড়ে দেবেন। বর্তমানে সক্রিয় রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় দল বিএনপি বলছে, আগে জাতীয় সংসদ নির্বাচন করে গণতান্ত্রিকভাবে রাজনৈতিক সরকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। গণপরিষদ গঠন করার কোনো প্রয়োজন নেই বলে মনে করছে দলটি।
নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) বলছে, পাঁচটি সংস্কার কমিশনের সংবিধানসম্পর্কিত সংস্কারগুলো গণপরিষদে নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত জাতীয় সংসদ নির্বাচন মেনে নেবে না তারা। এই দলটি আগে চায় গণপরিষদ। সংসদ নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচনও তাদের দাবির একটি। জামায়াতে ইসলামী গণপরিষদ বনাম জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে এখন অবধি খুব স্পষ্ট মন্তব্য করেনি। জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেছেন, সরকারকে জাতীয় দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে তাড়াতাড়ি নির্বাচন দিতে হবে। কি ধরনের নির্বাচন চায় তারা সেটা খোলাসা করে বলেনি এই দলটি।
অন্যান্য দলগুলো কিছুটা টলোমলো, যারা বিএনপির ঘরানার, তারা বিএনপির সঙ্গেই সুর মিলিয়ে জাতীয় সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি জানিয়ে যাচ্ছে। জাতীয় সংসদ বা গণপরিষদ যে নির্বাচনই হোক না কেন, কারা এই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারবে, আরো সুক্ষ্মভাবে বলতে গেলে, কারা পারবে না, তা নিয়েও বিতর্ক চলছে। দুর্ভাগ্যবশত তর্ক-বিতর্কে সেনাবাহিনীকেও টেনে আনা হয়েছে। আর এই কাজটা করেছেন নবগঠিত রাজনৈতিক এনসিপির দুই নেতা হাসনাত আব্দুল্লাহ ও সারজিস আলম। এই দুই নেতা জুলাই অভ্যুত্থানের পর থেকে একের পর এক বিতর্কের জন্ম দিয়ে যাচ্ছেন। অথচ কোটাবিরোধী আন্দোলন শুরু হওয়ার কিছুকাল আগেও তারা ছিলেন ছাত্রলীগের নেতাকর্মী। সেনাপ্রধানের সঙ্গে বৈঠকের প্রসঙ্গ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশ করে হাসনাত যে বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন, সেখানে সারজিস আবার ভিন্নমত প্রকাশ করে বিতর্ককে উসকে দিয়েছেন। এই সব তর্ক-বিতর্কে ঘৃতাহুতি দিয়েছে পঞ্চগড়ে সারজিসের গাড়িবহর নিয়ে শোডাউনের ঘটনা। যে দল নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের কথা বলছে, সংস্কারে আনার প্রত্যয় ব্যক্ত করছে, সেই দলের নেতার এমন আচরণ খোদ দলের মধ্যেই বিতর্কের জন্ম দিয়েছে।
রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য এইসব সংস্কারের প্রস্তাব গ্রহণ বাধ্যতামূলক নয়। যেমন সংস্কারের ১৬৬টি সুপারিশের মধ্যে ১১৩টির সঙ্গে একমত হয়েছে এনসিপি। বাকিগুলো তারা বাতিল করে দিয়েছে। বিএনপি যে অস্থায়ী সরকারের অধীনে কোনো সংস্কারই চায় না, তা অনেকভাবে জানিয়ে দিয়েছে। তাদের নেতা তারেক রহমান আট দফা প্রস্তাব করেছেন, যেগুলো নীতিনির্ধারণীবিষয়ক সংস্কার শিল্প প্রতিষ্ঠান উন্নয়ন, স্বাস্থ্যসেবা উন্নয়ন, জিনিসপত্রের দাম কমানো ইত্যাদি। এখন কি হবে? আপনারা দেখেছেন, যখন রাস্তায় যানবাহন চলাচলের কোনো শৃঙ্খলা থাকে না, তখন গাড়িগুলো সোজাসুজি ডানে-বায়ে, আড়াআড়ি সবদিকে চলতে থাকে, যে যেদিকে যেতে চায়। অন্যদের অগ্রযাত্রা রুদ্ধ করে নিজেকে এগিয়ে নেওয়ার যে প্রবণতা সৃষ্টি হয়, তার কারণে সবারই এগুনো বন্ধ হয়ে যায়। এটাকে বলে ডেডলক বা অচলাবস্থাÑ মোদ্দা কথায় হ-য-ব-র-ল।
তখন ট্রাফিক পুলিশ আসে যানবাহন নিয়ন্ত্রণের জন্য। তারা একদিকের যানবাহনকে সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেয়, যেসব গাড়ি ইন্টারসেকশনে আড়াআড়ি আটকে রয়েছে তাদেরকে ক্লিয়ার করে, একদিকটা একটু হালকা হলে, অন্যদিকের গাড়িকে যেতে দেয়। এখন প্রশ্ন হলো কে হবেন আমাদের ট্রাফিক পুলিশ? আরো প্রশ্ন আছে, তিনি কোনদিকের ট্রাফিক আগে বন্ধ করবেন? আর তিনি চাইলেই কি বন্ধ করতে পারবেন? যারা সংস্কার নিয়ে কাগজ লিখেছেন, তারা কি এইসব সমাধানের পথ বাতলে দিয়েছেন? যখন সংস্কার গ্রহণ বাধ্যতামূলক নয়, তখন জাতীয় ঐকমত্য হবে কিভাবে? নির্বাচন নিয়েও প্রশ্ন আছে। যে নির্বাচনই হোক না কেন, একটা নির্বাচনি পরিবেশ লাগবে। যখন ছাত্র নেতারা হুমকি দেন ‘এটা হতে দেব না’, ‘এটা করতে পারবে না’, সেটা নির্বাচনি ভাষা হয় না। আপনি বলতে পারেন, আমাদের দলকে নির্বাচিত করুন, তাহলে আমরা ‘এটা’ হতে দেব না। কিন্তু অন্যরা নির্বাচিত হলে তাদেরকে ‘এটা’ করতে দেবেন না, সেটাতো গণতান্ত্রিক পদ্ধতি নয়।
ধরুন ইউনূস সরকার এনসিপির দাবি মেনে ‘গণপরিষদ’ নির্বাচন করল আগে। বিএনপি যে তা মানবে না, এটা অনুমান করার জন্য খুব বেশি দূরদৃষ্টির প্রয়োজন নেই। দলটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ওপর আস্থা হারাচ্ছে। নির্বাচনের সম্ভাব্য সময়সূচি নিয়ে প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্য ‘অস্পষ্ট’ মনে হচ্ছে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের কাছে। তিনি স্বাধীনতা দিবসের সকালে ঢাকার শেরেবাংলা নগরে প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের কবরে শ্রদ্ধা নিবেদনের পর সাংবাদিকদের সঙ্গে বলেছেন, ‘আমরা বার বার বলে আসছি যে স্পষ্ট রোডম্যাপ এবং দ্রুত নির্বাচন। তা না হলে যে সংকটগুলো সৃষ্টি হচ্ছে, এই সংকটগুলো কাটবে না।’
স্বাধীনতা দিবসের আগের দিন সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, ‘নির্বাচনের ব্যাপারে আমি আগেও বলেছি, আবারও বলছি, এ বছর ডিসেম্বর থেকে আগামী বছরের জুনের মধ্যে নির্বাচন হবে।’ এর প্রতিক্রিয়ায় বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘এটা অত্যন্ত অস্পষ্ট কথা। ডিসেম্বর থেকে জুন ছয় মাস। সুতরাং এটা কোনো রোড ম্যাপ দেওয়া হয়নি।’ বিএনপি ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য নির্বাচনের কথা বলছে নাÑ এমন মন্তব্য করে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘বিএনপি জাতির স্বার্থে, জাতিকে রক্ষা করার স্বার্থে, স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বকে রক্ষা করার স্বার্থেই নির্বাচনের কথা বলছে এবং নির্বাচিত সংসদ এবং সরকারের কথা বলছে।’
বিএনপি আবারও সংসদ নির্বাচনের কথা বলেছে। ধরা যাক, অন্তর্বর্তী সরকার বিএনপিকে বুঝিয়ে-শুনিয়ে এনসিপির দাবি অনুযায়ী সংসদের আগে গণপরিষদ নির্বাচন দিল। কিন্তু সেই নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে নির্বাচিত হয়ে আসার কোনো আলামত এনসিপির কর্মকাণ্ডে প্রতীয়মান হচ্ছে না। যদি তা-ই হয় সংস্কারের কী হবে? দল গঠনের আগে যতটা জনসমনর্থন পেয়েছিল, প্রতিষ্ঠার মাসখানেকের মধ্যে এনসিপি নামের নতুন দলটি তা-ও হারাতে বসেছে বলে মনে হচ্ছে। গণপরিষদে নির্বাচন আগে হলে এবং সেই নির্বাচনে যারা বিজয়ী হয়ে আসল, তারা যদি সংস্কার কমিশনগুলোর কোনো সংস্কার প্রস্তাবের সঙ্গেই একমত না হয়, তখন কি হবে? তারা বর্তমান শাসনতন্ত্রে ভালো কিছু কিছু পরিবর্তন করে গণপরিষদ ভেঙে দিতে পারে। আপনার-আমার বলার কিছুই বলার থাকবে না তখন, কারণ তাদেরকে নির্বাচিত করা হয়েছে জনগণের ভোটে, তারা আমাদের প্রতিনিধি, আমাদের ‘চাওয়া’ আমরা তাদের কাছে ভোট দিয়ে হস্তান্তর করেছি। সুতরাং যেই কপাল সেই মাথা। সংবিধানবিশেষজ্ঞ ড. কামাল হোসেন যা বলেছিলেন আগে ‘বিদ্যমান সংবিধানেই কাক্সিক্ষত পরিবর্তন করা যেতে পারে।’
আবার গণপরিষদ নির্বাচনের সময়ও ঝামেলা হতে পারে। যেসব প্রার্থী তার নির্বাচনি প্রচারে বলবেন, না সংস্কার কমিশনের সংস্কারে আমি একমত নই, তাদের উপর কি ‘মব’ হামলা হবে? তাহলে গণতান্ত্রিক নির্বাচন কিভাবে হবে? এইবার অন্যদিকটাও ভাবুন, ধরুন, ইউনূস সরকার জাতীয় সংসদ নির্বাচন দিলেন ডিসেম্বরে। একটা দল দুই তৃতীয়াংশ আসন পেল, সরকার গঠন করল। তারা এসে বলল, আমরাতো সংস্কার মানিনি। সুতরাং একই লোক ১০বার প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হতে দোষ কি? যেহেতু তাদের দুই তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা, এই ১০বার ক্ষমতায় থাকতে তারা হয়তো সবরকম চেষ্টা করবেন।
আমার আশঙ্কাগুলো হয়তো একটু বেশি বেশি মনে হবে, কিন্তু অমূলক বা অতিরঞ্জিত নয়। তবে রাজনীতিবিদরাও অনেক সময়ও যুক্তিসঙ্গত আচরণ করেন। এমনও হতে পারে রাজনীতিকরা সবাই বসে কিছু ব্যাপারে একমত হবেন। যেমন, কতগুলো সংস্কার সুস্থ নির্বাচনের জন্য অত্যন্ত জরুরি। নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন, স্বাধীন বিচার ব্যবস্থা, নির্বাচন কমিশনকে সরকারের কর্তৃত্ব থেকে দূরে রাখা, একজন দুইবারের বেশি প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না এইসব বিষয়গুলোকে অধ্যাদেশের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করার বিষয়ে সবাই একমত হতে পারেন। আরো একমত হতে পারেন, যেই ক্ষমতায় আসবে, এগুলোকে সংবিধানে সংযোজন করবে। এইরকম কিছু ন্যূনতম সংস্কার গ্রহণ করে নির্বাচন হতে পারে ঐকমত্যের ভিত্তিতে। তাহলে এই নতুন সংস্কারগুলো মেনে সুন্দর একটা গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হতে পারে।
সংস্কার নিয়ে এনসিপির আকাক্সক্ষাকে প্রশ্নবিদ্ধ না করেও এই মন্তব্য করা যায় যে তারা এখনও কোনো জাতীয় নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত নয়। তাদের ঘর গোছাতে এবং দল গোছাতে আরো সময় লাগবে। সুতরাং এখন যেকোনো নির্বাচন তাদের জন্য খুব সুফল আনবে না। ইউনূস সরকার ক্ষমতায় থাকলে তারা বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবে, তারা মুখে না বললেও তারাই যে কিংস পার্টি, এটা তাদের চেয়ে বেশি তো অন্য কারোর জানা নেই। এখনই থামতে না জানলে রাজনীতি কিছুকালের জন্য হলেও পথ রুদ্ধ হতে পারে। অবশ্য এনসিপির প্রধান নাহিদ ইসলামের একটা মন্তব্য খুবই প্রশংসার দাবি রাখে। মার্চের প্রথম সসপ্তাহে এএফপিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, ‘আশা করি আমরা এই নির্বাচনে জিতব, কিন্তু এটাই শেষ নির্বাচন নয়।’ নাহিদ আরো বলেছেন, ‘আগামী নির্বাচনের আমাদের দল সরকার গঠন করতে না পারলেও, আমরা এমন একটি রাজনৈতিক শক্তি তৈরি করছি, যা আগামী কয়েক দশক রাজনীতিতে সরব থাকবে।’ নাহিদের বক্তব্যের সারমর্ম কিন্তু জয়-পরাজয় যাই হোক এনসিপি তাদের রাজনীতি করে যাবে। আমাদের রাজনীতিতে কেউ এই কথা বুঝেনি যে ‘এটাই শেষ নির্বাচন নয়’। সবাই সবসময় বর্তমান নির্বাচনকেই শেষ নির্বাচন ভেবে যে করেই হোক ক্ষমতায় যেতে চেয়েছে। আশা করি, নাহিদ তার এই বিশ্বাসটা তার দলের সবার কাছে গ্রহণযোগ্য করে তুলবেন। তাদেরকে বিশ্বাস করতে হবে, এটাই শেষ নির্বাচন নয়। কোনো একটা নির্বাচনে তাদের বড় পরিসরের সংস্কারগুলোকে জনগণ ভোট দেবে এবং তাদেরকে ক্ষমতায় বসাবে, ততদিন তারা দলের জন্য শান্তিপূর্ণভাবে কাজ করে যাবেন। এটাই তাদেরকে সফলতা এনে দিতে পারে।
এবার যারা ক্ষমতায় যাবেন তাদেরকে বুঝতে হবে, ক্ষমতায় গিয়ে যেন ভবিষ্যতে অন্যদের ক্ষমতায় আসার পথ রুদ্ধ করার কারণ না হন। শেখ হাসিনা ১৫ বছর ধরে সেই চেষ্টাই করেছেন, সফল হননি। যদি কোনোভাবে অন্যদের পথ রুদ্ধ করা হয়, ভবিষ্যতের নাহিদরা আবার বিদ্রোহ করবে। এই উপলব্ধিটা আমাদের রাজনীতিবিদদের জন্য একান্ত জরুরি।
লেখক : রাজনীতি বিশ্লেষক।
ভোরের আকাশ/মি