‘শাপলা’ পাচ্ছে না
মাহমুদ সালেহীন খান
প্রকাশ : ১৫ অক্টোবর ২০২৫ ১২:৩২ এএম
ছবি: সংগৃহীত
ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বেশ কয়েকটি নির্বাচনে মানুষ ভোট দিতে পারেনি। তাই ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনেকের কাছেই ‘ঈদের আমেজের’ মতো। কিন্তু মানুষের সেই আগ্রহ বিনষ্টে নতুন নতুন সমস্যা তৈরি হচ্ছে। ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের তারিখ যতই ঘনিয়ে আসছে, ভোট আয়োজন নিয়ে ততই উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বাড়ছে। এনসিপির শাপলা প্রতীক দাবি, জামায়াতে ইসলামীসহ কয়েকটি দলের পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন চাওয়া, নির্বাচনের আগে গণভোট চাওয়া, দল নিবন্ধন নিয়ে ঝামেলা- এইসব কারণে সেই উদ্বেগ সৃষ্টি হচ্ছে বলে মনে করছেন অভিজ্ঞজনেরা।
সবচেয়ে বড় একটি বিষয় নির্বাচনকে ঝামেলাপূর্ণ করছে জুলাই-আগস্ট বিপ্লবের মহানায়কদের গড়া জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) ‘শাপলা’ প্রতীক দাবিতে অটল থাকাকে কেন্দ্র করে। শাপলা প্রতীক না পেলে এনসিপি কি করবে, সেটাই এখন প্রধান একটি প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাজনৈতিক দল হিসেবে নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন পেতে যাচ্ছে এনসিপি। প্রতীক চূড়ান্ত হলে দলটিকে নিবন্ধন সনদ দেওয়া হবে। কিন্তু প্রতীক ইস্যুতেই দুটি ভিন্ন অবস্থানে অনড় এনসিপি ও নির্বাচন কমিশন। দলের প্রতীক হিসেবে শুরু থেকেই শাপলা চেয়ে আসছে এনসিপি। তবে শাপলা রাজনৈতিক দলের জন্য তৈরি করা প্রতীকের তালিকাতেই নেই বলে জানাচ্ছে ইসি।
গতকাল নির্বাচন কমিশনের (ইসি) জ্যেষ্ঠ সচিব আখতার আহমেদ বলেছেন, এনসিপিকে শাপলা দেওয়ার সুযোগ নেই। ১৯ অক্টোবরের মধ্যে এনসিপি শাপলার বিকল্প প্রতীক নেবেন এবং আমাদের জানাবেন। না হলে ইসি নিজ উদ্যোগে অন্য প্রতীক দিয়ে নিবন্ধন দেবে। গতকাল নির্বাচন কমিশন ভবনে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে ইসি সচিব এসব কথা বলেন।
নির্বাচন কমিশন নির্ধারিত তালিকা থেকে পছন্দের প্রতীক নিতে এনসিপিকে সময় বেঁধে দেওয়ার পর শাপলার পক্ষে সোশাল মিডিয়ায় সোচ্চার হয়েছেন দলটির নেতারা। ইসি সচিবের বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় দলটির দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহ গতকাল দুপুরে সামাজিক মাধ্যম ভেরিফায়েড ফেসবুক পোস্টে বলেন, শাপলা এনসিপিই পাবে। শাপলা প্রতীক না পেলে নিবন্ধন নেবে না এনসিপি প্রতিক্রিয়ায় এমনটাই জানিয়েছেন দলটির যুগ্ম আহ্বায়ক সারোয়ার তুষার।
ইসি সচিব আরও বলেন, ১৯ তারিখের মধ্যে তারা বিকল্প প্রতীকের চাহিদা দেবেন। শাপলা প্রতীক অন্তর্ভুক্ত করা দরকার নেই বলে কমিশন মনে করে। শাপলা ছাড়া নিবন্ধন না নিলে এটা তাদের বিষয়। ১৯ অক্টোবরের মধ্যে পছন্দ না জানালে এনসিপিকে ‘স্বীয় পদ্ধতিতে’ প্রতীক দেবে ইসি, বলেন তিনি।
এদিকে সকালে গণমাধ্যমে ইসি সচিব বলেন, আগামী রোববারের মধ্যে নির্বাচন পরিচালনা বিধির তফসিলে থাকা নির্ধারিত তালিকা থেকে দলের প্রতীক বাছাই করে জানাতে ব্যর্থ হলে ‘স্বীয় পদ্ধতিতে’ এনসিপিকে মার্কা দেওয়া হবে। ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে এনসিপিসহ দুটি দলকে নিবন্ধন দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় ইসি। দল দুটির প্রতীকসহ বিজ্ঞপ্তি দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে। ৩০ সেপ্টেম্বর দলটিকে তফসিলে থাকা ৫০টি প্রতীক থেকে ৭ অক্টোবর পর্যন্ত পছন্দ জানানোর জন্য চিঠি দেয় ইসি। নির্ধারিত সময়ে এনসিপি পছন্দের প্রতীক বাছাই না করে বিধি সংশোধন করে ফের শাপলা বরাদ্দের দাবি জানায়। কিন্তু ইসি কাউকে শাপলা প্রতীক না দেওয়ার বিষয়ে অনড় অবস্থানে রয়েছে।
এনসিপি শাপলা প্রতীক ছাড়া নিবন্ধন নেবে না বলে জানিয়ে দিয়েছে। এরপরও ইসি শাপলার বাইরে নিজস্ব উদ্যোগে অন্য প্রতীক বরাদ্দ দিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি হবে কি না- এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে ইসি সচিব বলেন, এটা তাদের ব্যাপার। এটা সময়ের ব্যাপার, সময়ে দেখা যাবে।
সবশেষ প্রতীক বরাদ্দে নীতিমালা : ১৯৯১ সালের পঞ্চম সংসদ নির্বাচনে দলের প্রতীক বরাদ্দের বিষয়ে তখনকার বিচারপতি আব্দুর রউফ কমিশন পাঁচটা নীতি অনুসরণ করে, এগুলো হলো, ১৯৭৯ সালে এবং তার পরে সংসদ নির্বাচনে রাজনৈতিক দলের অনুকূলে বরাদ্দকৃত প্রতীক যথাসম্ভব বহাল থাকবে। রাজনৈতিক দলের অতীত ও বর্তমান সদস্য সংখ্যা, ইতোপূর্বে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে অংশগ্রহণ, ফলাফল বিবেচনায় থাকবে। যে সব রাজনৈতিক দল শুধু বিশেষ একটি প্রতীকের জন্য আবেদন করবে তা সে দলের অনুকূলে সংরক্ষণ করা হবে। একই প্রতীকের জন্য একাধিক রাজনৈতিক দল দাবিদার হলে তাদের সমঝোতার অনুরোধ; ব্যর্থ হলে কমিশন প্রতীক বরাদ্দের বিষয়ে স্বীয় পদ্ধতি অবলম্বন করবে। প্রয়োজনে লটারি হবে। যে সকল রাজনৈতিক দল প্রতীক বরাদ্দের বিষয়ে একাধিক পছন্দ থাকবে, তাদের পছন্দ যথা-সম্ভব বিবেচনায় রাখবে। শাপলার বদলে গেজেটকৃত ৫০টি প্রতীকের থেকে যেকোনো একটিকে বাছাই করতে এনসিপিকে চিঠিও দিয়েছে কমিশন। তালিকা থেকে প্রতীক বাছাই করতে এনসিপিকে গতকাল মঙ্গলবার পর্যন্ত সময়ও বেঁধে দিয়েছিল তারা। তবে, এনসিপি বলছে তাদের পছন্দের শাপলা প্রতীক না দেওয়া হলে নির্বাচন কমিশনের তালিকাভুক্ত ৫০টি প্রতীকের অন্য কোনোটিই নেবে না তারা। শুধু তাই নয়, একই সঙ্গে তারা নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে আর কোনো ধরনের যোগাযোগও না রাখার পক্ষে দলটি।
এর আগে এনসিপির দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আব্দুল্লাহ বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘ইসি যদি শাপলা প্রতীক না দিয়ে স্বেচ্ছাচারী আচরণ করে তাহলে এই কমিশনের যেকোনো কার্যক্রমে আমাদের অনাস্থা থাকবে।’
তবে নির্বাচন কমিশন বলছে, তারা রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য প্রতীক তালিকার যে নতুন গেজেট করেছে সেখানে শাপলা না থাকায় এনসিপিকে শাপলা প্রতীক দেওয়ার সুযোগ নাই।
ইসির বিধিমালায় শাপলা প্রতীক না থাকায় এনসিপিকে তা দেওয়ার সুযোগ নেই ফের জানিয়েছেন ইসির সিনিয়র সচিব আখতার আহমেদ। এরপরই মূলত এই পোস্ট দেন হাসনাত আবদুল্লাহ। প্রতীক ইস্যুতে ইসির সঙ্গে দলটির একমত কোনোমতেই হচ্ছে না।
প্রসঙ্গত, শাপলা প্রতীক পেতে অনড় অবস্থানে এনসিপি। এ নিয়ে ইসির সঙ্গে একাধিকবার বৈঠক, চিঠি দেয় দলটি। বিভিন্ন সময়ে এনসিপি নেতারা তাদের বক্তব্যে হুঁশিয়ারি দেন, প্রয়োজনে এই প্রতীক পেতে তারা লড়বেন রাজপথে। পাশাপাশি নির্বাচনে অংশ্রগ্রহণের বিষয়েও পুনর্বিবেচনা করবেন। বিপরীতে, ইসি বারবার বলে আসছে, শাপলা তাদের বরাদ্দযোগ্য প্রতীকের তালিকায় না থাকায় এটি এনসিপিকে বরাদ্দ দেওয়া সম্ভব নয়। আর ইসি এখন একধরনের ফাইনাল বার্তা দিল দলটিকে।
দলটির যুগ্ম আহ্বায়ক সারোয়ার তুষার বলেন, ইসি সচিবের আচরণ স্বৈরাচারী। শাপলা প্রতীক অবশ্যই দিতে হবে কমিশনকে। প্রতীক দেওয়া নিয়ে নির্বাচনে কোনো জটিলতা তৈরি হলে তার দায় কমিশনকেই নিতে হবে।
তিনি আরও বলেন, ইসির সিদ্ধান্তে কোনো আইনি ভিত্তি নেই। ইসি চাইলেই শাপলা তালিকাভুক্ত করতে পারে।
এনসিপির যুগ্ম সদস্য সচিব জহিরুল ইসলাম মুসা ফেসবুক পোস্টে লেখেন, ‘এনসিপির মার্কা শাপলা। শাপলা দিতে হবে।’
দলের যুগ্ম সদস্য সচিব জহিরুল ইসলাম মুসা লেখেন, ‘বিষয়টা শুধু শাপলা প্রতীক ইস্যু না। ব্যাপারটা প্রতিষ্ঠান হিসেবে নির্বাচন কমিশনের স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা এবং সক্ষমতা প্রমাণের।
এর আগে প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেছেন, এনসিপিকে কেন শাপলা দেওয়া হবে না, সেটা তিনি জনগণের কাছে ব্যাখ্যা করবেন না।’
শাপলা প্রতীক এনসিপিকে বরাদ্দ না দেওয়া ইসির ‘মন-মর্জি’র বিষয় কি না, সেই প্রশ্ন তোলেন এই এনসিপি নেতা। এরপর এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম নিজের ফেসবুক পেজে ওই পোস্ট শেয়ার করেন।
ভোরের আকাশ/এসএইচ