আওয়ামী লীগে নিষিদ্ধ ও নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন বাতিল দাবি
এম. সাইফুল ইসলাম
প্রকাশ : ০৩ মে ২০২৫ ১০:৫৫ এএম
ছুটির দিনেও উত্তাল ছিল রাজধানী
আওয়ামী লীগের বিচার ও নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন বাতিলের দাবিতে ছুটির দিনেও গতকাল শুক্রবার উত্তাল ছিল রাজধানী। দাবি আদায়ে মাঠে ছিল একাধিক রাজনৈতিক দল। সমাবেশ থেকে দলগুলো তাদের স্পষ্ঠ অবস্থান তুলে ধরে দাবি না মানলে এর পরীনিতি সম্পর্কে সরকারকে দায় নিতে হবে বলে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে।
দুপুরের আগেই জাতীয় নাগরিক কমিটি (এনসিপি) ও হেফাজতে ইসলামসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দল ও সংগঠনের মিছিল ও সমাবেশে উত্তাল হয়ে ওঠে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা। দলীয় নেতাকর্মীরা মিছিল নিয়ে আসতে থাকে বায়তুল মোকররম মসজিদের দিকে। আওয়ামী লীগের বিচার ও রাজনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধ চেয়ে এনসিপি বায়তুল মোকাররম মসজিদের দক্ষিণ গেটে এ সমাবেশ করে। পতিত আওয়ামী লীগের বিচার ও সংস্কারের আগে এই দেশে কোনো নির্বাচন হবে না বলে সমাবেশে ঘোষণা দেন দলটির নেতারা।
অন্যদিকে, নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন বাতিল, নেতাদের নামে থাকা সব মামলা প্রত্যাহার এবং আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ চেয়ে আয়োজিত সমাবেশে হেফাজতে ইসলামের নেতারা দাবি মানা না হলে প্রয়োজনে ঢাকাসহ সারা দেশ অচল করার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। হেফাজতে ইসলামসহ ছাড়াও একই দাবিতে আহলে হাদীস বাংলাদেশসহ কয়েকটি সংগঠন বায়তুল মোকাররম এলাকায় সমাবেশ করে। বিকেলে জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ গেটের সামনে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের ও দলটির বিচারের দাবিতে এনসিপির সমাবেশে দলটির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা বক্তব্য রাখেন।
সমাবেশে এনসিপি আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেছেন, নৌকা মার্কাকে বাংলাদেশ থেকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে হবে। বিচার চলাকালীন সময়ে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক এবং সাংগঠনিক কার্যক্রম নিষিদ্ধ করতে হবে। গভীর ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে এখনো জুলাই ঘোষণাপত্র এখনো আসছে না বলে মন্তব্য করেন নাহিদ ইসলাম।
তিনি বলেন, জুলাই অভ্যুত্থানের নয় মাস পরেও আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ ও নিবন্ধন বাতিলের দাবিতে আমাদের রাজপথে নামতে হয়েছে, এটা আমাদের সামষ্টিক ব্যর্থতা বলে মনে করি। জাতির কাছে আমাদের অন্যতম প্রতিশ্রুতি ছিল ফ্যাসিবাদের বিচার নিশ্চিত করা এবং জুলাই চেনার আলোকে দেশের সংস্কার নিশ্চিত করা।
নাহিদ ইসলাম বলেন, বাংলাদেশের জনগণ ২৪ প্রথমবার রাজপথে নেমে আসেনি, জীবন দেয়নি। এর আগে বহুবার এ দেশের মানুষ রাজপথে নেমে এসেছেন জীবন দিয়েছেন। ১৯৭১ সালের পরে ১৯৭২ সালে আমার সোনার বাংলার স্বপ্ন মুজিববাদীদের হাতে বেহাত হয়ে গিয়েছিল। দেশটাকে ভারতীয় শাসকগোষ্ঠীর হাতে তুলে দিয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের আকাক্সক্ষা ব্যর্থ করে দেওয়া হয়েছিল। গণতন্ত্রের নামে বাকশাল কায়েম করা হয়েছিল। সমাবেশে আওয়ামী লীগের বিচারের প্রশ্ন অমীমাংসিত রেখে দেশে কোনো নির্বাচন হবে না বলে মন্তব্য করেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সদস্যসচিব আখতার হোসেন।
তিনি বলেন, যারা আওয়ামী লীগকে প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করবে তাদের বিরুদ্ধে ছাত্রসমাজ প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সময় নেবে না।
তিনি আরও বলেন, আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে সব রাজনৈতিক দলকে অবশ্যই রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে। কোনো রাজনৈতিক দল যদি এ থেকে বাইরে থেকে সুযোগ নিতে চায় জনগণ অবশ্যই তাদেরকে ইতিহাসের আস্তাকুড়ে নিক্ষেপ করবে।
আখতার হোসেন বলেন, যে আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের জনগণের বিরুদ্ধে সন্ত্রাস করেছে, বাংলাদেশে মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছে। সেই আওয়ামী লীগ বাংলাদেশে রাজনীতি করার অধিকার রাখে না। অন্তর্বর্তী সরকারকে বলতে চাই, আগের মতো সুশীল তত্ত্বাবধায়ক সরকার আপনারা না। আপনারা গণঅভ্যুত্থানের সরকার। গণঅভ্যুত্থানের ম্যানডেট নিয়ে আপনারা সরকারে বসেছেন।
তিনি বলেন, আপনাদের কাছে প্রশ্ন, যে আওয়ামী লীগ গণহত্যা চালিয়েছে সে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে কেন সময় ক্ষেপণ করা হচ্ছে। ৫ আগস্ট বাংলাদেশের জনগণ সিদ্ধান্ত নিয়েছে, আওয়ামী লীগের নামে মুজিববাদী আদর্শের নামে বাংলাদেশে কোনো রাজনীতি চলতে পারে না।
এনসিপির এ নেতা বলেন, এখন পর্যন্ত আওয়ামী লীগের নিবন্ধন আছে। আমরা হুঁশিয়ার দিয়ে বলতে চাই, আওয়ামী লীগের নাম নিবন্ধনের খাতা থেকে কেটে দিতে হবে।
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের উদ্দেশে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আব্দুল্লাহ বলেন, আহত এবং শহীদদের রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে আমরা আপনাদেরকে ক্ষমতায় বসিয়েছি। আমরা আপনাকে অনুরোধ করছি না, আপনাকে সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিচ্ছি, আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করতে হবে। গণহত্যাকারী আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করতে হবে।
সমাবেশে এনসিপির উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম বলেন, আজ থেকে ৯ মাস আগে আগস্টের ৩ তারিখে ঠিক এমন বিকেলে শহীদ মিনারের উন্মুক্ত মঞ্চে দাঁড়িয়ে সবাই এক হয়ে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে রায় দিয়েছিলাম। আজ ২ মে ছাত্র জনতা এক হয়ে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে আবারও রায় দিয়েছে। আমরা বাংলাদেশে খুনি আওয়ামী লীগের নিষিদ্ধকরণ চাই।
গতকাল শুক্রবার জুমার নামাজের পর থেকে বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ গেটের সামনে এই সমাবেশ শুরু হয়। সমাবেশে এনসিপির ঢাকা মহানগরের বিভিন্ন থানার নেতাকর্মীরা যোগ দেন। এসময় মিছিল আর স্লোগানে উত্তপ্ত হয়ে উঠে গোটা এলাকা। পৌনে পাঁচটার দিকে সমাবেশে যোগ দেন এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম। তার আগেই মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন দলের সদস্যসচিব আখতার হোসেন, মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী, জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক সামান্তা শারমিন, মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম ও হাসনাত আবদুল্লাহসহ জ্যেষ্ঠ নেতারা। পরে তারা বক্তব্য রাখেন। এছাড়াও সমাবেশে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে শহীদ খালেদ সাইফুল্লাহর বাবা কামরুল হাসানও সমাবেশে বক্তব্য দেন।
তিনি বলেন, আমার ছেলের বুকে ৭০টা গুলি করা হয়েছিল। একটা মানুষকে মারতে কত গুলি করতে হয়? হত্যার বিচার না হওয়া পর্যন্ত কোনো নির্বাচন হতে দেওয়া হবে না, স্বৈরাচারী ফ্যাসিবাদী হাসিনা ও তার দোসরদের কোনো স্থান হবে না।
দেশ আচল করার হুমকি হেফাজতের : এদিকে, জুমার নামাজের পর জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের উত্তর গেটের সামনে বিক্ষোভ সমাবেশে করে হেফাজতে ইসলাম। নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন বাতিল, হেফাজত নেতাদের নামে থাকা সব মামলা প্রত্যাহার এবং আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধসহ দাবিতে তারা এ সমাবেশ করে।
সমাবেশে সমাবেশ প্রধান অতিথির হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় সিনিয়র সহসভাপতি ও ঢাকা মহানগর সভাপতি মাওলানা জুনায়েদ আল হাবীব দাবি পূরণ না করা হলে ঢাকাসহ সারা দেশ অচল করার হুঁশিয়ারি দেন। তিনি সরকারকে উদ্দেশ্য করে বলেন, আমাদের দাবি না মানা হলে শনিবার (আজ) ঢাকা অচল হয়ে যাবে। আন্দোলনের মুখে হাসিনার বিদায় হয়েছে।
মসজিদে মসজিদে ঈমান রক্ষার দাবিতে মাঠে নামার আহ্বান : এ দিকে নারীকমিশনের প্রতিবেদনকে কোরআনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক দাবি করে হেফাজতের আজকের সমাবেশে যোগ দিতে রাজধানীর মসজিদগুলোতে প্রচারণা চালানো হয়। মসজিদের মেম্বর থেকে বলা হয়, এটা কোন রাজনৈতিক আন্দোল বা দাবি নিয়ে মাঠে নামার মতো বিষয় নয়। এটি ঈমান রক্ষায় একজন মুসলমানের প্রাণের দাবি। কে আহ্বান করেছে তা বড় কথা নয়। প্রত্যেকের উচিত ঈমানের দাবি পুরণে মাঠে থাকা।
সংবিধানে বহুত্ববাদের পরিবর্তে আল্লাহর ওপর আস্থা ও বিশ্বাস পুনর্বহাল, ফ্যাসিবাদের আমলে দায়েরকৃত সব মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার, শাপলা চত্বরসহ সব গণহত্যার বিচার; ফিলিস্তিনে এবং ভারতে মুসলিম গণহত্যা ও নিপীড়ন বন্ধের দাবিতে আজ শনিবার রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে মহাসমাবেশের ডাক দিয়েছে হেফাজতে ইসলামী।
হেফাজতের সমাবেশে সারা দেশ থেকে মানুষ অংশগ্রহণ করবে জানিয়ে জুনায়েদ আল হাবীব বলেন, ইতোমধ্যে দিনাজপুর থেকে ৪২টি বাস আসার জন্য প্রস্তুত হয়েছে। চার থেকে সাড়ে হাজার মানুষ বরিশাল থেকে লঞ্চে আসবে। সমাবেশ সফল করতে তিনি সবাইকে ফজরের নামাজের পর মিছিল নিয়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জড়ো হওয়ার আহ্বান জানান।
হেফাজতের কেন্দ্রীয় নায়েবে আমির মাওলানা মহিউদ্দিন রব্বানী বলেন, আগামীকাল আলটিমেটাম দেওয়া হবে। হেফাজতের নেতাদের নামে, আলেমদের নামে থাকা মামলা প্রত্যাহার এবং নারী কমিশন বাতিল না হলে প্রয়োজনে কঠোর কর্মসূচি দেওয়া হবে।
কেন্দ্রীয় নায়েবে আমির মাওলানা সারওয়ার কামাল আজিজী বলেন, আমাদের দাবি স্পষ্ট, তা মানতে হবে। না হলে প্রয়োজনে আরেকটা শাপলা চত্বর করা হবে। ইসলামবিরোধী এই কমিশন বাতিল করতে হবে, বাতিল না করা পর্যন্ত আমাদের সংগ্রাম চলবে।
সমাবেশে আরও বক্তব্য দেন হেফাজতে ইসলামের নায়েবে আমির আহমেদ আলী কাসেমী, কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা আজিজুল হক ইসলামাবাদী, কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা মীর ইদ্রিস, পল্টন জোনের উপদেষ্টা ও কেন্দ্রীয় নায়েবে আমির আবদুল কাইয়ুম সোবহানী, কেন্দ্রীয় সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক মুফতি জাবের কাসেমী প্রমুখ। বিক্ষোভ সমাবেশ শেষে হেফাজতে ইসলামের পল্টন জোনের সভাপতি মাওলানা সালাহ উদ্দিনের নেতৃত্বে একটি মিছিল বায়তুল মোকাররম মসজিদ থেকে বের হয়ে পল্টন হয়ে বিজয়নগর মোড়ে গিয়ে শেষ হয়।
আরো দুটি সংগঠনের মিছিল : নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন বিলুপ্ত এবং এর প্রতিবেদন বাতিলের দাবিতে বায়তুল মোকাররমের উত্তর ফটক এলাকায় পৃথক মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সমাবেশ করেছে আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ। এ ছাড়া ফিলিস্তিনের গাজায় গণহত্যা বন্ধ এবং স্বাধীন ফিলিস্তিন প্রতিষ্ঠার দাবিতে পৃথক বিক্ষোভ মিছিল করেছে জাতীয় বিপ্লবী পরিষদ। মিছিল থেকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের গাজা দখলের প্রতিবাদ এবং জাতিগত নিধন বন্ধের আহ্বান জানানো হয়েছে।
ভোরের আকাশ/এসএইচ