ভোরের আকাশ প্রতিবেদক
প্রকাশ : ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ০৬:১৩ পিএম
ফাইল ছবি
ডেঙ্গু পরিস্থিতির অব্যাহত অবনতিতে উদ্বিগ্ন রাজধানীবাসী। উপসর্গ নিয়েও হাসপাতাল ও চিকিৎসকের কাছে যাচ্ছেন না রোগীরা। মৌসুমী জ্বর, চিকুনগুনিয়া ও করোনা ভাইরাসের সঙ্গে অধিকাংশ উপসর্গ মিল থাকায় আরও বিপাকে পড়ছেন ডেঙ্গুরোগীরা। এমন পরিস্থিতিতে প্রতিদিনই ডেঙ্গুতে মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। সেপ্টেম্বরের ২২ দিনে ডেঙ্গুতে মৃতের সংখ্যা ৫০ ছাড়িয়ে গেছে। আর চলতি বছর জানুয়ারি থেকে এপর্যন্ত মোট মৃতের সংখ্যা দাঁড়াল ১৮১ জনে। গতকাল রোববার একদিনে সর্বোচ্চ ১২ জন ডেঙ্গুরোগীর মৃত্যু হয়েছে।
সোমবার (২২ সেপ্টেম্বর) স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম থেকে পাঠানো প্রতিবেদনে জানানো হয়, ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে গত ২৪ ঘণ্টায় আরও দুজনের মৃত্যু হয়েছে। তারা দুজন বরিশাল ও ময়মনসিংহ বিভাগের। এ নিয়ে চলতি বছর এখন পর্যন্ত মশাবাহিত রোগটিতে মৃতের সংখ্যা বেড়ে ১৮১ জনে দাঁড়াল। এছাড়া গত ২৪ ঘণ্টায় দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন আরও ৬৭৮ জন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, গত ২৪ ঘণ্টায় ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে ১২৬ জন, ঢাকা বিভাগে ১১৩ জন, চট্টগ্রাম বিভাগে ৯০ জন, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে ৭৪ জন, রাজশাহী বিভাগে ৫৫ জন, ময়মনসিংহ বিভাগে ৩৩ জন, খুলনা বিভাগে ২৫ জন, বরিশাল বিভাগে ১৪৯ জন, রংপুর বিভাগে ১০ জন এবং সিলেট বিভাগে ৩ জন ডেঙ্গু নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি বছর ১ জানুয়ারি থেকে সোমবার পর্যন্ত ডেঙ্গুতে মোট ১৮১ জন মারা গেছেন। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু (৮৫ জন) হয়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে। পাশাপাশি এই সময়ে বরিশাল বিভাগে ২৮ জন ছাড়াও চট্টগ্রাম বিভাগে ২৩ জন, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে ২২ জন, রাজশাহী বিভাগে ১০ জন, ময়মনসিংহ বিভাগে ৬ জন, খুলনা বিভাগে ৫ জন এবং ঢাকা বিভাগে ২ জন ডেঙ্গুতে মারা গেছেন।
দেশে এক বছরে সবচেয়ে বেশি ৩ লাখ ২১ হাজার ১৭৯ ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল ২০২৩ সালে। ২০২৪ সালে ১ লাখ ১ হাজার ২১১ জন, ২০২২ সালে ৬২ হাজার ৩৮২ জন, ২০২১ সালে ২৮ হাজার ৪২৯ জন, ২০২০ সালে ১৪০৫ জন এবং ২০১৯ সালে ১ লাখ ১ হাজার ৩৫৪ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল
বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন অনুষদের সাবেক ডীন ইমেরিটাস অধ্যাপক ডা. এবিএম আবদুল্লাহ বলেন, এ বছর ডেঙ্গুর সংক্রমণ বৃদ্ধির মূল কারণ এডিস মশা বৃদ্ধি। এর পেছনে রয়েছে আবহাওয়ার পরিবর্তন ও অনিয়মিত বৃষ্টিপাত। অন্যদিকে মশা নিয়ন্ত্রণে যে জোরালো কার্যক্রম দরকার, সেটি সঠিকভাবে হচ্ছে না। ফলে মশার বংশবিস্তার কমছে না। বিশেষ করে এডিস মশার কামড়ে যারা দ্বিতীয় বা তৃতীয়বার ডেঙ্গু আক্রান্ত হচ্ছেন, তাদের মৃত্যু বেশি হচ্ছে।
এছাড়া বয়স্ক, শিশু, উচ্চরক্তচাপ, ডায়াবেটিস, কিডনি-লিভার জটিলতার মতো দীর্ঘ মেয়াদে ভুগছেন-এমন রোগীর ডেঙ্গু হলে বেশি মারা যাচ্ছেন। এখনই জরুরি ভিত্তিতে দেশব্যাপী মশা নিধনে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। না হলে আক্রান্ত ও মৃত্যু আগামী কয়েক মাস মহামারির মতো বাড়তে থাকবে।
রোগতত্ত্ববিদরা বলছেন, এ বছর ডেঙ্গুর পাশাপাশি এডিস মশাবাহিত রোগ চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। চিকিৎসাব্যবস্থার নানা সীমাবদ্ধতার কারণে এ রোগ শিগগিরই চিহ্নিত করা সম্ভব হচ্ছে না।
জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের (নিপসম) কীটতত্ত্ব বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. মো. গোলাম ছারোয়ার বলেন, গত বছর মশার লার্ভার মৌসুম জরিপে দেখা গেছে, শহরে এডিস মশার ৯৯ শতাংশই এডিস ইজিপ্টাই এবং গ্রামাঞ্চলে ৯৫ শতাংশ এডিস এলবোপিক্টাস। শহর-গ্রাম সবখানেই ডেঙ্গুর জীবাণুবাহী এডিস মশার লার্ভার ঘনত্বের পরিমাণ নির্দিষ্ট মানদণ্ডের চেয়ে বেশি পাওয়া যাচ্ছে।
বিশেষ করে ঢাকা ও চট্টগ্রামে ডেঙ্গুর প্রধান বাহক এডিস ইজিপ্টাই মশা এবং বরিশালসহ বিভিন্ন এলাকায় এডিস অ্যালবোপিক্টাস মশা বেশি দেখা যাচ্ছে। শহরাঞ্চলে কমবেশি লার্ভিসাইড ও এডাল্টিসাইড স্প্রে হলেও গ্রামাঞ্চলে নিয়মিত হচ্ছে না। এভাবে চলতে থাকলেও আরও অন্তত তিন মাস ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া সংক্রমণ বাড়তে থাকবে। যেটি দীর্ঘ মেয়াদে জনস্বাস্থ্য সমস্যা হিসাবে দেখা দেবে।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য বলছে, ডেঙ্গুতে আক্রান্তদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বয়সভিত্তিক রোগী ২১ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে। সাধারণত বর্ষা মৌসুম শুরু হওয়ার পর থেকেই ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়তে থাকে। চলতি সেপ্টেম্বর মাসের শুরু থেকেই ডেঙ্গুর সংক্রমণ আগের মাসগুলোর চেয়ে বাড়ছে। এর সঙ্গে বাড়ছে মৃত্যুও। চলতি মাসে এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে যত আক্রান্ত ও মৃত্যু হয়েছে, তা এ সময়ে আগের কোনো মাসে হয়নি। এ বছর যত আক্রান্ত ও মৃত্যু হয়েছে, তা গত বছরের এ সময়ের চেয়ে বেশি।
দায়সারা নিয়ন্ত্রণব্যবস্থাকে দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশে ডেঙ্গুর সংক্রমণ ও মৃত্যুর উচ্চহার কর্তৃপক্ষের ব্যর্থতাই প্রমাণ করে। এখানে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে নতুনত্ব কিছু নেই। সবকিছু যেন চলছে দায়সারাভাবে। সমস্যার সমাধানে কার্যকর কোনো তৎপরতা নেই।
এ বিষয়ে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা তৌহিদ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘মশা নিয়ন্ত্রণে কার্যত কোনো কার্যক্রম নেই। বিষয়টি একেবারে গা-সওয়া হয়ে গেছে। সরকারের কোনো ভাবনা নেই। মশা নিয়ন্ত্রণে কার্যত ব্যর্থ সরকারের প্রতিষ্ঠানগুলো।’
এই বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘ঢাকার বাইরে এবার যে ডেঙ্গু বাড়তে পারে, তা শুরু থেকেই ধারণা করা হয়েছিল। কিন্তু ঢাকার বাইরে মশা নিয়ন্ত্রণে কোনো ব্যবস্থাই নেই।’
জানতে চাইলে আইইডিসিআর সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, ‘ডেঙ্গুর মৃত্যু কমাতে হলে চিকিৎসাব্যবস্থা বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে। প্রাথমিক, মধ্যম ও জটিল; সব রোগের চিকিৎসা হচ্ছে মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল বা বড় হাসপাতালগুলোতে। এই হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসক বাড়ালেও বাড়ে না রোগীর বেড। নেই আইসিইউর (নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র) ব্যবস্থা, যা আছে তাতে সব রোগীর হয় না। অনেকেই আছে ডেঙ্গুর লক্ষণে ভোগেন, কিন্তু টেস্ট করান না। হাসপাতালে গেলে অনেক সিরিয়াল, হয়রানি। দেশের অনেক মানুষ দরিদ্র, চিকিৎসা করার মতো টাকা থাকে না। হঠাৎ করে একদিন অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং পরীক্ষা করে দেখেন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত; তখন অনেকটা দেরি হয়ে গেছে।’
ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, ‘গ্রামের স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোতে টেস্টের ব্যবস্থা করে দিতে হবে। ঘনবসতি এলাকায় ভ্রাম্যমাণ গাড়িতে করে হলে স্যাম্পল নিয়ে পরীক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। সেইসঙ্গে শিশু ও গর্ববতী নারীসহ ঝুঁকিপূর্ণ রোগীদের আগে থেকে হাসপাতালে রেখে পর্যবেক্ষণ করতে হবে। ডাক্তার আর নার্স চেকআপ করলে তাদের অবস্থা খারাপ হবে না। খারাপ পরিস্থিতির আগে তাদের বড় হাসপাতালে পাঠানো হবে। এভাবে করলে চিকিৎসা দেওয়া সহজ হবে এবং জটিল রোগীর সংখ্যা কমে যাবে। তাতে মৃত্যু অনেক কমে যাবে।’
স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের মশক নিধন কর্মসূচি সন্তোষজনক নয় জানিয়ে ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, ‘এভাবে হচ্ছে না। এখন পর্যন্ত ডেঙ্গু মোকাবিলায় কোনো নতুন ধরনের উদ্যোগ দেখা গেল না। সেই গতানুগতিক ধারাতেই চলছে সবকিছু। যেসব এলাকায় ডেঙ্গুর প্রার্দুভাব আছে, সেসব এলাকায় নিয়মিতভাবে পরিষ্কার-পরিচ্ছনতা অভিযান পরিচালনা করতে হবে। সেইসঙ্গে এলাকাবাসীকে সচেতন করতে হবে। সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সারাদেশে একসঙ্গে অভিযান পরিচালনা করতে হবে, হাজার হাজার স্বেচ্ছাসেবকের মাধ্যমে এই কাজ করতে হবে।’
এদিকে, ডেঙ্গু পরিস্থিতি মোকাবেলায় অনেকটা অপারগতা প্রকাশ করেছে দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিরা! এমন প্রশ্ন ও ক্ষোভ আজ মানুষের মনে। অসহায় হয়ে পড়েছেন ডেঙ্গু রোগী ও তাদের স্বজনেরা। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চলতি বছরের শুরু থেকেই খারাপ পরিস্থিতির ইঙ্গিত পাওয়া গিয়েছিল। কিন্তু গুরুত্ব না দেয়ার কারণে ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। মশক নিধনের ব্যর্থতার দায় কেউ নিচ্ছে না। জনসচেনতাই এখন ডেঙ্গু মোকাবেলার মূল হাতিয়ার বলে বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছেন দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানের কর্তা ব্যক্তিরা। অথচ মশক নিধনসহ ডেঙ্গু মোকাবেলায় ইতোমধ্যে খরচ হয়ে গেছে কোটি কোটি টাকা।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পরামর্শ ও নির্দেশনায় সীমাবদ্ধ এডিস মশা নিধন! লার্ভা পর্যায়ে ধ্বংস করতে না পারলে উড়ন্ত এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ এবং ডেঙ্গু মোকাবেলায় সফলতা পাওয়া সম্ভব হবে না। ডেঙ্গুরোগের বাহক এডিস মশার বংশবিস্তারের তিন স্তর হলো-লার্ভা, বাড়ন্ত ও উড়ন্ত। লার্ভা ধ্বংসে সফলতা দেখাতে পারছেন না দায়িত্বপ্রাপ্তরা। সীমিত সংখ্যক বাসাবাড়িতে অভিযান চালিয়ে জরিমানা আদায় করে লার্ভা নিয়ন্ত্রণে আনা যাবে না। ডেঙ্গু মোকাবেলায় বাড়াতে হবে জনসম্পৃক্ততা। সিটি করপোরেশনের মশক নিধন বিভাগের পাশাপাশি প্রত্যক ওয়ার্ড কাউন্সিলরসহ এলাকার গণমান্য ব্যক্তিদের কর্মসূচিতে সম্পৃক্ত করতে হবে।
ভোরের আকাশ/এসএইচ