মো. রেজাউর রহিম
প্রকাশ : ২৩ নভেম্বর ২০২৫ ১২:১৫ এএম
ফাইল ছবি
দেশের গ্রামাঞ্চলে নতুন আমন ধান তোলার আনন্দে রয়েছেন কৃষকরা। ইতোমধ্যে সারা দেশে ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ জমির ধান কাটা শেষ হয়েছে। গ্রামাঞ্চলের কৃষকদের উঠানে এখন আমন ধানের গন্ধে ম-ম করছে। ধান কাটা ও মাড়াইয়ে রীতিমতো ব্যস্ত সময় পার করছেন কৃষকরা। আর এবছর আগের বছরের তুলনায় বেশি জমিতে আমনের আবাদ হয়েছে এবং উৎপাদনও বেড়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। এছাড়া দেশের গ্রামাঞ্চলের হাট-বাজারগুলো এখন নতুন ধানে ভরে গেছে। নতুন ধানের দামও সন্তোষজনক থাকায় কৃষকদের মধ্যে উদ্দিপনাও বেড়েছে। গত কয়েক বছর ধরে দেশে আমনের উৎপাদন বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা দেশের মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতে সহায়ক হবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
দেশের বিভিন্ন জেলায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চলতিবছর অতিবৃষ্টি ও বন্যার কারণে দেশের কিছু কিছু এলাকায় জলাবদ্ধতার ফলে জমির ধানে ক্ষতি হলেও শেষাবধি ফলন ভালো হওয়ায় তা সামগ্রিকভাবে আমন উৎপাদনের ওপর খুব বেশি প্রভাব ফেলবে না। তবে উৎপাদনের সঠিক তথ্য পাওয়ার জন্য ধান কাটা শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। কৃষকরা জানিয়েছেন, বর্তমানে হাট-বাজারগুলোতে ধানের যে দাম পাচ্ছেন, তাতে তারা খুশি।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, এবার ২০২৫-২০২৬ মৌসুমে সারা দেশে ৫৭ লাখ হেক্টর জমিতে আমন চাষের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল। এবং উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে প্রায় ১ কোটি ৭৮ লাখ মেট্রিক টন। এর মধ্যে দেশের বেশ কয়েকটি জেলায় লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি জমিতে আমন চাষ হয়েছে। বিশেষ করে নরসিংদি, দিনাজপুর, ফরিদপুর, সুনামগঞ্জ, চট্টগ্রাম, সিরাজগঞ্জ নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ, হবিগঞ্জ, ময়মনসিংহে আমনের উৎপাদন ভালো হয়েছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ও কৃষি অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত কয়েক বছর ধরে দেশে ধারাবাহিকভাবে হেক্টর প্রতি আমনের গড় উৎপাদন বাড়ছে। গত ২০২৪-২৫ মৌসুমে হেক্টর প্রতি আমনের গড় ফলন হয়েছে ২.৯৫ টন, যা আগের বছরের ২০২৩-২৪-এর গড় ২.৮১ টন থেকে বৃদ্ধি পেয়েছে। এছাড়া, ২০২২-২৩ অর্থবছরে হেক্টর প্রতি ২.৬৯ টন, ২০২১-২২ অর্থবছরে ২.৬১ টন, ২০২০-২১ অর্থবছরে ২.৫৫ টন উৎপাদন হয়েছে।
জানা গেছে, দেশের বেশিরভাগ জেলায় ইতোমধ্যে স্বল্প ও মধ্যম মেয়াদি আমন জাতের ধান কাটতে শুরু করেছেন কৃষকরা। নরসিংদী জেলার শস্যভাণ্ডার খ্যাত রায়পুরা, মনোহরদী, বেলাব ও শিবপুর উপজেলার জমি থেকে কৃষকরা পাকা ধান কেটে ঘরে তুলতে ব্যস্ত। ধান কাটা, মাড়াই ও ঘরে তোলার সময় গ্রাম জুড়ে উৎসবের আমেজ বিরাজ করছে।
জেলার কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত উপ-পরিচোলক (শস্য) কেবিডি. সালাহ উদ্দিন টিপু ও অতিরিক্ত উপপরিচালক (উদ্যান) কৃষিবিদ সুব্রত কান্তি দত্ত জানান, এবছর সময়মতো বৃষ্টিপাত হওয়ার কারণে ধানের ফলন খুবই ভালো হয়েছে।
নরসিংদির পলাশ উপজেলার পারুলিয়া গ্রামের কৃষক আবদুল খালেক মিয়া জানান, তিনি প্রায় দুই একর জমিতে আমন ধান চাষ করেছেন। ধান খুবই ভালো হয়েছে। সময়মতো ধান ঘরে তোলা সম্ভব হলে লাভবান হবেন বলে উল্লেখ করেন তিনি।
শিবপুর উপজেলার কৃষক আব্দুর রহমান জানান, তার প্রায় সাত একর জমিতে বিভিন্ন জাতের আমন ধান চাষ হয়েছে। প্রতি একর জমিতে ৪০ থেকে ৫২ মণ ফলনের আশা করছেন তিনি।
রায়পুরা উপজেলার রহিমাবাদ গ্রামের কৃষক শফিকুল ইসলাম ও কৃষক আদুল হক বলেন, আমন ধান লাগানোর পর সময়মতো বৃষ্টি হওয়ার কারণে ফলন ভালো হয়েছে। পানি সেচের জন্যও এবছর বাড়তি টাকা খরচ হয়নি। তার এক একর জমিতে সার, বীজ, কীটনাশকসহ ধান ঘরে তোলা পর্যন্ত খরচ হয়েছে ১৮ হাজার টাকা। যার বাজার মূল্য ২৩ হাজার টাকা।
সিরাজগঞ্জে খবর নিয়ে জানা গেছে, রায়গঞ্জে রোপা আমন ধান ঘরে তোলার ধুম পড়ে গেছে। ধান কাটা মাড়াই ও গোলাজাত করতে কৃষাণ কৃষাণিরা এখন ব্যস্ত সময় পার করছেন। ইতোমধ্যে উপজেলার প্রায় ৬৫ শতাংশ জমির ধান কাটা হয়ে গেছে। অবশিষ্ট জমির ধান দুই সপ্তাহের মধ্যে কাটা মাড়াইসম্পন্ন হতে পারে বলে উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে।
উপজেলার চান্দাইকোনা ইউনিয়নের প্রান্তিক কৃষক সিমলা গ্রামের ফরহাদ মোল্লা জানান, তিনি দুই বিঘা জমিতে ব্রি-ধান ১০৩ আবাদ করেছিলেন। কাটা মাড়াই করে ধান পেয়েছেন ৩২ মণ।
খরচের বিষয়ে তিনি বলেন, বিঘাপ্রতি খরচ হয়েছে প্রায় ৮ হাজার টাকা।
ধামাইনগর ইউনিয়নের বিনোদনবাড়ি গ্রামের কৃষক মনিন্দ্র দত্ত জানান, তিনি তিন বিঘা জমিতে কাটারিভোগ ধানের আবাদ করেছিলেন। কারেন্ট পোকার আক্রমণের কারণে ফলন কম হয়েছে। মোট ধান পেয়েছেন ৩৮ মণ। তার খরচ হয়েছে বিঘাপ্রতি প্রায় সাড়ে ৭ হাজার টাকা। বাজারে এবার এ ধান বিক্রি করেছেন ১৮৪০/- টাকা মণ দরে। গত বছরের তুলনায় মণে প্রায় ১০০ টাকা দাম বেশি পেয়েছেন বলে জানান তিনি।
একই ইউনিয়নের কৃষ্ণপুর গ্রামের কৃষক আজহার আলি বলেন, তিনি ২৮ বিঘা জমিতে স্বর্ণা ৫ ও ব্রিধান ৫১-এর আবাদ করেছেন। মাজরা পোকা ও কারেন্ট পোকার (বাদামী গাছ ফড়িং) আক্রমণে কীটনাশক তিন বার দিতে হয়েছে। এতে ফলন কিছুটা কম হয়েছে। গড়ে বিঘাপ্রতি ধান পেয়েছেন ১৪-১৫ মণ হারে। খরচ হয়েছে প্রতি বিঘায় প্রায় ৯ হাজার টাকা। বাজারে এসব ধান বিক্রি হচ্ছে ১২৫০ টাকা থেকে ১৩০০ টাকা। গত বছরেও এধরনের দামই ছিল বলে জানান।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, যারা মাঠে নিজেরা কাজ করতে পারে তাদের খরচ কম হয়, তাদের মোটামুটি লাভ থাকে।
উপজেলা কৃষি অফিসার মো. মোমিনুল ইসলাম ভোরের আকাশ’কে জানান, এবার আগাম আমন ধানের চেয়ে নাবি ধানের ফলন ভালো হয়েছে। শুরুতে অতিবৃষ্টিতে কিছু কিছু এলাকায় জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হওয়ায় প্রায় ১০৪ হেক্টর জমিতে ধানের আবাদ হয়নি।
তিনি বলেন, ভারতের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে ঝটিকা বাতাস ও বৃষ্টির কারণে গড়ে প্রায় ১২১ হেক্টর জমির ধান আংশিক ক্ষতি হয়েছে। তবে নতুন নতুন জাত যেমন ব্রিধান ১০৩, ১০৮ ও ১১০ সহ উফশী ধানের চাষ ও সঠিক সময়ে বালাই ব্যবস্থাপনা করার কারণে এবার ফলন ভালো হয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশের মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতে এবং আমদানি নির্ভরতা কমাতে কৃষি উৎপাদন বিশেষ করে ধান ও খাদ্যশষ্য উৎপাদনের ওপর বাড়তি জোর দিতে হবে। আর এজন্য কৃষকদের উৎপাদন খরচ কমানোর ওপর জোর দিতে হবে। পাশাপাশি সহজশর্তে কৃষকদের ঋণপ্রাপ্তি নিশ্চিত করা এবং উৎপাদিত ফসলের যথাযথ দাম প্রাপ্তির বিষয়টিকে গুরুত্ব দিতে হবে।
ভোরের আকাশ/এসএইচ