রাষ্ট্রীয় শোক পালিত
মাহমুদ সালেহীন খান
প্রকাশ : ২১ ডিসেম্বর ২০২৫ ১২:০২ এএম
গতকাল রাজধানীর মানিক মিয়া এভিনিউতে ওসমান হাদির জানাযায় লাখ জনআর ঢল
কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবরের পাশে সমাহিত করা হয়েছে ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক শরীফ ওসমান হাদিকে। গতকাল ৪টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে জাতীয় কবির সমাধিসৌধে তাকে দাফন করা হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়াজ আহমদ খান বলেন, ‘শহীদ শরিফ ওসমান হাদি ইতিহাসের অংশ হয়ে গেছে। দেশের জন্য তার যে ত্যাগ আল্লাহ তাআলা কবুল করুক। তার পরিবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্প্রসারিত পরিবারের অংশ। আমরা চূড়ান্তভাবে সম্মান জানাতে আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের পাশে তাকে কবরস্থ করা হয়েছে। আমরা মনে করি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তার সন্তানকে বুকে নিয়েছে। মা তার ছেলেকে বা বিশ্ববিদ্যালয় তাকে গ্রহণ করেছে।’
এর আগে দুপুর আড়াইটায় জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় হাজার হাজার মানুষের অংশগ্রহণে তার জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। তার কফিন কবি নজরুলের সমাধিসৌধে পৌঁছায় বিকাল পৌনে ৩টায়। দাফনের সময় অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর সহযোগী অধ্যাপক সাইফুদ্দিন আহমদ, কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী, জাতীয় নাগরিক পার্টির আখতার হোসেন, হাসনাত আবদুল্লাহ, নাসির উদ্দিন পাটওয়ারী এবং হাদির পরিবারের সদস্যরা।
দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে সরেজমিন দেখা যায়, ছোট-বড় মিছিল নিয়ে মানুষ মানিক মিয়া অ্যাভিনিউতে প্রবেশ করছে। অনেকের মাথায় জাতীয় পতাকা বাঁধা, কেউ আবার পতাকা গায়ে জড়িয়ে এসেছেন।
জানাজায় অংশ নিতে আসা আনোয়ার হোসেন বলেন, ওসমান হাদিকে দল-মত নির্বিশেষে সব শ্রেণিপেশার মানুষ ভালোবাসত। তার দেশপ্রেম আমাদের অনুপ্রাণিত করেছে। আমার কাছে মনে হয়েছে, আমার আপন ভাই মারা গেছেন। তাই হোটেল মালিকের কাজ থেকে ছুটি নিয়ে জানাজায় এসেছি।
শাহজালাল নামের আরেকজন বলেন, ‘হাদি আমার ভাই। তার এমন মৃত্যু আমরা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছি না। আমার পরিবারের সবাই তার মৃত্যুতে কান্না করেছে। আল্লাহর কাছে দোয়া করি, তিনি যেন তাকে জান্নাত নসিব করেন।
হত্যাকাণ্ডের বিচার প্রকাশ্যে করার দাবি জানিয়েছেন তার বড় ভাই আবু বকর সিদ্দিক। তিনি বলেন, আমার ভাই শরিফ ওসমান হাদির বিচার যেন প্রকাশ্যে এই বাংলার জমিনে আমরা দেখতে পারি। জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় হাদির জানাজার আগে তিনি এই দাবি জানান। জানাজার ইমামতি করেন হাদির বড় ভাই আবু বকর সিদ্দিক নিজেই।
আবু বকর সিদ্দিক বলেন, আজ লক্ষ লক্ষ তৌহিদি জনতা হাজির হয়েছেন ওসমান হাদির জানাজার নামাজে অংশ নিতে। তিনি স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য বাংলাদেশের মানুষের কাছে একটি বার্তা দিয়ে গেছেন। হাদির একটি সন্তান রয়েছে, যার বয়স মাত্র আট মাস। সন্তান জন্মের পর সে আমাকে বলেছিল, এমন একটি নাম রাখতে, যার মধ্যে বিপ্লবী চেতনা ও সাহসিকতার পরিচয় থাকবে। অনেক যাচাই-বাছাই করে আমি তার সন্তানের নাম রাখি ‘ফিরনাস’একটি বিপ্লবী ও সাহসী নাম।
তিনি আরও বলেন, আজ তার সন্তানের চেহারার দিকে তাকানো যায় না। আজ আমার মা পাগলপ্রায়। আমরা ছয় ভাইবোনের মধ্যে সবচেয়ে ছোট ছিল শরিফ ওসমান হাদি।
আবু বকর সিদ্দিক বলেন, আজ আপনাদের কাছে আমার একটাই দাবি। রাজধানী ঢাকায় প্রকাশ্যে জুমার নামাজের পর খুনিরা গুলি করে পালিয়ে যায়-সাত থেকে আট দিন পেরিয়ে গেলেও যদি তারা পার পেয়ে যায়, এর চেয়ে লজ্জার কিছু জাতির জন্য আর হতে পারে না। যদি তারা পাঁচ থেকে সাত ঘণ্টার মধ্যে সীমান্ত পেরিয়ে যেতে পারে, তাহলে তারা কীভাবে গেল- এই প্রশ্ন জাতির কাছে রেখে গেলাম। আমার কোনো চাওয়া-পাওয়া নেই।
তিনি বলেন, আমার ভাই ওসমান হাদি শহীদ হয়েছে। শহীদ হওয়ার আকাক্সক্ষা সে সব সময়ই প্রকাশ করত। আপনারা তার বক্তব্য শুনেছেন। হয়তো আল্লাহ তাআলা তাকে সেই শহীদি মর্যাদা দান করেছেন। কিন্তু এই ঋণ আমি কখনো ছাড়ব না। আমার ভাই শরিফ ওসমান হাদির বিচার যেন প্রকাশ্যে এই বাংলার জমিনে আমরা দেখতে পারি। সাত দিন হয়ে গেল, এখনো আমরা কিছুই করতে পারিনি-এই দুঃখে কলিজা ছিঁড়ে যাচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, আমরা ওসমান হাদির জন্য দোয়া করি, তার স্ত্রী ও সন্তানের জন্য দোয়া করি। তার সন্তান যখন বাবাকে দেখার জন্য কোলে আনা হয়, তখন মনে হয়Ñ সে আর কোনো দিন জানবে না তার বাবা কেমন ছিলেন। ওসমান হাদি আর ফিরে আসবে না। ওসমান, তুমি দেখে যাওÑ লক্ষ লক্ষ জনতা আজ তোমার জন্য পাগল। তুমি আমাদের সবাইকে পাগল বানিয়ে দিয়ে গেছ।
আবু বকর সিদ্দিক বলেন, আমরা আল্লাহর কাছে দোয়া করি-আল্লাহ যেন আমার ভাই শহীদ ওসমান হাদিকে জান্নাতুল ফেরদৌসের মেহমান হিসেবে কবুল করেন। আমরা যারা বেঁচে আছি, তারা যেন ঈমান, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করে তৌহীদের বাংলাদেশ গড়ে তুলতে পারি- সেই তৌফিক আল্লাহ তাআলা আমাদের দান করুন।
তিনি আরও বলেন, আপনাদের সবার কাছে দোয়া চাই। আমার মেজ ভাই ওমর ফারুক ঘটনাস্থলে ছিল-তার জন্য দোয়া করবেন। আমার ছোট বোন মাসুমা মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছে, চিকিৎসকরা বলেছেন অবস্থা গুরুতর। আমাদের পরিবারের জন্য দোয়া করবেন। আমাদের আর কোনো চাওয়া-পাওয়া নেই। শরিফ ওসমান হাদি, তুমি বেঁচে থাকো মানুষের হৃদয়ে। আল্লাহ তাআলা তাকে জান্নাতের সর্বোচ্চ মাকাম নসিব করুন।
জানাজায় লাখো মানুষের অংশগ্রহণ : ওসমান হাদির জানাজায় অংশ নিতে সকাল থেকে মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে মানুষের ঢল নামে। ‘আমরা সবাই হাদি হবো, যুগে যুগে লড়ে যাবো’, ‘হাদি ভাইয়ের রক্ত বৃথা যেতে দেব না’- এমন স্লোগান দিয়ে সবাই মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়েয়ে প্রবেশ করেন। জানাজা উপলক্ষে মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ ও আশপাশে নেওয়া হয় বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা। সেনাবাহিনীর পাশাপাশি পুলিশ, র্যাব ও আনসার সদস্য মোতায়েন করা হয়। এছাড়া, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা টহল দেন। আড়াইটার পর জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় লাখো জনতার অংশগ্রহণে বড় ভাই আবু বকর সিদ্দিকের ইমামতিতে ওসমান হাদির জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। এসময় পুরো এলাকায় শোকাবহ পরিবেশের সৃষ্টি হয়। জানাজার নামাজ শেষে তাকে দাফনের জন্য নেওয়া হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়।
জানাজায় প্রধান উপদেষ্টা, উপদেষ্টা পরিষদ, তিন বাহিনীর প্রধান ও রাজনৈতিক নেতারা : জানাজায় প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস, উপদেষ্টা পরিষদ, তিন বাহিনীর প্রধান, জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমান, সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া মো. গোলাম পরওয়ার, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ, এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারাও উপস্থিত ছিলেন। জানাজাপূর্ব বক্তব্য রাখেন ইনকিলাব মঞ্চের সদস্য সচিব জাবের ও ধর্ম উপদেষ্টা ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন।
‘হাদি ভাই, আমাদের রেখে তুমি একা কোথায় চলে যাচ্ছো, আমাদেরও নিয়ে যাও, একা তো চলে যাওয়ার কথা না.... ও হাদি ভাই...!’ ওসমান হাদির মরদেহ লাশবাহী অ্যাম্বুলেন্স থেকে নামানোর সময় এভাবেই আহাজারি করছিলেন তার রাজনৈতিক কয়েকজন সহকর্মী। বিকাল ৩টার দিকে মরদেহ বহনকারী অ্যাম্বুলেন্সটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের পাশের কবরস্থানে এসে পৌঁছায়। তবে নিরাপত্তাজনিত কারণে শবযাত্রায় অংশ নেওয়া কাউকেই কবরস্থানের ভেতরে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি।
এদিকে হাদির লাশ কবরস্থানে ঢুকার মুহূর্তে ওসমান হাদির অসংখ্য সহকর্মীদেরও চোখে অশ্রু ঝরতে দেখা যায়। হাবিবুর রহমান নামে এক ঢাবি শিক্ষার্থী বলেন, হাদি ভাইয়ের সঙ্গে অসংখ্য দিন নির্বাচনী কাজ করা হয়েছে। হাদি ভাইয়ের স্মৃতিগুলো কোনোভাবেই ভুলা যাচ্ছে না। এইরকম হাদি আর কখনও ফিরে আসবে বলে মনে হয় না। হাদির লাশবাহী গাড়ি কবরস্থান এলাকায় ঊংলভা সময়ে অ্যাম্বুলেন্সের ছাদে করে আসতে দেখা গেছে জাতীয় নাগরিক পার্টির দক্ষিণাঞ্চলের সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহ, ডাকসুর ভিপি সাদিক কায়েম ও ইনকিলাব মঞ্চের সদস্য সচিব আবদুল্লাহ আল জাবেরকে। তারা মাইকের মাধ্যমে জনতাকে শৃঙ্খলা বজায় রাখার আহ্বান জানান এবং মরদেহ নিরাপদে গন্তব্যে পৌঁছাতে সহযোগিতা করার অনুরোধ করেন।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, অসংখ্য মানুষ গাড়ির সঙ্গে হেঁটে যেতে শুরু করলে একাধিকবার যান চলাচলে বিঘ্ন ঘটে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাও সক্রিয় ভূমিকা নেন। তবুও মানুষের ঢল থামেনি। ‘হাদি হাদি’ স্লোগানে পুরো এলাকা বারবার মুখর হয়ে ওঠে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে নেওয়ার পথে শাহবাগ ও আশপাশের এলাকায় সাময়িকভাবে যান চলাচল নিয়ন্ত্রণ করা হয়।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জানায়, জনসমাগমের কারণে অতিরিক্ত সতর্কতা নেওয়া হয়েছে যাতে কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটে। ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক ওসমান হাদির দাফনের পর সহযোদ্ধাদের শাহবাগে জড়ো হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন প্ল্যাটফর্মটির সদস্য সচিব আবদুল্লাহ আল জাবের। গতকাল দুপুরে জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় হাদির জানাজা পূর্ব বক্তব্যে তিনি বলেন, ‘আমরা এখানে কি কান্নার জন্য এসেছি? আমরা এখানে কিসের জন্য এসেছি? আমার ভাইয়ের রক্তের বদলা নেওয়ার জন্য আজকে আমরা এই জানাজায় দাঁড়িয়েছি।’
হাদির হত্যার বিচারের দাবিতে কোনো ধরনের সহিংসতার আহ্বানে সাড়া না দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে জাবের বলেন, ইনকিলাব মঞ্চ থেকে সব ধরনের সিদ্ধান্ত জানানো হবে। হাদির জানাজা ও দাফন শেষে সবাইকে শাহবাগে জড়ো হওয়ার আহ্বান জানান তিনি।
আক্রমণের এক সপ্তাহ পেরোলেও হাদির হামলাকারীকে গ্রেপ্তার করা হয়নি উল্লেখ করে জাবের বলেন, আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী ও প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী খোদা বখস চৌধুরীকে এক সপ্তাহর নেওয়া পদক্ষেপ জনগণকে জানাতে হবে।
এর আগে বক্তব্য দেন ধর্ম উপদেষ্টা আ ফ ম খালিদ হোসেন। তিনি হাদির জন্য সবার কাছে দোয়া চান। জাবেরের পর বক্তব্য দেন প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস।
তিনি বলেন, ‘প্রিয় ওসমান হাদি, তোমাকে আমরা বিদায় দিতে আসি নাই এখানে। তুমি আমাদের বুকের ভেতরে আছো। এবং চিরদিন, বাংলাদেশ যতদিন আছে, তুমি সকল বাংলাদেশির বুকের মধ্যে থাকবে। এটা কেউ সরাতে পারবে না।’
ভোরের আকাশ/এসএইচ