নারায়ণগঞ্জ প্রতিনিধি
প্রকাশ : ১৭ অক্টোবর ২০২৫ ০২:০০ এএম
ছবি সংগ্রহীত
নারায়ণগঞ্জে সরকারি স্বাস্থ্যসেবায় যুক্ত হলো নতুন অধ্যায়। দীর্ঘদিনের জটিলতা, অভাব ও ফাইলবন্দি প্রস্তাবের সংস্কৃতিতে গা না ভাসিয়ে বাস্তব পরিবর্তনের দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন জেলা প্রশাসক (ডিসি) মোহাম্মদ জাহিদুল ইসলাম মিঞা।
বৃহস্পতিবার (১৬ অক্টোবর) “গ্রীন অ্যান্ড ক্লিন নারায়ণগঞ্জ” কর্মসূচির আওতায় জেলা পরিষদের অর্থায়নে নারায়ণগঞ্জ জেনারেল (ভিক্টোরিয়া) হাসপাতালে হস্তান্তর করা হলো দুটি অত্যাধুনিক চিকিৎসা যন্ত্র। একটি ব্লাড সেল কাউন্টার (সিবিসি মেশিন) এবং একটি পোর্টেবল ইসিজি মেশিন।
এই উদ্যোগে জেলার সবচেয়ে প্রাচীন (৮৭ বছরের) সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসা ব্যবস্থায় ঘটেছে বড় ধরনের উন্নয়ন। দীর্ঘদিন ধরে হাসপাতালটিতে রক্ত পরীক্ষা করা হতো পুরোপুরি হাতে-কলমে, অর্থাৎ ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে। এতে সময় লাগত বেশি, ভুলের আশঙ্কাও ছিল। তাছাড়া হার্টের রোগীদের জরুরি অবস্থায় ইসিজি পরীক্ষা করার মতো কোনো পোর্টেবল যন্ত্রও ছিল না। যা গুরুতর রোগীদের বেডেই দ্রুত সেবা দেওয়ার জন্য অত্যাবশ্যক।
জেলা প্রশাসক জাহিদুল ইসলাম সম্প্রতি হাসপাতালটি পরিদর্শনকালে এই ঘাটতির বিষয়টি জানতে পারেন এবং বিষয়টি দ্রুত মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব আকারে পাঠান। তার উদ্যোগ ও তদবিরে দ্রুত অনুমোদন আসে। পরে টেন্ডার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বিশ্বের স্বনামধন্য কোম্পানির তৈরি আধুনিক দুটি মেশিন সংগ্রহ করে জেলা পরিষদের মাধ্যমে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের হাতে তুলে দেওয়া হয়।
ভিক্টোরিয়া হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও) ডা. মো. জহিরুল ইসলাম জেলা প্রশাসকের এই উদ্যোগের প্রশংসা করে বলেন, “আগে আমাদের এখানে অটোমেটিক সিবিসি মেশিন ছিল না। এখন আমরা আরও দ্রুত ও নির্ভুলভাবে প্লাটিলেট কাউন্টসহ রক্তের অন্যান্য উপাদান পরীক্ষা করতে পারব। এতে ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসা অনেক উন্নত হবে। আর পোর্টেবল ইসিজি মেশিনের কারণে এখন সরাসরি রোগীর বেডের কাছেই পরীক্ষা করা সম্ভব হবে, যা রোগী ও চিকিৎসক উভয়ের জন্যই বড় সুবিধা।”
জেলার সিভিল সার্জন ডা. এ এফ এম মুশিউর রহমান বলেন, ভিক্টোরিয়া হাসপাতাল ১০০ শয্যার হলেও প্রতিদিন গড়ে কয়েক শ রোগী এখানে ভর্তি থাকেন। আমরা কাউকে ফিরিয়ে দিই না। এই নতুন মেশিনগুলো আমাদের সক্ষমতা ও চিকিৎসা মান দুই-ই বাড়িয়ে দেবে। জেলা প্রশাসক শুধু স্বাস্থ্য নয়, জেলার প্রতিটি খাতেই মনোযোগীভাবে কাজ করছেন এটাই একজন প্রকৃত জনবান্ধব প্রশাসকের পরিচয়।
স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. হারুন অর রশিদ জানান, হাসপাতালের পুরনো একটি পরিত্যক্ত ভবন ইতিমধ্যেই অপসারণ করা হয়েছে এবং নতুন ভবনের প্রস্তাব মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। তবে ভবন নির্মাণে সময় লাগবে অন্তত দুই বছর। এ সময়ের মধ্যে ডেঙ্গুর ঝুঁকি ও পরিবেশ দূষণ এড়াতে জেলা প্রশাসক ‘গ্রীন অ্যান্ড ক্লিন’ কর্মসূচির আওতায় হাসপাতালের খালি জায়গায় বাগান তৈরি করে দিয়েছেন।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে জেলা পরিষদের প্রশাসক ও জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ জাহিদুল ইসলাম মিঞা বলেন, নারায়ণগঞ্জ জেলার কোটি মানুষের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা আমাদের দায়িত্ব। সরকারি হাসপাতালগুলোর প্রতি মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনতে হলে সেবার মান উন্নয়ন অপরিহার্য। ভিক্টোরিয়া হাসপাতালে প্রতি মাসে লক্ষাধিক রোগী চিকিৎসা নিতে আসেন তাদের সেবা মান উন্নত করাই এখন মূল লক্ষ্য।
তিনি আরও বলেন, আগামী রবিবার (১৯ অক্টোবর) থেকে মেশিনগুলো পূর্ণাঙ্গভাবে চালু হবে। আমাদের লক্ষ্য হলো সরকারি চিকিৎসা ব্যবস্থায় আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়িয়ে সাধারণ মানুষকে মানসম্মত সেবা দেওয়া। সরকারি হাসপাতালেও মানুষ যেন নিরাপদ, নির্ভরযোগ্য ও আন্তরিক চিকিৎসা পায়, সেটিই নিশ্চিত করতে চাই।
ডিসি জাহিদুল ইসলাম উপস্থিত চিকিৎসক ও নার্সদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, সরকারের সব উন্নয়নমূলক পদক্ষেপ তখনই সফল হবে, যখন আপনাদের সেবার মানসিকতা থাকবে। রোগীর প্রতি মনোযোগ, আন্তরিকতা ও সহানুভূতিই একজন চিকিৎসকের আসল পরিচয়।
অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন জেলা সিভিল সার্জন ডা. আবুল ফজল মুহাম্মদ মুশিউর রহমান। উপস্থিত ছিলেন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক নাঈমা ইসলাম, সহকারী কমিশনার মো. তারিকুল ইসলাম, এলজিইডি নির্বাহী প্রকৌশলী মো. হারুন অর রশিদ, হাসপাতালের চিকিৎসক, নার্স ও স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ।
সবশেষে জেলা প্রশাসক বলেন, আমরা চাই নারায়ণগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালটি একদিন ‘মডেল সরকারি হাসপাতাল’ হিসেবে পরিচিত হোক। এটি কেবল যন্ত্র হস্তান্তরের অনুষ্ঠান নয়—এটি সরকারি স্বাস্থ্যসেবার প্রতি আমাদের দায়বদ্ধতার প্রতীক।
এই উদ্যোগকে অনেকেই নারায়ণগঞ্জে সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় বাস্তব পরিবর্তনের সূচনা হিসেবে দেখছেন।
ভোরের আকাশ//হ.র