আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশ : ২৭ জুলাই ২০২৫ ০১:৩৩ এএম
ভারত-মালদ্বীপ সম্পর্ক: সংঘাতের ছায়া কাটিয়ে ফের ঘনিষ্ঠতার পথে
ভারত ও মালদ্বীপ ফের ঘনিষ্ঠতার পথে হাঁটছে। ‘ইন্ডিয়া আউট’ স্লোগান তুলে ক্ষমতায় আসা প্রেসিডেন্ট মোহামেদ মুইজ্জুর আমলে দুই দেশের সম্পর্কে টানাপোড়েনের পর সম্প্রতি সম্পর্ক উন্নয়নের নতুন ইঙ্গিত মিলেছে।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সাম্প্রতিক মালদ্বীপ সফরে প্রতিরক্ষা, বাণিজ্য, বিজ্ঞান গবেষণা সহ একাধিক ক্ষেত্রে দ্বিপাক্ষিক অংশীদারত্বের ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। যৌথ বিবৃতিতে উভয় দেশ একে অপরকে ‘বিশ্বস্ত অংশীদার’ হিসেবে বর্ণনা করেছে।
প্রধানমন্ত্রী মোদি বলেন, “মালদ্বীপ আমাদের সবচেয়ে কাছের প্রতিবেশী। ভারতের ‘নেইবার ফার্স্ট’ নীতিতে এবং ভারত মহাসাগর বিষয়ক দৃষ্টিভঙ্গিতে মালদ্বীপের গুরুত্ব অপরিসীম।” তিনি আরও বলেন, “প্রাকৃতিক দুর্যোগ কিংবা মহামারী—সবসময়ই ভারত মালদ্বীপের পাশে থেকেছে।”
অন্যদিকে প্রেসিডেন্ট মুইজ্জু বলেন, “ভারত দীর্ঘদিন ধরেই মালদ্বীপের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ ও বিশ্বস্ত অংশীদার। আমাদের সহযোগিতা নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য, শিক্ষা থেকে শুরু করে জনগণের দৈনন্দিন জীবন পর্যন্ত ছড়িয়ে আছে।”
ক্ষমতায় আসার পর মুইজ্জু প্রথমেই মালদ্বীপ থেকে ভারতীয় সেনা প্রত্যাহারের নির্দেশ দেন, যা নয়াদিল্লিতে ভালোভাবে নেওয়া হয়নি। পরে মোদির লাক্ষাদ্বীপ সফর ঘিরে মালদ্বীপের মন্ত্রীদের মন্তব্যে বিতর্কের সৃষ্টি হয় এবং ভারতে ‘বয়কট মালদ্বীপ’ ট্রেন্ড করে। এতে দুই দেশের পর্যটন সম্পর্কেও প্রভাব পড়ে।
তবে মালদ্বীপের ৬০তম স্বাধীনতা দিবসে প্রধানমন্ত্রী মোদিকে আমন্ত্রণ জানানো এবং সফরে একাধিক চুক্তি সাক্ষর—সবই ইঙ্গিত দেয় যে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের বরফ গলতে শুরু করেছে।
দুই দেশের মধ্যে চারটি সমঝোতা স্মারক এবং তিনটি চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছে। ভারত মালদ্বীপকে প্রায় ৪,৮৫০ কোটি টাকার লাইন অফ ক্রেডিট দিয়েছে, যা প্রতিরক্ষা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং আবাসন খাতে ব্যয় করা হবে। এছাড়া ভারতের অর্থায়নে পরিচালিত প্রকল্পগুলোর ঋণ শোধের শর্তও শিথিল করা হয়েছে।
ভারত-মালদ্বীপ মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (IMFTA) নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। ভারত মালদ্বীপকে ৭২টি হেভি ভেহিকেল ও সরঞ্জাম সরবরাহ করেছে এবং মালেতে প্রতিরক্ষা ভবন উদ্বোধন করা হয়েছে।
মালদ্বীপে ভারতের বাণিজ্যিক প্রভাব দীর্ঘদিন ধরেই স্থায়ী। ২০২১ সালে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ৩০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা ২০২৩ সালে বেড়ে দাঁড়ায় ৫৪৮ মিলিয়ন ডলারে। ভারত মালদ্বীপে মূলত ওষুধ, ইঞ্জিনিয়ারিং সামগ্রী, কৃষিপণ্য রপ্তানি করে এবং স্ক্র্যাপ ধাতু আমদানি করে।
মুইজ্জু ক্ষমতায় আসার আগে থেকেই ভারতবিরোধী অবস্থান নেন এবং চীনের দিকে ঝুঁকতে থাকেন। চীন সফর শেষে মালদ্বীপ থেকে ভারতীয় সেনা প্রত্যাহারের ঘোষণাও দেন। ভারতীয় বিমান বাহিনীর উপস্থিতিকে ‘হস্তক্ষেপ’ বলে অভিযোগ তোলেন মুইজ্জু, যদিও ভারত তার উপস্থিতিকে মানবিক সহায়তা ও জনকল্যাণমূলক কর্মকাণ্ডের অংশ বলে ব্যাখ্যা করে আসছে।
আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিশ্লেষক কমার আঘা বলেন, “রাজনীতিতে কেউ স্থায়ী মিত্র বা শত্রু নয়। চীনের সঙ্গে সম্পর্ক গড়তে গিয়ে মালদ্বীপ ভারতের কাছ থেকে সরে গিয়েছিল, কিন্তু চীনের কাছ থেকে আশানুরূপ কিছু না পাওয়ায় এখন আবার ভারতের প্রয়োজন অনুভব করছে।”
উপমন্যু বসু, মানব রচনা ইনস্টিটিউটের অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর বলেন, “ভারতের জন্যও মালদ্বীপ গুরুত্বপূর্ণ। ভারতের নেইবার ফার্স্ট নীতির বাস্তবায়ন, চীনের প্রভাব মোকাবিলা এবং আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক অবস্থান জোরদার করার জন্য দিল্লি এই সম্পর্ককে গুরুত্ব দিচ্ছে।”
মালদ্বীপের প্রতিরক্ষা সক্ষমতা বাড়াতে ভারত পাশে থাকবে বলে জানিয়েছেন মোদি। তিনি বলেন, “আবহাওয়া যেমনই হোক, আমাদের বন্ধুত্ব সবসময় উজ্জ্বল ও পরিষ্কার থাকবে।”
মুইজ্জুও বলেছেন, মালদ্বীপ সরকার একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনীতি গড়তে এবং যুবশক্তিকে ক্ষমতায়ন করতে চায়। সেই লক্ষ্যে ভারত গুরুত্বপূর্ণ সহায়ক হিসেবে কাজ করছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, দুই দেশের বর্তমান সহযোগিতা ইতিবাচক ইঙ্গিত দিলেও, এর ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশনা এবং চীনের প্রতিক্রিয়া নজরে রাখা জরুরি।
সূত্র: বিবিসি বাংলা
ভোরের আকাশ//হ.র