সতর্ক অবস্থানে বাংলাদেশ
ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ নিয়ে উদ্বিগ্ন বিশ্ব। প্রতিবেশী দেশ হিসেবে বাংলাদেশের উদ্বেগ যেন দূরবর্তী দেশগুলোর চেয়ে কয়েকগুণ বেশি। ভারতের সঙ্গে দেশটির রয়েছে চার হাজার কিলোমিটারের বেশি সীমান্ত রেখা। উদ্বেগ প্রকাশ করার পাশাপাশি উভয় দেশকে শান্ত থাকার, সংযম প্রদর্শনের বার্তা পৌঁছে দিয়েছে আন্তর্বর্তী সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। সীমান্তে সতর্ক অবস্থানে রয়েছে বর্ডার গার্ড, বাংলাদেশের (বিজিবি) সদস্যরা।দেশের নিরাপত্তা যেন বিঘ্নিত না হয় সেজন্য সীমান্তে পুলিশ সুপারদের (এসপি) সতর্ক থাকার নির্দেশ দিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। সারাদেশে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের জীবন ও সম্পদের ওপর কোনো দুষ্কৃতকারী যেন হামলা, আক্রমণ বা ভাঙচুর করতে না পারে, সেদিকে বিশেষ সতর্কামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে সরকার। সব মিলিয়ে সুক্ষ্ম হিসেব নিকেষ কষে নিরপেক্ষ অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ।নিরাপত্তা ও কূটনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, বর্তমানে অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে ভারত সরকারের সম্পর্কে চরম অবনতি এবং পাকিস্তানের সঙ্গে উন্নতি ঘটছে। ভারত ও বাংলাদেশের জনগণের মধ্যেও পরস্পরবিরোধী বক্তব্য ও মন্তব্য ছোড়াছুড়ি প্রবল হয়ে উঠেছে। বিরাজমান পরিস্থিতি সর্বাত্মক যুদ্ধে রূপ নিলে বাংলাদেশের উদ্বেগ বাড়বে বহুগুণ। দুই দেশ সামাল দিতে বিপাকে পড়বে দেশটি।চলমান পরিস্থিতি বিবেচনায় সাবেক কূটনীতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষকেরা পাকিস্তান ও ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ককে ‘স্পর্শকাতর অবস্থায়’ বলে উল্লেখ করছেন। তারা বলছেন, এখন দুই দেশের সংঘাতে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার যদি পাকিস্তানের দিকে ঝুঁকে পড়ে, তাহলে ভারতের সঙ্গে এ সরকারের সম্পর্কে আরও নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।আবার ভারতের দিকে ঝুঁকলেও সমস্যা পড়তে হবে বাংলাদেশকে। কারণ এর প্রভাব পড়তে পারে পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে। এছাড়া বর্তমানে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ভারত বিরোধী শক্তিগুলোর প্রভাব বেড়েছে; তারা অন্তর্বর্তী সরকারকে সমর্থন দিয়ে আসছে। তাদের মধ্যেও প্রতিক্রিয়া হতে পারে। এমন বাস্তবতায় ভারত-পাকিস্তানের এই সংঘাতে বাংলাদেশের সতর্ক ও নিরপেক্ষ অবস্থান নেওয়া প্রয়োজন। বাংলাদেশের উত্তর-পূর্ব সীমান্তের সাথে ভারতের সাতটি অঙ্গরাজ্য আছে। সেগুলোতে যদি ভারত-পাকিস্তান সংঘাতের কোনো প্রভাব পড়ে এবং অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি হয়, তখন এর সরাসরি প্রভাব পড়তে পারে বাংলাদেশে। ফলে নিরাপত্তার প্রশ্নে উদ্বেগের বিষয় এখানে রয়েছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।অন্তর্বর্তী সরকারের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান গত বুধবার বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, উভয়পক্ষকে সংযত হওয়ার আহ্বান জানানোর পাশাপাশি বাংলাদেশ মনে করে কূটনৈতিক দিক থেকে আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করা উচিত।তিনি বলেন, ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনা নিরসন করে শান্তিপূর্ণ ও স্থিতিশীল অবস্থানে ফিরে আসবে বলে বাংলাদেশ আশা করে।এদিকে, ভয়ের কোনো কারণ নেই, আমাদের সীমান্ত সম্পূর্ণ নিরাপদ-এই বলে গতকাল বৃহস্পতিবার দেশবাসীকে আশ্বস্ত করেছেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট(অব) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী।ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে বিরাজমান যুদ্ধাবস্থার প্রেক্ষিতে বাংলাদেশে বসবাসরত হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনের ওপর যেন দুষ্কৃতকারীরা হামলা করতে না পারে সে লক্ষ্যে সতর্ক থাকার জন্য পুলিশের সকল ইউনিটকে নির্দেশনা দিয়েছে পুলিশ সদর দপ্তর।গত বুধবার পুলিশ সদরদপ্তরে অপারেশন শাখা থেকে এই নির্দেশনা সংবলিত একটি চিঠি পুলিশের সকল ইউনিট ও জেলা এবং থানাগুলোতে দেওয়া হয়েছে। আইজিপির পক্ষে এতে স্বাক্ষর করেন পুলিশ সদরদপ্তরে অপারেশন শাখার অ্যাডিশনাল ডিআইজি (অপারেশনস) শাহজাদা মো. আসাদুজ্জামান।চিঠিতে বলা হয়, সীমান্ত এলাকায় কোন দুষ্কৃতকারী যাতে কোনও প্রকার উসকানিমূলক আচরণ বা অস্থিশীলতা সৃষ্টি করতে না পারে সে বিষয়ে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন এবং প্রয়োজনীয় নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।চিঠিতে আরও বলা হয়েছে, সারাদেশে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের জীবন ও সম্পদের ওপর কোনো দুষ্কৃতকারী যেন হামলা, আক্রমণ বা ভাঙচুর করতে না পারে, সেদিকে সতর্ক নজর রাখতে হবে। উসকানিমূলক আচরণ বা অস্থিরতা সৃষ্টির মাধ্যমে আইন-শৃঙ্খলার অবনতি ঘটানো প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করার কথাও উল্লেখ করা হয়েছে।এছাড়া মোবাইল, ইন্টারনেটসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী যাতে গুজব বা প্রোপাগান্ডা ছড়িয়ে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করতে না পারে, সেদিকে সর্বোচ্চ সতর্ক দৃষ্টি রাখারও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ভারত-পাকিস্তান সংঘাতকে ঘিরে বাংলাদেশের নিরাপত্তা যেন বিঘ্নিত না হয় সেজন্য সীমান্তে পুলিশ সুপারদের (এসপি) সতর্ক থাকার নির্দেশ দিয়েছেন পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম।গত বুধবার এক অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে আইজিপি বলেন, ভারতের সাথে আমাদের সীমান্তবর্তী জেলা ৩০টি এবং মিয়ানমারের সাথে ৩টি। আমরা সর্বাত্মক চেষ্টা করবো যেন এর প্রেক্ষিতে আমাদের নিরাপত্তা বিঘ্নিত না হয়।গত বুধবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে উভয়পক্ষকে সংযম প্রদর্শনের আহ্বান জানানো হয়েছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃবিতে বলা হয়েছে, ভারত ও পাকিস্তানের চলমান পরিস্থিতি নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করছে। উভয় দেশকে শান্ত থাকার, সংযম প্রদর্শনের এবং পরিস্থিতি আরও খারাপ করতে পারে, এমন কোনো পদক্ষেপ নেওয়া থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানায় বাংলাদেশ। বাংলাদেশ আশাবাদী, আঞ্চলিক শান্তি ও স্থিতিশীলতার লক্ষ্যে কূটনৈতিক প্রচেষ্টার মাধ্যমে উত্তেজনা প্রশমিত হবে এবং শেষ পর্যন্ত এই অঞ্চলের জনগণের কল্যাণের জন্য শান্তি বিরাজ করবে।এদিকে, ঢাকা থেকে মধ্যপ্রাচ্যগামী রুটের ফ্লাইটগুলো পাকিস্তানের আকাশসীমা এড়িয়ে চলছে। অন্যদিকে, মধ্যপ্রাচ্য থেকে বাংলাদেশে আসার পথে দুইটি ফ্লাইট মাঝ আকাশ থেকে ফিরে গেছে। ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর সূত্র এ তথ্য জানায়।জানা গেছে , ঢাকা থেকে কয়েকটি মধ্যপ্রাচ্য রুটের ফ্লাইট পাকিস্তানের আকাশ ব্যবহার করে। কিন্তু গত বুধবার মধরাত থেকে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের কারণে ঢাকা থেকে মধ্যপ্রাচ্যগামী ফ্লাইটগুলো নিরাপদে বিকল্প রুটে গন্তব্যে যাচ্ছে। ফ্লাইটে কোনো ধরনের ব্যাঘাত ঘটেনি। তবে গত বুধবার দিবাগত রাতে তুরস্ক থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে আসা তার্কিশ এয়ারলাইন্স (টিকে-৭১২) এবং কুয়েত থেকে ঢাকাগামী কুয়েত এয়ারওয়েজের একটি ফ্লাইট (জে-৯৫৩৩) পাকিস্তানের আকাশপথ দিয়ে ভারত হয়ে বাংলাদেশে আসার কথা ছিল।তবে ফ্লাইট ট্র্যাকিং ওয়েবসাইট ফ্লাইটরাডার২৪ জানিয়েছে, তার্কিশ এয়ারলাইন্সের ফ্লাইটটি মাঝপথে বাংলাদেশে আসার সিদ্ধান্ত বাতিল করে ওমানের মাসকট আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করেছে। কুয়েত এয়ারওয়েজের ফ্লাইটটি প্রায় দেড় ঘণ্টা উড্ডয়নের পর আবারও কুয়েতে ফিরে যায়।এবিষয়ে আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, আসলে আমাদের তো সেই ধরনের কাঠামো গড়ে ওঠেনি। আমাদের সরকারগুলো হয় দিল্লিপন্থি নয়তো ইসলামাবাদপন্থি হয়ে যান। বাংলাদেশপন্থি হন না। সেটা হলে হয়তো আমরা আজকে দুটো দেশকেই ঢাকায় আমন্ত্রণ জানাতে পারতাম। কিন্তু আমরা সেই ধরনের কাঠামো তৈরি করতে পারিনি। এখানে বড় পেশাদারিত্ব দরকার। জ্ঞান-গবেষণার বিষয় আছে। যেগুলো সম্প্রতি দেখছি কাতার, সৌদি আরব এমনকি টার্কিও বড় ধরনের নেগোসিয়েশন করার সক্ষমতা রাখে। সিঙ্গাপুরও রাখে।কিন্তু আমরা সেই পর্যায়ে এখনো যেতে পারিনি। যদিও আমাদের দেশের পক্ষ থেকে স্টেটমেন্ট দেওয়া হয়েছে, দুই পক্ষই যেন যুদ্ধ থেকে বিরত থাকে। এর চেয়ে বেশি কিছু আমার মনে হয় না এই মুহূর্তে করতে পারবে। তবে আমাদের হোমওয়ার্ক করে রাখতে হবে। যদি বড় যুদ্ধ হয় তাহলে বাংলাদেশে কী ধরনের পরিস্থিতি হতে পারে। কী ধরনের সমস্যা হতে পারে। সেগুলো কীভাবে মোকাবিলা করবে। এগুলো বড় আকারেই আমার মনে হয় এখন থেকে ট্রেসিং করা দরকার।ভূ-রাজনীতি বিশ্লেষক ব্রি. জেনারেল (অব.) শামিম কামাল বলেন, প্রতিবেশীর কোনো ধরনের ক্ষয়ক্ষতি হলে তার প্রভাব তো প্রতিবেশীর ওপর পড়বেই। আপনার পাশের ঘরে যদি আগুন লাগে, আপনার বিল্ডিং বা ঘরেও আগুন লাগতে পারে বা এর উত্তাপ তো আপনার গায়েও লাগবে। এটা খুবই স্বাভাবিক।তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ অতীতে কোনোদিনই কোনো পক্ষ নেয়নি। বাংলাদেশের জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের যে চেতনা সেটা ফলো করতে হবে। এখানে কোনো পক্ষ নেওয়া নির্বুদ্ধিতা হবে।নিরাপত্তা বিশ্লেষক অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল মুনীরুজ্জামানের পাশাপাশি চীনে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত মুন্সি ফয়েজ আহমেদ বাস্তবতাকে বিবেচনায় নেওয়ার কথা বলছেন। তারা মনে করেন, অন্তর্বর্তী সরকারকে সতর্ক অবস্থানে থেকে কৌশল ঠিক করতে হবে। অতীতেও বিভিন্ন সময় ভারত-পাকিস্তান সংঘাতের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সরকারগুলো সতর্ক ও কূটনৈতিকভাবে নিরপেক্ষ অবস্থানে থাকার চেষ্টা করেছে।ভোরের আকাশ/এসএইচ