মাজাহারুল ইসলাম
প্রকাশ : ০২ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ০১:০৮ এএম
প্রতীকী ছবি
জাতীয় পার্টির সঙ্গে গণঅধিকার পরিষদের নেতাকর্মীদের সংঘর্ষ এবং তা নিয়ন্ত্রণে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর লাঠিচার্জে গণঅধিকার পরিষদের নেতা নুরুল হক নুর আহতের ঘটনা নিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক ধরনের অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। নুরের ওপর হামলার পর গত রোববার অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও এনসিপি প্রতিনিধি দলের সঙ্গে যমুনার বৈঠক করেছেন। আজ মঙ্গলবার আরও সাতটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টা বৈঠক করবেন।
এর মধ্যে গতকাল সোমবার সেনাপ্রধান ওকায়ার-উজ জামান রাষ্ট্রপতি ও প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক করেছেন। নুরের ওপর হামলার মাত্র একদিন আগেই আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করেছে নির্বাচন কমিশন। এমন পরিস্থিতিতে গণঅধিকার পরিষদ-জাতীয় পার্টি সংঘাত ইস্যু ঘিরে দেশের রাজনীতিতে বড় অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে জামায়াতে ইসলামী ও এনসিপি আওয়ামী লীগের মতো জাতীয় পার্টির কার্যক্রমও নিষিদ্ধের দাবি জানিয়েছে।
তবে বিএনপি তাদের সঙ্গে একমত নয়। দলটি জাতীয় পার্টির কার্যক্রম নিষিদ্ধ চায় না। নুরের ওপর হামলার পেছনে অন্য কোনো কারণ আছে কী-না সেটি নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠছে রাজনীতির আলোচনায়। এমনকি বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা মনে করছেন, নির্বাচনকে পেছানো বা ব্যাহত করার একটি পরিকল্পিত উদ্দেশ্য থাকতে পারে এই হামলার পেছনে।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘পরিকল্পিতভাবে নির্বাচনকে ব্যাহত করার জন্য রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে অস্থির করার জন্য একটা মহল কাজ করছে।’ তবে জামায়াত ইসলামী নির্বাচন নিয়ে ষড়যন্ত্রের বিষয়টি এখনই ভাবছে না।
দলটির নেতারা বলেছেন, পরিস্থিতি ঘোলাটে করতে কোনো না কোনো পক্ষের ইন্ধন থাকতে পারে। যদিও গণঅধিকার পরিষদ শুক্রবারের ওই ঘটনার পর থেকেই অভিযোগ করে আসছে যে, দেশের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো জাতীয় পার্টিকে বিরোধীদল বানানোর চেষ্টা চালাচ্ছে। যে কারণে তাদের দলের ওপর হামলা চালানো হয়েছে।
রাজনৈতিক অস্থিরতা, নানা প্রশ্ন : গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর গত শুক্রবার রাতে সেনাবাহিনী ও পুলিশের হামলায় আহত হন বলে দাবি করেছেন দলটির নেতাকর্মীরা। ওইদিন জাতীয় পার্টির কার্যালয়ের সামনে দুই দফায় সংঘর্ষও হয় দল দুটির নেতাকর্মীদের মধ্যে। বর্তমান সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক দল গণঅধিকার পরিষদের প্রধানকে প্রকাশ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী লাঠিপেটা করলে তিনি গুরুতর আহত করার পর এ নিয়ে নানা আলোচনা তৈরি হয়।
বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এর প্রভাব নিয়ে নানা আলোচনা দেখা যায়। যেখানে অনেকেই ওই হামলা ও মারধরের ঘটনাটিকে স্বাভাবিক হিসেবে দেখছেন না। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর স্পষ্টভাবেই বলেছেন, রাজনৈতিক পরিস্থিতি অস্থির করার জন্য পরিকল্পিতভাবেই ঘটনাটি ঘটানো হয়েছে।
নুরের ওপর হামলার ঘটনার জের ধরে জামায়াত, এনসিপি, ইসলামী আন্দোলনসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল বিক্ষোভও করেছে। শুক্রবারের ওই ঘটনার পরদিন শনিবার জাতীয় পার্টির ওই রাজনৈতিক কার্যালয়ে হামলা ও অগ্নি সংযোগের ঘটনা ঘটে। গণঅধিকার পরিষদের মিছিল থেকেই হামলার ঘটনার অভিযোগও ওঠে। স্বাভাবিকভাবেই এই বিষয়গুলো নিয়ে হঠাৎ রাজনীতিতে এক ধরনের গুমোট পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।
আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের সময়সীমা গত কয়েক মাস ধরে দেশের রাজনীতিতে নানা প্রশ্ন ছিল। সরকারের পক্ষ থেকে স্পষ্ট কোনো ঘোষণা না থাকায় গত কয়েক মাস বিএনপিসহ কয়েকটি দল এ নিয়ে নানা শঙ্কাও প্রকাশ করেছিল। তবে গত পাঁচই আগস্ট প্রধান উপদেষ্টা তার ভাষণে আগামী বছরের ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে নির্বাচনের ঘোষণা দেয়। এরপর গত বৃহস্পতিবার নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশন।
রোডম্যাপ ঘোষণার পরদিনই জাতীয় পার্টি ও গণঅধিকার পরিষদের সংঘর্ষ ঘিরে নুরুল হক নুরসহ দলটির নেতাকর্মীদের ওপর সেনাবাহিনী ও পুলিশের হামলার পর আগামী জাতীয় নির্বাচন নিয়েও শঙ্কার প্রশ্ন তুলছে বিএনপিসহ কোনো কোনো রাজনৈতিক দল। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরাও এই শঙ্কাকে উড়িয়ে দিচ্ছেন না। বরং এর পেছনে কিছু যুক্তিও তারা তুলে ধরেছেন।
বিশ্লেষক রেজওয়ানা করিম স্নিগ্ধা বলেন, ‘নুরের ওপর হামলাসহ গত তিন চারদিনে বেশ কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে। প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি কৃষি বিশ^বিদ্যালয়গুলোতে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে গ্রামবাসীর সঙ্গে ছাত্রদেও সংঘর্ষ হয়েছে। হঠাৎই এক ধরনের অস্থির পরিবেশ তৈরি হয়েছে। যেটিকে দেশের ভেতর বা বহিঃশক্তির ইন্ধনেও হতে পারে। ঠিক এই মুহূর্তে রাজনৈতিক অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করে কোনোভাবে নির্বাচনকে প্রলম্বিত করার একটা উদ্দেশ্য থাকতে পারে।
গণঅধিকার পরিষদ ও জাতীয় পার্টির মধ্যে এই সংঘর্ষ এই পরিকল্পনার অংশ বলেই তিনি ধারণা করছেন। এই ধরনের পরিস্থিতির পেছনে সরকারের ভূমিকা নিয়ে কিছু প্রশ্ন তুলেছেন বিশ্লেষকদের কেউ কেউ। তারা বলছেন, সরকার চাইলেই পরিস্থিতিকে অন্যভাবে সামাল দিতে পারতো। কিন্তু সে রকম কোনো পদক্ষেপ সরকারের পক্ষ থেকে তারা দেখছেন না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক কাজী মারুফুল ইসলাম বলেন, ‘সরকারের একক কোনো সেন্ট্রাল কমান্ড নেই। সরকারের নিজেদের ভেতরেই দুই ধরনের সিদ্ধান্ত। যা অন্তর্বর্তী সরকারের সক্ষমতাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে। একটি দলের প্রধানকে যখন আক্রমণ করা হয় তখন রাষ্ট্র বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর মহলের অগোচরে তা হয়েছে বলে আমি মনে করি না। কিন্তু আমরা দেখলাম এরপরই সরকারের কেউ কেউ নিন্দা জানাচ্ছে আবার চিকিৎসার দায়িত্ব নিচ্ছে।’
গত রোববার সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা চেষ্টা করতেছি। একটা কার্যালয়ে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে, এখন আগুন ধরায়ে দেওয়ার আগেই যদি পুলিশ অ্যাকশনে যেতো তখন আপনারা বলতেন শান্তিপূর্ণ অনুষ্ঠানে কেন বাধা দিল?
শুক্রবার রাতে ওই সংঘর্ষের ঘটনার পর আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ অধিদপ্তর থেকে পাঠানো একটি বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছিল, ‘মব ভায়োলেন্সের মাধ্যমে পরিস্থিতি অশান্ত করার চেষ্টা’এবং ‘সংগঠিতভাবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর আক্রমণ’ হয়েছে। ফলে ‘জননিরাপত্তা রক্ষার্থে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বল প্রয়োগে বাধ্য হয়’।
তবে শেষ পর্যন্ত যদি নির্বাচনকে বানচাল বা বিলম্বিত করার জন্যই এমন পরিস্থিতি তৈরি করা হয় সেটিতে দিন শেষে কেউ লাভবান হবে না বলেও মনে করেন বিশ্লেষকরা। অধ্যাপক সাব্বির আহমেদ বলেন, ‘নির্বাচনকে সামনে রেখে নানা ধরনের অস্থিরতা হবে। যদি এটাকে ঘিরে নির্বাচন বানচাল করার চেষ্টা করা হয় এবং সেই প্রচেষ্টা সফল হয়, নির্বাচন না হয় তাহলে তো কেউ লাভবান হবে না। পুরো দেশই ক্ষতিগ্রস্ত হবে’।
আলোচনায় জাতীয় পার্টি ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসে। এরপর ২০১১ সালে আদালতের রায়ের মাধ্যমে সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করা হলে দেশে এক ধরনের রাজনৈতিক সংকট তৈরি হয়। আওয়ামী লীগের অধীনে ২০১৪ সালে একতরফা নির্বাচনে বিএনপি জামায়াতসহ অনেক রাজনৈতিক দল অংশ না নিলেও নির্বাচনে অংশ নেয় জাতীয় পার্টি। ওই নির্বাচনে গঠিত সংসদে জাতীয় পার্টি বিরোধীদল এবং দলটির কয়েকজন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকারের মন্ত্রিসভায়ও ছিলেন। যা নিয়ে দেশের রাজনীতিতে নানা হাসি তামাশাও ছিল। জাতীয় পার্টি গৃহপালিত বিরোধী দলের তমকা পেয়েছিল।
এরপর ২০১৮ এবং ২০২৪ সালের নির্বাচনেও আওয়ামী লীগের সঙ্গে অনেকটা ‘সমঝোতা’ করেই নির্বাচনে অংশ নিতে দেখা যায়। সংসদের বিরোধী দলেও দেখা যায় দলটিকে। শুধু জাতীয় নির্বাচন নয়, স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলোও যখন বিএনপি বয়কট করে আসছিল তখন জাতীয় পার্টির নেতারা সে সব নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল। যে কারণে শেখ হাসিনা সরকার পতনের গত এক বছরের রাজনীতির মাঠে অনেকটা কোণঠাসা অবস্থায় রয়েছে আওয়ামী লীগের এক সময়ের মিত্র এই দলটি।
গত কয়েক মাস ধরে বিভিন্ন সময়ে জাতীয় পার্টিকে নিষিদ্ধের দাবিতে গণঅধিকার পরিষদ, এনসিপি ও জামায়াত ইসলামীর পক্ষ থেকে দলটি নিষিদ্ধেও দাবি জানানো হয়েছে। এ নিয়ে দলগুলো বিভিন্ন কর্মসূচিও পালন করেছে। গত শুক্রবার সন্ধ্যায়ও গণঅধিকার পরিষদ- জাতীয় পার্টির মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটেছিল জাতীয় পার্টির কার্যক্রম নিষিদ্ধের দাবিতে একটি বিক্ষোভ মিছিল থেকে।
গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান বলেছেন, সরকারের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো আগামী নির্বাচনে জাতীয় পার্টিকে বিরোধীদল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে তৎপরতা চালাচ্ছে। যে কারণে তারা বিক্ষোভসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করছে।
অন্যদিকে গত রোববার একটি বিজ্ঞপ্তিতে জাতীয় পার্টি বলেছে, ‘জাতীয় পার্টি কখনো সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করেনি, তাই সন্ত্রাসবিরোধী আইনে জাতীয় পার্টিকে নিষিদ্ধ করা বা কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ করার আইনগত দাবি উঠতে পারে না। আরপিও অনুযায়ী যেসকল কাজ করলে একটি দলের নিবন্ধন বাতিল হতে পারে, এমন কোন কাজ জাতীয় পার্টি কখনই করেনি। জাতীয় পার্টির বিরুদ্ধে এমন কোনো অভিযোগও নেই। যারা জাতীয় পার্টি নিষিদ্ধের দাবি তুলছে তাদের এ দাবি অযৌক্তিক।’
ভোরের আকাশ/এসএইচ