মাজাহারুল ইসলাম
প্রকাশ : ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ০১:৩৩ এএম
ছবি: সংগৃহীত
জুলাই সনদের ভিত্তিতে আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন এবং নির্বাচনে পিআর পদ্ধতিতে ভোটসহ বেশ কয়েকটি দাবিতে উত্তপ্ত হচ্ছে রাজনৈতিক অঙ্গন। একইসঙ্গে পিআর পদ্ধতির পক্ষে-বিপক্ষ নিয়ে মতানৈক্যে রয়েছে দেশে বিদ্যমান রাজনৈতিক দলগুলোর। নির্বাচন নিয়ে নতুন শঙ্কা তৈরি হয়েছে পিআর পদ্ধতি। পিআর পদ্ধতির পক্ষে বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে রাজনৈতিক দলগুলো। এর মধ্যে ১৮টি রাজনৈতিক দল পিআর পদ্ধতির পক্ষে।
অপরদিকে দেশের বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপি সহ ২৮টি দল বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে। বিএনপি বলছে পিআর পদ্ধতিতে তারা কোনোভাবেই রাজি নয়। যদি তাদের ওপর পিআর পদ্ধতি চাপিয়ে দেওয়া হয় তাহলে তারা রাজনৈতিকভাবে মোকাবিল করবে। জুলাই সনদ বির্তকে নির্বাচন বিলম্বিত হলে দেশের জন্য নিরাপত্তার হুমকির মুখের পড়তে পারে বলছে বিএনপি, কিন্তু জুলাই সনদ বাস্তবায়ন ছাড়া নির্বাচনে অংশ নিবে না বাংলাদেশ জামায়াত ইসলামীসহ কয়েকটি ইসলামীদল।
এদিকে, ফেব্রুয়ারিতেই ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোট আয়োজনের লক্ষ্যে সরকারের ঊর্ধ্বতন মহল ও নির্বাচন কমিশন (ইসি) সংশ্লিষ্ট সব কর্মকাণ্ড বেশ জোরসোরে এগিয়ে যাচ্ছে, ইতোমধ্যে সংসদ নির্বাচনে ব্যবহারের জন্য ভোটের সামগ্রী সরবরাহ শুরু হয়েছে। বিভিন্ন ধরনের সরঞ্জাম আসতে শুরু করেছে নির্বাচন কমিশনে (ইসি)। ভোটের প্রস্তুতিতে কোনো কমতি নেই।
এরই মধ্যেই নির্বাচনের মাঠে থাকা রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে (আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব) পিআর নিয়ে উত্তপ্ত হচ্ছে রাজনৈতিক মাঠ-এমনটাই ভাবছেন দেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা। তাদের মতে, নির্বাচনের ঘোষণাসহ সকল প্রস্তুতি ইতিবাচক হলেও মাঠের রাজনীতিতে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ও সংশয় এখনো কাটেনি। জুলাই সনদ বাস্তবায়ন, সংস্কার ও বিচার ও পিআর পদ্ধতিতে ভোট করার শর্তে আন্দোলনে যাচ্ছে জামায়াতে ইসলামী, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, ইসলামী আন্দোলন, খেলাফত মজলিস, নেজামে ইসলাম পার্টিসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দল। কিন্তু বিএনপি ও এর সমমনাদলগুলো বলছে, নির্বাচিত সংসদ জুলাই সনদ বাস্তবায়ন করবে। একইসঙ্গে পিআর পদ্ধতিতে ভোটের বিপক্ষে কঠোর দাবি জানিয়েছেন বিএনপি ও তাদের সঙ্গী দলগুলো।
বিএনপি বলছে, জুলাই সনদ বাস্তবায়নে বিশেষ সাংবিধানিক আদেশে আইনি পন্থার বাইরে সংবিধান সংশোধনীর কোনো নজির সৃষ্টি হোক সেটা আমরা চাই না। জুলাই সনদের বাস্তবায়ন পদ্ধতি নিয়ে গত বৃহস্পতিবার ঐকমত্য কমিশনের প্রস্তাবিত স্পর্শকাতর কিছু সুপারিশের সঙ্গে অনৈক্য রয়ে গেছে বিএনপির। আগের মতোই বিএনপির বিপরীত অবস্থানে জামায়াতে ইসলামীসহ কয়েকটি ইসলামীদল।
বিচার এবং সংস্কার ছাড়া নির্বাচন হলে ভোট বর্জনেরও হুমকী দিয়েছে দল দুটি। পিআর পদ্ধতির ঘোর বিরোধিতায় রয়েছে দেশের বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপি। সর্বোপরি, পিআর ইস্যুতে দ্বি-ধারায় বিভক্তির প্রকাশ্যে রূপ নিয়েছে রাজনৈতিক অঙ্গন। পিআর প্রসঙ্গে মতানৈক্যতেই ভোট বাধাগ্রস্ত হওয়ার সম্ভবনা বেশি দেখছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাদের অসংলগ্ন বক্তব্যেও তাই ফুটে উঠেছে বলেও মনে করেন তারা।
পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন এবং জাতীয় পার্টি ও ১৪ দলকে নিষিদ্ধকরণসহ ৫ দফা দাবি : পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন এবং জাতীয় পার্টি ও ১৪ দলকে নিষিদ্ধকরণসহ ৫ দফা দাবি আদায়ে ঢাকাসহ সারা দেশে বিক্ষোভ মিছিলসহ দুই দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেছে জামায়াতে ইসলামী। তাদের দাবিগুলো তুলে ধরেন, জুলাই জাতীয় সনদের ভিত্তিতে আগামী ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচনের আয়োজন করা, জাতীয় সংসদের উভয়কক্ষে পিআর পদ্ধতি চালু করা, অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের লক্ষ্যে সবার লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করা, ফ্যাসিস্ট সরকারের সকল জুলুম নির্যাতন গণহত্যা ও দুর্নীতির বিচার দৃশ্যমান করা এবং স্বৈরাচারের দোসর জাতীয় পার্টি ও ১৪ দলের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা। এই পাঁচ দফা দাবি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ১৮ সেপ্টেম্বর রাজধানী ঢাকায় সমাবেশ ও বিক্ষোভ মিছিল, ১৯ সেপ্টেম্বর দেশের সকল বিভাগীয় শহরে বিক্ষোভ মিছিল ও ২৬ সেপ্টেম্বর দেশের সকল জেলা-উপজেলায় বিক্ষোভ মিছিল করবে দলটি।
এ বিষয়ে দলটির নায়েবে আমির সাবেক এমপি ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মো. তাহের বলেন, বর্তমানে বাংলাদেশ একটি রাজনৈতিক সংকটের মধ্য দিয়ে সামনে অগ্রসর হচ্ছে। ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের সফল গণঅভ্যুত্থানের পর স্বৈরাচার শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে পালিয়ে যায়। প্রশাসনিক কাঠামো ভেঙে পড়ে। দেশে কোনো সরকার না থাকায় সাংবিধানিক শূন্যতার সৃষ্টি হয়। সংবিধানের অনেক বিধানাবলি অকার্যকর হয়ে পড়ে। এমন পরিস্থিতিতে জনগণের অভিপ্রায়ের পরম অভিব্যক্তি ও জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়। এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বৈধতার উৎস ও ভিত্তি হচ্ছে সংবিধানের অনুচ্ছেদ-৭ এ বর্ণিত বিধানাবলি ও জনগণের অভিপ্রায়।
তিনি বলেন, সংবিধানের ত্রুটি ও রাষ্ট্রীয় কাঠামোগত অব্যবস্থাপনার সুযোগে কর্তৃত্ববাদী শাসন, ভিন্ন মত দমন, দুর্নীতি ও দলীয়করনের ফলে গোটা দেশ অকার্যকর হয়ে পড়ে। তিনি আরও বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর রাষ্ট্রের প্রয়োজনকে সামনে রেখে, জনগণের প্রত্যাশা পূরণের লক্ষ্যে গণহত্যার বিচার, রাষ্ট্র সংস্কার ও স্বৈরাচারীর ফিরে আসার সকল পথ রুদ্ধ করার প্রত্যয় নিয়ে কাজ শুরু করে। গঠিত হয় বিভিন্ন সংস্কার কমিশন। সংস্কার কমিশনগুলোর সুপারিশের ভিত্তিতে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন ১৬৭টি প্রস্তাবের ভিত্তিতে রাজনৈতিক দলসমূহের সঙ্গে আলোচনায় বসে। দীর্ঘ আলোচনার পর ৮৪টি প্রস্তাব আকারে গৃহীত হয়। অনেকগুলো প্রস্তাবের সঙ্গে দুই একটি রাজনৈতিক দলের ভিন্নমত পোষণ করায় অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগ্রহণ করা সম্ভব হয়নি।
নির্বাচন প্রসঙ্গে কথা বলতে গিয়ে জামায়াতের নায়েবে আমির বলেন, অধিকাংশ রাজনৈতিকদল, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, কলামিস্ট, লেখক, গবেষক, শিক্ষাবিদসহ নানা শ্রেণির মানুষ পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচনের পক্ষে একমত পোষণ করেছেন। কিন্তু জনদাবি কার্যকরে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে না। তাই জনদাবি আদায়ের লক্ষ্যে গণআন্দোলনের কোনো বিকল্প নেই।
পিআরসহ ৫ দাবিতে যুগপৎ কর্মসূচি ঘোষণা ইসলামী আন্দোলন : নির্বাচনের আগে জুলাই সনদের পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন, জাতীয় পার্টি ও ১৪ দলের রাজনীতি নিষিদ্ধ করা, নির্বাচনী লেভেল প্লেইং ফিল্ড নিশ্চিত করা, জুলাই গণহত্যার বিচার এবং পিআরের দাবিতে যুগপৎ আন্দোলনে নামছে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ।
এ প্রসঙ্গে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মাদ রেজাউল করীম বলেন, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের মূল উদ্দেশ্য ছিল দেশের মৌলিক সংস্কার নিশ্চিত করা, কিন্তু সেই লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হয়ে কেবল নির্বাচনের দিকে মনোযোগ দেওয়া হচ্ছে। এটি দেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতিকে আবারও পুরোনো অশুভ চক্রে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারে।
চরমোনাই পীর তার বক্তব্যে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পেছনের মূল উদ্দেশ্যগুলো তুলে ধরে বলেন, জুলাইয়ের আন্দোলন শুধু ক্ষমতার পালাবদলের জন্য ছিল না, বরং তা ছিল দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির শুদ্ধতা, রাষ্ট্রের ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা এবং সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে স্বাধীন করার জন্য।
তিনি আরও বলেন, বিগত ১৪ মাসেও জুলাই সনদ চূড়ান্ত না হওয়ায় এবং আইনি সংস্কারে বাধা আসার কারণে আমরা হতাশ। নির্বাচনের পর সংস্কারের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়িত হওয়ার আশা খুবই কম। তাই নির্বাচনের আগেই সংস্কারের আইনিভিত্তি নিশ্চিত করা জরুরি। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত ধারাবাহিক আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন চরমোনাই পীর। তিনি জানান, কর্মসূচিগুলো ধীরে ধীরে আরও কঠোর হবে।
নেজামে ইসলাম পার্টি : নেজামে ইসলাম পার্টির মহাসচিব মাওলানা মুসা বিন ইজহার জানান জুলাই সনদের আইনিভিত্তি, গণহত্যা ও দুর্নীতিবাজদের বিচার এবং ফ্যাসিবাদের দোসর ও জাতীয় পার্টি নিষিদ্ধের দাবিতে ঐক্যমত।
পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচনসহ ৬ দফা দাবি : জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি, সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে (পিআর) নির্বাচনসহ দেশের চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে ছয় দফা দাবি জানিয়েছে খেলাফত মজলিস।
দলটির মহাসচিব আহমদ আবদুল কাদের বলেন, অবিলম্বে জুলাই জাতীয় সনদ ঘোষণা করা ও এর আইনিভিত্তি দেওয়া, ঘোষিত জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫-এর ভিত্তিতেই ফেব্রুয়ারি ২০২৬-এর জাতীয় নির্বাচন আয়োজন করা, পিআর (সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব) পদ্ধতিতে জাতীয় সংসদের উচ্চকক্ষের সদস্য নির্বাচন করা, আওয়ামী ফ্যাসিবাদ ও তার দোসরদের অপরাধের বিচার দৃশ্যমান করা, আওয়ামী ফ্যাসিবাদের সব দোসরের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড স্থগিত ও নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করা, নির্বাচনে সবার জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করা, অবৈধ অস্ত্র, পেশিশক্তি, কালোটাকার প্রভাবমুক্ত সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া এবং দেশের সকল প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গানের শিক্ষক নিয়োগের প্রজ্ঞাপন অবিলম্বে বাতিল করে ধর্মীয় শিক্ষক নিয়োগের কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া। জুলাই জাতীয় সনদের আইনিভিত্তি প্রদানের জন্য দুটি প্রস্তাব তুলে ধরা হয় সংবাদ সম্মেলনে।
এর মধ্যে জুলাই জাতীয় সনদ-২০২৫ স্বাক্ষরের পর দুই মাসের মধ্যে গণভোটের মাধ্যমে জুলাই সনদকে সাংবিধানিক ও আইনি মর্যাদা বা বৈধতা প্রদান করা; অথবা জুলাই সনদে রাষ্ট্রীয় পলিসি বা ব্যবস্থাপনাসংক্রান্ত বিষয়গুলো অর্ডিন্যান্স বা নির্বাহী আদেশে বাস্তবায়ন করা। আর সংবিধান সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো রাষ্ট্রপতির প্রোক্লেমেশন তথা সাংবিধানিক ঘোষণার মাধ্যমে আশু কার্যকর করা। তবে শর্ত হচ্ছে আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশনে কোনো পরিবর্তন-পরিবর্ধন ছাড়াই সেগুলো রেটিফাই (আনুষ্ঠানিক অনুমোদন) করতে সংসদ সদস্যগণ বাধ্য থাকবেন- এ মর্মে সকল দল ও পক্ষের কাছ থেকে লিখিত প্রতিশ্রুতি গ্রহণ করা।
এসব দাবি আদায়ে ১৮ সেপ্টেম্বর ঢাকায় বিক্ষোভ মিছিল, ১৯ সেপ্টেম্বর দেশের সব মহানগরীতে বিক্ষোভ মিছিল এবং ২৬ সেপ্টেম্বর জেলা-উপজেলায় বিক্ষোভ মিছিল কর্মসূচি ঘোষণা করেছে খেলাফত মজলিস। খেলাফত মজলিসের মহাসচিব আহমদ আবদুল কাদের বলেন, ‘সরকার জুলাই জাতীয় সনদের আইনিভিত্তি প্রদানের সুস্পষ্ট উদ্যোগ না নিলে পরবর্তীতে বৃহত্তর কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে।’
তিনি জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের আকাক্সক্ষা পূরণ ও নতুন বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় সংস্কারের জন্য ঘোষিত শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি বাস্তবায়নে দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানান। দাবি পূরণে খেলাফত মজলিস মাঠে থাকবে উল্লেখ করে মহাসচিব বলেন, দেশের ৯০ শতাংশ মানুষ পিআর পদ্ধতির পক্ষে। সে জন্য তারা এ দাবি করছেন। তবে নতুন এই দাবি ও কর্মসূচি পূরণে সম্মিলিত কোনো কর্মসূচি হবে কি না বা অন্য কোনো দল যুক্ত হবে কি না, সে বিষয়ে খোলাসা করে কিছু বলেননি আহমদ আবদুল কাদের।
বিএনপির নেতারা বলছেন, বিএনপি পিআর পদ্ধতিতে ভোটের প্রস্তাবকে আমলেই নিতে রাজি নয়। বিষয়টি চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হলে রাজনৈতিকভাবে তা মোকাবিলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে দলটি।
নির্বাচন বাধাগ্রস্ত হলে রিজিওনাল সিকিউরিটির জন্য থ্রেট হতে পারে : বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, সংস্কার, বিচার এবং নির্বাচন কোনোভাবেই একটা আরেকটি ওপর সম্পর্কিত নয়। সংস্কার সংস্কারের মতো চলবে, এটা কন্টিনিউ প্রসেস। বিচারেও টাইম লিমিট করা যায় না, তাতে অবিচার হবে তাহলে। সেটা চলবে, যে সরকারই আসুক, কিন্তু নির্বাচনকে এটা কন্ডিশনাল করা যাবে না। নির্ধারিত টাইমলাইনে নির্বাচন হতেই হবে।
সালাউদ্দিন আহমেদ বলেন, আরও অনেকগুলো বিষয়ে সংস্কারের প্রয়োজন আছে, যেগুলো হয়ত আপনারা সময়ের অভাবে ট্রেস করতে পারেননি। সেগুলো জাতিকে সামনে ট্রেস করতে হবে। এখানে ১৯টি মৌলিক বিষয় চিহ্নিত করা হয়েছে। বাস্তবে মৌলিক বিষয় আরও অনেক আছে। আমরা ৮২৬টি ছোট-বড় সংস্কার প্রস্তাব পেয়েছি। এগুলো দলে আলোচনা করে লিখিত মতামত দিয়েছি। মাত্র ৫১টি প্রস্তাবে আমরা দ্বিমত করেছি, ১১৫টি প্রস্তাবে আমাদের মতামতসহ ভিন্নমত দিয়ে গ্রহণের পরামর্শ দিয়েছি। এ বিষয়ে চূড়ান্ত ঐকমত্য হয়েছে প্রায়। মৌলিকগুলো নিয়ে ৮৪৫টি সংস্কার প্রস্তাব হয়। তিনি বলেন, দুই দিন পরে টিকবে না, চ্যালেঞ্জ হয়ে যেতে পারে কোথাও এমন কোনো বিষয় আমরা রেখে যেতে চাই না। আমরা যেসব বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছি, তা বাস্তবায়ন হচ্ছে এবং হয়ে যাবে। প্রসিডিউলের জন্য বাস্তবায়নে একটু সময় লাগে।
এখন ১৯টি সাংবিধানিক ইস্যু বাকি থাকার কথা তুলে ধরে সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, এর মধ্যে কিছু কিছু বিষয়ে ‘নোট অব ডিসেন্টসহ আমরা একমত হয়েছি। আমাদের বিবেচনায় ৭০ অনুচ্ছেদের ৪টি বিষয়ে এমপিদের স্বাধীনতা না থাকলে ভালো হয়। সর্বনিম্ন দুটি বিষয়ে সবাই একমত হয়েছে। নোট অব ডিসেন্টের ভাষা উল্লেখ করে সনদ তৈরি হচ্ছে এবং সেভাবে আমরা স্বাক্ষর করবো। যারা জনগণের ম্যান্ডেট পাবে তারা তাদের নোট অব ডিসেন্ট রক্ষা করে বাস্তবায়ন করবে। এটি কোনো জটিল বিষয় নয়।
দুই তিনটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছাড়া বাকিগুলো খুবই সাধারণ বিষয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, এগুলো বাস্তবায়ন খুব সহজ। কিন্তু ফোরাম কোনটা? সাংবিধানিক বিষয়গুলো পরবর্তী সংসদ ছাড়া অন্য কোনো ফোরাম করতে পারে কিনা? এ ব্যাপারে আইনি পরামর্শ দিতে পারে সুপ্রিম কোর্ট। আমরা সেখানে যেতে পারি এবং সহায়তা নিতে পারি। এর বাইরে কিছু থাকলে জানান, আমরা একমত। আমরা সনদে স্বাক্ষর করতে প্রস্তুত আছি, তা আগেও বলেছি।
জুলাই সনদ বাস্তবায়ন জটিল হচ্ছে : বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, জুলাই সনদ বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায় এসে এটি আরও জটিল পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, জাতির কাছে এমন কোনো নিদর্শন রেখে যেতে চাই না, যেটা দুদিন পরে টিকবে না বা চ্যালেঞ্জ হতে পারে।
ফ্যাসিবাদবিরোধী জাতীয় ঐক্য ধরে রাখা এবং শক্তিতে রূপান্তরিত করতে আরও বেশি নেগোশিয়েট করার কথা তুলে ধরে সালাহউদ্দিন বলেন, আমরা কম্প্রোমাইজ করবো। আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে কোনো পন্থা বের করতে পারলে তাতে একমত হবো। প্রস্তত করা চূড়ান্ত জুলাই সনদে ক্লারিক্যাল মিসটেক এবং কিছুটা বিভ্রান্তি আছে। এটা আমরা কারেকশন করে দেব, এটা মেজর কিছু নয়। তবে এটি জাতীয় দলিল, রাজনৈতিক সমঝোতার দলিল, ঐতিহাসিক দলিল হবে, সে জন্য এটা নির্ভুল হওয়া বাঞ্ছনীয়। যেসব বিষয়গুলো আলোচিত হয়নি, সেগুলো এতে অন্তর্ভুক্ত করা ঠিক হবে না। বিতর্ক যত কম
করা যায়।
শেষ সময়ে এসে সনদের আইনত ভিত্তি দেওয়া না হলে স্বাক্ষর না করা নিয়ে কয়েকটি দলের অবস্থানের বিষয় তুলে ধরে তিনি বলেন, আমরা বলেছি, আইনিভিত্তি নিয়ে আলোচনা হলে তাতে আমরা অংশ নেবো। সেই আলোচনা শুরু হয়েছে। তার আগে কমিশন বিশেষজ্ঞদের মতামত নিয়েছে। সেখান থেকে অঙ্গীকারনামার যে ড্রাফট দেওয়া হয়েছে, তাতে আমরা লিখিত মতামত দিয়েছি। যেসব বিষয় পরে টিকবে না, সেগুলো এতে উত্থাপন করা ঠিক হবে না।
সালাহউদ্দিন বলেন, কোনো আদালতে প্রশ্ন তোলা যাবে না, তেমন কোনো দলিল হতে পারে না, সংবিধানের ওপর সনদকে স্থান দেওয়া গ্রহণযোগ্য নয়। এর বাইরেও অনেক পন্থা থাকতে পারে যাতে আমরা এটার বৈধতা দিতে, আইনিভিত্তি দিতে পারি। আপিল বিভাগের পরামর্শ নিতে পারি আমরা, এটা এক্সট্রা কনিস্টিটিউশনাল অর্ডার বা স্পেশাল কনিস্টিটিউশনাল অর্ডার করা যায় কিনা। তাহলে ভবিষ্যতে জুডিশিয়ালিতে এটা চ্যালেঞ্জ করলেও বলতে পারবে আমরা মতামত নিয়েছিলাম। এখন সেই পরামর্শ আপনারা দিতে পারেন, নাও পারেন।
তিনি বলেন, স্পেশাল কনিস্টিটিউশনাল অর্ডারে আপনি (প্রধান উপদেষ্টা) করলেন। আমরা কেউ কিছু বললাম না। ঐকমত্য কমিশন থেকে আমরা আপনাকে দায়িত্ব দিলাম, সনদ বাস্তবায়নের ব্যাপারে আপনি সিদ্ধান্ত দেন। তারপর আপনি করলেন। কিন্তু যেকোনো একজন নাগরিক যদি এটা নিয়ে চ্যালেঞ্জ করে কোথাও যায়, সেটা আপনার গ্লোবাল রিপোটেশন নিয়ে প্রশ্ন তুলবে। আমরা অনেক আলোচনা করেছি, সেখান থেকে আপনি কোনো মতামত নিতে পারে। সেই স্বাধীনতা আপনার আছে।
গত ১৫ বছরে আওয়ামী আমলে বিএনপি সবচেয়ে বেশি অবিচারের শিকার হয়েছে উল্লেখ করে সালাহউদ্দিন বলেন, আমরা গুম-হত্যা-নির্যাতনের শিকার হয়েছি। বিচার চলবে, এটা আমাদের কমিটমেন্ট, জাতির কমিটমেন্ট। কিন্তু নির্বাচনকে এটা কন্ডিশনাল করা যাবে না। আর যদি ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে দেশে নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য যেকোনো করম একটা অনিশ্চিত পরিবেশ সৃষ্টি হয়, সেটা ফ্যাসিবাদ চেষ্টা করছে। আমরা যদি এমন কোনো কর্মকাণ্ড করি যে ফ্যাসিবাদী শক্তি সুযোগ পাবে, আস্কারা পাবে সেটা আমাদের জাতীয় জীবনের জন্য অনেকে বলছেন, এটা জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি হবে।
জনগণের ম্যান্ডেট না নিয়ে রাজপথে কর্মসূচি দিলে গণতন্ত্র বাধাগ্রস্ত হবে : বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেছেন, জনগণের ম্যান্ডেট না নিয়ে রাজপথে কোনো কর্মসূচি দিলে গণতন্ত্র বাধাগ্রস্ত হবে। যার যে দাবি তা নির্বাচিত হয়ে পূরণ করার আহ্বান জানান তিনি।
আমীর খসরু বলেন, গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনায় যত দেরি হবে দেশ তত বিপদগ্রস্ত হবে। রাজপথের পর্ব শেষ হয়েছে। জনগণের মালিকানা ফেরানোর সময় এখন। অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে দ্রুত নির্বাচন না হলে দেশে বিভক্তি ও গৃহযুদ্ধের শঙ্কা থাকে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
অন্যান্য দল : নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, নির্বাচন সামনে রেখে এখন নিম্নকক্ষে পিআর করার সময় পাওয়া যাবে না। সময়ের বিবেচনায় আমরা এখন নিম্নকক্ষে পিআর চাই না। কারণ, এখানে ঐকমত্য হওয়ারও ব্যাপার রয়েছে। কিন্তু উচ্চকক্ষে পিআর চাই।
বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, আমাদের দেশের মানুষ সামগ্রিকভাবে সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত নয়। এবার উচ্চকক্ষে সেটা শুরু করলে পরবর্তীকালে আমরা অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে নিম্নকক্ষেও সিদ্ধান্ত নিতে পারব।
গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি বলেন, পিআর পদ্ধতি এখন পর্যন্ত আলোচনার বিষয় নয়, কোনো কোনো দলের রাজনৈতিক দাবি। এখন উচ্চকক্ষে পিআরের প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। এর পক্ষে আমরা অবস্থান নিয়েছি।
ভোরের আকাশ/এসএইচ