আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশ : ২৪ জুলাই ২০২৫ ০৪:১৫ এএম
ব্রহ্মপুত্রে চীনের মেগা-বাঁধ: উদ্বেগে বাংলাদেশ ও ভারত
তিব্বতের হিমালয় পাদদেশে বিশ্বের সবচেয়ে বড় জলবিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণ শুরু করেছে চীন। বিশাল এ প্রকল্পে ব্যয় হবে প্রায় ১৭০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। নির্মাণ শেষে এটি যুক্তরাজ্যের বার্ষিক বিদ্যুৎ চাহিদার সমপরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে সক্ষম হবে বলে দাবি করছে বেইজিং।
চীনের বর্তমান বৃহত্তম জলবিদ্যুৎ প্রকল্প থ্রি গর্জেস বাঁধকেও ছাড়িয়ে যাবে নতুন এই প্রকল্প। সম্প্রতি দেশটির প্রধানমন্ত্রী লি কিয়াং বাঁধটির নির্মাণ কাজ উদ্বোধনের ঘোষণা দিলে চীনের নির্মাণ ও প্রকৌশল খাতে শেয়ারের দর ঊর্ধ্বমুখী হয়।
বেইজিংয়ের দৃষ্টিতে প্রকল্পটি পরিচ্ছন্ন জ্বালানি, কর্মসংস্থান এবং স্থবির অর্থনীতিকে গতিশীল করার প্রতিশ্রুতি বহন করছে। তবে ভাটির দেশ ভারত ও বাংলাদেশের জন্য এটি পানি নিরাপত্তা নিয়ে নতুন করে উদ্বেগের জন্ম দিচ্ছে।
বাঁধটি নির্মাণ হচ্ছে তিব্বতের ইয়ারলুং জাংবো নদীতে, যা ভারতীয় ভূখণ্ডে ব্রহ্মপুত্র নামে প্রবেশ করে এবং বাংলাদেশেও একই নামে প্রবাহিত হয়। দুই দেশের কোটি মানুষের জীবন-জীবিকা এ নদীর উপর নির্ভরশীল।
চীনের পরিকল্পনায় রয়েছে ৫০ কিলোমিটার দীর্ঘ নদীখাতে পাঁচটি পৃথক বাঁধ নির্মাণের পরিকল্পনা। যেখানে নদীটি প্রায় ২ হাজার মিটার উচ্চতা থেকে নিচে নেমে আসে। ২০৩০-এর দশকের শুরুর দিকেই প্রকল্পটির প্রথম ধাপে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
তবে চীন এখন পর্যন্ত প্রকল্পের সম্ভাব্য সময়সীমা ও খরচ ছাড়া সুনির্দিষ্ট প্রযুক্তিগত পরিকল্পনা প্রকাশ করেনি।
তথ্যের স্বচ্ছতার অভাব প্রকল্পটি নিয়ে ভারত ও বাংলাদেশের উদ্বেগ বাড়িয়ে তুলছে। কারণ, সেচ, জলবিদ্যুৎ ও পানীয় জলের জন্য ব্রহ্মপুত্র নদ দু’টি দেশেরই গুরুত্বপূর্ণ জীবনরেখা।
চলতি বছরের শুরুতে ভারতীয় রাজ্য অরুণাচল প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী আশঙ্কা প্রকাশ করে জানান, বাঁধটি নির্মাণের ফলে রাজ্য দিয়ে প্রবাহিত নদীর ৮০ শতাংশ পানি শুকিয়ে যেতে পারে। পাশাপাশি ভাটির আসামসহ আশপাশের এলাকায় প্লাবনের ঝুঁকিও বাড়বে।
কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মাইকেল স্টেকলার বলেন, শুধু পানি নয়, এই বাঁধ নদীর সঙ্গে আসা পলিমাটির প্রবাহও কমিয়ে দেবে, যা কৃষির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পুষ্টি উপাদান সরবরাহ করে।
বিশেষজ্ঞ সায়নাংশু মোদক মনে করেন, চীনের স্বচ্ছতার অভাব ও অতীত সীমান্ত বিরোধ নতুন করে সংঘাতের আশঙ্কা তৈরি করছে। তাঁর মতে, এমন পরিস্থিতিতে চীন ভবিষ্যতে ইচ্ছাকৃতভাবে পানিপ্রবাহ বন্ধ করতে পারে বলেও উদ্বেগ রয়েছে।
চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অবশ্য জানিয়েছে, ইয়ারলুং জাংবো নদীতে নির্মিত এই প্রকল্প দেশটির সার্বভৌম অধিকারের আওতাভুক্ত। তারা দাবি করছে, প্রকল্পটি পরিচ্ছন্ন জ্বালানি উৎপাদন ও বন্যা প্রতিরোধে ভূমিকা রাখবে।
যদিও ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে এখনো আনুষ্ঠানিক মন্তব্য করেনি, তবুও দেশটি ব্রহ্মপুত্র নদের ওপর নিজস্ব দুটি জলবিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণের পরিকল্পনা করেছে। এর মধ্যে একটি অরুণাচল প্রদেশে, যার সম্ভাব্য উৎপাদন ক্ষমতা ১১.৫ গিগাওয়াট। এটি বাস্তবায়িত হলে হবে ভারতের বৃহত্তম জলবিদ্যুৎ প্রকল্প।
সায়নাংশু মোদক বলেন, ভারত এভাবে নিজের দাবি মজবুত করতে চাইছে, যাতে চীন পানিপ্রবাহ ঘোরানোর চেষ্টা করলে ভারত বলতে পারে—“আমরা এই পানি ব্যবহার করছি”। এতে করে চীন একতরফাভাবে নদীর দিক পরিবর্তন করতে পারবে না।
বাঁধটি নির্মিত হচ্ছে একটি ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চলে, যেখানে ভূমিধস, হিমবাহ সৃষ্ট বন্যা এবং বৈরী আবহাওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। চলতি বছরের শুরুতে তিব্বতে বড় ধরনের ভূমিকম্পের পর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই ধরনের মেগা প্রকল্প সেখানে নিরাপত্তাজনিত ঝুঁকি সৃষ্টি করতে পারে।
তাছাড়া বাঁধটির কাছাকাছি এলাকায় চীন আরেকটি ছোট জলবিদ্যুৎ প্রকল্পও নির্মাণ করছে, যেটি উচ্চতা ও আবহাওয়া জনিত চ্যালেঞ্জের কারণে বছরে মাত্র চার মাস কাজের উপযোগী।
বাঁধ ও পানিসম্পদ নিয়ে আঞ্চলিক বিরোধ নতুন কিছু নয়। পাকিস্তান যেমন ভারতের বিরুদ্ধে সিন্ধু চুক্তি স্থগিত করে পানিকে রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহারের অভিযোগ এনেছে, তেমনি অতীতে মিসর-ইথিওপিয়ার মধ্যেও নীলনদের বাঁধ ঘিরে দীর্ঘ বিরোধের সৃষ্টি হয়েছিল।
এই প্রেক্ষাপটে চীনের ব্রহ্মপুত্রে বাঁধ নির্মাণ শুধু পরিবেশগত নয়, রাজনৈতিক ও কৌশলগতভাবেও দক্ষিণ এশিয়ার জন্য গুরুত্বপূর্ণ এক ইস্যু হয়ে উঠেছে।
সূত্র: রয়টার্স
ভোরের আকাশ//হ.র