মাজাহারুল ইসলাম
প্রকাশ : ২১ জুলাই ২০২৫ ০৯:৪৭ এএম
সংগৃহীত ছবি
আগামী জাতীয় নির্বাচনে কোন পদ্ধতি প্রয়োগ করা হবে তা নিয়ে বিরোধ চলছে দেশের বৃহৎ রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) ও জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশসহ বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দল। নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে পরস্পরবিপরীত অবস্থানে রাজনৈতিক দল দু’টি। চলমান পদ্ধতি ফার্স্ট পাস্ট দ্য পোস্টের পক্ষে রয়েছে বিএনপি ও তাদের যুগপৎ আন্দোলনের সঙ্গী দলগুলোসহ একাধিক দল। যদি কেউ পিআর পদ্ধতি চালু করতে চায়, জাতির সামনে এসে নিজেদের রাজনৈতিক প্রস্তাব তুলে ধরুক, নির্বাচন করুক, জয়লাভ করুক; তারপর পিআর আনুক। কিন্তু বিএনপির ঘাড়ে চেপে কিংবা রাষ্ট্রের ঘাড়ে চাপিয়ে কিছু আদায় করা যাবে না। জাতি এসব ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে বলেও কঠোর হুঁশিয়ারি দেন বিএনপি। এ পদ্ধতির বিরোধীতা করে জামায়াতসহ বেশ কয়েকটি ইসলামী রাজনৈতিক দল পার্টি লিস্ট প্রোপোরশনাল রিপ্রেজেন্টেশন (পিআর) পদ্ধতিতে নির্বাচনের জোড় দাবি জানাচ্ছে।
গত শনিবার রাজধানীতে অনুষ্ঠিত জামায়াতের ইসলামীর জাতীয় সমাবেশ থেকে সরকারের উদ্দেশ্য কঠোর বার্তা দেন দলটির শীর্ষ নেতারা, পিআর পদ্ধতি না হলে বাংলাদেশে কোনো নির্বাচন করতে দেওয়া হবে না। কিন্তু বিএনপি বলেছে, পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন সম্ভব নয়। এ পদ্ধতিতে নির্বাচন হলে সংসদে হবে অনৈক্য। সরকার হবে দুর্বল এবং উদ্ভূত সরকারে পতন ঘটবে। ছোট ছোট দলগুলোর নানা চাহিদা তৈরি হবে। ফলে বাংলাদেশের বিশৃঙ্খল রাজনীতি আরও বেশি বিশৃঙ্খল হয়ে উঠবে। এতে বাংলাদেশ আরও সংকটে পড়ে যাবে বলে কঠোর বিরোধিতা করে আসছে বিএনপি তাদের যুগপৎ আন্দোলনের সঙ্গী দলগুলোসহ একাধিক দল।
পক্ষান্তরে জামায়াতে ইসলামী, খেলাফত মজলিস, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, এবি পার্টিসহ বেশকিছু রাজনৈতিক দলের এই পদ্ধতির পক্ষে দৃঢ় অবস্থান রয়েছে। ফলে পিআর পদ্ধতি নিয়ে রাজনীতির মাঠে ছড়াচ্ছে ব্যাপক উত্তাপ। কোনোভাবেই পিআর পদ্ধতি বাস্তবায়ন করতে দেয়া হবে না সাফ জানিয়েছে বিএনপি। দীর্ঘ সময়ে রাজনৈতিক মাঠে স্বৈরাচার হাসিনা সরকারবিরোধী আন্দোলনে ঐক্যবদ্ধ থাকলেও এ পদ্ধতি নিয়ে বিএনপি-জামায়াত পরস্পর বিপরীত মুখী।
এদিকে, বাংলাদেশে এই মুহূর্তে জাতীয় সংসদ নির্বাচন পিআর পদ্ধতিতে করাটা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ বলে মন্তব্য করেছেন দেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষকসহ বিশিষ্টজনরা। তাদের মতে, পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচনটা কতটুকু গণতান্ত্রিক হবে, সেটিই বড় জিনিস। পিআর পদ্ধতি বিশ্বের প্রায় ৮০টি দেশে পরিচালিত হয়। তবে, আমাদের দেশে একটা নির্বাচনকে সামনে রেখে হঠাৎ করে পিআর পদ্ধতিতে যাওয়াটা খুব সহজ হবে না।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা জানান, পিআর পদ্ধতির বাস্তবায়ন চ্যালেঞ্জ। সাধারণত যুক্তরাষ্ট্রীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থায় পিআর পদ্ধতির প্রয়োগ করা হয়। সেখানে এককেন্দ্রিক ব্যবস্থায় এটির প্রযোগ হয়। আমরা তো সেই পদ্ধতিতে নেই। আমাদের আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলও নেই। সুতরাং এখানে ব্যাপক প্রতিনিধিত্বের জন্য আনুপাতিক নির্বাচনের প্রয়োজন নেই। সেই কারণে আনুপাতিক নির্বাচনের যে ন্যায্যতা, সেটি খুব বেশি আমাদের দেশে টেকে না। রাজনৈতিক দলগুলোর প্রার্থীর বাইরে বাংলাদেশে স্বতন্ত্রপ্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করেন অনেকে। পিআর পদ্ধতিতে স্বতন্ত্রপ্রার্থীদের নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ খুবই কম।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কাজী মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান বলেন, সাধারণত যুক্তরাষ্ট্রীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থায় পিআর পদ্ধতির প্রয়োগ হয়। সেখানে এককেন্দ্রিক ব্যবস্থায় এটির প্রয়োগ হয়। আমাদের দেশে তো সেই পদ্ধতিতে নেই। আমাদের আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলও নেই। সুতরাং এখানে ব্যাপক প্রতিনিধিত্বের জন্য আনুপাতিক নির্বাচনের প্রয়োজন নেই। সেই কারণে আনুপাতিক নির্বাচনের যে ন্যায্যতা, সেটি খুব বেশি আমাদের দেশে টেকে না।
তিনি আরও বলেন, সব দল মনে করলে এটি চালু করতে পারে। কিন্তু এটি যারা চাচ্ছে তারা যদি শুধুমাত্র রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিত্ব থাকতে হবে এ চিন্তা করে, তাহলে ঠিক হবে না। কারণ, আমরা তো রাজনৈতিক দলের অংশ চাই না, চাই ভোটারদের অংশ কিংবা প্রতিনিধিত্ব। পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন হলে কোনো দল একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে না। তখন সরকার গঠনের জন্য ছোট ছোট দলগুলোর সমর্থনের ওপর নির্ভর করতে হবে। তখন সংসদে থাকবে অনৈক্য। সরকারগুলো হবে দুর্বল এবং উদ্ভূত সরকারে পতন ঘটবে। এছাড়া, ছোট দলগুলোর নানা চাহিদা তৈরি হবে। ফলে বাংলাদেশের বিশৃঙ্খল রাজনীতি আরও বেশি বিশৃঙ্খল হয়ে উঠবে। এতে বাংলাদেশ আরও সংকটে পড়ে যাবে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
এ বিষয়ে নির্বাচন বিশ্লেষক অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদ বলেন, এটিতে (পিআর) কোনো দল লাভবান হবে আর কোনো দল ক্ষতিগ্রস্ত হবে সেটি বড় বিষয় নয়। নির্বাচনটা কতটুকু গণতান্ত্রিক হবে, সেটিই বড় জিনিস। আমাদের দেশে একটা নির্বাচনকে সামনে রেখে হঠাৎ করে পিআর পদ্ধতিতে যাওয়াটা খুব সহজ হবে না।
পিআর পদ্ধতিতে জটিল কিছু বিষয় আছে উল্লেখ করে এই নির্বাচন বিশ্লেষক বলেন, এটি আগে বুঝতে হবে। বিভিন্ন দেশে পরিচালিত এই পদ্ধতির ওপর গবেষণা করতে হবে। এরপর কোনটা আমাদের জন্য উপযুক্ত, সেটি বের করতে হবে। তাই বাংলাদেশে এই মুহূর্তে জাতীয় সংসদ নির্বাচন পিআর পদ্ধতিতে করাটা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ হবে বলেও মনে করেন তিনি। রাজনৈতিক দলগুলোর প্রর্থীর বাইরে বাংলাদেশে স্বতন্ত্রপ্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করেন অনেকে। পিআর পদ্ধতিতে স্বতন্ত্রপ্রার্থীদের নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ খুবই কম।
এ প্রসঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহ উদ্দিন আহমেদ বলেছেন, বিএনপি কোনভাবেই পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন চায় না। পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন যারা চায় তাদের অসৎ উদ্দেশ্য আছে বলে মন্তব্য করেন তিনি। বিভিন্ন ধরনের বিভ্রান্তি সৃষ্টির মধ্য দিয়ে নির্বাচনকে বিলম্বিত করতে চায় কিছু রাজনৈতিক দল। তারা জনগণের ভাষা বোঝে না। দেশের জনগণ পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন বুঝে না বলেও উল্লেখ করেন সালাহউদ্দিন।
তিনি আরও বলেন, যদি কেউ পিআর পদ্ধতি চালু করতে চায়, জাতির সামনে এসে নিজেদের রাজনৈতিক প্রস্তাব তুলে ধরুক, নির্বাচন করুক, জয়লাভ করুক; তারপর পিআর আনুক। কিন্তু বিএনপির ঘাড়ে চেপে কিংবা রাষ্ট্রের ঘাড়ে চাপিয়ে কিছু আদায় করা যাবে না। জাতি এসব ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে বলেও কঠোর হুঁশিয়ারি দেন বিএনপির এই নেতা।
পিআর প্রসঙ্গে শনিবার রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে মহাসমাবেশের বক্তব্যে জামায়াতে ইসলামের নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেছেন, কেন্দ্র দখল বা টাকা দিয়ে ভোট কেনা যাবে না বলে অনেকে পিআর পদ্ধতির নির্বাচন চান না।
তিনি বলেন, পিআর পদ্ধতিতে কেন্দ্র দখল হবে না, তাহলে মতলব পূরণ হবে না। যেটা স্বচ্ছ নির্বাচন, সেটার বিরোধিতা করার মানে হলো নতুন বাংলাদেশ গড়ার ব্যাপারে তারা সিনসিয়ার (আন্তরিক) না।
বিএনপির দিকে ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, আমরা মনে করি, কোনো একটি বড় দল, বা তিনটি দল না চাইলে পিআর পদ্ধতি আটকে যাওয়াটা অবিচার হবে; বৈষম্য হবে। অধিকাংশ দলই পিআর পদ্ধতিতে সমর্থন দিচ্ছে। শুধু এক লাইনে ব্যাখ্যা দিতে চাই, জনসমর্থনের দিক থেকে পাঁচ-ছয়টা দল, এনসিপি, চরমোনাই পীর, সব ইসলামী দল, গণঅধিকার পরিষদের পক্ষে রয়েছে বলেও উল্লেখ করেন জামায়াতের এই নেতা।
তাহের বলেন, বাংলাদেশের মানুষ একটা পরিবর্তন চায় এবং এমন একটি ব্যবস্থা আমরা আনতে চাই, যেন ফ্যাসিস্ট আর ফিরে না আসে।
ভোরের আকাশ/এসএইচ