বিশ্ব উচ্চ রক্তচাপ দিবস
নিখিল মানখিন
প্রকাশ : ১৭ মে ২০২৫ ০১:১৩ পিএম
নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হচ্ছে ৮৫ শতাংশ রোগী
দুইবার ‘মাইল স্ট্রোক’ এর শিকার হয়েছেন ময়মনসিংহের ধোবাউড়া উপজেলার বণিক্যপাড়া গ্রামের বাসিন্দা যাকোব মান্দিক (৬৫)। তিনি দীর্ঘদিন ধরে উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন। তার পক্ষে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী জীবনযাপন এবং চিকিৎসাসেবা গ্রহণ সম্ভব হয়ে ওঠে না। স্ট্রোকের শিকার হওয়ার আগে উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত হওয়ার বিষয়টি জানতে পারেননি তিনি। এভাবে দেশের হাজার হাজার মানুষ অজান্তেই উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা বলছেন, জানার আগেই উচ্চ রক্তচাপ এমন পরিবেশ তৈরি করে, যেখানে হৃদরোগ, হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক, কিডনির ক্ষতিসহ বিভিন্ন জটিল অসংক্রামক রোগ বাসা বাঁধে। আর অনেক রোগীকে মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যায়।
রাজধানীর মগবাজার এলাকার ইনসাফ বারাকাহ হাসপাতালের বিপরীত পার্শ্বে ফুটপাতে চা বিক্রি করেন মো. ইয়াসিন ও তার স্ত্রী ফাতেমা বেগম। স্বামীকে না জানিয়ে বিদেশে যাওয়ার জন্য এক রিক্রুটিং এজেন্সিকে কয়েক লাখ দিয়েছেন ফাতেমা বেগম। বিষয়টি জানার পর টেনশনে অস্থির মো. ইয়াসিন।
ফাতেমা বেগম ভোরের আকাশকে জানান, তার স্বামী উচ্চ রক্তচাপের রোগী। আর বিষয়টি জানার পর দুই সপ্তাহ আগে অসুস্থ হয়ে পড়েন। হাসপাতালে মেডিকেল পরীক্ষা করানোর পর হার্ট অ্যাটাক হওয়ার কথা তারা জানতে পারেন। রাগে অস্থির হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার স্বামীর শরীর কাঁপতে থাকে বলে জানান ফাতেমা বেগম।
ঘাড় ব্যথা ও বমি বমি ভাব হওয়ার কারণ বুঝতে পারেননি একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের অটো রিকশাচালক মো. আবুল কাশেম। গত বৃহস্পতিবার রাজধানীর জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের জরুরি বিভাগে পরীক্ষা করানোর পর বিষয়টি ধরা পড়ে। রোগীর সঙ্গে আছেন বড় ভাই জলিল মিয়া।
তিনি ভোরের আকাশকে জানান, ঘাড় ব্যথা ও বমি বমি ভাব হওয়ার পর বিছানায় হেলে পড়েন তার ছোট ভাই আবুল কাশেম। গরমের কারণে এমনটি হতে পারে বলে তারা প্রথমে ধারণা করেন। কিন্তু শরীর নিস্তেজ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হলে রোগীকে হাসপাতালে নিয়ে আসেন। চিকিৎসকের কথা অনুযায়ী উচ্চ রক্তচাপের কারণেই রোগীর এমন অবস্থা হয়ে বলে জানান মো. জলিল মিয়া।
এভাবে বাংলাদেশে নীরব ঘাতক হয়ে উঠেছে উচ্চ রক্তচাপ। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের ভাষ্য এবং বিভিন্ন গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশে উচ্চ রক্তচাপ আক্রান্তদের মধ্যে ৩৮ শতাংশ রোগী চিকিৎসাসেবা নিয়ে থাকে। নিয়মিত ওষুধ সেবনের মাধ্যমে রোগটি নিয়ন্ত্রণে রাখতে পেরেছে মাত্র ১৫ শতাংশ অর্থাৎ প্রতি ৭ জনে ১ জন। বাকি ৮৫ শতাংশ রোগী উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হচ্ছে। উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সরকার বেশকিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করলেও দেশব্যাপী নিরবচ্ছিন্ন ওষুধ সরবরাহের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে না।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কেবল উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমেই অসংক্রামক রোগজনিত অকালমৃত্যু অনেকটা কমিয়ে আনা সম্ভব। আসন্ন ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে এ খাতে প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ প্রদানের পরামর্শ দিয়েছেন তারা।
চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা বলেন, হৃৎপিণ্ডের ধমনিতে রক্তপ্রবাহের চাপ অনেক বেশি থাকলে সেটিকে উচ্চ রক্তচাপ বা হাই ব্লাডপ্রেশার হিসাবে চিহ্নিত করা হয়। দুটি মানের মাধ্যমে এই রক্তচাপ রেকর্ড করা হয়। যেটার সংখ্যা বেশি সেটাকে বলা হয় সিস্টোলিক প্রেশার; আর যেটার সংখ্যা কম, সেটা ডায়াস্টলিক প্রেশার। প্রতিটি হৃদস্পন্দন, অর্থাৎ হৃৎপিণ্ডের সংকোচন ও সম্প্রসারণের সময় একবার সিস্টোলিক প্রেশার এবং একবার ডায়াস্টলিক প্রেশার হয়। একজন প্রাপ্তবয়স্ক সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের রক্তচাপ থাকে ১২০-৮০ মিলিমিটার মার্কারি। কারও ব্লাডপ্রেশার রিডিং যদি ১৪০-৯০ বা এর চেয়েও বেশি হয়, তখন বুঝতে হবে তার উচ্চ রক্তচাপের সমস্যা আছে। অন্যদিকে রক্তচাপ যদি ৯০-৬০ বা এর আশপাশে থাকে, তাহলে তাকে লো ব্লাড প্রেশার হিসাবে ধরা হয়। যদিও বয়স-নির্বিশেষে রক্তচাপ খানিকটা বেশি বা কম হতে পারে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও’র-২০২৩ প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্তদের (৩০-৭৯ বছর বয়সী) অর্ধেকই (৫৫ শতাংশ পুরুষ, ৪৬ শতাংশ নারী) জানে না যে তাদের উচ্চ রক্তচাপ রয়েছে।
গ্লোবাল হেলথ অ্যাডভোকেসি ইনকিউবেটর (জিএইচএআই)-এর গবেষণা প্রতিবেদন জানানো হয়, বাংলাদেশে প্রতি চারজন প্রাপ্তবয়স্কের মধ্যে একজন উচ্চ রক্তচাপে ভুগছে। হৃদরোগ, স্ট্রোক, ক্যানসার, কিডনি রোগ, শ্বাসতন্ত্রের রোগ ও ডায়াবেটিসসহ বিভিন্ন অসংক্রামক রোগের অন্যতম প্রধান ঝুঁকি উচ্চ রক্তচাপ। ডব্লিউএইচও’র গ্লোবাল রিপোর্ট অন হাইপারটেনশন-২০২৩ (সর্বশেষ) এর তথ্য অনুযায়ী ২০১৯ সালে বাংলাদেশে ২ লাখ ৭৩ হাজার মানুষ হৃদরোগজনিত অসুস্থতায় মৃত্যুবরণ করেছে, যার ৫৪ শতাংশের জন্য দায়ী উচ্চ রক্তচাপ।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন অনুষদের সাবেক ডিন অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ ভোরের আকাশকে বলেন, উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে অসংক্রামক রোগের প্রকোপ অনেকটাই কমানো সম্ভব। সরকার ইতোমধ্যে কমিউনিটি ক্লিনিকের মাধ্যমে উচ্চ রক্তচাপের ওষুধ প্রদানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে, যা অত্যন্ত প্রশংসনীয়। তবে ওষুধ সরবরাহ নিরবচ্ছিন্ন রাখতে এ খাতে পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ নিশ্চিত করতে হবে।
তিনি আরও বলেন, দেশের হাজার হাজার মানুষ অজান্তেই উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন। জানার আগেই উচ্চ রক্তচাপ এমন পরিবেশ তৈরি করে, যেখানে হৃদরোগ, হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক, কিডনির ক্ষতিসহ বিভিন্ন জটিল অসংক্রামক রোগ বাসা বাঁধে। আর অনেক রোগীকে মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যায়।
উচ্চ রক্তচাপের কারণ ও লক্ষণ নিয়ে জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. এস টি এ আজম ভোরের আকাশকে বলেন, উচ্চ রক্তচাপের একেবারে সুনির্দিষ্ট কোনো লক্ষণ সেভাবে প্রকাশ পায় না। তবে সাধারণ কিছু লক্ষণের মধ্যে রয়েছে- প্রচণ্ড মাথা ব্যথা করা, মাথা গরম হয়ে যাওয়া এবং মাথা ঘোরানো, ঘাড় ব্যথা করা, বমি বমি ভাব বা বমি হওয়া, অল্পতেই রেগে যাওয়া বা অস্থির হয়ে শরীর কাঁপতে থাকা, রাতে ভালো ঘুম না হওয়া, মাঝে মাঝে কানে শব্দ হওয়া এবং অনেক সময় জ্ঞান হারিয়ে ফেলে রোগী। এসব লক্ষণ দেখা দিলে নিয়মিত রক্তচাপ পরিমাপ করতে এবং ডাক্তারের পরামর্শে ওষুধ খাওয়ার পরামর্শ দেন অধ্যাপক ডা. এস টি এ আজম।
উচ্চ রক্তচাপের কারণসমূহ উল্লেখ করে তিনি বলেন, সাধারণত মানুষের ৪০ বছরের পর থেকে উচ্চ রক্তচাপ হওয়ার ঝুঁকি বাড়তে থাকে। এছাড়া অতিরিক্ত ওজন বা স্থূলতা, পরিবারে কারও উচ্চ রক্তচাপ থাকলে, নিয়মিত ব্যায়াম বা শারীরিক পরিশ্রম না করলে, প্রতিদিন ছয় গ্রাম অথবা এক চা চামচের বেশি লবণ খেলে, ধূমপান বা মদ্যপান বা অতিরিক্ত ক্যাফেইন জাতীয় খাদ্য/পানীয় খেলে, দীর্ঘদিন ধরে ঘুমের সমস্যা হলে এবং শারীরিক ও মানসিক চাপ থাকলে থাকলে উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত হওয়ার শঙ্কা থাকে।
ভোরের আকাশ/এসএইচ